ল্যাম্পপোস্টের অচেনা রূপ শেষ পর্ব

0
1242

#ল্যাম্পপোস্টের_অচেনা_রূপ.
#পর্ব:- ০৩ (শেষ)

কবিরের সঙ্গে কথা শেষ করে ইমাদ তার সঙ্গের জামসেদকে বললো,
” এখানে লাশ পুতে রাখলে কেউ জানবে না তো আবার? ”

” কি যে বলেন ভাই! এই ছাড়া বাড়িতে পুরনো কবরস্থানে দিনের বেলাতেই মানুষ ভয়ে আসে না। এটা একদম নিরাপদ। তাছাড়া,,! ”

” তাছাড়া কি? ”

” আমরা লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে তারপর মাটিচাপা দিয়ে মাটির উপর লতাপাতা দিয়ে দেবো। কেউ যদি ভুল করেও আসে তবুও এখানে যে গর্ত খোঁড়া হয়েছে সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। ”

” কদিন পরে তো গর্তের উপর লতাপাতা শুকিয়ে যাবে তখন যদি দেখা যায়? ”

” ততদিনে কেউ বুঝবে না ভাই। আর কবরস্থান কেউ খুঁড়বে না। আর ওই ছেলে মেয়ে দুজন তো এই গ্রামের না তাই সন্দেহ করবে না। ”

ঠিক তখনই ইমাদের মোবাইলটা আবারও শব্দ করে কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো কবির আবারও কল করেছে।

” হ্যাঁ কবির। ”

” ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। ”

” কি হয়েছে? ”

” ওই মেয়ে তো রুমের মধ্যে ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। ”

আৎকে ওঠে ইমাদ!

” কি বলো এসব? নোরা আত্মহত্যা করতে চায় কেন? তুমি ওকে আটকাও। ”

” ভাই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন ভাই, ফাঁস নিলেই কিন্তু মরে যাবে। আপনার আর বিয়ে করা হবে না। ”

” তুমি দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করো আমি এখনই আসতেছি। যেভাবেই হোক দরজা ভেঙ্গে ওকে থামাও। দরকার হলে চড়থাপ্পড় লাগাও। তবুও যেন মরতে না পারে। ”

কল কেটে দিয়ে ইমাদ আর জামসেদ কবরস্থান থেকে বের হয়ে গেল। জামসেদ বললো,

” ভাই কি হয়েছে? ”

” নোরা নাকি রুমের মধ্যে গলায় ফাঁস দেবার চেষ্টা করছে। মেয়ে মানুষ আর ভালো হবে না। একটু পরে তো এমনিতেই মারতাম, তাহলে আগেই মরার জন্য লাফালাফি কিসের। ”

” ভাই মরলে কিন্তু আপনার পাপ কম হবে। তখন সব পাপা হবে ওই মেয়ের নামে। আত্মহত্যা করার জন্য যেই পাপা হয় সেই পাপা হবে। ”

ইমাদ কিছু বলে না কিন্তু বিরক্ত হয়েছে খুব। মনের বিরক্ত সে মনের মধ্যেই রাখলো৷ দ্রুত পা চালিয়ে মাঠের ভেতর থেকে হাঁটতে লাগলো।

জামসেদ ও ইমাদ কবরস্থান থেকে যাবার পাঁচ মিনিট পরেই সৈকত ফিসফিস করে রোমানের নাম ধরে ডাকলো৷

” রোমান, এই রোমাইন্না কোই তুই? ”

” আমি তো কবরের মধ্যে। ”

” ওরা চলে গেছে, তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়। ওদের পিছন পিছন যেতে হবে রে, ওরা কাকে যেন খুন করে এখানে লাশ লুকাবে৷ সেজন্য এখানে এসে গর্ত করেছে। ”

” আমার তো পা মচকে গেছে মনে হয়। আমি কীভাবে যাবো বল তো? ”

” তাহলে তুই থাক আমি যাই। দেখি লোকজন খবর দিয়ে ধরতে হবে তো নাহলে ওরা খুন করবে। তোর চাচার কাছে কল করতে হবে। ”

” আমি থাকবো মানে? এই বাগানের মধ্যে পুরনো কবরস্থানে ভাঙ্গা কবরের মধ্যে থাকবো নাকি? তাহলে তো আর আমাকে পেতে হবে না। সকালে এসে মাটিচাপা দিয়ে যাবি। ”

” কবরস্থানে আবার ভয় কিসের? একদিন মরলে তখন তো এভাবেই কবর দিয়ে রেখে যাবে। আর সেই সময় কীভাবে থাকবি? ”

কথা বলতে বলতে রোমানকে টেনে তোলে সৈকত। অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে দুজন মিলে কবরস্থান থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে চলতে থাকে।


কবির তখন মোবাইলে বলেছিল যে বিয়ে পড়াতে পারে এরকম একজনকে আনা হয়েছে। আসলে কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। সেরকম একজন পাওয়া গেছে, তাই তাকে নিয়ে আসা যায় কিনা এটা বোঝার জন্য কবির বাড়িয়ে বলেছিল। মূলত যাকে পাঠানো হয়েছে সে এখনো আসেনি। তবে বলেছে কাজি পাওয়া যাবে না।

বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে কবিরের নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকে ইমাদ। কিন্তু সমস্ত বাড়ি নিশ্চুপ, কোথাও কেউ নাই।
ইমাদ একটু ঘাবড়ে গেল, কিন্তু তবুও সতর্কতার সঙ্গে চারিদিকে উঁকি দিল। রাহাতের লাশ সেখানে সেভাবেই পড়ে আছে। কিন্তু কবিরের থাকার কথা ছিল বাহিরে, সে নেই কেন।

ইমাদ এবার জানালা দিয়ে নোরা যে রুমে ছিল সেই রুমে উঁকি দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু রুমের মধ্যে অন্ধকার, নোরা বাতি বন্ধ করে রেখেছে। ইমাদ মোবাইলে বাতি জ্বালিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু তেমন কিছু পেল না। একটা টর্চ এনে চেষ্টা করা হলো তবুও ব্যর্থ হয়ে গেল ইমাদ।

” দরজা খোলা ইমাদ ভাই। ” দরজার সামনে থেকে জানালো জামসেদ।

” কি বলো, ভেতরে যাওয়া যাবে? ”

” হ্যাঁ যাবে, আসেন। ”

” তুমি আমার পিছনে থাকো, কবির কোথায় গেল কে জানে? নোরার রুম অন্ধকার কেন। ”

টর্চ হাতে নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো ইমাদ। ভেতরে ঢুকেই সে দরজার দু’দিকে টর্চ ধরলো কারণ নোরা যদি আক্রমণ করতে চায় তাহলে দরজার কাছেই লুকাবে।
ঠিক এখানেই ইমাদের ভুলটা হলো।

চারিদিকে লাইট দিয়ে খুঁজে রুমের মধ্যে কিছু পাওয়া গেল না। রুমের বাতি জ্বালিয়ে দিল ইমাদ। জামসেদ তখন ওয়াশরুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কবির। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

কিছুক্ষণ আগে নোরা যখন দিকবিদিকশুন্য হয়ে মরতে চাচ্ছিল। তখন কবিরের রুমের মধ্যে প্রবেশ করার আগ্রহটা নোরার মাথায় একটা বুদ্ধি এনে দেয়। কবির দরজা ধাক্কাতে ব্যস্ত ছিল, নোরা তখন নিচে নেমে আসে৷ কবির যদি আবারও জানালার কাছে যেত তাহলে হয়তো দেখতে পেত নোরা নেমে গেছে। কিন্তু কবির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো।

নোরা খাটের পাশে একটা ফুলদানিতে রাখা ফুল দেখে সেই ফুলটা বের করলো। তারপর ফুলদানি হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ডান হাত দিয়ে ফুলদানি শক্ত করে ধরে প্রস্তুতি নিয়ে বাম।হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল। উপরে ও মিডেলে দুটো ছিটকিনি ছিল।
ইমাদ কবিরকে সতর্ক করেছিল যে দরজা খুলে দিলে নোরা আঘাত করবে। কিন্তু কবিরের সেই কথা মাথায় ছিল না। নোরার কাছে মাত্র তিন সেকেন্ড যথেষ্ট ছিল একটা আঘাত করার জন্য। যা হবার হবে, মরতেই তো হবে তাহলে একটু রিস্ক নিতে দোষ কি?
দরজা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে রুমের মধ্যে ঢুকতেই মাথা লক্ষ্য করে ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে নোরা। নোরার ভাগ্য ভালো তবে কবিরের ভাগ্য যথেষ্ট খারাপ।
এক আঘাতেই কবির ফ্লোরে পড়ে গেল। নোরার তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তখন ফুলদানি হাতে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। কিছুক্ষণ পরে নিস্তেজ হয়ে যায় কবির। নোরা কবিরের দেহটা টেনে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে রাখে। তারপর রুমে ফ্লোরের রক্ত বিছানার চাদর দিয়ে মুছে চাদরটা খাটের নিচে রেখে বাতি বন্ধ করে বের হয়ে যায়। বের হবার সময় দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেল।

বাড়ির ভিতর থেকে বের হতেই প্রানের মধ্যে বেঁচে থাকার আশার আলো দেখতে পেল নোরা। কিন্তু তখনই সামনের দিক থেকে কাউকে আসতে দেখে লুকিয়ে গেল সে। ইমাদ আর জামসেদ! নোরা চুপচাপ লুকিয়ে থাকে, ইমাদ আর জামসেদ বাড়ির ভিতর ঢুকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নোরা আবার হাঁটতে শুরু করে। কিছুটা সামনে গিয়ে সে গতিপথ পরিবর্তন করে কারণ রাস্তায় যদি কেউ ইমাদের সঙ্গের থাকে। তাই নোরা ডানদিকে মাঠের মধ্যে নেমে যায় আর তখনই দেখা হয় সৈকত ও রোমানের সঙ্গে। সৈকতের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে রোমান। মুখোমুখি হতেই নোরার গলা শুকিয়ে গেল। রোমান ও সৈকত দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা বুঝতে পারছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা একটা মেয়ে।

রোমান বললো ” দোস্ত এতো রাতে মেয়ে মানুষ আসলো কীভাবে? এই কে আপনি? ”

নোরা বুঝতে পারছে না তার কি করার উচিৎ। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখের উপর মোবাইলের আলো ফেললো সৈকত।

” কে আপনি, আগে তো কখনো দেখিনি! ”

নোরা বুঝতে পারলো এরা আর যাই হোক কিন্তু ইমাদের লোক নয়।
নোরা বললো, ” এখান থেকে খুলনা শহরের মধ্যে যাবার রাস্তাটা কোনদিকে বলতে পারেন? ”

” রাস্তা থেকে মাঠের মধ্যে নেমে আপনি রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছেন নাকি? ” বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো রোমান।

কিন্তু সৈকত বললো, ” এই শীতের মধ্যেও আপনি ঘামছেন। আর আপনার ওড়নায় রক্ত কিসের? আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন। ”

নোরা এবার হাতজোড় করে বললো, ” ভাই আমি বড় একটা বিপদের মধ্যে আছি। আমার এক বন্ধু আমাকে ষড়যন্ত্র করে নিয়ে এসেছে। ও আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুন করেছে, আমাকেও খুন করতে চায়। ”

রোমান বললো ” দোস্ত এদের জন্যই কি কবরস্থানে কবর খুঁড়েছে ওরা? ”

” হতে পারে। ”

” ভাই আপনারা কার কথা বলছেন? ”

” আমরা কবরস্থানে দুটো লোককে দেখেছি। তারা একটু আগে এদিকেই এসেছে। আচ্ছা এখন কথা বলে সময় নষ্ট করবো না। আমি রোমানের চাচাকে কল করেছি, এখনই পুলিশ চলে আসবে, আপনি চলুন। ”

নোরা এক মুহূর্ত ভাবলো যাবে কি যাবে না। পরে অবশ্য যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ সে না গেলে ওই বাড়ি এরা হয়তো চিনবে না।

নোরা বললো ” ওরা মনে হয় বাড়ির ভিতর আছে। আমি ওদের যেতে দেখেছি। ”

” তাহলে সেখানেই ধরতে হবে। রোমান তুই চাচার কাছে আবার কল দে তো। ”



সকাল আটটা।
মা-বাবা ও পুলিশের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে নোরা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। রোমানের পায়ের ব্যথা বেড়েছে বলে সে বাড়িতে চলে গেছে। রাহাত ইমাদের লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আহত কবিরকেও নিয়ে গেছে সেখানে। শুধু অক্ষত ছিল জামসেদ, তাকে আপাতত হাজতে রাখা হয়েছে।

ইমাদ পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নিজেই নিজের গলায় ছুড়ি চালিয়েছে। তবে মৃত্যুর আগে জামসেদকে বলেছে ” তোমরা তো বেশি দোষ করো নাই, তোমাদের শাস্তি কম হবে। পুলিশের কাছে ধরা দাও। আমাকে পেলে ফাঁসি দিবে। ”

পুলিশের সবকিছু জবানবন্দি দিয়ে সৈকতের কাছে বিদায় নিয়ে নিজের মা-বাবার সঙ্গে বাসায় রওনা দিল নোরা। ইমাদের জঘন্য আচরণের কোনো কারণ জানতে পারলো না। রাহাতকে ইমাদ খুন করলো কেন সেটাও জানা গেল না। তবে নোরা নিজের মনে মনে বহুদিন আগের একটা ঘটনা কারণ হিসেবে ভাবছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি জোড়ালো কারণ নয়।

ঘটনাটা ছিল ” নোরার সঙ্গে ইমাদের এরকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাহাত মানতে পারতো না। আর সে কারনেই ইমাদকে অনেক অপমান করেছিল রাহাত। তখন আবার নোরা ইমাদের এক বন্ধুর কাছে জানতে পেরেছিল ইমাদ ওকে পছন্দ করে। কিন্তু ইমাদকে জিজ্ঞেস করাতে সে অস্বীকার করে। তারপর থেকে আবার সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। রিফাত আর ঝামেলা করেনি। কিন্তু সেই অপমান ইমাদ নিজের মধ্যে পুষে রেখেছিল কিনা সেটাই ভাবছে নোরা।

সারারাতের পরিশ্রম আর ঠান্ডায় নোরার শরীরে জ্বর এসে গেল। সে তার মায়ের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। ব্যস্ত শহরের হাজারো মানুষ পেরিয়ে তারাও চলছে আপন আলয়ে।

ইমাদের উপর নোরার করা সন্দেহের সত্যতা প্রমাণিত হয় কবির সুস্থ হবার পর। কবিরের কাছে যখন নোরা জিজ্ঞেস করলো ইমাদ কেন করেছিল এমনটা। তখন কবির ঠিক সেই পুরনো ঘটনাই নোরার কাছে বললো। কবিরের মুখে শুনে সেদিন আবার নোরা ভাবতে লাগলো, পৃথিবীতে কত মানুষ কতকিছুই তো ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু সবাই পারে না কেন। কেন পুষে রাখে মনে, গোপনে।

সমাপ্ত।

মোঃ সাইফুল ইসলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here