ল্যাম্পপোস্টের অচেনা রূপ পর্ব ১

0
1399

#থ্রিলার
গায়ে হলুদের গোসল করা শেষ হতেই ভাবি আমার কানে কানে বললো,
” তোর বয়ফ্রেন্ড বারবার কল দিচ্ছে। ছেলেটা কি জানে যে তোর অন্য যায়গা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? ”

আমি কিছু না বলে চুপচাপ গামছা দিয়ে চুলের পানি মুছতে লাগলাম। ভাবি আমার হাতটা ধরে বললো,

” আমি জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কিছু করার নেই। তুই তো তোর বাবা আর ভাইকে ভালো করে চিনিস। তাদের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো কথা যায় না। ”

আমি বললাম ” তোমার কিছু করতে হবে না ভাবি৷ আমার কপালে যা আছে তাই হবে। ”

ভাবির সামনে থেকে নিজের রুমে এলাম। এসে দেখি তুমিও অনেকবার কল করেছ। তারপর তোমাকেই আগে কল দিলাম। কারণ আমি ভালো করে জানতাম তুমি আমাকে পালাতে সাহায্য করবে। আমি তোমার এই সাহায্য সারাজীবন মনে রাখবো ইমাদ।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে নোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে। আর নোরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইমাদ। ঠান্ডায় ইমাদের কাঁপুনি ধরে গেছে। একটা শীতের চাদর নিয়ে এসেছে সেটাও নোরা নিয়ে গেছে। নোরা বাসা থেকে পালানোর সময় কোনো শীতের কাপড়ও আনতে পারে নাই।

ইমাদ বললো ” তোমার বয়ফ্রেন্ডকে তাড়াতাড়ি কল দিয়ে আসতে বলো। ঠান্ডায় আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে ভাই। তোমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের হাতে তুলে দিয়ে আমি বাসায় যাবো। ”

” বাসায় যাবে মানে? তোমার সঙ্গে না কথা ছিল আমাদের সঙ্গে ঢাকা যাবে। তারপর সেখানে পৌঁছে দিয়ে তুমি আবার খুলনায় ব্যাক করবে। এরকমই তো কথা ছিল ইমাদ, তাই না? ”

” হ্যাঁ ছিল, আর সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু কথা ছিল সেটা ভুলে গেছ? তুমি সঙ্গে করে কোনকিছু নিয়ে আসো নাই কেন? ”

” তুমি বুঝতে পারছ না কেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান, আজকে গায়ে হলুদ গেছে, কালকে বিয়ে হবে। তাই এখন যদি দেখে আমি সবকিছু ব্যাগ ভর্তি করে বাসা থেকে বের হচ্ছি তাহলে বের হতে দিবে? তাছাড়া রাহাতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। রাহাত বলেছে আমি এক কাপড়ে বের হলেই চলবে৷ ”

” তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কল দিয়েছ? ”

” দিচ্ছি তো বারবার কিন্তু কেন যে রিসিভ করছে না কে জানে। পাঁচ মিনিট আগে মেসেজ দিয়ে বললো যে, আমি একটু ব্যস্ত, পরে কল দিচ্ছি। আমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আর সে নাকি ব্যস্ত মানুষ। ”

” বাহ বাহ, যার বিয়ে তার খবর নাই আর আমি ইমাদ বেকুবের মতো তোমাকে নিজের শীতের চাদর দিয়ে একা শীতে কাঁপছি। ”

” আর একবার চাদরের খোঁটা দিলে আমি কিন্তু তোমার চাদর তোমাকে ফিরিয়ে দেবো। ”

~
~

রাত ১০:২৬ মিনিট।
ইমাদ আর নোরা এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। যে বাসে তাদের ঢাকা যাবার কথা ছিল সেই বাস আরো ঘন্টা খানিক আগে চলে গেছে। নোরার বয়ফ্রেন্ড রাহাত এখনো আসেনি। রাহাতের নাম্বার অন আছে কিন্তু সে কল রিসিভ করছে না। নোরা বেশ কিছু মেসেজ করেছে কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসেনি।

নোরার কাছে গিয়ে ইমাদ বললো,

” একটা কথা বলবো? ”

বিমর্ষ মুখে ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নোরা। নোরার এমন অসহায় মুখ দেখে ইমাদের মায়া লাগে। সে আবার চুপ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। নোরা তখন ইমাদের কথা শোনার জন্য নিজেই প্রশ্ন করে,

” কি বলবে বলো। তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না? তুমি কি চলে যাবে? ”

” আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? রাহাত সাহেব তো এখনো আসছে না। এদিকে রাত অনেক হয়ে গেছে। তোমার বাসা থেকে আমাকে অনেকবার কল করেছে। ”

” রাহাতের নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নাহলে এভাবে সবকিছু প্ল্যান করে কল রিসিভ করবে না কেন। ”

” আমি বলি কি, তুমি বাসায় ফিরে যাও। ”

” কেন? আরেকজনকে বিয়ে করার জন্য? ”

” এছাড়া উপায় কি বলো তো? বাসায় হয়তো এখনো কাউকে তেমন বলেনি৷ কাল সকাল হলে সবাই জেনে যাবে তোমার পালানোর কথা। যেই বাড়িতে বিয়ে ঠিক হয়েছে তারাও জেনে যাবে বিয়ের কনে পালিয়ে গেছে। তখন আর ফিরে গিয়ে কিন্তু লাভ হবে না নোরা। ”

” আর যদি রাহাত কল করে বলে যে নোরা তুমি সামান্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারলে না। তখন কি জবাব দেবো তাকে? ”

” তাহলে কী করবে এখন? ”

” এক কাজ করি, তোমার সঙ্গে তোমার বাসায় যাই চলো। আজকের রাতটা তোমার বাসায় নাহয় কাটিয়ে দেবো। তারপর সকালের আগেই রাহাত কল দিবে এটা শিওর। ”

” কিন্তু আমি ব্যাচেলর থাকি। সেখানে তোমাকে নিয়ে রাখা যাবে না। ”

” তাহলে কোই যাবো? ”

” আচ্ছা দেখি ব্যবস্থা করা যায় নাকি। ”

ইমাদ তার মোবাইল বের করে এক বন্ধুর কাছে কল করে। নোরা নিজের মোবাইল বের করে রাহাতের নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু রাহাত রিসিভ করে না। ইমাদ কথা শেষ করে বললো,

” আমার একটা ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে? সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। ওদের নিজেদের বাসা আছে সেখানে থাকতে পারবে। ”

নোরা কিছু বলার আগেই তার মোবাইলে রাহাত মেসেজ করে। মেসেজে একটা ঠিকানা দেওয়া আছে। ঠিকানা দিয়ে তার নিচে লিখেছে,

আমি হঠাৎ করে একটা ঝামেলায় পড়েছি নোরা। তুমি তো জানো আমি টুকটাক রাজনীতি করি। তুমি তোমার ফ্রেন্ড ইমাদকে নিয়ে একটু কষ্ট করে রূপসা নদীর এপাড়ে আসো৷ খেয়াঘাট থেকে নেমে নিচের নাম্বারে কল দিও। একটা ছেলে গিয়ে তোমাকে আর ইমাদকে নিয়ে আসবে। আমি এখানে একটা গ্রামের বাড়িতে আছি। তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আসো।

নোরা উচ্ছসিত হয়ে ইমাদের কাছে সবকিছু বললো। ইমাদ বিরক্ত হয়ে বললো,

” কনকনে শীতের রাতে এখন নদীর ওপাড়ে যেতে হবে? কেন সে এসে নিয়ে যায় না কেন। ”

” তুমি যাবে না? না গেলে বলো আমি একা একা চলে যাবো সমস্যা নেই। এই লোকটা আমাকে রাহাতের কাছে নিয়ে যাবে। ”

” একাই চলে যাবে? ”

” হ্যাঁ, কারণ আমার তো রাহাত ছাড়া আর কোনো স্থান নেই তাই না। তুমি নিজেই আজকের রাতটা শুধু রাখতে পারবে না একটু আগে বললে। তবুও যতটুকু করেছ তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ”

” চলো। ”

স্টেশন থেকে বের হয়ে ওরা ইজিবাইকে উঠে বসে। তারপর ইজিবাইকে চড়ে সোজা রূপসা ঘাটে। শীতের রাতে এগারোটা বাজতেই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। একটা বিভাগীয় প্রধান শহরে এরকম দৃশ্য অবাক হবার মতো। তবে নিস্তব্ধ এই রাতের শহর খুব একটা খারাপ লাগে না।

রূপসা নদী পার হয়ে রাহাতের পাঠানো সেই নাম্বারে কল করে নোরা। লোকটা ঘাটেই দাঁড়িয়ে ছিল, নোরা আর ইমাদের কাছে এসে দাঁড়াল।

” এখান থেকে কতদূর? ” প্রশ্ন করে ইমাদ।

” বেশি দুরে না, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। বাসায় যেতে বেশি সময় লাগবে না। ”

নোরা বললো,
” তুমি কি সঙ্গে যাবে? নাকি ম্যাসে ফিরে যাবে। ”

” যাবো। ”

কালো রঙের একটা প্রাইভেট কারে করে তারা রওনা দিল। গাড়ির মধ্যে আরেকজন আছে, তিনি হচ্ছেন ড্রাইভার। রাহাতের পাঠানো লোকটা আর ড্রাইভার বসেছে সামনে। নোরা আর ইমাদ পিছনে বসে আছে। নোরা বললো,

” আপনার নাম কি ভাই? ”

” আমার নাম কবির হাওলাদার। ”

” আপনার সঙ্গে যেহেতু গাড়ি আছে তাহলে আপনি গাড়ি নিয়ে আমাকে আনতে যাননি কেন? ”

” গাড়ি নিয়ে যেতে হলে সেই ব্রিজ ঘুরে তারপর যেতে হবে। সেজন্য আপনাদের ঘাট পার হয়ে আসতে বলেছি। ”

” রাহাত কি সেই বাড়িতেই আছে? ”

” না, তিনি কাজি আনতে গেছে, আপনাদের আজ রাতেই বিয়ে হবে। তারপর এই গাড়িতে করেই সকাল হবার আগে ঢাকায় রওনা দিবেন। ”

ইমাদ একমনে তার মোবাইল টিপছে। নোরা তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,

” ইমাদ শুনছো, আজ রাতেই আমার বিয়ে। ”

~
~

রাত ০১ঃ৪৫ মিনিট।
প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে একটা রুমের মধ্যে বসে আছে নোরা ও ইমাদ। রাহাত এখনো আসেনি। কবির নামের লোকটা একটু পরপর এসে খবর নিয়ে যাচ্ছে। খাবারের ব্যবস্থা করেছে, ইমাদ ও নোরা একসঙ্গে খাবার শেষ করেছে।

খাবার শেষ করে নোরা শাড়ি পরার জন্য ইমাদকে রুম থেকে বের করে দিল। কবির নামের লোকটা বউ সাজার জন্য যা যা দরকার সবকিছু দিয়ে গেছে। রাহাত এলেই নাকি বিয়ে হবে। আবার কোনো ঝামেলা হলো কিনা কে জানে।

ইমাদ বাহিরে আছে, শীতের চাদরটা এখন ইমাদ জড়িয়ে রেখেছে। নোরা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা বিদেশি সোয়েটার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নোরা যেহেতু শাড়ি পরবে তাই সবকিছু এখন বাদ।

ড্রইং রুমে ওপাশে আরেকটা রুম আছে। সেই রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে ইমাদ। ইমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কবির হাওলাদার।

” ইমাদ বললো, সকাল হবার আগেই লাশগুলো কীভাবে সরানো যায় কিছু ভেবেছ? ”

কবির বললো, ” কোনো চিন্তা করবেন না ভাই। আপনি মেয়েটাকে মারার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করে দেবো। ”

” রাহাতের লাশ কোথায়? ”

” পাশের ঘরেই আছে, ফ্লোরে যেসব রক্ত ছিল সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। ”

” আমি নোরাকে খুন করার পরে এখানে কিন্তু এক মুহূর্তও থাকবো না। তুমি আর সবুজ দুজন মিলে লাশ গুম করে তারপর আসবে। ”

” ভাই একটা কথা বলি? ”

” বলো! ”

” মেয়েটাকে মেরেই ফেলবেন তাহলে এভাবে শাড়ি পরিয়ে বউ সাজানোর দরকার কি? শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়। ”

” যে যন্ত্রণা দুই বছর ধরে বুকের ভেতর বাসা বেঁধে আছে সেই যন্ত্রণা সহজে শেষ হয় না। বিয়ের সাজে সজ্জিত অবস্থায় নোরাকে যখন খুন করবো তখন পুরনো সব কষ্ট আমি ভুলে যেতে পারবো। ”

” শাড়ি পরে বের হলেই কি খুন করবেন? ”

” দেখি কি করা যায়। ”

ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইমাদ আর কবিরের সব কথা শুনে ফেললো নোরা। সে ইমাদের কাছে এসেছিল কিছু একটা নিতে। শাড়ি এখনো পরেনি। ইমাদের সমস্ত কথা শুনে শরীর কাঁপতে লাগলো নোরার।
নোরা বিড়বিড় করে বললো ” রাহাতকে ইমাদ খুন করে ফেলেছে? কিন্তু কেন? ”

কবির যেহেতু বলেছিল রাহাতের লাশ পাশের রুমে আছে তাই নোরা নিঃশব্দে পাশের রুমের খোঁজ নিল। ফ্ল্যাটের মধ্যে মোট তিনটা রুম এবং একটা ড্রইং ডাইনিং আছে। এক রুমের বারান্দায় ইমাদ ও কবির দাঁড়িয়ে আছে। আরেক রুমে নোরা ছিল। তাই বাকি আরেকটা রুমের মধ্যে গেল নোরা। দরজা বাহির থেকে ভেড়ানো ছিল। রুমের মধ্যে গিয়ে একটা সাদা রঙের বস্তা দেখতে পেল।

নোরা সেই বস্তার মুখ খুলে দেখে সেখানে একটা মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে কেটে রাখা হয়েছে। নোরার হাত-পা শীতের রাতে আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে জমে গেল।

নোরার হঠাৎ মনে হলো তাকে তো পালাতে হবে। নাহলে ইমাদ তাকেও মেরে ফেলবে। পিছন ফিরে তাকাতেই নোরা দেখল দরজার সামনে ইমাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কবির হাওলাদার। নোরার হাত-পা কাঁপতে লাগলো।

ইমাদ তার পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে নোরার হাতে দিল। মোবাইলটা রাহাতের, রাহাতের মোবাইলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নোরা।

ইমাদ বললো, ” রাহাত সাহেবকে বিকেলেই বন্দী করে আনা হয়েছে। তুমি যখন তার কল রিসিভ করোনি তখন তিনি আমাকে কল করেন। আমি তাকে কৌশলে এখানে নিয়ে আসি মিথ্যা বলে। আর সন্ধ্যা থেকে যেসব মেসেজ রাহাতের মোবাইল তোমার মোবাইলে গেছে সেগুলো সব কবির তোমাকে দিয়েছে। ”

নোরা কাঁদতে কাঁদতে বললো ” তুমি ওকে কেন খুন করলে? ”

ইমাদ তার হাতের সিগারেটে আরেকটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,

” শুধু সে নয়, তোমাকেও খুন করবো। যাও সুন্দর করে শাড়ি পরে আসো৷ ”

~ চলবে….
|

গল্পঃ-
#ল্যাম্পপোস্টের_অচেনা_রূপ।
#পর্বঃ- ০১.

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here