#ল্যাম্পপোস্টের_অচেনা_রূপ.
#পর্ব:- ০২
ইমাদ নোরাকে লাল শাড়িতে বউ সাজিয়ে কেন খুন করতে চায় সেটাই বুঝতে পারছে না নোরা। বেশ কিছু সময় সে ইমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ইমাদ বললো,
” দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করো না নোরা। তুমি তাড়াতাড়ি বউ সেজে আসো, তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। তারপরও যদি কিছু দরকার হয় তাহলে ডাক দিও। ”
নোরা একটুও নড়লো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে চোখের দৃষ্টি সাদা বস্তাবন্দি রাহাতের লাশের টুকরোর দিকে।
নোরা সেদিকে তাকিয়ে ইমাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” আমাকেও খুন করে এভাবে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে দিবে তাই না? ”
” না তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। ”
” কি ব্যবস্থা? ”
” এতো অধৈর্য কেন তুমি? তোমাকে তো সবকিছু জানানো হবে। যাও তাড়াতাড়ি শাড়ি পরো। ”
ইমাদ আবার কবিরকে বললো,
” ওর কাছ থেকে মোবাইল দুটো নিয়ে আয় কবির। এতক্ষণ তো নোরা কিছু জানতো না তাই নিজে থেকে কাউকে করতো না। কিন্তু এখন তো নোরা বুঝতে পেরেছে তাই কল দিয়ে বলে দিবে। ”
কবির সামনে এগিয়ে এসে নোরার হাত থেকে রাহাতের মোবাইলটা নিয়ে গেল। নোরার নিজের মোবাইলও তার হাত ছিল, সেটাও হাত থেকে ছিনিয়ে নিল কবির।
ইমাদ নোরার ডান হাতটা ধরে টেনে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারপর পাশের রুমে গিয়ে বিয়ের শাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
” ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হবে। আমি ৩০ মিনিট পরে দরজা খুলে যেন দেখি তুমি বউ সেজে খাটে বসে আছো। ”
নোরা তাকিয়ে রইল নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগা এই মানুষটার দিকে। যে মানুষটার হাতে হয়তো আগামীকাল সকাল হবার আগেই তার মৃত্যু হবে। অথচ নোরা এই ইমাদের একটা নাম দিয়েছিল ল্যাম্পপোস্ট।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট যেমন কোনো স্বার্থ ছাড়া মানুষের পথচলার জন্য উপকার করে। ইমাদও ঠিক তেমনিভাবে নোরার জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে সাহায্য করতো। নোরা তার জীবনে যতগুলো মানুষের সন্নিকটে এসেছে তাদের সবার মধ্যে ইমাদ ছিল সবচেয়ে আলাদা। অথচ তার সেই সাহায্যের ” ল্যাম্পপোস্টের অচেনা রূপ ” আজ তাকে অবাক করছে খুব।
নোরা বললো,
” যদি শাড়ি না পরি, যদি তোমার কথা মতো কাজ না করি তাহলে কি করবে? মেরে ফেলবে! তুমি তো আমাকে এমনিতেই মেরে ফেলবে, তাহলে শাড়ি পরে আর কি হবে। মেরে ফেলো, এতো নাটক করার কি আছে? ”
ইমাদ আরেকটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট হাতে নিয়ে বললো,
” ৩০ মিনিট পর যদি তৈরি না হও তাহলে প্রতি পাঁচ মিনিটের জন্য তোমার হাতের একটা করে আঙ্গুল কাটা হবে। ”
ইমাদ রুম থেকে বের হয়ে দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিল। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারও এসে হাজির হয়েছে।ড্রাইভারের নাম জামসেদ, ইমাদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
” কবরস্থানের সবকিছু রেডি হয়েছে? ”
জামসেদ বেশ গর্বের সঙ্গে বললো,
” জ্বি ভাই আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই সব করা হয়েছে। শীতের রাতে সহজে ঘর থেকে কেউ বাহিরে আসে না। আর কবরস্থানে যাবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ”
” ঠিক আছে চলো, কবরস্থান থেকে ঘুরে আসি৷ তারপর ফিরে এসে বাকি কাজ করবো। ”
কবির পিছন থেকে বললো,
” আমি কি বাড়িতে থাকবো নাকি সঙ্গে আসবো? ”
” তুমি কবরস্থানে গিয়ে কি করবে? এখানে নোরা একা একা আছে, তার যদি কিছু দরকার হয় তাহলে তখন পাবে সে কোথায়? ”
” দরকার হলেই তো হবে না ইমাদ ভাই। এতো রাতে কিছু চাইলেই তো এনে দিতে পারবো না। তাছাড়া আপনি কবরস্থানে গেলে আমি কি দরজা খুলবো নাকি বলেন? ”
ইমাদ খানিকটা ভাবলো, তারপর বললো,
” না খোলার দরকার নেই। ভিতরে তো অনেক কিছু আছে, দেখা গেল ভারি শক্ত কিছু একটা নিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করবে। তুমি দরজা খুলতেই আঘাত করবে মাথায়। ”
” ঠিক আছে তাহলে খুলবো না। ”
কবিরকে রেখে জামসেদ ও ইমাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। চারিদিকে ঘনঘন কুয়াশায় ছেয়ে গেছে সম্পুর্ণ গ্রাম। বাড়ি থেকে বের হয়েই রাস্তা দিয়ে খানিকটা সামনে গিয়ে মাঠের মধ্যে নেমে গেল দুজনেই। কবরস্থানে যেতে গেলে মাঠ থেকে যদি যায় তাহলে মানুষের সামনে পরার সম্ভবনা নেই। কিন্তু রাস্তা দিয়ে গেলে কেউ না কেউ সামনে আসতেই পারে, যদি আসে?
— — — — — — — — — — —
প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে রোমানদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। সৈকতের হাতে একটা ব্যাঙ, দুটো তাবিজ ও একটা গামছা। এগুলো তাদের একটা কবরের মধ্যে ফেলতে হবে। সৈকত তাই দাঁড়িয়ে আছে রোমানের অপেক্ষায়। একা একা এতো রাতে সৈকত কবরস্থানে কিছুতেই যেতে পারবে না। তাই তারা দুজন মিলে যাবে।
ছোট্ট একটা ক্ষীণ আলো আসছে এগিয়ে। সৈকত বুঝতে পারলো রোমান বাসা থেকে বের হয়েছে। বিড়বিড় করে বললো ” শালা এতক্ষণে বাসা থেকে বের হবার হলো। ”
কাছে এসেই রোমান বললো,
” সবকিছু ঠিকঠাক এনেছিস তো? ”
” তোর কি মনে হয় আমি ফেলে আসবো কিছু? কাজটা তো আমার তাই না? তোর কাজ হলে নাহয় বুঝতাম। ”
” তোর কি মনে হয় এগুলো করলে তুই তানিয়ার মা-বাবাকে রাজি করাতে পারবি? ”
” রাজি না হয়ে যাবে কোই? কবিরাজ তো ভালো করেই বলে দিল যদি ব্যাঙ, গামছা পড়া, আর তাবিজ দুটো পুরনো কবরের মধ্যে ফেলতে পারি তাহলে কাজ হবে। ”
” দেখ সৈকত, এসব কবিরাজ আমার একদম বিশ্বাস হয় না ভাই। সব টাকা খাবার ধান্দা, এসব কবরের মধ্যে ফেললে মানুষ কীভাবে রাজি হবে বল তো আমাকে? ”
” তোকে বিশ্বাস করতে হবে না। তুই শুধু আমার সঙ্গে চল, আমিই যা করার করবো। ”
” কবরের মধ্যে কীভাবে ফেলবি? কবর খুড়তে হবে নাকি অন্য কোনো বুদ্ধি আছে? ”
” একটা শাবল নিছি সঙ্গে। শুধু কবরের মধ্যে প্রথমে ঢুকাবো। তারপর কবরের বাঁশ চিরে যখন ভিতরে চলে যাবে তখন তো ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হবে। তারপর ছিদ্রটা বড় করবো, সেই ছিদ্র দিয়ে ভিতরে ফেলে দেবো। ”
” দেখা গেল কবরের লাশ তোর শাবল টেনে ধরলো তখন কি করবি সৈকত? টেনে ধরে যদি বলে, কিরে তোদের জন্য মরেও শান্তি নেই নাকি। ”
” ফাজলামো করিস না তো, এমনিতেই মনের মধ্যে ভয় লাগছে। বেশিক্ষণ কিন্তু দেরি করবো না। ”
” ঠিক আছে চল চল। ”
গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে নির্জন এ স্থানটা। এখানে আশেপাশে বহুদূর কোনো বাড়িঘর নেই। যাদের এই কবরস্থান, তাদের সর্বশেষ পদচারন ছিল বছর দশেক আগে। বাড়ির মালিক ৮৬ বছর বয়সে যখন মারা গেল তখন তাকে এই কবরস্থানে কবর দিয়ে আনাগোনা শেষ হয়েছে। যারা উত্তরসূরী বেঁচে আছে তারা সবাই ঢাকার বাসিন্দা।
সৈকত ও রোমান দুজনেই কবরস্থানে ঢুকলো। কবরস্থানে ঢুকেই একটা বিশাল গর্ত খোঁড়া দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজনেই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ভয় পেল রোমান। বাতি বন্ধ করে রোমান বললো,
” এখানে কবর খুঁড়েছে কে? ”
এক অন্ধ আরেকজন অন্ধের কাছে পথের কথা জিজ্ঞেস করলে যেমন হয়। সৈকত বললো,
” আমি কীভাবে জানবো? সন্ধ্যা বেলা যখন দেখে গেলাম তখন তো কিছু ছিল না। তাহলে এই রাতের মধ্যে গর্ত এলো কীভাবে? ”
” আমি ভেবেছিলাম তুই খুঁড়েছিস মনে হয়। ”
” আমি কেন খুঁড়বো? ”
” চল পালিয়ে যাই, আমার কেমন ভয় লাগছে। চারিদিক কতো নির্জন, যদি কোনো মানুষও হয় তাহলে আমাদের কিন্তু মেরে ফেলবে। রাতের অন্ধকারে কবর খুঁড়েছে এ-র মানে হচ্ছে তারা নিশ্চয়ই অবৈধ কিছু করবে। সেখানে আমাদের সাক্ষী হিসেবে কোনদিন বাঁচিয়ে রাখবে না। ”
” ওটা কি রে? মানুষের কণ্ঠ তাই না? ”
মোবাইলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে ইমাদ ও জামসেদ। ইমাদের কথা শুনেই চমকে গেছে সৈকত।
রোমান বললো, ” তাই তো, মানুষ মনে হয়! ”
” ওরা তো এদিকেই আসছে, চল পালাই। ”
” পালানোর দরকার নেই, কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি ওরা কি করতে চায়। ”
” মরার জন্য নাকি? চল ভাই। ”
দুজন মিলে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে পিছনে যেতে লাগলো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ রোমানের, কারণ সে একটা খাদের মধ্যে পরে গেল। সম্ভবত কোনো ভাঙ্গা কবর কিংবা শেয়ালের গর্ত হতে পারে। কবরস্থানের পুরোটা বিভিন্ন ছোটছোট ঝোপঝাড় আর লতাপাতা দিয়ে আবৃত। সেখানে কোথায় গর্ত ছিল সেটা তাদের জানার কথা নয়। এদিকে ইমাদ ও জামসেদ কবরস্থানের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। সৈকত চাইলেও তখন মোবাইলের বাতি ব্যবহার করতে পারছে না। অন্ধকারে তাদের সেই মোবাইলের আলো দেখে ফেলবে তারা।
রোমান বললো,
” দোস্ত পা মনে হয় ভেঙ্গে গেল রে। আমাকে ধর। ”
সৈকত ফিসফিস করে বললো,
” তুই কোনো কথা বলিস না। চুপচাপ একটু বসে থাক রোমান ওরা কবরস্থানে এসে গেছে। আমিও ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকি। নাহলে দুজনেই মরে যেতে পারি। ”
রোমানের পায়ে প্রচুর ব্যথা করছে তবুও রোমান মুখে হাত চেপে ধরে বসে আছে। ইমাদ ও জামসেদ তাদের সেই খুঁড়ে রাখা গর্তের কাছে এসে দাঁড়ালো।
ইমাদের কাছে কল করেছে কবির।
ইমাদ বললো,
” কবির বলো। ”
” ভাই কাজি সাহেবকে পাওয়া যায়নি৷ তবে এক হুজুরকে ধরে আনা হয়েছে, সে বিয়ে পড়াতে পারে। কিন্তু তার কাছে কাবিনের কাগজপত্র নেই। ”
” তাতেই চলবে, কাবিনের কাগজপত্র দিয়ে আমার কাজ কি কবির? নোরা বউ সাজলে আমি তাকে বিয়ে করবো তারপর আমাদের বাসর হবে। আমি তো তার সঙ্গে সংসার করবো না। ”
” ভাই মেরেই তো ফেলবেন, তাহলে আবার বিয়ের কি দরকার। সকাল কিন্তু হয়ে যাচ্ছে প্রায়। বেশি দেরি করলে তখন কিন্তু লাশ নিয়ে বিপদ হবে। ”
” আমি কি নোরার সঙ্গে অবৈধভাবে মেলামেশা করবো নাকি। সেজন্য তো বিয়ে করে বউ বানিয়ে নেবো। তুমি চিন্তা করো না, আমরা আসছি৷ ”
ইমাদ কল কেটে দিল। অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবির মনে মনে বললো ” শালা ফাজিল, খুন করবে তাতে দোষ নেই, অবৈধভাবে মেলামেশা করলে দোষ। ”
~
~
~ চলবে…..
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)