#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৪
#হালিমা রহমান
প্রথম জৈষ্ঠ্যের মন মাতানো হাওয়ার সাথে টুপটুপিয়ে ঝরে পড়া কয়েক পশলা বৃষ্টির শীত শীত আমেজ একদম ধা করে গেঁথে গেছে ভিতরে।বৈশাখের অনবরত গরমে এতোদিন অতিষ্ঠ ছিল গোটা শহর।বারান্দা ধরে চোখ পাতলে কেবল চোখে পড়তো সারি সারি গাড়ির অত্যাচারে মুখ বুজে পড়ে থাকা ধুলোমলিন ব্যস্ত রাস্তা।আজ আর দৃশ্যটা তেমন নেই।রাস্তায় দু-একটা রিকশার টুংটাং গান ছাড়া আর বিশেষ কিছুই কানে আসে না,চোখেও পড়ে না।বিশ্রামাবাসের দো-তলার ফ্ল্যাট বি-এর ভিতরটাও আজ ঠিক মাথার উপরের বিশাল আকাশের মতো। থম ধরা,গুমোট,গুরুগম্ভীর।বাচ্চারাও বুঝে গেছে কিছু একটা হয়েছে।তাই দুইবারের উপরে তিনবার ড্রইংরুমে দাপাদাপি করার সময় লাবনীর কিল খেয়ে চুপ মেরে গেছে লাবিব।অন্যসময় হলে অন্তুর কাছে যেয়ে নালিশ করতো।কিন্তু আজ চাচার কালো হয়ে আসা মুখ দেখে আর সাহস হলো না।আজকের মেঘাচ্ছন্ন বেলা নালিশের জন্য নয়।
বিকাল থেকে বাজের সাথে পাল্লা দিয়ে নেমেছে মেঘের জল।প্রেমনগরের রাস্তা নিচু।মেঘগলা আশীর্বাদের ঠাই হয়েছে রাস্তায়।সন্ধ্যার মুখে আধ-ভেজা শার্ট গায়ে গোড়ালি ডুবে যাওয়া দুধ চায়ের রঙ ধরা পানি পেরিয়ে ঘরের ভিতরে পা রেখেই বুঝলো শান্ত,কিছু একটা ঠিক নেই। সোফার উপরে এখনো একগাদা কাপড়-চোপড়। ছাদ থেকে আনার পরে এখনো গোছানো হয়নি।খাটের কুঁচকানো চাদরটা, রান্নাঘরের থালাবাটির ঝনঝনানি,লাবনীর মুখের ভয়াবহ বিরক্তির ভাব,অন্তুর ক্ষোভমাখা চেহারা আর বাচ্চা দুটোর আতঙ্কে ডুবে যাওয়া চোখ-মুখ দেখে ঘরের বেহাল দশা বোঝার জন্যে শার্লক হোমস হতে হয় না।বয়সটা তো আর এমনি এমনি হয়নি।
লাবনী রেগে গেলে অথবা বিরক্ত হলে শান্ত মানাতে চায় সমসময়।বউয়ের জানা-অজানা অভিব্যক্তিগুলো হাতের তালুর মতো পরিচিত।মেয়ের রাগ কম।পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দু-একবার সরি বলে টুক করে একটা চুমু খেলেই সব শান্ত।আজ ঠিক একই কাজ করলো শান্ত।তবে ঠিকঠাক হলো না।চুলের উপরে শান্তর ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠলো লাবনী।
” সবসময় এত আদেখলামো কেন? নতুন বিয়ে তোমার?”
আঁতকে উঠে শান্ত।ভাবুক গলায় বলে,
” আমি কি কিছু করেছি? দুপুরে ফোন করে আদা-রসুন আনতে বললে এনেছি।বাইরের খাবার খেতে নিষেধ করেছো,নিষেধ শুনেছি।খাইনি।তোমার সাথে গত এক সপ্তাহে আমার কোনো ঝামেলা হয়নি।তাহলে? বাচ্চারা কিছু করলো?”
সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে আসা অফিস ফেরত ক্লান্ত-শ্রান্ত স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করা উচিত না।মনে মনে লজ্জিত না হয়ে পারে না লাবনী।লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো নাকের দু’পাশে।প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের ডান হাতের উল্টো পিঠে শান্তর কপালের সামান্য ঘামটুকু মুছে দিলো। স্বভাবসুলভ নরম আহ্লাদি গলায় বললো, ” বাইরে তো গরম নেই তাহলে এতো ঘাম হলো কী করে? বসো, পানি নিয়ে আসি।”
প্রসঙ্গ বদলালেও মনের খচখচানি ভাবটা যায় না শান্তর।লাবনীর পিছনে ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকেছে শিলা।চোখ ঘুরিয়ে,হাত নাচিয়ে নিচু গলায় পেটের খবরটা উগড়ে দিলো,
” আব্বু খালামনি কাঁদে।”
” কে কাঁদে?”
” ঐ খালামনিটা।বিকাল থেকেই কাঁদে।”
” কেন?”
” জানি না।চাচ্চু বলেছিলো খালামনিকে বাড়িতে দিয়ে আসবে।খালামনি মনে হয় যেতে চায় না।তাই কাঁদে।”
খবরটা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক।শিলার মুখের কথা ঠিকঠাক বোঝা গেল না।আসল খবর শোনার জন্য ভিতরটা টনটন করলেও লাবনী কিছু বললো না বলে আগ বাড়িয়ে কিছুই বললো না শান্ত।চুপচাপ থাকলো প্রতিদিনের চেয়ে বেশি।চঞ্চল মনটাকে ফ্রিফায়ারে ব্যস্ত রেখে সোফার উপরে বসে রইলো কয়েক ঘন্টা।মনে ক্ষীণ আশা,এই বুঝি লাবনী কিছু বলবে।কিন্তু রাত সাড়ে দশটায় খাওয়ার টেবিলে যাওয়ার আগেও যখন কিছু খোলাসা হলো না তখন অগত্যা মুখ খুলতে হয়।
” বাড়িতে কী হয়েছে লাবনী?”
” কিছুই না।”
” মিথ্যা বলো কেন? শিলা যে বললো..
” শিলার কথা বিশ্বাস করার মতো খারাপ দিনও তোমার এসে গেছে শান্ত? কিছু হলে আমি বলতাম না?”
লাবনীর ধারালো গলা,নির্বিকার মুখের মাঝেও তীক্ষ্ণ বিরক্তির আভাস।আপনা-আপনি অবিশ্বাসটুকু গোপন হয়ে গেল শান্তর।তবে খেই না হারিয়ে আরেকবার প্রশ্ন করে, ” অন্তু খাবে না?”
” ওর নাকি মাথাব্যথা করছে।বলেছে পরে খাবে।”
অন্তুর ঘরের বন্ধ দরজার দিকে চোখ বুলিয়ে আড়চোখে সূচির দরজায় তাকায় শান্ত।এক লোকমা ভাত মুখের গহ্বরে চালান করে দিয়ে হালকা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ” ঐ মেয়েটা খাবে না?”
” ঐ মেয়েটার একটা নাম আছে।ওর নাম সূচি।”
” সূচি বুচি যাই হোক, খাবে না?”
” জানি না।”
” ডাক দাও।”
” ক্ষুধা লাগলে খাবে।তোমার এতো মাথাব্যাথা কেন? ভাত খাও।”
বাপের পাশে বসে শিলার মতোই ফিসফিসিয়ে ঘোষণা করলো লাবিব, ” আজকে খালামনি শুধু কাঁদে আব্বু।নাক মুছে আর কাঁদে।আবার নাক মুছে আবার কাঁদে।আমি পর্দার পিছনে…..আহ”
আচমকা লাবনীর ভারী হাতের কিল খেয়ে থামলো লাবিব।ভাত রেখে ছেলেকে দাঁত কিড়মিড়িয়ে শাসালো লাবনী।ঠিক তখনই গভীর চোখের সচেতনী পর্যবেক্ষণ শেষে বুঝলো শান্ত,গৃহিণীর অবয়ব ফুটে আজ ঠিকরে পড়ছে বিরক্তি।হতাশায় মেশানো একরাশ গভীর বিশ্রি বিরক্তি।
_________________________
ড্রইংরুমের সোফার উল্টো পিঠের দেয়ালের বিশাল দামী ঘড়ির কাঁটা যখন টিকটিক করে ঠিক বারোতে নামলো, তখন ঘরের বাইরে পা রাখলো সূচি।বুকের কাছে ডান হাতের মুঠোয় ওড়নার আঁচলটা শক্ত করে ধরা।বিড়ালের মতো পায়ের ছন্দ,নিরিবিলি রাতে একদম নিশ্চুপ।জানালার কাচ গলে বেয়ে পড়া ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলদে আলোয় সূচিকে দেখাচ্ছে একদম হরর মুভির ভূতের মতো।চোখ-মুখ ফোলা,মুখের ভাষা কঠিন।হৃৎপিণ্ডের তীব্র গতি চাপা পড়ে গেছে মনের বেপরোয়া ইচ্ছার নিচে।আজ মাঝ রাতে সূচি একটু বেশিই উন্মাদ।
দরজার কাছাকাছি পৌঁছে এলোমেলো আধ-খোলা চুল থেকে খসে পড়া ওড়নার আঁচল সবে মাথায় তুলে দিয়েছে মেয়েটা, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গমগমিয়ে উঠলো ভরাট পুরুষালি কন্ঠ, ” আমার একটা থাপ্পড়ের ওজন নেওয়ার মতো শক্ত-পোক্ত গাল আছে তোমার?”
হৃৎপিন্ডটা বোধহয় এক লাফে গলার কাছে এসে গেছে।সেকেন্ডের মাঝেই জ্বলে উঠেছে রুমের নগ্ন বাল্ব।সাদা আলোয় অন্তুর জ্বলজ্বলে চোখ-দুটো দেখেই আপাদমস্তক কচি পাতার মতো বার দুয়েক কেঁপে উঠলো সূচি।হতাশা ও বিরক্তিতে অন্তু যখন সোফার গায়ে একটা লাথি বসিয়ে দিলো তখন হুঁশ ফিরলো সূচির।মনে হলো অচেনা শহরেও একজন শুভাকাঙ্ক্ষীকে বিশ্রিভাবে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ও।কিন্তু কিছু করার নেই আসলে।জীবন বাঁচানো ফরজ।
” জীবনের বড় ভুলটা করেছিলাম চব্বিশে এপ্রিল রাতে।পূবের বিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে মরতে দিতাম অথবা চোখ বন্ধ করে চলে আসতাম যদি,তাহলেই ভালো হতো।তোমাকে বাঁচানোর প্রতিদান তুমি এভাবে দেবে তা যদি আগে জানতাম তবে তোমাকে আমি কখনো বাঁচাতাম না সূচি।বরং পিছন থেকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতাম।”
” আমি উদয়পুরে যাব না অন্তু ভাই।আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না?ফিরে যেতে হলে আমি মরতে যেতাম না।বিশ-একুশ দিনে কী এমন হয়েছে যে উদয়পুরে ফিরে যাওয়ার রুচি আমার হবে? কিচ্ছু ভুলিনি আমি।উদয়পুর আমাকে কিছু দেয়নি।যেখানে আমি মৃত সেখানে আমি আবার কিছুতেই ফিরব না।আমি বরং মরব।”– নিচু স্বরে হাহাকার করে উঠলো সূচি।
” সুইসাইডটা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে তোমার।এই রাত-বিরেতে ঢং করার কোনো মানে আছে সূচি?সত্যি করে বলো তো কী আনন্দ পাচ্ছো এমন করে?”
কপাল চেপে ধরে সোফার গায়ে সজোরে আরেকটা লাথি বসিয়ে দিলো অন্তু।চশমা ছাড়া ওর মুখটা ভীষণ ভিন্ন দেখায়।নিরীহ ভাবটা নেই,কেমন একটা রুক্ষতা জড়িয়ে আছে পুরোটায়।সবসময় বোধহয় এমন দেখায় না।এখন বেশি রেগে আছে বলেই হয়তো এমন লাগছে।সারা শরীর থেকে চুইয়ে পড়া ভয়ংকর রাগে ওকে অচেনা লাগে খুব।এই অন্তুকে সূচি একটুও চেনে না।
” তোমার প্ল্যান কী বলো তো? এই ঘরে যে বেশিদিন থাকবে না তা তো দুপুরেই বললে।কিন্তু এই মাঝ রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে তুমি কী বুঝাতে চাও? আমাকে একটু খুলে বলো তো।”
প্রশ্ন করেও উত্তরের আশা কিন্তু করলো না অন্তু।সূচির ঘরের দরজার দিকে আঙুল হেলিয়ে ইশারা করে ভয়ংকর চাপা গলায় হুংকার ছাড়লো,
” দুই সেকেন্ডের মাঝে রুমে যাবে।আরেকটা বাড়তি কথা বললে এবার সত্যিই চড় খাবে।তোমার মতো হাঁটুর বয়সী ইঁচড়েপাকা মেয়েকে থাপড়ানোর মাঝে মারাত্মক আনন্দ পাওয়া যায়।ফাজিল মেয়ে।বাইরে তোমার ভাই-ব্রাদার বসে আছে তো,এই মাঝ রাতে বেড়াতে গেলে তোমাকে আদর করে ঘুরতে নিয়ে যাবে।বেয়াদব কোথাকার,আর কিছু খুলে বলতে হবে?”
এতোক্ষণের বেপরোয়া সাহসের পাহাড় ধসে পড়লো সূচির।শেষ যাত্রার হতাশ ক্লান্ত মুমূর্ষু রোগীর মতো ক্ষীণ স্বরে বললো, ” আমি আর পারছি না অন্তু ভাই।সেই উদয়পুরে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আমি বরং দশবার মরতে রাজি।”
” তুমি একটা সাইকো সূচি।নিজেও বুঝতে পারছো না তুমি মেন্টালি কতোটা সিক।”
চাপা আক্রোশে ফেটে পড়া অন্তুর গলায় এই কথা দুটো বিকালেও শুনেছে সূচি।শব্দগুলোর মানে জানে না। এগুলো ওর কাছে নতুন।তবে কিড়কিড়িয়ে কানে বাজে দুটো।কান দিয়ে ঢুকে ধা করে অবশ করে দেয় জমাট বাঁধা অলস বোকা মস্তিষ্ককে।
আজ বিকালে ভয়ংকর একটা কান্ড ঘটে গেছে বিশ্রামাবাসের দো-তলার ফ্ল্যাট বি-তে।প্রতিদিনের মতো কলেজ থেকে ফিরলেও আজ অন্তুর কথা-বার্তা,চাল-চলনে ছিল অদ্ভুত একটা কাঠিন্য।এ যে সূচির জন্য ধার করা আলগা গাম্ভীর্য তা বেশ বোঝা যায়।কলেজ থেকে ফিরে সূচির কথা ঘুণাক্ষরেও জিজ্ঞেস করেনি ছেলেটা।বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে শেভ করলো,সময় নিয়ে গোসল করলো,ব্যাগ গোছালো,হুমায়রার কাছে কল করে ফয়সালের খবর নিলো– সবকিছু স্বাভাবিক।মনে হয় যেন জটিল কিছু না স্রেফ বিয়ের পরে বউ নিয়ে সানন্দে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে।দুপুরে খাবার টেবিলে যখন সূচি এলো না তখনও বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি অন্তু।কেবল খাওয়ার শেষে লাবনীকে ডেকে নিচু গলায় বললো, ” লঞ্চের জন্য কিছু খাবার দিয়ে দিও ভাবি।লঞ্চের ক্যান্টিনের খাবার আমারই ভক্তি হয় না।”
বেলা তিনটে অবধি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বিপত্তি ঘটলো তিনটার পরে।বাইরে তখন উথাল-পাতাল অবস্থা।হাওয়া ছুটেছে লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো।তুমুল বাতাসের সাথে মাঝে-মাঝে ঝরে পড়ছে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি।আশপাশের বাড়ির ছাদে কাপড় আনার জন্যে যখন
মহিলাদের হুটোপুটি চলছে, তখন বজ্রকন্ঠে হাঁক ছাড়ে অন্তু,
” সূচিইইই,বেরিয়ে এসো।”
বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে। চোখ রাঙায় লাবনী।ধমক দিয়ে বলে, ” আস্তে অন্তু।হার্টফেল করাবে নাকি?”
” ও বেরোয় না কেন? তিনটার বেশি বাজে।”
” যা ঝড় শুরু হচ্ছে।আজকে কি..
” হ্যাঁ আজকেই যাব।অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে,আর না।”
লাবনীকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না ধীরে-সুস্থে সূচির দরজার দিকে এগিয়ে গেল অন্তু।আধ-ভেজানো দরজার ফাঁকে ভিতরের কিছু একটা দৃশ্য দেখে টোকা না দিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে মাছি মারার মতো একটা ভঙ্গি করে চোখের ইশারায় লাবনীকে ডেকে মাত্রাতিরিক্ত শান্ত গলায় বললো, ” একটা জঘন্য ছবি দেখে যাও। একদম চোখের সামনে কাউকে সুইসাইড করতে দেখেছো? না দেখলে এদিকে আসো।আরে তুমি নামছো কেন সূচি? ওড়নার ফাঁসটা ঠিকঠাক হয়নি।একটু তিড়িংবিড়িং করলে ওটা ছুটে যাবে।আমার হাতে দাও।আমি ঠিকভাবে দিয়ে দেই।শেষমেশ বাঁচাতে যখন পারলামই না তখন মরতেই হেল্প করি বরং।”
গলার স্বর শান্ত হলেও কপালের দু’পাশের ফুলে ওঠা রগ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল অন্তুর রাগ।এরা ভাইয়েরা ভাইয়েরা রেগে গেলে কেমন যেন হয়ে যায়।মানুষের মতো দেখায় না তখন আর।
এরপরের ঘটনা খুবই সাধারন।খাটের উপরে রাখা কাঠের চেয়ার থেকে নেমে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লো সূচি।ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো লাবনী।সবার শেষে ধীরে-সুস্থে ঘরে ঢুকে লাবনীর পাশে দাঁড়িয়ে মুখখানা গম্ভীর করে ভাষণের জন্য প্রস্তুত হলো অন্তু।
” তুমি ভয় পেয়ো না ভাবি। ও শুধু ভয় দেখাচ্ছে।ও কখনোই মরবে না।মরলে আরো আগেই মরতো।যে বেঁচে থাকার স্বাদ বোঝে সে কখনো মরতে চায় না।সূচিও মরবে না।দরজা খুলে কেউ ফাঁসি দিতে যায়? গাধা মেয়ে একটা,মরতে হলে দরজা আটকে মরো যাতে আমরা কেউ না দেখে বাঁচাতে না পারি।”
অন্তুর বাজে কথায় ভয়ংকরভাবে বিরক্ত হলো লাবনী।অবশ্য তার বিরক্তির পিছনে সূচির অবদানও কম নয়।এই বোকা মেয়েটার উপরেও ও কিছুটা বিরক্ত।মনে হচ্ছে সূচি এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।নিজের জায়গায় ফিরে না গেলে ও কোথায় থাকতে চায়?
লাবনী এগিয়ে এলো।খাটের উপরে বসে আলতো হাতে সূচির এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে আরেকটা ওড়নায় প্যাঁচিয়ে দিলো মেয়েটাকে।ওর মুখে মধুর অভাব নেই।কথায় ভিজিয়ে মানুষের কলিজা কেটে খেতে পারবে।বিরক্তি লুকিয়ে কথায় যথাসম্ভব মধু ঢেলে নরম গলায় বললো, ” কী হচ্ছে?
পাগলামি করছো কেন?”
” আমি ওখানে যাব না আপু।কিছুতেই যাব না।ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
” মারবে না।”
” মারবে। আপনি ওদেরকে দেখেননি।আর আমি ওখানে কোথায় যাব? আমার তালাক আব্বা কখনো মেনে নেবে না।তাছাড়া আমি কখনো আমাদের বাড়িতে যাব না।বড় আপার কাছে থাকতে হলে আমি আগেই ওখানে যেতাম।আমি চাই না বড় আপার কাছে যেতে।আমি যেখানে যাই সেখানেই অভিশাপ হয়ে দাঁড়াই।উদয়পুর আমার জন্য না, আমিও উদয়পুরের জন্য না।”
দু-আঙুলে সূচির চোখের পানিগুলো মুছে দিলো লাবনী।সূচি যে মানসিকভাবে অসুস্থ তা ও বেশ জানে।মেয়েটার বয়স কম,সামলে নেওয়ার ক্ষমতা কম অথচ খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে বেশি।তাই তার মন-মানসিকতা যে আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো নয় তা বোঝাই যায়।এসব চিন্তা -ভাবনা মাথায় এলেই আর কঠিন হতে ইচ্ছা করে না লাবনীর।তাই শান্ত গলায় নতুন একটা খবর দিলো সূচিকে।অথবা বলা যায় ঠান্ডা মাথায় মারাত্মক একটা ভুল করলো মেয়েটা।
” তোমাকে কেউ কিছু করবে না সূচি।কারণ মরা মেয়েকে ফিরে পেলে মা-বাবা বরং খুশিই হবে।উদয়পুরে তুমি ফিরে যেতে পারো।কেউ কিছু বলবে না।উদয়পুরে তুমি মৃত।”
চমকে মাথা তোলে সূচি।বিস্মিত গলায় বোকার মতো প্রশ্ন করে, ” মৃত মানে?”
” মানে সবাই জানে তুমি সুইসাইড করেছো।তোমার পরনের শাড়িটা নদীতে খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই সবাই ধরে নিয়েছে তুমি সুইসাইড করেছো।”
খবরটা নতুন।সূচি এতোদিন এটা জানতো না।ব্যস হয়ে গেল।পাগল আরো ক্ষেপে গেল।এখন ওর একটাই কথা।যেখানে ও মৃত সেখানে ও আর ভুল করেও বাঁচবে না।উদয়পুরের অধ্যায় চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাক।
আধ-ঘন্টা ধস্তাধস্তির পরেও সূচির সাথে পারলো না লাবনী।মেয়েটা সেই তখন থেকেই পা দুটো জড়িয়ে ধরে বসে আছে।কিছুতেই ছাড়ছে না।লাবনী প্রথমে অবাক হলো,তারপরে চরম বিরক্ত হলো,সবশেষে মাত্রাতিরিক্ত হতাশ হলো।যতই ছাড়াতে চায় সূচি ততোই লেপ্টে ধরে।ওর এক কথা ও যাবে না।প্রয়োজনে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে থাকবে কিন্তু তবুও যাবে না।কিছুতেই যাবে না।ও মরবেও না, উদয়পুরেও ফিরে যাবে না।ও এই শহরেই নিজের মতো করে বাঁচবে।
সূচিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াতে না পেরে লাবনী যখন ক্লান্ত ঠিক তখনই আবার শুরু হলো অন্তুর তান্ডব।ধা করে হাতের ব্যাগটাকে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে টেবিলের গায়ে ধাম করে একটা লাথি বসিয়ে দিলো।সাপের মতো ফোঁসফোঁস মরে নিশ্বাস ফেলে কপাল চেপে রাগ চাপার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।গর্জে উঠে বললো, ” তোমার মন-মানসিকতা সব নিচু সূচি।বারবার মানুষের পা ধরতে লজ্জা করে না? সেন্স নাই তোমার।ছিঃ! এর চেয়ে উদয়পুর কি খুব খারাপ।ওখানে না গেলে কোথায় থাকবে তুমি? এখানে? এও কি সম্ভব!”
” আমি এখানেও থাকব না অন্তু ভাই।এখান থেকেও চলে যাব।শুধু একটু সময় দিন।”
পাগলের কথায় কান দেওয়ার কোনো মানে হয় না।রাগে দিশেহারা হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো অন্তু।বিরবির করে বললো, ” আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।ফয়সালকে ফোন দিচ্ছি, ও এসে ওর বউ নিয়ে যাক।”
সূচিকে ভয় দেখানোর জন্য এ শুধু কথার কথা।ফয়সালের ঢাকা আসার অবস্থা নেই এখন।কিন্তু এই কথাটাতেই অবস্তা সেকেন্ডের মাঝে বদলে গেল।চট করে উঠে দাঁড়ালো সূচি।বড় বড় চোখ দুটো তখন রক্তজবা।পারলে অন্তুকে ভস্ম করে দেয় চোখের আগুনে।বিকৃত গলায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে ধমকে ধমকে বললো, ” আর কখনো আমাকে ওই জানোয়ারের বউ বলবেন না অন্তু ভাই।আমার তালাক হয়েছে।আপনি একবার বাঁচিয়েছেন তার জন্য আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।কিন্তু একবার বাঁচিয়ে আরেকবার মারার অধিকার আপনাকে আমি দিইনি। আমি উদয়পুর যাব না মানে যাবই না।আমি মরবও না,উদয়পুরেও যাব না,
এখানেও থাকব না।বাকিটা যা থাকে কপালে।”
এই ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেই আরেকবার ঘর ছাড়ার উদ্যোগ নিলো সূচি।কিন্তু অন্তু ও লাবনীর মতো চোখের সামনে থেকে এ নেহাৎ ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।বিরক্তিতে, হতাশায়, রাগে হাতের ফোনটাকেই মেঝেতে আছড়ে ফেললো অন্তু।চরম আক্রোশে চেঁচিয়ে বললো, ” তুমি একটা সাইকো সূচি।মেন্টালি সিক তুমি।তোমার উদয়পুর ফোবিয়াটা প্যানিক ডিসঅর্ডারের চেয়েও মারাত্মক হয়ে গেছে।এটা কবে যাবে তোমার? কবে উদয়পুরের প্রতি ভয়টা কাটবে?”
প্রশ্ন তো এখানেই।কিন্তু উত্তর কোথায়?
চলবে…..