শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) শেষ পর্ব

0
492

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-২০ ( শেষ পর্ব)
#হালিমা রহমান

কাল ঘুমাতে ঘুমাতে বেশ রাত হয়েছে বলেই উঠতে খুব বেলা হয়ে গেল আজ।ফজরের নামাজ ছুটে গেছে।অ্যালার্মটা হয়তো আফজাল বন্ধ করে দিয়েছে।তাই কোথা দিয়ে সকাল এলো তাই টের পেল না হুমায়রা।আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসতেই চোখ গেল নাক বরাবর ঘড়ির দিকে।সকাল পৌনে নয়টা।সর্বনাশ! ওর মতো সংসারী আর্লি রাইজারের কাছে এ অনেক বেলা।
পর্দা টেনে দেওয়া জানালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে গলে পড়া সোনা রঙা সূর্য কিরণ জায়গা করে নিয়েছে মশারির উপরে।ঠিক মাথার উপরে।সামনের ঘর থেকে ভেসে আসছে হুমায়রার টিয়ার চিৎকার।বেচারার ক্ষুধা পেয়েছে হয়তো।আফজাল নেই।বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফ্যান বন্ধ করে গেছে।ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার মেয়েটা।শাড়ি গুছিয়ে নিচে নেমে কলতলায় ছুট দেওয়ার আগেই পা থেমে গেল।টেবিলের উপরে বাজছে আফজালের ফোন।রিং হচ্ছে অনবরত।আফজালের দেখা নেই।গোসলে গেছে বোধহয়।অগত্যা ফোনটা হুমায়রাকেই ধরতে হয়।

” আসসালামু আলাইকুম।”

ও-পাশ থেকে ভেসে এলো উচ্ছ্বাসে ঘেরা ভারী পুরুষালী কন্ঠ।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।আফজাল ভাই কোথায়?”

” উনি গোসলে।”

” আপনি কে? ওনার ওয়াইফ?”

” জ্বি।”

” ভাবী আমার সালাম নিবেন।আমি আফজাল ভাইয়ের কলিগ সোলায়মান।”

” উনি আসলে কিছু বলতে হইব?”

” ভাই আসলে বলবেন হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতে। আমি কিছু পিক দিয়েছি।আমার মেয়ে হয়েছে ভাবী।দোয়া করবেন।”

” আলহামদুলিল্লাহ।আপনার ভাই আসলে ফোন দিতে বলুমনি।”

চট জলদি কথা শেষ করে ফোন হাতে নিয়েই বাইরে বেরোয় হুমায়রা।উঠোন থেকে ভেসে আসছে আফজালের কন্ঠ।সুরে সুরে গান ধরেছে।উঠোনে টান টান দড়িতে মেলে দিচ্ছে গত রাতের ব্যবহৃত টি-শার্ট।

” আপনের ফোন আসছিল।”

” কে?”

” সোলায়মান নামের একজন।হের বলে বাচ্চা হইছে।”

” মাশাল্লাহ। সাত বছর পরে অবশেষে বেচারার একটা বাচ্চা এলো।”

” ছবি পাঠাইছে বলে।”

কাঁধে ফেলে রাখা গামছা নিংড়ে পানিগুলো মাটিতে ফেলে দেয় আফজাল।হাত দুটোর পানি ভালোভাবে মুছে হাত পেতে বলে, ” দেখি ফোন দাও।”

” নেন।”

” নাস্তা বানানোর দরকার নাই আজকে।বাজার থেকে নেহারি আর পরোটা আনবনে। সবাই মিলে খাব।”

ডেটা চালু করতেই টুংটাং শব্দে রীতিমতো ঝিম মেরে উঠলো নির্জীব ফোনটা।আফজাল হাসে।সোলায়মান নামের সদ্য বাবা বনে যাওয়া পুরুষটা বিশটা ছবি পাঠিয়েছে।হোয়াটসঅ্যাপে সোলায়মানের ছবির হদিশ পাওয়ার পরে আরেকটা নোটিফিকেশন এলো।আফজাল অবাক হয় বেশ।কাল শেষ রাতে একটা ভিডিও এসেছে ফোনে।প্রেরকের নাম দেখে অবাক হতে হয়।ফয়সাল পাঠিয়েছে। অদ্ভুত! এই ছেলে এতো রাতে কীসের ভিডিও পাঠালো?

” হুমায়রা, আম্মাকে যেয়ে নাস্তা করতে মানা করো।আমি পরোটা আনছি।”

সকালের কাজ নেই। হুমায়রা অলস গায়ে ও ঘরের দিকে ঢলতে ঢলতে পা বাড়ায়।কাঁঠাল গাছের দিকে এমনিই হাঁটতে হাঁটতে ভিডিও অন করে আফজাল।মিনিট কয়েক দেখার পরে কিন্তু মুখের ভাব আর আগের মতো থাকে না।চনমনে হয়ে উঠে সে।অজানা আশংকায় কচি কিশলয়ের মতো কাঁপে ভিতর-বাহির।

” আম্মা সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ আপনার?”

সকাল সকাল হুমায়রাকে দেখে ভিতরটা তেতো হয়ে আসে রোমেলা বানুর।জ্বিভটা টনটন করে শক্ত কিছু বলার জন্যে।কিন্তু মনের উত্তাপ গোপন করে বেশ গম্ভীর গলায় বলেন, ” না।ক্যান?”

” আমগো সাথে খায়েন।আপনের ছেলে বাজার থেকা নাস্তা আনব।”

” হ,হ আনো।কুইড়া মাইয়া মানুষ।রত লাড়ায়া নাস্তা বানাইবা ক্যান? জামাইয়ের কষ্টের পয়সা হোটেলে ঢাইল্লা হোটেলের নাস্তা খাও।তোমগোই তো দিন।”

প্রতিবাদ করে হুমায়রা।ত্যক্ত গলায় উত্তর দেয়, “আপনের ছেলে নিজেই কইছে আনব।আমি কই নাই।আমার নাস্তা বানাইতে কোনো সমস্যা নাই।”

” হ,হ চিনি তোমারে।এমনে চললে কলাগাছ লাগাইতে হইব ভিটায়।”

সকাল সকাল বাসি মুখে আর কোনো তর্কে জড়াতে ইচ্ছা হয় না হুমায়রার।মুখ কালো করে ঘরের পথ ধরার আগেই থমকে যায়। দরজা দিয়ে পাগলের মতো এদিকেই ছুটে আসছে আফজাল।এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে ফোন ধরে রাখা,অন্য হাত চুলে।শক্ত মুঠোতে টানছে মাথার চুল।উদভ্রান্তের মতো ছুটে যাচ্ছে সামনে,ফয়সালের ঘরের দিকে।স্ত্রীকে পাশ কাটানোর সময় অজান্তেই বউয়ের পা মাড়িয়ে দিলো।ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে অবাক চোখে স্বামীর গমন পথের দিকে চেয়ে রইলো হুমায়রা।আশ্চর্য! লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে?
________________________________
ধাম করে দরজা খুলতেই নজরে এলো গোটা রুমটা।খাটের কাছের জানালাটা বন্ধ।রুমের ভিতর ভ্যাপসা গন্ধ।বিছানার চাদর বাদে সবকিছু পরিপাটি।কুঁচকানো চাদরের মাঝে ফয়সালের ফোনটা উলটো করে করে রাখা।বালিশ দুটো জায়গা মতো।দেখলেই বোঝা যায় এ ঘরে কাল কেউ শয্যা নেয়নি।ভাবগ্রস্তের মতো নীরব পায়ে ঘরে ঢুকলো আফজাল।হাঁটতে পারে না ঠিক মতো।বিছানার কাছে রাখা চেয়ারের পায়ের সাথে হোঁচট খেতেই দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়রার টনক নড়ে।তড়িঘড়ি করে ঘরে স্বামীর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে।কপালে নরম হাত ছুঁইয়ে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে, ” কী হইছে? এমন করেন ক্যান?”

” বউউউউ, কে আইছে ঘরে? আফজালে নাকি?”

সেকেন্ড কয়েক পরেই প্রশ্নকর্তাকে দেখা গেল ফয়সালের দরজায়।আফজালের ছোটাছুটির শব্দ পেয়ে উঠে এসেছেন এদিকে।কিন্তু ছোট ছেলের দুয়ারে এসে পা থমকে যায়।আফজাল হাঁটু ভেঙে পড়ে আছে নিচে।শূন্য দৃষ্টি মেলে আশেপাশে চায়।রোমেলা বানু থমকে যান।মনের ভিতর অকারণেই দামামা বাজছে।অজানা রহস্যে আনচান করছে মন।ব্যস্ত পায়ে ছুটে আসেন ছেলের ঘরে।মেঝেতে লেপ্টে বসে ছেলের অভিব্যক্তিহীন মুখটা দু’হাতের আজলায় তুলে নেন।

” কী হইছে বাজান? এমন করো ক্যান?”

উত্তর দেয় না আফজাল।কেবল নীরব দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে।অগত্যা তাই প্রশ্নটা আবার করতে হয়,
” আম্মারে কও কী হইছে? খারাপ লাগতাছে? কি গো বউ, কী হইছে?”

” জা..জানি না আম্মা।আমার ভয় করতাছে হেরে দেইক্ষা।মাত্রও তো…. কন্ঠের কাঁপনে কথা শেষ করতে পারে না হুমায়রা।

” আফজাল দেহি,আম্মার দিকে তাকাও।কী হইছে বাপ? এমন করো ক্যান? খারাপ কিছু হইছে?”

” আম্মা আমাদের ফয়সাল”— বিরবিরানিটা ঠিক বোঝা যায় না।কপাল কুঁচকে ফেলেন রোমেলা বানু।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে ফের প্রশ্ন করেন, ” কী করছে ফয়সালে? বেদ্দপি করছে তোমার লগে? ওয় তো একটা পাগল।”

” ফয়সাল নাই আম্মা।”

তিনটে শব্দ নয় যেন একটা বোমা ফাটলো ঘরে।কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হয় রোমেলা বানুর।ছটফটিয়ে উঠেন।দম আঁটকে আসা মাছের মতো তড়বড় করেন।

” নাই মানে? নাই মানে কী?”

” ফয়সাল বেরিয়ে গেছে আম্মা।”

” একটা থাবড়া দিয়া চাপার দাঁত ফালায়া দিমু।কই গ্যাছে আমার পোলায়? কী কছ হাবিজাবি?”

আর বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয় বলেই ফোনের লক খোলে আফজাল।ভিডিওটা সামনেই ছিল।ওটা অন করে।সাউন্ড বাড়ায়।টেনে আবার শুরুর দিকে নিয়ে যায়।অন্ধকার ঘর,ক্যামেরায় ফায়সালকে নজরে আসে না।কেবল অন্ধকার।সেই অন্ধকার ভেদ করে ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পরে ভেসে আসে ফয়সালের গলা।তাপ-উত্তাপহীন কন্ঠে একের পর এক ঝরছে অর্থবোধক বাক্য।

“এই বিয়েতে আমার বিন্দুমাত্র মত ছিল না ভাইয়া।কথাটা হয়তো তুমি শুনেছো।খুবই পুরোনো খবর।এই মাঝ রাতে এতো পুরোনো কাসুন্দি ঘাটার ইচ্ছা আমার নেই। শুধু একটা প্রসঙ্গ টানতেই কথাটা বলা।আম্মা সূচিকে বউ করেছিল স্রেফ সম্পত্তির লোভে।সূচির বাবার জায়গা-জমি সব সূচির উপর বর্তেছে।সূচি নামমাত্র মালিক।শ্বশুর মরার পরে আদতে জমির মালিক আমিই হব।এই বিশাল পরিকল্পনার পিছনে আমার প্রতি আম্মার ভালোবাসাও হয়তো ছিল।ভবিষ্যতে তিনি হয়তো আমাকে বিরাট সম্পদশালী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।অথবা এভাবেও ভাবতে পারো তুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু পাওনি বলে আম্মার পরিকল্পনাটা আমার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একদম কাট কাট ছিল।আম্মা চেয়েছেন আমি সুখী ও ধনী হই।অঢেল টাকা-পয়সা থাকলে নিশ্চয়ই কারো সুখের অভাব থাকবে না।কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দরী বউয়ের।ভাবীর মতো সুন্দরী অথবা আরো রূপবতী কেউ।যাকে আমার পাশে মানাবে,যাকে পছন্দ মতো শাড়ি পরিয়ে আরাম,যাকে দেখলে চোখের তৃষ্ণা মেটে,বন্ধু-বান্ধবের সামনে যাকে পাশে নিয়ে মাথা উঁচু করে বসা যায়–এরকম কেউ।চাহিদা এইটুকুই।এটুকু যখন পূরণ হলো না তখন মুখে তিন কবুল বললেও মনে মনে বিয়েটাকে কিন্তু আমি মানিনি।মনোযোগ দিয়ে ভাবলে এখন আর সেই দূর্ঘটনাকে আমার বিয়ে মনে হয় না ভাইয়া।ওটা একটা ব্যবসা ছিল,বিয়ে নয়। তোমারটা বিয়ে ছিল তাই তুমি এখনো সংসার করছো। আমারটা ব্যবসা ছিল তাই মাত্র চার মাসেই পাট চুকে গেছে।ব্যবসা জমেনি,মতে মত মিলেনি,সব ঘেটে গেছে।আজ দেখো লোকসান ছাড়া আমার ঝুলিতে কিছু নাই।
চার দেয়ালের মাঝে সূচিকে মেনে নিতে আমার ঠিক এক মাস সময় লেগেছে।চার দেয়াল বলতে কী বুঝিয়েছি তা তুমি বুঝেছো নিশ্চয়ই।সব ভেঙে বলব না।এ বাড়ির সংসার সম্পর্কে তোমার অজানা কিছু নেই।জানোই তো দাদা থেকে শুরু করে তুমি,কেউ সুখী হয়নি এই ঘরে।আমিও ব্যাতিক্রম নই।তবে জানো একটা কথা আমার প্রায়ই মনে জাগতো।যেই আম্মা আমার মতামতকে অগ্রাহ্য করে সূচিকে ঘরে আনলো, সেই আম্মা কেন পরে এমন করলো? এতো জ্বালাতন,এতো মেন্টাল টর্চার,এতো দাঁতে কাটা– কেন? ভাবতাম আম্মার স্বভাবটাই এমন।সবার সাথেই হয়তো এমন আচরণ করে।আমি নিজের ছেলে অথচ আমাকে আগে জানোয়ার,অমানুষ ছাড়া কথা বলতো না।কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়,কেন আম্মার আচরণ এমন? অদ্ভুতভাবে এই প্রশ্নটার উত্তর পেলাম আজকে।পোড়ানোর জন্যে যখন ঘর থেকে আবর্জনাগুলো বের করছিলাম, তখন সূচির শাড়ির একদম নিচে একটা কাগজ পেলাম।অন্তু ভাইয়ের লেখা একটা চিঠি।খুব সম্ভবত শীতের শেষে প্রথম যখন এসেছিল তখন লিখেছে।আমি মনোযোগ দিয়ে পুরোটা পড়লাম।বিশাল চিঠি,অনেক কিছুই লেখা ছিল ওখানে।তার মাঝে একটা কথা আমার মনে ধরেছে।লিখেছে,মানুষ দেখে শিখে অথবা ঠেকে শিখে।আমাদের আম্মা দেখেই শিখেছে ভাইয়া।দাদীকে দেখে সংসার শিখেছে সে।দাদী আম্মার সাথে কেমন করতো তা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে তুমি বেশি ভালো জানো।আম্মার মনে হয়েছে তারও ঘরের বউদের সাথে এমন করা উচিত। তাই করেছে।আরেকটা কারণ অবশ্য আছে।অন্তু ভাইয়ের ভাষ্যমতে, আমাদের আম্মা কঠিন কর্তৃত্ববাদে আক্রান্ত।সবক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ফলাতে চায়।এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বোধহয় আমি-তুমি ছাড়া আর কেউ নই।
চলে যাচ্ছি ভাইয়া।না,না, ভুল বললাম।আমি আসলে পালিয়ে যাচ্ছি।তোমরা নিশ্চয়ই বলবে পালিয়ে যাওয়াই সমাধান নয়।কিন্তু আমি তো সমস্যা সমাধান করতে চাইছি না।মন বলতেও একটা শব্দ আছে।আমি শুধু নিজের মন মতো একটু বাঁচতে চাইছি।বিয়েটা মন মতো হলো না,সংসারটা মন মতো হলো না,পরিণতিও আমার মন মতো না।তাই এবারে একটু মনের কথায় সায় দিচ্ছি। একটু ভালো থাকার উদ্দেশ্যে, জীবনের জমা-খরচ হিসাব করতে,একটু শান্তিতে শ্বাস নিতে,নতুন করে বাঁচতে–আমি পালিয়ে যাচ্ছি তোমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে।যেখানে আমার পরিচিত কেউ নেই,মা নেই, ভাই নেই,বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই।শুধু থাকব আমি আর আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। একটু বেশিই ঝুঁকি নিচ্ছি। তবে শান্তিতে দু’দন্ড বাঁচার জন্যে এছাড়া আর গতি নেই।তুমি হয়তো ভাববে উদয়পুর কী দোষ করলো? এখানে থেকেই সব নতুন করে শুরু করতে পারতাম।কিন্তু না,তা কখনোই হতো না ভাইয়া।উদয়পুরকে এখন আর আমার সহ্য হয় না।কাজী বাড়ির নাম মনে আসলেও একদম পাগল পাগল লাগে নিজেকে।নিজের ঘরের চার দেয়াল আমার গলা চেপে ধরে প্রতি মুহূর্তে। বিশ্বাস করো আম্মাকেও আমার সহ্য হয় না।খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলি তার সাথে।আজ সারাদিন আমি কিন্তু স্বাভাবিক ছিলাম না ভাইয়া।নিখুঁত অভিনয় করেছি।অথচ দেখো, এতো কাছে থেকেও তুমি বুঝতে পারোনি।এই অভিনয়টাই জীবন না ভাইয়া।আমি জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাই,অভিনয়কে নয়।আবার ভুল করে ভেবে বসো না সূচির দুঃখে দেবদাস হয়ে পথে পথে ঘুরে বেরাচ্ছি।ওতো মাখামাখো ভালোবাসার সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই।আগেও ছিল না, এখনো নেই।ওকে কখনো আমি শখ করে একটা শাড়িও গিফট করিনি।দু’দন্ড বসে প্রেমালাপ করিনি অথবা স্বেচ্ছায় ভালোবেসে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাইনি।বিয়ের মতো পবিত্র একটা বন্ধনকে যখন আমি ব্যবসা বলছি তখন বুঝতেই পারছো সম্পর্কটা কোথায় ছিল।তবে একটা বিশ্রি অপরাধবোধে যে ভুগছি তা অস্বীকার করব না।ওর মৃত্যুটা এখনো বিশ্বাস হয় না।
তবে একটা জিনিস ভেবে দেখলাম।সূচির এই দুর্ঘটনাটা দরকার ছিল ভাইয়া।আমার তথাকথিত ভয়ের দেয়ালটা ভাঙার জন্যে হলেও দরকার ছিল।আমি এখন ভেবেই অবাক হই আগে কেন আম্মাকে এতো ভয় পেতাম? ওটা আদতেই ভয় ছিল নাকি স্রেফ ছোটবেলার অভ্যাস ছিল? নাকি সূচিকে পছন্দ করতাম না বলে আম্মা ওর সাথে যা ইচ্ছা তা করলেও আমার গায়ে লাগতো না? অবচেতন মনে কি আমি মেয়েটাকে খুব বেশিই ঘৃণা করতাম? তাই ওর অভিযোগ বা কষ্ট আমাকে আগে ছুঁতে পারতো না? জানি না ভাইয়া।এই ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো ক্লিয়ার না।
কথা শেষ করতে ইচ্ছে করছে না।আমি এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে কী হবে জানো? আরেকটা মেয়ে বউ হয়ে আসবে। আমি হয়তো তাকে ভালো রাখতে পারব।কিন্তু আমি তো সারাক্ষণ বউকে ধরে বসে থাকব না। সে অনেকটা সময় থাকবে আম্মার সাথে।আম্মার আচরণ ঠিক কতখানি বদলেছে তা তো জানি না।আবার যদি সূচির ঘটনার মতো হয়? আমি কি আম্মার মুখ চেপে ধরে রাখতে পারব?
যাক গে, আর অজুহাত দেব না।মূল কথা হচ্ছে আমার এখানে প্রাণে সইছে না তাই আমি পালাচ্ছি।তবে সত্যি বলতে আম্মার প্রতি একটা ক্ষোভ কাজ করছে।তাই তাকে মানসিক যন্ত্রণার মাঝে রাখার জন্যেও বাড়ি ছাড়া দরকার।আমিই এখন আম্মার দুর্বলতা।আমাকে দু-দন্ড না দেখলে আম্মা অসুস্থ হয়ে যায়।তবে বোঝো,আমাকে এতোদিন না দেখলে তার কেমন লাগবে।ঘুমটাই হারাম হয়ে যাবে নিশ্চিত।মনে হয় না এর চেয়ে বড় মানসিক শাস্তি আর কিছু দরকার।চিন্তা করো না,ভাবীর সাথে আম্মা আগের মতো কিছু করবে না।আমাকে বাড়ি ছাড়তে দেখলে নিজের ভুল একটু হলেও বুঝবে।আম্মা দেখে শিখেছিল।এবার নাহয় ঠেকে শিখুক।

তবে সব দোষ মায়ের ঘাড়ে তুলে দিয়ে নিজে সাধু সাজব না।আমার দোষ আমি জানি।আমার অপরাধও অনেক ছিল।অস্বীকার করব না।সবচেয়ে বড় দোষ ছিল আমি আমার বউকে কখনো মূল্যায়ন করিনি,সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করিনি,তাকে মানসিক শান্তি দেওয়ার চেষ্টাও করিনি,আম্মার অন্যায় দেখেও দেখিনি।সেই জের টানতেই ভেসে যাচ্ছি অনেক দূরে।তবে একটি দুর্ঘটনা অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে।আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এবারে আমি অনেক অনেক বেশি ভালো থাকব।ওহ ভালো কথা,আমি কিন্তু আবার বিয়ে করব।সুন্দরী, টুকটুকে একটা বউ এবার আমারও হবে।তার কাছে আমার কলঙ্ক আমি আজীবন গোপন রাখব।কিছু কিছু জিনিস অজানা থাকলে আহামরি ক্ষতি হয় না।
এক কাপড়ে যাচ্ছি।শুধু বিশ্বাস আছে আমি কাজ করে খেতে পারব।পরিশ্রম করতে জানি,শরীরেও জোর আছে।হয়তো লঞ্চের স্টাফ হয়ে ভেসে যাব অন্য কোনো জেলায়।নয়তো অন্য কোনো অচেনা শহরে গাড়ির হেল্পার হব।যেটা সামনে পাব সেটাই করব।ফোনটা ফেলে যাচ্ছি।আমার খোঁজ আমি না দিলে তোমরা আমাকে খুঁজে পাবে না।তোমার পাঁচ হাজার টাকা আমি ফেরত দেব ভাইয়া।একবারে না।অনেক বছর পরে এক হাজার অথবা পাঁচশ টাকা করে তোমার বিকাশে পাঠাব।বিষয়টা মজার না? টাকা হাতে পেলে ভেবে নিও বেঁচে আছি ও ভালো আছি।
আর কথা বাড়াব না।ভিডিওটা বিশাল বড় হয়ে গেছে। শুধু একটা অনুরোধ,আর বিদেশে যেও না।এতো পরিশ্রমের পরে তোমাকে চেনাই যায় না।কালো হয়ে যাচ্ছ।ভাবীর পাশে মানায় না একটুও।দেশে থাকো,জমিগুলো বর্গা দাও,খামারটা নিজের করে নাও।আব্বার কোনো সম্পত্তির উপরে আমার আর কোনো দাবি-দাওয়া নেই।স্বেচ্ছায় সব ত্যাগ করছি।আমার ভাগেরটুকু তোমার নিতে খারাপ লাগলে মানিককে দিও।ফিরে আসার ইচ্ছা নেই।আজীবন উদয়পুর থেকে পালিয়ে বাঁচব।এই পালানোতে সুখ আছে,আছে তৃপ্তি আর নতুন আকাঙ্ক্ষা। এই গল্পে তোমাকে দরকার ছিল ভাইয়া।অভিশপ্ত কাজী বাড়ির সকল দায়-ভার তোমার কাঁধে তুলে দেওয়ার জন্যে হলেও তোমাকে দরকার ছিল।কাজী বাড়িকে বাসযোগ্য করার যোগ্যতা তোমার আছে,আমার নেই।ভালো থেকো।অন্য কোথাও আমিও খুব ভালো থাকব।”

দশ মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিও শেষ হলো ঠিকই। কিন্তু সহসা এর রেশ কাটে না।তিনটি প্রাণী বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রয়।মুখে কথা নেই,দৃষ্টিতে প্রাণ নেই।ওদের মাঝে হুমায়রার মনের জোর সবচেয়ে বেশি।তবে ও নিজেও না চমকে পারে না।ফয়সাল! কালকেও ছিল এখানে।বাড়িতে না থাকলেও উদয়পুরে ছিল।কিন্তু আজ নেই।কোথায় আছে তা স্বয়ং খোদা ছাড়া জানে ফয়সাল নিজে।এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছে। আশ্চর্য! উদয়পুর ওদের কাছে এতো বিষাক্ত ঠেকে কেন?
খালি পেটে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে রোমেলা বানুর।ভরভর করে বমি করতে ইচ্ছা করে।কথা বেরোয় না কিছুতেই।ভিডিও শেষ হওয়ার পর এক মিনিট সজ্ঞান থাকার সামর্থ্যটুকুও সহ্য হয় না।গলার কাছে দলা পাকানো কান্না গিলে নেওয়ার আগেই চোখ বুজে আসে তার।অন্ধকারে অতলে হারিয়ে যান একটু একটু করে।কিছু একটা বলার চেষ্টা করার আগেই বোঁটা খসা আমের মতো ঝুপ করে পড়ে যান বড় ছেলের বুকের উপরে।
_______________________________

দু’হাজার তেইশ সালের জানুয়ারিতে দূষণের শহরে শীত পড়েছে অনেক।বহু বছর পরে সকাল সকাল গায়ে ভারী জ্যাকেট অথবা সোয়েটার জড়ানোর শীত পড়েছে। খবরে হরদম বলছে শৈত্যপ্রবাহ চলছে।উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি রাজধানীতেও বাড়ছে শীতের প্রকোপ।তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কষ্টে চোখে পানি আসে। এসব তো ভীষণ দুঃখের খবর।কিন্তু এর চেয়েও বেশি দুঃখে আছে সূচি।খবর পেয়েছে ইতালিতে করোনার ভয়াল থাবা আবার বেড়েছে। লাবনীর মামা ওখানেই থাকে।এক সকালে ফোনে ভাসতে ভাসতে খবর এলো ভদ্রলোক করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি।দেশে আসতে পারবে না।গোটা আকাশটা সূচির মাথায় ভেঙে পড়লো।লাবনীর মামা না এলে চলবে কেন? তিনিই তো বৃদ্ধাশ্রমের মালিক।তিনি না দেখলে সূচির চাকরি মিলবে কী করে?
হাসফাস করতে করতে লাবনীর কাছে উড়ে যায় সূচি।এ কয়েক মাসে ওদের সম্পর্কটা আপনি থেকে তুই-তুমিতে নেমে এসেছে।অস্থির চিত্তে পায়চারী করতে করতে গলা শুকায় সূচি,
” লাবনী আপু,এখন উপায়?”

” উপায় মানে?”

” আরে তুমিই তো বলেছিলে তোমার মামা দেশে এসে আমার ইন্টারভিউ নিলেই চাকরি হবে।”

” হ্যাঁ, বলেছিলাম।”

” এখন তো আসবে না।”

” উঁহু।”

” তাহলে আমার চাকরি?”

মুচকি হাসে লাবনী।সূচির গাল টেনে দিয়ে কপট রাগ করে বলে, ” আমাদের থেকে পালিয়ে যাওয়ার এতো তাড়া কেন তোর? চিন্তা করিস না।মামা ফোন করে বলেছে তোকে যেন আমি নিয়ে যাই।আমাকে ওখানে সবাই চিনে।”

” আমাকে না দেখেই চাকরি দেবে?”

” কেন দেবে না? আমার উপরে মামার পুরো ভরসা আছে।তাছাড়া তোর ছবি আর বায়োডাটা আমি মামাকে দিয়েছি।সুস্থ হলেই তো দেশে আসবে।তখন দেখবে।এতো প্যারা নেওয়ার কিছু নেই তো।”

সৌভাগ্যে বড় বড় চোখ দুটোতে বৃষ্টি ভর করে।কিন্তু কাউকে দেখায় না তা।দু-আঙুলে আস্তে করে মুছে নেয়।

” এই খালামনি, তুমি চলে যাবে?”

” হ্যাঁ তো বাবা।”

” ধুর, তুমি গেলে পড়াবে কে? ফাইভের বইগুলো কত কঠিন!”

লাবিবের দেখাদেখি শিলাও এসে ঝাপিয়ে পড়েছে গায়ের উপরে।সূচির কাঁধে মুখ গুজে দিয়ে মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করে, ” সত্যিই চলে যাবে?”

” হুম।”

” আমি আর হিসু করব না তোমার গায়ে।থাকো না খালামনি।আমি ছয়ের নামতা পারি না।”

আরেক দফা চোখ ঘোলা হয় সূচির।বাচ্চাদের সামনে কাঁদতে লজ্জা নেই।তাই ভোরের শিশির টুপটাপ ঝরে পড়লেও মোছার প্রয়োজনবোধ করে না।কিছু কিছু সময় কেঁদেও সাধ।
লাবিব সাবধানী চোখে দেখে পাতানো খালামনিকে।ছোটদের কাছে বড় মানুষদের চোখের জল ভয়ংকর জিনিস।ওরা বোঝে না কিছুই কিন্তু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে অল্পতেই।দ্রুত হাতে সূচির চোখ মুছে দেয় লাবিব।সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ” কেঁদো না খালামনি।তুমি না থাকলে আমাদের মন খারাপ হবে না।আমি তোমার ছবি এঁকে রাখব।মন খারাপ হলে ছবিটাকে দেখব।তুমি চলে যাও তবুও কেঁদো না।”

যাবার আগের দিন রাতের কথা।ভাত মুখে ঢুকলো না সূচির।ও তীব্র মাত্রায় উত্তেজিত।নতুন আবাস,নতুন পরিচয়, নতুন ঠিকানা নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বোনা শেষ।ওর চোখে সোনালী আলোর ঝিলিক।লাবনীর চোখ টাটায়।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ” কি রে এতো খুশি? মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস।”

” শ্বশুরবাড়ি না নিজের নতুন বাড়ি যাচ্ছি।তুমি বুঝবে না।”

” হাহ! একটি মিথ্যে মৃত্যুকে ঘিরে কত কান্ড! তুই পালিয়ে এলি,ফয়সালটাও উদয়পুর ছাড়লো।যদি আজকে তোর মিথ্যে মৃত্যুর খবরটা না ছড়াতো তবে কী হতো? ঘটনার মোড় নব্বই ডিগ্রিতে বদলে যেত।”

ফয়সালের উদয়পুর ছাড়ার খবর গোপন করেনি অন্তু।সূচির সামনেই বলেছে।ঐ ভিডিওটা এসেছে ওর কাছেও।আফজালের সাথে ওর গলায় গলায় খাতির।সে নিজেই পাঠিয়েছে।ভিডিও সূচি নিজে দেখেছে। কিন্তু বিশেষ উত্তাপ দেখা যায়নি ওর চোখে-মুখে।কেবল মাঝে মাঝে একটু শক্ত হয়ে উঠেছিল চোখ-মুখ।মেয়েটা এখন সবকিছু হজম করতে জানে।লাবনীর কথায় গাল ফুলে উঠে সূচির।নাকের পাটা ফুলিয়ে উত্তর দেয়, ” মিথ্যে মৃত্যু! তাই বুঝি? তোমরা শুধু দেহের মৃত্যুই দেখো,আত্মারটা না।আমার বাঁচার চান্স এক পার্সেন্টও ছিল না।অন্তু ভাই সেদিন না আসলে কেমন হতো?”
গলার উপরে জিপার টানার মতো করে এ মাথা-ও মাথা বাম হাতটা টেনে খতম হওয়ার ভঙ্গিটা দেখিয়ে দেয় সূচি।
” এভাবেই মরে যেতাম।”

সেদিন রাতের বেলা দরজায় ছিটকিনি তোলার আগেই হুট করে দুয়ারে এসে দাঁড়ায় অন্তু।হাতে দুটো ব্যাগ।একটা ছোট,একটা বড়।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইতেই খুব কোমল হাসি হাসে অন্তু।

” এগুলো তোমার সূচি।”

” কী এসব?”

” আমার তরফ থেকে ছোট্ট গিফট।”

জোর করে হাতে গুজে দিয়ে চম্পট দেয় অন্তু।ওর গমনপথের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে খিল আঁটে সূচি।খাটে এসে বসে ছোট ব্যাগটাই খোলে।একটা ফোনের বাক্স।খুব বড় নয়,মাঝারি।বড় ব্যাগটা বেশ ভারী। ওটাতে গোটা দশেক উপন্যাস।উপন্যাসগুলো বের করে খাটে রাখার সময় ঝপ করে আরেকটা কাগজ পড়লো কোলের উপরে।চার ভাঁজ করা ফকফকে সাদা কাগজ।আগ্রহ নিয়ে চোখের সামনে পাতে সূচি।মুক্তোর মতো গুটিগুটি সাজানো অক্ষর ওর মন কেড়ে নেয়।

অতি প্রিয় সূচি,

তুমি যখন আরেকটু বড় হবে তখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখবে নিশ্চয়ই।আমার কেন যেন মনে হয় তখন তুমি তোমার কাজটাকে আর সম্মান করতে পারবে না।সন্তুষ্ট থাকতেও ভুলে যাবে।কারণ কী জানো? আমাদের দেশে আমরা যেকোনো কাজকে দুটো মোটা দাগে ভাগ করে ফেলি।উচ্চ কাজ ও নিম্ন কাজ।আসলে উঁচু-নিচু বলতে কোনো কথা নেই।সবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখার বিষয় হচ্ছে তুমি কোথায় সন্তুষ্ট। আপাতত এখন যে সন্তুষ্টি কাজ করছে তোমার মাঝে তা ভুলে যেও না।নিজের কাজটাকে কখনো ছোট করে দেখো না।নিজের অবস্থান অনুযায়ী নিজেকে কখনো ছোট ভেবো না।ছোট ভাবলেই ক্ষতি।যেই মানসিক অশান্তি থেকে পালিয়ে এসেছো আবার দেখবে তাই ফিরে এসেছে।তোমাকে দেখলে আমার কেন যেন শুকতারার কথা খুব মনে পড়ে।এই বয়সে ওর মতোই নিশ্চল,স্থির, অবিচল তুমি।শুকতারা ভোরে থাকে পূব আকাশে,সন্ধ্যায় পশ্চিমে।তোমার অবস্থানটাও অনেকটা ওরকম।মানুষটা একই আছো অথচ অবস্থানটা বদলে গেছে।ঐ দূর আকাশের শুকতারার সাথে তোমার কত মিল,তাই না? এখন বাকি জীবনে ওর মতো জ্বলজ্বল করতে পারলেই হলো। একদম ষোলোকলা পূর্ণ।
তোমার মতো ছোট দু-আঙুলে একটা মানুষকে খুব বেশি উপদেশ দিতে ইচ্ছা করে না।যতটুকু দিলাম ততোটুকু সামনেই দিতে পারতাম।কিন্তু আমার মনে হয় তুমি আমার সামনে খুব সংকোচ বোধ করো। তাই ছোট্ট চিঠিটা তোমার জন্যে।
চিঠির মতো উপহারগুলোও তোমার।ফোনে সিম আছে।আমার আর লাবনী ভাবীর নম্বর সেভ করা।যদি কখনো দরকার পড়ে তাহলে চাইলে আমাকে কল করতে পারো।কিন্তু আমি দোয়া করি সেরকম দরকার যেন তোমার আর কখনো না হয়।আমাদের থেকে দূরে একা বেঁচে থাকতে শিখো,ভালো থাকো,সুখী হও– এর বেশি প্রত্যাশা নেই।
কখনো যদি উদয়পুর ফিরে যেতে চাও তাহলেও নিঃসংকোচে বলতে পারো।আমি নিজে নিয়ে যাব।
সময় বদলায় সূচি।সময়ের চেয়ে ভালো শিক্ষক আর নেই।এ আসবে-যাবে,ঘাড়ে ধরে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাবে।একটা সময় দেখবে পরিস্থিতি হুটহাট বদলে গেছে।ভালো সময় তোমারও আসবে।তখন তোমার ঘরে এক কাপ ঘন চা আর তোমার হাতের এক প্লেট সন্দেশ খেতে খেতে তোমার সফলতার গল্প শুনব।মনে থাকবে?

ইতি
তোমার চরম শুভাকাঙ্ক্ষী অন্তু।

ঠোঁটের উপরে পিছলে যাওয়া হাসিটুকু আঁটকায় না সূচি।এই একটি মানুষের সাথে যখন ও কথা বলে তখন মনে হয় ও অনেক বড় কিছু।এভাবেই বলে অন্তু ভাই।চিঠিটা আবার ভাঁজ করে শ্রীকান্ত প্রথম খন্ডের ভিতরে গুজে দেয় সূচি।গায়ের শালটা জড়িয়ে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের একমাত্র জানালার কাছে।চঞ্চল হাতে খুলে দেয় জানালা।এক পশলা শীতল হাওয়া এসে আলুথালু বেশে জড়িয়ে যায় ওর সারা দেহে।খারাপ লাগে না সূচির।এলো চুলের মাথাটা এলিয়ে দেয় গ্রিলে।চোখ বন্ধ করে পরম আবেশে।চোখের উপর দিয়ে ছুটে যায় ওর অতীত।সবার আগে আসে বড় আপা।সূচির প্রাণপ্রিয় বড় আপা কেমন হাসছে দেখো! ইশতিয়াককেও ও দেখে।দেখে মাকে,ভাবী মহলকে,লিলি,রনি,রত্না,হুমায়রাকে।নিজের বাড়িটা ও স্পষ্ট দেখে।মনি ভাবীর ঘরের পিছনের ঝোপ,পুকুর,সদর দরজার বুড়ো খেজুর গাছ,ফকফকা উঠোনের পেটে গোটা কয়েক ঘর,সুপারি গাছ,স্যাঁতসেঁতে কলতলা,উঠোনের দাড়িয়াবান্ধা আর বৌচি খেলার ঘরটাও স্পষ্ট দেখে ও।এক ফোঁটা জল চোখের কোলে গড়িয়ে পড়ার আগে আলিঝালি আবছা একটা অবয়বও ভাসে চোখের উপরে।কোঁকড়া চুলগুলো ওর চিরচেনা।আরেকটু স্পষ্ট হওয়ার আগেই ঝট করে চোখ মেলে সূচি।বর্ষার ম্লান জলে ভেসে যায় ওর দু-চোখ।বাড়ির জন্য ওর মন কেমন করে।কিন্তু ভেঙে পড়ে না বছর উনিশের মেয়েটা।মুখে নয়,মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে।একদিন ও অনেক বড় হবে।ঐ দূর আকাশের মতো হবে। বড় হতে হতে যেদিন বড় হওয়ার মতো আর কোনো পর্যায় থাকবে না,সেদিন ক্ষান্ত হবে ও।এর আগে নয়।
_______________________________
পরিশিষ্টঃ ফয়সালের অন্তর্ধান নিয়ে বহু গল্প শাখা-প্রশাখা মেলেছিল গ্রামে।চায়ের কাপে বহু আলোচনা হতো কাজী বাড়ির ছোট ছেলেকে নিয়ে।অনেক গুজবও উঠেছিল গ্রামে।কেউ কেউ বলতো ওকে পাশের গ্রামে দেখেছে।কেউ বলতো বরিশালে থাকে ফয়সাল।প্রত্যক্ষদর্শী নিজে দেখেছে।ও সেখানে বিয়ে করেছে।একটা সুন্দর বউ আছে ওর।ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে।বউ অসুস্থ,বাচ্চা হবে সামনে।আবার মাঝখানে বাজারের এক লোক বরিশাল থেকে ফিরে বলেছিল,ফয়সালকে সুন্দরবন-১০ লঞ্চে দেখেছে।ও সেখানে স্টাফের কাজ করে।স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। আগের মতো চেহারা নেই।আরেকবার শোনা গেল নতুন আরেক কথা।ঢাকা থেকে ফিরে উদয়পুরের এক লোক বললো,ফয়সালকে ও ঢাকায় দেখেছে।একটা গ্যারেজে কাজ করে।কালি-ঝুলি মাখা মুখটা সে প্রথমে চিনতেই পারেনি।এতো এতো গুজবের কোনোটাই বেশিদিন টিকে না গ্রামে।সময়ে সময়ে বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায়।কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত।ফয়সাল আসেনি উদয়পুর।কখনোই আসেনি।আবার লোকে বাক-বিতন্ডায় জড়ায়।কেউ সূচির দিকে আঙুল তোলে,কেউ বা ফয়সালের দিকে।রোমেলা বানু,সাহিদা বেগম,মমিন শেখ– কেউ বাদ যায় না অভিযোগ থেকে।উদয়পুরে সূচি-ফয়সাল অনেক বছর বেঁচে রইলো।বাজারের চায়ের কাপে,মহিলাদের আড্ডায়,মানুষের মুখে মুখে।

( সমাপ্ত)

( বি.দ্রঃ ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।শুরু থেকে শেষ অবধি সমর্থন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here