ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ১৫

0
326

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|পনের তম পর্ব |

বিস্তৃত মাঠের বুকে ছোট ছোট দূর্বা ঘাস জন্মেছে। খালি পায়ে হাঁটলে পায়ে ঠান্ডা অনুভব হবে। ইচ্ছে করবে, ঘাসের উপরই শুয়ে পড়ি।
কাল পরিবর্তন হয়েছে। শীতকাল শেষ হয়ে ধরণীতে বসন্তকালের আগমন ঘটেছে। স্কুল খোলা হয়েছে সেই কবে। প্রতিদিন সকালে এখন আর আরবি পড়া হয়না। পুরো কোরআন খতম দেয়া শেষ তাই অমার ছুটি। এতদিন সকালে আরবি পড়ার অজুহাতে যাবির ভাইয়ার সাথে দেখা হতো, এখন সেটাও হয় না। দু’মাস আগে যাবির ভাইয়ার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। আমি যদি জৌতিষী হতাম তাহলে সেদিন ঐ ভুলটা করতাম না। উনার দেওয়া মুঠোফোন আর ফেরত দিতাম না।
সেদিনের সেই সুন্দর মুহূর্ত ভুলা অসম্ভব। যাবির ভাইয়ার আশেপাশে থাকলে মন আনন্দে নেচে উঠে। ইচ্ছে করে পথের পর পথ উনার তালে তাল মিলিয়ে হাঁটতে। সেদিন প্রথম একসাথে আয়ুব চাচার হাতের ঝালমুড়ি খেয়েছি। আমার ইচ্ছেগুলোর মধ্যে এটাও একটা ইচ্ছে ছিল। অন্যবারের মতো ঝালমুড়ি খাওয়ার শেষে যাবির ভাইয়া পাঞ্জাবিকে রুমাল বানাননি। বরঞ্চ আমার দেওয়া সেই রুমাল দিয়ে নিজের মুখ মুছে নিয়েছিলেন সাথে আমার মুখও মুছে দিয়েছিলেন। আমি শুধু লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছিলাম।

অতীতের কথা স্বরণ করে মুচকি হাসছিলাম স্কুলের খোলা মাঠে বসে। সায়মা এখনো আসে নাই। সকালে প্রাইভেট পড়ানোর কথা ছিল কিন্তু শিক্ষক আসেনি। ক্লাস শুরু হতে অনেক সময়। উনার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। বিগত দুই মাস যাবত আমাদের দেখা হয় না। মালা,মেহেদীকে পড়ানো বাদ দিয়েছেন। অজুহাত দিয়েছেন উনার পরীক্ষা। বড়ো মা তো তাই বলল। আজকাল ভাবীর বাসায় যাওয়ার সুযোগ পাই না। বড়ো মা নিজে বসে থেকে অবসর সময়ে পড়ান নয়তো ঘুমাতে বলেন। একপ্রকার ঘরবন্দি রাখেন। রাস্তার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সায়মার আগমন ঘটে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দৌড়ে আসছে। আমাকে মাঠে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে কাছে আসে। ঘাসের উপর ব্যাগ ফেলে বসে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, –” কিরে মনু, এভাবে বসে বসে তোর উনার কথা ভাবছিস নাকি?”

সায়মার কথায় চটে গেলাম। এমনিতেই উনার বিরহে কাতর তার উপর সায়মা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভেংচি কেটে বললাম, –” আমি কারো কথা ভাবছি না। যে আমাকে স্বরণে রাখেনি তার কথা আমি কেনো ভাবতে যাব।”

সায়মা হাসছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে মন খারাপ। সে প্রশ্ন করল, –” স্যার আসবে না?”
মাথা নেড়ে ইশারায় না বললাম। সায়মা হঠাৎ বলল, –” শলাকাঠি দিয়ে ঘাস লুকানো খেলবি?”

আমি খুব করে বুঝতে পারলাম সায়মা আমার মন ভালো করতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
শলা কাঠি ঘাস লুকানো খেলাকে আনেকেই পাটকাঠি খেলা বলে। আমরা শলাকাঠি ঘাস লুকানো খেলা বলি।

এই খেলার নিয়ম হচ্ছে, একটি চিকন ছোট শলাকাঠি নিতে হবে। সবুজ ঘাসের উপর বাম হাত উপুর করে রাখতে হবে। ডান হাতে থাকবে শলাকাঠি যা ঘাসের মধ্যে লুকাতে হবে। এমনভাবে লুকাতে হবে যেন প্রতিপক্ষ খুঁজে না পায়। আর খুঁজে পেলে সে খেলবে। আবার যদি প্রতিপক্ষ খুঁজে না পায় তাহলে যে খেলবে তার খুঁজে দিতে হবে।
শুরু হয়েছে খেলা। প্রথমে হাত অদলবদল করে আমরা নিশ্চিত হলাম কে আগে খেলবে। হাত অদলবদল করার নিয়ম আছে। অনেকেই আমরা বাটাবাটি বলি। দুজনের হাত একসাথে করে সামনে আনতে হবে। যদি দুজনের হাতের একই পিঠ হয় তাহলে আবারো চেষ্টা করতে হবে। প্রথমবার আমাদের দুজনের হাত এক রকম হয়ে যায় যার ফলস্বরূপ আবারও হাত বাটি। এবার বিপরীত হয়ে যায় সায়মা হাতের উল্টো পিঠ আমার হাতে নিচের অংশ। আমি খেলা শুরু করি।

অনেক সময় নিয়ে শলাকাঠিটা ঘাসের ভেতর লুকাই। সায়মা দুই হাতে ঘাস উঠিয়ে অনেক ভাবে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু অসফল হয়। এবার আমার খোঁজার পালা একবার দুইবার তিনবার করে অনেকবার চেষ্টা করলাম নিজের লুকানো শালাকাঠি খুঁজে পেলাম না। এবার সায়মা আনন্দিত হল। আমার উদ্দেশ্যে বলল, –” তোর জীবনটা এমনই। এমন জায়গায় আটকে আছিস যেখান থেকে নড়তেও পারিস না সরতেও পারিস না। যাক বাদ দে আমাকে দে আমি করি।”

সায়মার কথার প্রত্যুওরে কিছু বললাম না। প্রায় বিশ মিনিট খেলে ক্লাস করতে চলে গেলাম।
——–
মধ্য দুপুর, স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। সকল শিক্ষার্থীরা যার যার বাড়ি ফিরছে। সায়মা আর আমি গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছি হঠাৎ মনে পড়লো পলাশ ফুলের কথা। ফাল্গুন মাসে পলাশ ডালে পলাশ ফুল ফুটেছে অথচ আমি এখনো পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এবছরে এখনো পলাশ ফুলের মালা গাঁথা হয়নি। ভাবলাম শুভ্রপুষ্প থেকে ঘুরে আসি। অনেকদিন যাওয়া হয় না। সেখানে ঘুরে পুরনো দিনের কথা মনে করব আর কিছু ফুলও কুড়িয়ে আনবো। যদিও জানি এ সময় ফুল পাওয়া অসম্ভব। ছোট ছোট বাচ্চারা সেই সকালে ফুল করিয়ে নিয়ে গেছে। মনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে নেই। সায়মাকে বিদায় জানিয়ে শুভ্রপুষ্পে চলে আসলাম।

পলাশ গাছের নিচে সবুজ সবুজ ঘাস জমেছে। যেহেতু এখন ফাল্গুন মাস রোদের প্রখরতাও একটু বেশি। পলাশ গাছের নিচে চার-পাঁচটা পলাশ ফুল পড়ে আছে। এগুলো দিয়ে আমার মালা গাঁথা হবে না। আর এত উঁচু গাছ যে আমি চাইলেও গাছে উঠে ফুল পারতে পারব না। আশেপাশে তাকালাম কারো খোঁজ করছি। মেহেদির সহপাঠীকে দেখতে পেলাম ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছে। তাকে ধরে বেঁ’ধে এনে পলাশ গাছে উঠালাম। সমপরিমাণ ফুল পাড়িয়ে বিদায় করলাম ছেলেটিকে। এখানে সুই সুতা পাওয়া অসম্ভব তাই ফুলগুলোকে স্কুলের পোশাকের মধ্যে নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।

মধ্য দুপুর প্রতিদিন এসে বড়ো মাকে গোসল করতে দেখি আর মাকে খাবারের টেবিলে খেতে দেখি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা ভিন্ন। দরজার সামনে প্রায় পনের জোড়ার মতো জুতা দেখতে পেলাম। নিজের চঞ্চলতা থেকে কমিয়ে আস্তে ধীরে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম। অনেক মানুষের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অপরিচিত মানুষদের দেখে সালাম জানালাম। অনেকেই সালামের উত্তর নিল আবার অনেকেই আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। মাথা নত করে সেখান থেকে চলে আসলাম। বিছানার উপর পলাশফুল রেখে দিলাম। গোসল করে মালা গাঁথবো।
কাপড় হাতে নিয়ে তৈরি হচ্ছিলাম গোসলে যাবো।এমন সময় বড়ো মা ঘরে প্রবেশ করেন। আলমারির ভিতর থেকে একটা নতুন জামা নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে তাগাদা দিলেন তাড়াতাড়ি গোসল করে আসার জন্য। হতবাক হয়ে রইলাম বড়ো মাকে অনেকবার প্রশ্ন করলাম, –” কেন নতুন জামা পরবো?”
বড়ো মা বেশি কিছু বললেন না। শুধু বললেন, –” বাবা বলেছে।”
গোসল করে নতুন জামা পরিধান করে বিছানায় বসে রইলাম। চিন্তা করছি এত মানুষের আগমনের কারণ। বের করতে পারলাম না কেননা আমাদের বাসায় বাবার ব্যাবসার তাগিদে অনেক মেহমান আসা যাওয়া করে।
বরাবরের মতো বড়ো মা ঘরে আসার কথা কিন্তু এবার বিপরীত ঘটলো। ঘরে প্রবেশ করলেন মা। হাতে কিছু গয়নার বক্স ।আমার কাছে এসে গম্ভীর মুখে দাঁড়ালেন। একে একে কানে, গলায় এবং হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। আমি অবাক নয়নে শুধু দেখছি। অবশেষে মাকে প্রশ্ন করলাম, –” আমাকে এভাবে সাজাচ্ছো কেনো?”
মা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, –” তোকে আজ দেখতে এসেছে। যদি পছন্দ হয় তাহলে আংটি পরিয়ে চলে যাবে। ছেলে খুব ভালো। সরকারি চাকরি করে। দুই তিন মাসের ভেতর বিদেশে স্যাটেল হবে। তোর বাবা সমন্ধে নিয়ে এসেছে। কোনো তিড়িং বিরিং করবি না।”

মার কথা শুনে চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরতে শুরু করল। মাকে করুন স্বরে বললাম, –” আমি বিয়ে করব না। বাবাকে বলে দাও আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই।”

মা আমাকে কিছু বলবে এমন সময় বড়ো মা ঘরে প্রবেশ করেন। আমার কাছে এসে মাথায় ঘোমটা টেনে বলেন, –” আমরা তোর ভালো চাই। তোকে যেমন ভালোবাসি তেমন তুই যেনো সুখী হোস সেটাও চাই। তোর বাবা ছেলের খোঁজ খবর নিয়েছে ছেলে খুব ভালো। তোকে সুখে রাখবে।”

এবার আর সহ্য করতে পারলাম না। গর্জে উঠলাম। দুই মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম, –” আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি বিয়ে করব না। আমি যাবির ভাইয়াকে ভালোবাসি। বিয়ে যদি করতে হয় উনাকে বিয়ে করব।”

আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে গালে পরপর দুইটা থাপ্পড় পড়ে। থাপ্পড়টা দিয়েছেন আমার মা। তিনা রাগে ফুস করে উঠলেন। আমার হাত শক্ত করে ধরে বললেন, –” বাপের মত হতে চাও? এক কূলে বসে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাও? তা হতে দিব না। যা যা হচ্ছে তা হতে দাও। নইলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
মা আমার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা স্বাভাবিক বিষয় কিন্তু বড়ো মা কিছু বলছেন না এই বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগলো। বড়ো মার চোখ মুখ শক্ত। মাথায় ঘোমটা টেনে হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিলেন।

অপরিচিত মানুষদের সামনে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে বসে আছি। বাবা সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। বড়ো মা সামনে আসেননি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন। মালা মেহেদী বসে বসে মেহমানদের জন্য আনা ফল শরবত গোগ্রাসে গিলছে। চোখে পানি টলমল করছে পলক ফেললেই ঝড়ে যাবে কারোর কথা কানে আসছে না। মনে মনে যাবির ভাইয়ার কথা স্বরণ করছি। দোয়া করছি যেনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যায়।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম জাদু বলতে কিছুই নেই। একজন মহিলা আমার পাশে এসে বসলেন। থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঁচু করে ধরে বললেন, –” এ তো লাল পরী। আমাদের সামাদের সাথে খুব সুন্দর মানাবে। দেখি মা তোমার হাতখানা সামনে আনো।”

আমি অসহায় চোখে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনার চোখ মুখ এখনো আগের মতো শক্ত। দ্বিতীয়বারের মতো আশাহত হলাম। মহিলাটি আস্তে করে আমার ডাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলের আংটি খুলে নিজের সাথে নিয়ে আসা আংটি পরিয়ে দিলেন। চক্ষুদ্বয়ের সামনে বাম হাত নিয়ে আসলাম। এতদিনে সযত্নে রাখা যাবির ভাইয়ার আংটির পরিবর্তে অন্য আংটি দেখে চোখে পানি চলে আসলো।
সকলে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আমার কর্ণধারে কিছুই প্রবেশ করছে না। চোখের সামনে সব ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে অস্ফুট স্বরে বললাম, ” আপনি কোথায়, আমি যে অন্য কারোর হতে চলেছি।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here