ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ১৪

0
327

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|চোদ্দ তম পর্ব |

সবুজে ঘেরা গ্রাম ছেড়ে জন্মভূমিতে চলে এসেছি। দুইদিন পর বাড়িতে এসে সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে, অনেক বছর পর নিজ গৃহে ফিরে এসেছি।
বড়ো মা বাড়ি ফিরেই কাজে লেগে পড়েছেন। মালা, মেহেদী নিজেদের ঘরে ঘুমাচ্ছে। রজনীর মধ্যভাগ। ভ্রমণের মাঝপথে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সময়ের সংক্রমণে ফিরতেও দেরী হয়ে গেলো। মুঠোফোনের দিকে বার কয়েকবার দৃষ্টিপাত করলাম। মন বলছে, তার কন্ঠনালী থেকে অস্পষ্ট স্বর শুনতে। কিন্তু বাস্তবিকই নিজের অনুভূতিকে আড়াল করলাম। কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। আমি না হয় মনের ইচ্ছেকে বিসর্জন দেই। আগামীকাল হয়তো আমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।

শীতের সকালে সূর্যের কিরণ দেখা মিলল তো আপনি ভাববেন, আপনার কাছে আজ বিশেষ দিন। আপনি নাও ভাবতে পারেন তবে আমি ভাবি। ঘুম জড়ানো চোখে যখন সূর্যের আলো চোখে এসে বিঁধে তখনই আনন্দে মন নেচে উঠে। কুয়াশাচ্ছান্ন শীতের প্রভাব বেশি থাকে। নীলাভ আকাশে সূর্যের রশ্মি জমিনে পড়তেই হিম ভাবটা ফুরিয়ে আসে। গায়ের ভারি বস্ত্র ছেড়ে পাতলা শাল গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ঘর থেকে বের হয়ে আমার মন খারাপ হয়ে আসলো। তিনদিনে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার পরিবারেও সংকট আছে। ভালোবাসার সংকট। শান্তির সংকট। মা হাতে ব্যাগ পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রক্তিম বর্ণ চোখ করে বাবা মার ঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছি। মায়ের তাকানোর মর্মার্থ বুঝে ঘামছি। অতি শীঘ্রই বাড়ির পরিবেশ পরিবর্তন হতে চলছে। মা আমাকে আদেশের স্বরে বললেন, –” দরজায় কড়াঘাত করে আয়, মায়া।”
মায়ের শক্ত স্বর শুনে কেঁপে উঠলাম। অন্তরে খুব দোয়া করছি বড়ো মা যেন ঘরে না থাকেন। দরজায় দুইবার কড়াঘাত করলাম। এত বেলা হয়েছে, বড়ো মা শুয়ে থাকার মানুষ না। হয়তো বাবা ঘরে একা আছেন। আরো চার পাঁচবার কড়াঘাত করলাম। বাবা দরজা খুললেন। চোখ কচলে চশমা পরতে পরতে বললেন, –” তোর বড়ো মার রাতে জ্বর এসেছিল। এখন ঘুমাচ্ছে। তুই কিছু নাস্তা বানিয়ে ফেল,মা।”

ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা এখনো মাকে দেখেনি। অস্পষ্ট স্বরে প্রত্যুওরে বললাম, –” বাবা, মা এসেছে।”
বাবার মুখ মুহূর্তে শক্ত হয়ে আসলো। চশমা ঠিক করে মার দিকে তাকিয়ে বলল, –” বাড়ির ঝামেলা এবার এত তাড়াতাড়ি মিটে গেছে?”

আগুনে ঘি ঢেলে দিল বাবা। মা হাতের ব্যাগ ফেলে বাবার কাছে এসে চিৎকার করে বললেন, –” এই ছিল তোমার মনে? আমি থাকতে কিছু করতে পারো না বলে আমি চলে গেলে আমারই ঘরে আমার সতিনের সাথে?”

–” গলা নামিয়ে কথা বলো সুরজাহান। ভুলে যেয়ো না, তুমি যেমন এই বাড়ির বউ তেমন ফুলবানুও এই বাড়ির বউ।”
–” সে বউ হলেও আমি তোমার সন্তানদের মা হই। আমার অধিকার এখানে বেশি। সে এই বাড়িতে পড়ে আছে কেনো? তোমার মা তো বেশ বলেছিল, তোমার সংসার তোমার ঘর, তোমার পতি শুধুই তোমার বর। বড়ো আপা ও তা মেনে নিয়েছিল। এত বছরে আমার সন্তানদের হাতের মুঠোয় করল, এখন তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। তোমাকে কী জাদু করেছে। রুপ দেখিয়ে ফাসিয়েছে নিশ্চিত।”

–” সুরজাহান?”

পর পর দুইটা থাপ্পড়ের আওয়াজে চমকে উঠলাম। ইতিমধ্যে বড়ো মা দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। বাবা মার ঝগড়া দেখতে নেই এতে সন্তানের উপর গাঢ় প্রভাব ফেলে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে কাঁদছি। মা আরো বেপোরোয়া হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। ফল কাটার চা’কু এনে বড়ো মাকে আঘাত করতে চাইলেন, পারলেন না। বাবা তার আগেই আটকে দিলেন এবং শক্ত স্বরে বললেন, –” এতবছর মুখ ফুটে কিছু বলিনি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে। সন্তানরা বড়ো হয়েছে। ভালো মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। আজ আমি রৌনক চৌধুরী বলে রাখছি। এই চৌধুরী বাড়িতে সবার হক সমান। বউদের সাথে সন্তানদের। আমি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফুলবানুকে তার পরিপূর্ণ অধিকার থেকে বঞ্চিত করব না। এক সপ্তাহ ফুলবানুর সাথে থাকব আরেক সপ্তাহ সুরজাহানের সাথে। এই নিয়ে আরেকটা কথা বললে আমার তালাক দিতে বুক কাঁপবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছো?”

মা কিছু বললেন না। হনহন করে ঘরে ঢুকে গেলেন। বাবা বড়ো মাকে ধরে আমাদের ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –” তোমার কিছু লাগবে?”
প্রত্যুওরে মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, –” সুরজাহানের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কে চাইবে স্বামীকে অন্য কারোর হাতে তুলে দিতে!”

–” তুমি তো তুলে দিয়েছো।”

বড়ো মা আর কিছু বললেন না। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। বাবা আর কথা বাড়ালেন না। আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, –” কিছু রান্না করে নে, মা।”

প্রত্যুওরে কিছু বলব তার আগেই বড়ো মা উওর দেন, –“তোমার এই মেয়েকে আমি জীবনেও গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করতে দেইনি। সেখানে রান্না করবে কীভাবে। আমি রান্না করব। মায়া পাশে থাকলেই হবে। তুমি সুরজাহানের কাছে যাও। রাগ জিনিসটা খুবই খারাপ। দেখো ও যেন ভুল কিছু করে না বসে।”

বাবা চলে গেলেন। আমি বড়ো মার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, –” তোমার জীবনে এত কষ্ট কেনো বড়ো মা? আমি তার গর্ভে না এসে তোমার গর্ভে আসতে পারলাম না।”

–” এভাবে বলতে নেই, মা। মা তো মা-ই। মাকে খারাপ বলতে নেই, পাপ হয়। তওবা কর। জীবনে যাই করিস না কেনো, বড়োদের ঝামেলায় জড়াবি না। মাকে ভালোবাসবি।”

বড়ো মার কথায় কিছু বললাম না। জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম পাশে। বিড়বিড় করে বললাম, –” তুমি এতো ভালো কেনো, বড়ো মা?”

————–

ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট গতিতে চলছে। গভীর মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে শোনা যায় সেকেন্ডের কাঁটার টিকটিক শব্দ। কখনো ঘন্টার স্থানে এসে ঢংঢং আওয়াজ করছে। আমার মনও সাথে সাথে ডিপডিপ আওয়াজ করছে। আর কিছু সময়। আমি নিশ্চিত যাবির ভাইয়া আমার কথা মতো শুভ্রপুষ্পে এসে সে আছে। কথা ছিল আমি উনাকে গিয়ে চমকে দিবো কিন্তু আমি এখনো বাড়িতে। বড়া মাকে কয়েকবার বলতে চেষ্টা করছি, পারছি না। মা ঘুমাচ্ছেন। বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল বিধায় প্রেশার বেড়েছে। ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন। মনে সাহস জুগিয়ে বড়ো মার থেকে অনুমতি নিয়ে নিলাম, –” মা, কাজ শেষ। তুমি এবার বিশ্রাম করো। আমি সায়মার বাসা থেকে ঘুরে আসি।”

বড়ো মা কিছুক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে রইলেন। অসুস্থ স্বরে আদেশের স্বরে বললেন, –” মেহেদীকে সাথে নিয়ে যা।”
বড়ো মার কথায় খুশি হলাম। হাসিমুখে তৈরি হওয়ার জন্য রওনা হতেই বড়ো মা আবারো ডেকে বললেন, –” তোকে বিশ্বাস করি বলেই একা পথ চলতে দেই। আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না।”

মলিন হেসে বের হলাম। মেহেদী আর আমি পথ হাঁটছি। আমি ভাবছি মেহেদীর কথা, শুভ্রপুষ্পে তো আর তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। উনার কথা বাবাকে বলে দিবে। কিছু পথ হাঁটতেই মেহেদী বায়না ধরলো বন্ধুর বাসায় যাবে। আমিও সায় দিলাম। মেহেদীকে বন্ধুর বাড়ি রেখে রওনা হলাম।

অন্তরে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যুগ পাড় হয়ে গেছে উনাকে দেখিনা। মাটির পথ ধরে হাঁটছি। আর কিছু সময় তারপর উনাকে দেখতে পাবো।
শীতকালে শুকনো ঘাসের উপর বসে আছেন যাবির ভাইয়া। কারোর অপেক্ষা করলে যেমন আমরা আনমনে অনিচ্ছায় কাজ করি উনিও তাই করছেন। চিমটে চিমটে ঘাস তুলছেন আর দূরে ফিকে মারছেন। উনাকে দেখে হৃদপিন্ড খুব জোরেই বাজতে শুরু করলো। হাত পা কেঁপে অবশ হয়ে যাচ্ছে। কাঁপা স্বরে ডাকলাম, –” কারোর অপেক্ষা করছেন বুঝি?”

অনাকাঙ্ক্ষিত কোন জিনিস যদি আপনার সামনে চলে আসে তাহলে আপনি যেমন অবাক হবেন, যাবির ভাইয়ার অবস্থাও এখন তেমন। আমাকে দেখে একটু না অনেকটুকুই অবাক হয়েছেন। আমার পানে হা করে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি লাজুক মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছি। যাবির ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। এতক্ষণ গাছের নিচে বসে ছিলেন, দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ায় খেয়াল করেননি ফলস্বরূপ গাছের ডালের সাথে মাথায় আঘাত পেলেন।
উনি আঘাত পেলেন আর ব্যথা পেলাম যেন আমি। শব্দ করে ইশশশ বললাম। অবশ্য আমার থেকে সেই ডালটা আরো এক হাত উপরে হবে। উনি লম্বা মানুষ তাই মাথায় আঘাত পেয়েছেন সহজেই।
যাবির ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ডলে দিচ্ছেন। আমি বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, –” বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?”

উনি প্রত্যুওরে কিছু বললেন না। অবাক নয়নে এখনো তাকিয়ে আছেন। আমি আবার বললাম, –” কথা বলবেন না?”
ভেবেছিলাম অন্যান্য প্রেমিক পুরুষদের মত জড়িয়ে ধরবেন অথবা আমার গালে কষে থা’প্প’ড় মারবেন। কিন্তু কোনটাই করলেন না বরঞ্চ আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে বললেন, –” তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেই, মায়া?”

এমন আদরে আবদার কি ফেলা যায়? হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাসিমুখে বললাম, –” ছুঁয়ে দিন, মানা করেছে কে? আপনি আলতো হাতে আমায় ছুঁয়ে দিবেন,আমি চোখ বুঝে তা অনুভব করব।”

যাবির ভাইয়া হেসে ফেললেন। আলতোভাবে আমার হাত ধরলেন। প্রথমে আস্তে করে ধরেছিলেন কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে উনার হাতের বন্ধন আর শক্ত হয়ে গেলো।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাত উনার হাতের বন্ধনে আবদ্ধ। উনার হৃদয় স্পন্দন অনুভব করতে পারছি, শুনতে পারছি হৃদয়ের আকুলতা। নীরবতা ভঙ্গ করে উনি বললেন, –” এভাবে হঠাৎ করে আর এসো না, মায়া। দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবো। তারপর তুমি পাগলি প্রেমিকা হয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। আর আমায় খুঁজবে।”

–” আপনার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়, এই দোয়া করি সব সময়। কেননা আপনি কিনা অন্তরে কষ্ট হয়।”

–” আমার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটবে, মায়া? বেশি দূর না। ঐ যে আকাশি গাছ দেখছো, ওই পর্যন্তই হাঁটব। খুব ইচ্ছে করছে তোমার পাশাপাশি থাকার।”

যাবির ভাইয়ের কথায় মুচকি হাসলাম। সবুজ ঘাসের উপর উনার হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
বর্তমানে আমার একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমাদের সময়ের সাথে গানটাও মিলে গিয়েছে। মনে মনে গুন গুন করে গাইছি তখনই যাবির ভাইয়ার স্বর কানে ভেসে উঠে। উনি আমার হাতে অধর ছুঁয়ে দিয়ে গলা ছাড়লেন,

” এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হবে মায়াময়ী, বলো তো!

উনার কথার প্রত্যুওরে জোরে বলতে ইচ্ছে করছে, –” আমি চাইনা এ পথ শেষ হোক। আমি চাই সময় থেমে থাকুক। পথ আরো দীর্ঘ হোক। অনুভূতিরা সুন্দরভাবে কাছে আসুক। ফাগুন হাওয়ায় ভেসে উঠুক সকল প্রেমিক যুগল। সাথে আমি এবং সে!”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here