শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৫

0
280

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৫
#হালিমা রহমান

দীর্ঘক্ষণ যাবৎ বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাতা দুটো খুলতে বেশ বেগ পেতে হলো ফয়সালকে।সবসময়ের মতো দুমদাম খুলতে পারলো না।পিটপিট করে, একটুখানি মেলে, সময় নিয়ে পিঁচুটি ভরা চোখ দিয়ে যখন আশেপাশে দেখলো তখন আবিষ্কার করলো জায়গাটা ও চেনে না।পায়ের কাছের কালচে সাদা দেয়ালটাও অচেনা।অলস, ঘুণে ধরা মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে জোর করে কিছু ভাবতে পারে না।চোখ ফিরিয়ে বহু কষ্টে ডান দিকে তাকাতেই নজরে এলো একটা নতুন মুখ।এলোমেলো কিছু চুল কালো ক্যাপের বাইরে অনাদরে বেরিয়ে এসেছে।বসে বসে ঝিমানো মানুষের মুখটা নরম।ক্লান্তি যেন সারা শরীর থেকে চুইয়ে পড়ছে।টান টান চামড়ায় ভীষণ একটা নিরীহ ভাব।কপাল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বহু বছর পুরোনো বসন্তের দাগ, টিকালো নাক,পুরু ঠোঁট, ভিনদেশে রোদে পোড়া-বৃষ্টিতে ভেজা তামাটে রঙের শরীর ও হাড় বেরোনো শক্ত-পোক্ত লম্বা শরীরটা দেখে বহুক্ষণ পরে ফয়সাল চিনলো তাকে।খরা বসে যাওয়া জ্বিভ নেড়ে অস্ফুটে ডেকে উঠলো, ” বড় ভাইয়া।”

বাবা-মায়ের পরে ফয়সালের বৈধ অভিভাবকের নাম কাজী আফজাল। বয়সে বড়, গম্ভীর,সহজ-সরল ভাইটাকে আগে বেশ ভালোই বাসতো ফয়সাল।মাঝখানে হাঁড়ি আলাদা হওয়ার পরে মায়ের আদেশে আফজালের সাথে বহু বছর খুব একটা যোগাযোগ হয়নি তার।মায়ের অভিমানও তার জন্য শাসন।কথা বললেই ঝামেলা হবে বলে ও অনেকটাই নিস্পৃহ ছিল বড় ভাইয়ের ব্যাপারে।বহু বছর যাবৎ স্বাভাবিক কথা-বার্তা বন্ধই ছিল প্রায়। শুধু মনে ছিল কোনো এক দেশে ওর একটা বড় ভাই আছে– ব্যাস সম্পর্কটা এ অবধিই সীমাবদ্ধ। আফজালের দিক থেকেও আভিমানের ভাগটা বেশি ছিল।কোলে-পিঠে বড় করে তোলা ভাইয়ের প্রবল গা ছাড়া ভাবে হয়তো রুষ্ট হয়েছিলো খুব।তাই তার দিক থেকেও যোগাযোগটা প্রায় ছিল না বললেই চলে।
কিন্তু ছোট ভাই বিছানায় পড়তেই বোঝা গেল বড় ভাইয়ের সেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা এখনো আছে হয়তো।এক আকাশ অভিমান ডিঙিয়ে তড়িঘড়ি করে দেশে চলে এলো।এমনিতেও মাস শেষে আসার কথা ছিল।ফয়সালের খবর পেয়ে এক সপ্তাহ আগেই চলে এলো।দেশে ফিরে বাড়ি যায়নি আগে।এসেছে হাসপাতালে।ক্লান্তিতে ঝিমাচ্ছিলো বসে বসে।ফয়সালের ক্ষীণ স্বর কানেই এলো না।ঠিক কতক্ষণ পরে তা জানা নেই।ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে প্রবল একটা ঝাঁকুনি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চোখের পাতা দুটো অভ্যাসবশত মেলতেই ঘুম পালিয়ে গেল আফজালের।আনন্দ ও বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে দু’চোখ ভরে দেখলো ফয়সালের জ্ঞান ফিরেছে।ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো চেয়ে আছে ওর দিকেই।

হাসপাতালে রোমেলা বানু অথবা হুমায়রা–কেউ নেই। ওরা বাড়িতে।মাঝখানে বুবুর শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় হুমায়রাকে দিয়ে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন রমিজ শিকদার।রোমেলা বানুর শরীরটা এখন কিছুটা ভালো।দুর্বলতা কমেছে।ফয়সালের জ্ঞান ফেরার খবর দেওয়া হয়েছে এক ঘন্টা আগে।আসছে ওরা।জ্ঞান ফেরার পর যা হওয়ার তাই হলো।রমিজ শিকদার চোখের পানি মুছে ডাক্তার ডাকলেন।ডাক্তার এসে দেখে গেল,প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেল,আফজাল ছোট ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বললো,ফয়সাল কিছুক্ষণ কথা বললো,কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো,তারপর পনেরো মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করলো,সবশেষে আবার চোখ মেললো।যন্ত্রণায় হয়তো চোখের কোল বেয়ে দু-ফোঁটা পানি বেয়ে পড়েছিলো,আফজাল সযত্নে তা মুছে দিলো।রমিজ শিকদারও ততোক্ষণে এসে বসেছেন ছোট বেডের এক কোণে। তাকে যেন দেখলোই না ফয়সাল।আফজালের দিকে ফিরে ভগ্ন স্বরে বললো, ” মার খেলে এমনই কষ্ট হয় ভাইয়া?”

” বেশি কষ্ট হচ্ছে তোর?”

” মনে হচ্ছে চামড়া কেটে মরিচ দিয়ে দিয়েছে কেউ।”

” ইশ!”

ভিতর থেকে উগলে আসা প্রবল বাষ্প গিলে নিতে কথা বন্ধ হয় আফজালের।নির্নিমেষ চোখে সামনের দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো ফয়সাল।মুখের অভিব্যক্তি ভিন্ন,চোখে-মুখে প্রবল উদাসীনতা,মনের ভিতর কী তা প্রভু জানেন।হয়তো ওর হাতেই মার খাওয়ার পরে সূচির যন্ত্রণা উপলব্ধি করার চেষ্টায় মত্ত ও।

” ফয়সাল তোর সাথে কিছু কথা ছিল।বুবু আসার আগেই শেষ করা দরকার।”

কয়েক সেকেন্ড থেমেও ফয়সালের কোনো উত্তর না পেয়ে থেমে গেলেন না রমিজ শিকদার।মেহেদী রঙা দাঁড়িতে আলগোছে দু’বার হাত বুলিয়ে গলাটাকে তৈরি করে নিলেন।

” তোর সাথে কারো শত্রুতা ছিল রে?”

” না।”

” ভেবে বলিস।পুলিশ কেসের ব্যাপার কিন্তু।ব্যবসায়িক ঝামেলা-টামেলা ছিল না? ধর কোনো পাওনাদার টাকা দিচ্ছিলো না বা তোর কারো সাথে কিছুদিন ধরে ঝামেলা চলছিলো– এরকম ব্যাপার।”

” না,তেমন কিছুই ছিল না।”

” সেদিন রাতে তাহলে কী হয়েছিলো? দেখেছিলি কাউকে? তোর সাথে কারো ঝামেলা না থাকলে..

” মামা তাহলে হামলাটা ফয়সালের শ্বশুর বাড়ির দিক থেকেই হয়তো হয়েছে।গ্রামের অন্যদের থেকে ওকে মারার কারণ ওদের বেশি।প্রতিশোধ বলতেও একটা শব্দ আছে পৃথিবীতে। এ তো পাগলেও বলবে যে ঐ বাড়ির কেউই ফয়সালকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে।”

নীরব হতে হয় রমিজ শিকদারকে।আফজালের কথা দিনের আলোর মতো সত্য।কিন্তু ঘটনার মোড় তো একটা নয়।মোড় একটা হলে বরং ঝামেলা কমে যেতো।মাঝখান দিয়ে আরো অনেক কাহিনী আছে যা আফজাল জানে না।তাই প্রিয় ভাগ্নেকে বাকিটা জানিয়েই দিলেন।

” ফয়সালের শ্বশুরের অবস্থা ওর চেয়েও খারাপ।ভদ্রলোক ব্রেন স্ট্রোক করেছে, পুরো শরীর প্যারালাইজড। কথা অবধি বলতে পারে না।আয়ু আছে তাই এখনো বেঁচে আছে।যেদিন রাতে ফয়সালকে আমরা ভোলা হাসপাতালে নিয়েছিলাম সেদিন রাতে ওনাকেও হাসপাতালে নিয়েছে। সেই সন্ধ্যা থেকেই নাকি অনেক অসুস্থ ছিল ফয়সালের শ্বশুর।জ্বর ছিল,তারপরে রাতের দিকে স্ট্রোক করেছে।তাই ওদিক থেকে হামলা আসেনি সেটা ধরেই রাখ।”

বোবার মতো চেয়ে থাকে ফয়সাল।আফজালকেও চুপ করতে হয়। ভাইয়ের প্রাক্তন শ্বশুরকে চেনে না বলেই হয়তো খুব একটা শোকাচ্ছন্ন হয় না।কিছুক্ষণ বিমূঢ় থেকে ফের প্রশ্ন করে, ” কোথায় শুনেছো এই কাহিনী?”

” হুমায়রা ফোন করে বললো।উদয়পুরে এটাই নাকি এখন হট টপিক।”

” ফয়সালের শালা-সম্বন্ধী কেউ নাই যারা হামলা করতে পারে?”

” উঁহু, একটা ভায়রা আছে।কিন্তু ওদের সাথে সূচিদের পরিবারেরই খুব একটা যোগাযোগ ছিল না এতোদিন।মুখ চাওয়া-চাওয়ি পর্যন্ত নেই।মমিন শেখ অসুস্থ হওয়ার পরে নতুন করে মেয়ের জামাইয়ের সাথে সন্ধি হয়েছে।আবার ওদের নতুন বাচ্চা হয়েছে।বুঝতেই পারছিস এই বিপদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ শালী হত্যার প্রতিশোধ নিতে যাবে না।”

” ফয়সালের ভায়রার নাম ইশতিয়াক নাকি?”

” হ্যাঁ এরকই একটা কিছু।তোদের বাড়ির ওদিকেই তো।তুই চিনিস?”

” না।কিন্তু ওদের বাবু হওয়ার সময় হুমায়রা হাসপাতালে ছিল।তাই হুট করেই মনে পড়লো।হুমায়রার কাছে শুনেছি ভদ্রলোক নাকি খুব নিরীহ গোছের মানুষ।কারো সাতে-পাঁচে নেই।”

” তাই তো কেস করিনি।শুধু শুধু হয়রানির দরকার কী? ফয়সাল এবার তুই বলতো, সেই রাতে কিছু দেখেছিলি? যে মেরেছে তার মুখ দেখেছিস? একটু মনে কর বাপ।শুধু তুই নামটা বল তারপরে হারামজাদার চৌদ্দ শিকের ব্যবস্থা আমি করছি।মুকুলকে বলে রেখেছি।ছাত্রলীগের বড় নেতা তো আমাকে বলেছে কোনো টেনশন নিতে না।কেস-টেসের ব্যাপার ও নিজেই দেখবে।মুকুলকে চিনিস না? ঐ যে তুই যখন জেলে গেছিলি তখন…

মামার কথা কানে ঢোকে না ফয়সালের।চোখ বন্ধ করে ভাবে।মগজে চাপ পড়ে।এলোমেলো তাল ছাড়া কিছু ঘটনা মনে পড়ে।সূচিকে মনে পড়ে,সংসারের প্রথম দিকের কথা মনে পড়ে,নিজের বিতৃষ্ণার কথা মনে পড়ে,উভয় সংকটের কথা মনে পড়ে,শেষদিকের ঘটনা চোখে ভাসে, মাকে মনে পড়ে,তপুকে মনে পড়ে আর সবশেষে মনে পড়ে সেই রাতের দৃশ্য।একটা কালো রাত ছিল,উপরে অন্ধকার আকাশ ছিল,ধুলোমলিন রাস্তা ছিল,রাস্তার পাশের কাঁটাগাছ ছিল,দূর থেকে ভেসে আসা নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দ ছিল আর ছিল ফয়সালের অস্বস্তি।মাথায় আঘাত আসার পরে যখন পিছু ফিরেছিল তখন ছিল একটা অবয়ব।অন্ধকার আকাশের মতোই কালো একটা অবয়ব।

” ফয়সাল, কি রে ফয়সাল কাঁপছিস কেন? এই ভাই,এদিকে তাকা।”

আফজালের ভীত কন্ঠ কানে আসতেই বাস্তবে ফিরে ফয়সাল।বুঝতে পারে ও এতোক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল।অভ্যাসবশত বাম হাতটা চোখের সামনে এনে আঁতকে উঠে। কড়ে আঙুলটা যেন ছোট ছোট লাগছে।

” আমার এই আঙুলে ব্যান্ডেজ কেন?”

” তোর কড়ে আঙুলের মাথাটা পড়ে গেছে।চিন্তা করিস না,ঠিক হয়ে যাবে।ভাগ্যিস পুরো আঙুলটাই পড়ে যায়নি।”

কিছুক্ষণ থম ধরে চুপ মেরে থাকে ফয়সাল।চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় বলে দেয়, ” আমার কারো সাথে শত্রুতা নেই মামা।কাউকে দেখিনি।কে মেরেছে তাও জানি না।শুধু আলিঝালি একটা ছায়ার মতো দেখেছিলাম।পুলিশ কেসের দরকার নেই।”

” কিন্তু..”

” বাদ দাও না।আর ভালো লাগে না আমার।আমি কি একটু শান্তি পাব না কোথাও? পুলিশ এলে কী হবে? শুধু শুধু প্রশ্ন করবে।আমি চাই না এসব।একটু দয়া করো তোমরা।আমাকে একটু শান্তি দাও।এতো এতো জটিলতা আর ভালো না।আমার এই তো সামান্য বয়স।জীবনের শুরু মাত্র।এই বয়সে এতোকিছু কি প্রাপ্য ছিল মামা? তুমিই বলো।প্রথম থেকে তো তুমিই সব জানতে।সূচিকে মারধর করেছিলাম বলে তুমিই তো থাপ্পড় মেরেছিলে আমাকে। মনে নেই? তুমিই বলেছিলে আমি পাপ করেছি।আমার কাছে এটা কোনো পাপ নয় কারণ আমি পরিস্থিতির শিকার।ওকে না মারলে কাকে মারতাম? ও অশান্তি করেছে,আমি মেরেছি,ও মরেছে।কিন্তু এরপরেও যাও তোমার কথাই মেনে নিচ্ছি।তাহলে ধরেই নাও এটা পাপের শাস্তি।আল্লাহ তো কাউকে ছেড়ে দেয় না।দয়া করে আর পুলিশি ঝামেলায় আমাকে জড়িয়ো না মামা।আমি তোমাদের পায়ে ধরছি।”

বলতে বলতে আচমকা রেগে উঠে ক্লান্ত হয়ে যায় ফয়সাল।বুক ওঠা-নামা করে হাঁপড়ের মতো।আফজাল জড়িয়ে ধরে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “শান্ত হ।তুই না চাইলে কোনো পুলিশ কেস হবে না।”

রোমেলা বানুর মুখটা শীর্ণ।চোখ-মুখ শুকনো।বোরকায় মোড়ানো শরীরটাকে বাইরে থেকেই খুব ছোট দেখায়।এতোবছর পরে মাকে দেখে অভিমান কাজ করে না আর।বরং ভিতর থেকে উথলে আসে মমতা।মাকে আফজাল ভালোবাসে।সত্যিই ভালোবাসে।মায়ের কষ্ট ও নিজে দেখেছে।দেখেছে ছেলেদের উপরে রুষ্ট হওয়া দাদির স্বেচ্ছাচারিতা আর বাবার কাপুরুষতা।তাই সব ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছিলো মাকে।মাঝে বছরে বছরে ভালোবাসায় চিড় ধরেছে,সম্পর্কের রঙ বদলেছে।প্রবল কর্তৃত্ববাদে আসক্ত মায়ের বদলে যাওয়া রূপ দেখে অভিমান জন্মেছে,রাগ জন্মেছে, হতাশ হয়েছে। কিন্তু আজ ফয়সালকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে রোমেলা বানু যখন ভেঙে পড়া মানুষের মতো বড় ছেলের বুকে আছড়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন,তখন আর অভিমান থাকলো না বুকে। হাড় বেরোনো শক্ত দুটো হাতে শক্ত করে আগলে ধরলো আফজাল।মাকে কুকড়ে-মুকড়ে বুকের ভিতর ধরে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আলগোছে।চুপিচুপি সান্ত্বনা দিলো, ” কাঁদছো কেন? আমি এসেছি না? এতো কাঁদতে হয়?তোমার কি একটা ছেলে? সব ঠিক হয়ে যাবে।”

” বেজন্মায় আমার পোলারে মাইরা লাইছে।”

” আহা! মুখটা ভালো হলো না আম্মা।টেনশন নিও না তো।ফয়সাল তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।”

যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও জোর করে আফজালকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন রমিজ শিকদার।ছেলেটার উপরে ধকল নেহাৎ কম যায়নি।তাছাড়া ব্যাগ-পত্তরে কতকিছু আছে এখানে।হাসপাতালে এতো মানুষের ভীড়ে যদি কিছু খোয়া যায়! মনের নিভৃত কোণে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল হুমায়রার।কত বছর পরে এসেছে মানুষটা! মুরুব্বিদের সামনে চোখ তুলে দেখতেও গা গিরগির করে।মেয়েটা খুব লাজুক কি না।তাই মাটির দিকে চেয়ে থাকে।সামনাসামনি দেখা হওয়ার পরে একবার মৃদুস্বরে সালাম দিয়েছে মাত্র।এতোদিন পরে তাকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়াটাকে ভীষণ সৌভাগ্য মনে হয়।নতুন বউদের মতো পুরোনো স্বামীকেও অচেনা ঠেকে,চোখ তুলে চাইতে বিব্রতবোধ হয়। বউয়ের অবস্থা বোঝার মতো তার সাথে বন্ধুত্ব রোমেলা বানুর নেই।অথবা বলা যায় পরিস্থিতি নেই।তাই রমিজ শিকদার যখন আফজালের সাথে হুমায়রাকেও বাড়ি চলে যেতো বললো,তখন কপাল কুঁচকে গেল তার।কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বললো,
” ওর যাওয়া লাগব ক্যান? আইছেই তো আমার লগে।”

” এখানে হুমায়রা থেকে কী করবে? আমি আর তুমি আছি তো,ও চলে যাক।”

আফজাল বাঁধা দেয়।ক্লান্ত-শ্রান্ত গলায় নিষেধ করে বলে, ” দরকার নেই মামা।হুমু থাকুক।আমি আবার সন্ধ্যার দিকে আসবনি।তখন তুমি আম্মা আর ওকে নিয়ে বাড়ি চলে যেও।রাতে আমি থাকবনি।”

” পোদ্দারি কম করে বউকে নিয়ে বাড়ি যা।সিনেমার হিরো হয়ে যাসনি যে এতো ধকলের পরে আবার হাসপাতালে থাকতে পারবি।বউকে নিয়ে যা,আস্তে-ধীরে কালকে সকালে আসিস।ওহ আর হুমায়রা,আসার সময় খাবার নিয়ে এসো তো মা।হোটেলের খাবার আর মুখে রোচে না।”

মনের প্রবল ইচ্ছা মাটি চাপা দিয়ে হুমায়রাও একবার থাকতে চায়।মিনমিনিয়ে বলে, ” আমি থাকি মামা।আম্মা একা এখানে থাকব আর..

” তোমরা কি আমার চেয়ে বেশি বোঝো? এতো সামাজিকতা দেখানোর সময় আছে তোমাদের এখন? যাও বাড়ি যাও।কালকে থেকো মন চাইলে।”

আর কথা বলা যায় না।রমিজ শিকদারের রামধমকে চুপ করতে হয়।হুমায়রার মনে তখন একশো প্রজাপতি ডানা মেলেছে। হাজারটা রঙমশাল ও বাজি ফাটার আনন্দে ভিতর-বাহিরে টালমাটাল অবস্থা।শত কষ্টেও আনন্দে হুটোপুটি খেয়ে রঙধনুর দেখা পায়।আনন্দে থই পায় না। বাসের একদম শেষ সিটে এসে বসতেই নেকাবের ভিতরে আকর্ণ বিস্তৃত নীরব হাসির ঝুমঝুমিতে ওর সন্তুষ্টি প্রকাশ পায়।আফজাল চোরা চোখে তাকায়।তীব্র গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে এক পশলা উন্মাদ হাওয়ার মতো অর্ধাঙ্গিনীর খুশিতে ঝিকঝিক করা চোখ দুটো ওর অন্তরাত্মা ছুঁয়ে দেয়।কত বছর পর দেখা! সামনা-সামনি দু-চোখ ভরে দেখা!আফজাল মুহূর্তেই ভুলে গেল হাসপাতালের কথা,বিপদের কথা,ভাইয়ের কষ্টের কথা,তার কষ্টের কথা।গাড়ি ততোক্ষণে চলতে শুরু করেছে।আলতো করে বউয়ের কাঁধ চেপে ধরে।ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,
” খুব খুশি?”

খুশির আতিশয্যে কথা বলতে পারে না হুমায়রা।শুধু মাথা নেড়ে ইশারায় বোঝায়, একটুও না।

আফজাল হাসে।হুমায়রার কাঁধের উপরে এলিয়ে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত হয়।আরেক হাতে বউয়ের ডান হাতের আঙুলগুলো মুঠোতে পুরে রাখে।এই টুকরো টুকরো ছুঁয়ে দেখার আনন্দও আজ অনেক।চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দেয় আফজাল।পাশেই হুমায়রা বসা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে স্বামীকে।বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরে অস্ফুটে নিজের মতামত জানায়, ” আপনে অনেক শুকায়া গেছেন।গায়ের রঙটাও ক্যামন জানি হয়া গেছে।অনেক পরিশ্রমের কাজ ঐখানে? অনেক কষ্ট, না?”

আফজাল কিছুই বলে না।চুপ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে।বাসের জানালা গলে তেজী কিরণ আসে ভিতরে।বাইরে রাস্তার ধারের গাছগুলো দৌড়ে ছুটছে।বাস ভর্তি নানা গ্রামের মানুষ,পাশে প্রিয় স্ত্রী।স্ত্রীর পেলব দৃষ্টি তার দিকেই,ঠোঁটের কোণে হয়তো আনন্দ নয়তো দুঃখ।নরম আঙুল ছুঁয়ে দেয় তার রোদে পোড়া কঠিন চামড়া।আফজাল বলে না কিছুই।চোখ বন্ধ করেও বোঝে হুমায়রার নরম দৃষ্টি মেপে যাচ্ছে তার বাহ্যিক কাঠামোটাকে।আজ হুমায়রা কিছুটা বেসামাল,কিছুটা নির্লজ্জ,কিশোরীর মতো চপল।আজ চক্ষে তাহার অসীম তৃষ্ণা।
_______________________________

সূচির নিজেকে খুব পরগাছার মতো মনে হয় আজকাল।অবশ্য মনে হয় না,ও নিজেকে স্বর্ণলতাই ভাবে।শিকড় নেই,নিজস্ব মাটি নেই,নিজের বলতে কিছু নেই।শুধু বেঁচে থাকা দরকার তাই বেঁচে আছে।এখন আর কাঁদতে ভালো লাগে না তার।এটুকু বয়সে সূচি বুঝে গেছে ওর জীবনটা এমনই যাবে।ভাসতে ভাসতে আজ এ ঘাটে তো কাল আরেক ঘাটে।এখানে কান্নাকাটি করে লাভ নেই,চোখের পানি ফেলার সময় নেই,ইচ্ছাও নেই,শক্তিও নেই।তাই আপাতত ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে বিশাল একটা ভাবনায় ব্যস্ত মেয়েটা।ভাবনাটা বিশাল,প্রশ্ন একটাই।এরপরে সূচি কোথায় যাবে? উত্তর জানা নেই অথচ এই এক উত্তরের উপরে জীবন-মরণ নির্ভর করছে।এখানে থাকা যাবে না,উদয়পুরে সূচি যাবে না।যাবে না মানে কখনোই যাবে না।গ্রাম থেকে কেউ এলেও যাবে না।তাহলে আর কোথায় যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয় সূচি।হতাশায় কাঁপে হাত-পা।দেশের চৌষট্টিটা জেলায় এমন একটা জায়গাও কি নেই যেখানে ও একটু নিরিবিলিতে বাঁচতে পারবে? একটু নিশ্চিন্ত হয়ে দু-দন্ড বসতে পারবে?

” খালামনি আমার পড়াটা একটু নেবে?খালামনি,এই খালামনি।”

” হুম?”

লাবিবের ধাক্কায় চিন্তা কাটে সূচির।এই ঘরে এই দুটো বাচ্চাকেই ওর বড্ড আপন মনে হয়।এরা কাছে আসলেই একাকিত্বের পর্দাটা সরে যায় একটু একটু করে।পরশুর সেই পাগলাটে কান্ডের পর থেকে সূচি খুব একটা বেরোয় না ঘর থেকে।এই ঘরে ও আস্তানা গেড়েছে জোর করে।লাবনীও খুব একটা কথা বলে না,অন্তুও নির্বিকার।সূচি যে ঘরবন্দী এ নিয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই।শুধু বাচ্চা দুটোই ঘুরঘুর করে।হুটহাট ঘরে এসে লুটোপুটি খায় এই ঘরে।সন্ধ্যায় বই-খাতা এনে দুম করে পড়তে বসে।সুর করে যখন পড়ে তখন অভিভূত না হয়ে পারে না সূচি।আর মন খারাপ করতে ইচ্ছে করে না। ওদের মতো ওরও তখন সব ভুলে তাল মিলিয়ে গলা ছেড়ে আবৃত্তি করতে অথবা নামতা পড়তে ইচ্ছা করে।

” খালামনি বলছি কিন্তু।”

” আচ্ছা।”

” আবোল-তাবোল,লিখেছেন সুকুমার রায়
ছুটলে কথা, থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ তবলা….

” ওদেরকে তুমি ঐ ঘরে পড়তে পাঠিয়েছো, তাই না ভাবি?”

টেবিলের উপরের তৃতীয় চায়ের কাপে এক চামচ চিনি ছেড়ে দিয়ে হাসলো লাবনী।মাথা নেড়ে বললো,
” হুম।”

” যাতে সূচি একাকিত্বে না ভোগে, তাই তো?”

” হুম। তাছাড়া মেয়েটা ওদেরকে ভালো পড়ায়।তোমার ভাতিজি গাধাটার তিনের নামতা কিছুতেই হচ্ছিলো না।আমার কাছে বসলেই মার খেতো।কাল দেখলাম সূচি মুখে মুখে পড়াচ্ছে।আজকে সকালে ধরলাম,দেখলাম শিলার নামতা এখন ঠোঁটের আগায়।শি ইজ এ ভেরি গুড টিচার।অন্তত আমার বাচ্চাদের জন্য আমার থেকেও ভালো।এই বাচ্চা-কাচ্চাকে আমি ঠিক পড়াতে পারি না।”

অন্তু কপাল কুঁচকায়।সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করে, “তোমার মাথায় কী চলছে বলো তো?”

” কিছুই না।”

” আমি জানি কিছু চলছে।”

” সত্যি বলব?”

” আমি কি মিথ্যেটা আশা করছি?”

” শোনো এই দুদিন ধরে আমি অনেক ভেবেছি বুঝলে।ভেবে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি।বলতে পারো পোদ্দারি করে একচেটিয়া একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।কিন্তু মনে হচ্ছে এই সিদ্ধান্তটা তোমাদের দুই ভাইয়ের পছন্দ হবে না।”

” আমার অপছন্দ হবে কি না তা বলতে পারছি না।কারন সূচির প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই, রাগও নেই ভাবি।আমি সত্যিই চাই ওর একটা গতি হোক।মেয়েটা ভালো থাকুক।ওর প্রতি আমার একটা স্নেহ কাজ করে খুব।নিজের ক্ষমতা থাকলে ওর জন্য খুব সুন্দর একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতাম।মেয়েটা যে মানসিকভাবে কতটা অসুস্থ তা হয়তো আমি-তুমি বাইরে থেকে আন্দাজ করতে পারছি না।আচ্ছা সেসব কথা যাক,এখন কী সিদ্ধান্ত নিয়েছো তাই বলো।”

” সূচি যখন উদয়পুর যেতেই চাইছে না তখন ভাবছি ওকে এখানেই রেখে দেব।আগে গ্রামে লজিং মাস্টার থাকতো না,ওরকম।”

বিস্ময়ে নির্বাক চোখে চেয়ে থাকে অন্তু।চাহনিতে কৃতজ্ঞতা,কিছুটা অবিশ্বাস।মুচকি হেসে ওর দিকে গরম চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় লাবনী।বাকি দুটো কাপ নিজের দু-হাতে নিয়ে সূচির ঘরের দিকে এগোয়।

” তুমি কি একটু বেশিই ভালো ভাবি? অথবা তুমি কি খুব অসাধারণ কেউ?”

মাঝ পথে থেমে পিছু ফিরে লাবনী।কৌতুকে নাচে ওর দুটো চোখ।গলায় সুর করে গুনগুনিয়ে গান গায়, ” আমি মানুষের মতো দেখতে একটা পরী।বুঝেছো? আমি ডানাকাটা পরী,আমি ডানাকাটা পরী।”

” মাদার তেরেসার সময়ে তুমি জন্মালে ভালো হতো ভাবি।তাদের দলে মিশে বেশ নাম করতে পারতে।”

মায়ের হাতে চা দেখে হামলে পড়লো শিলা।লোভীর মতো জ্বিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে আহ্লাদী গলায় বললো, ” ও আম্মু,আমাকে একটু দাও।আধা কাপ মাত্র।”

” টেবিলের উপরে জুস আছে।জুস খা যেয়ে।”

” দাও না একটু।”

” বাচ্চারা চা খায় না শিলা।ঘুমাতে পারবি না রাতে।”

” সবসময় তুমি এমন করো।ভাল্লাগে না আমার।আমি আর পড়বই না।ধুর।”

শিলা ও লাবিব চলে গেল জুস খেতে।এটা ওদের অবসর।পড়ার মাঝের এই অবসর চলবে আগামী এক ঘন্টা অবধি।লাবনীকে দেখে মাথা নিচু করে ফেলে সূচি।লাবনীর বিরক্তি ভাবটা ওর কাছে দিনের আলোর চেয়ে বেশি সত্য।তাই মাথা তুলে চাইতে লজ্জা করে।খুব বিশ্রি একটা হীনমন্যতা কাজ করে ভিতরে।

” ছাদে যাবে সূচি?”

কথাটা ঠিক বোঝা গেল না।চোখ দুটো তুলে তাই অবুঝের মতো প্রশ্ন করে সূচি, ” কোথায় যাব?”

” ছাদে।”

” এই সন্ধ্যার মুখে?”

” হুম।কেন ভূতে ভয় পাও?”

” না।”

” তাহলে চলো।ছাদে লাইট আছে।অবশ্য সাত তলার উপরে, এই একটু সমস্যা।সিঁড়ি বাইতে হয় অনেক।”

যাওয়ার ইচ্ছে মোটেও ছিল না সূচির।মূলত এও এক অত্যাচার।এতোগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো শক্তি ওর কোমড়ে নেই,পায়েও নেই।কিন্তু আশ্রয়দাতার মুখের উপরে ঠিক না করা যায় না।তাই অগত্যা গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছুটতে হলো ছাদে।এই ভরা সন্ধ্যায়, ক্লান্ত শরীরে।

বিশাল বাড়ির বিশাল ছাদ।দৈত্যের মতো বাড়ি বটে।বিশ্রামাবাসের ছাদটাকে বিশাল একটা মাঠের মতোই মনে হয় সূচির কাছে।ও আর কখনো এতো বড় দালান দেখেনি,এতো বড় খেলার মাঠের মতো ছাদও দেখেনি।রেলিঙের কাছে কাছে সারি সারি টব।সেখানে ছোট-বড় গাছ।কিছু কিছু জায়গায় দড়ি টাঙানো।ওখানে হয়তো কাপড় মেলা হয়।ছাদের চার মাথায় চারটে বাহারি লাইটের দেখাও মিললো।জ্যোৎস্নার মতোই উজ্জ্বল ওদের আলো।

” ফ্লোরেই বসো সূচি।এখানে চেয়ারও নেই,দোলনাও নেই।একটা ছোটলোক বাড়িওয়ালার বাড়ি।শালা শুধু টাকা কামাতেই জানে,খরচা করতে জানে না।একটা বিশাল দোলনা লাগিয়ে দিলেই কিন্তু পারে।”

দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে একটুখানি ফ্লোর ঝেরে দুজনে বসলো।লাবনী বসলো আয়েস করে,সূচি বসলো সংকুচিত হয়ে। লাবনীর সাথে এখন আর স্বাভাবিক হতে পারে না ও।তাই লাবনী যখন তৃপ্তি নিয়ে গরম চায়ে চুমুক দিলো তখনও সূচি থম মেরে বসে রইলো চুপচাপ।মনে ভয়, এই বুঝি আশ্রয়টুকু ছুটে যায় কপাল থেকে।এই বুঝি বাড়ি থেকে বের করে দেয় ওরা।

” তোমার সাথে কিছু কথা আছে সূচি।”

কলিজায় টান পড়ে সূচির।বসন্ত বাতাসে দোল খাওয়া কচি পাতার মতো ভিতরটা দোলে। কান খাড়া করে রাখে অজানা দুঃসংবাদের আশায়।

” আমি যা বলব তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে।এরপর নিজের কথা থাকলে বলবে।কোনো কান্নাকাটি না,কোনো পায়ে ধরাধরি না,সুইসাইডের হুমকি না,কিচ্ছু না।বুঝেছো? আই রিপিট,কোনো প্রকারের কান্নাকাটি না।”

এক চুমুকে আধা কাপ চা শেষ করে ফেললো লাবনী।সূচি তখনো নিচের দিকে চেয়ে আছে।লাইটের স্পষ্ট আলোয় ওর ভীতু মুখটা স্পষ্ট।একটি নতুন ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় মৃদু কাঁপছে।

” তোমার উদয়পুরে যাওয়া উচিত সূচি।”

” আমি যাব না আপু।”

” অকারণেই ভয় পাচ্ছো।”

” আমার শরীরের দাগগুলো এখনো যায়নি আপু।”

লাবনী থমকায়।মেয়েটার উদয়পুরে যাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করার জন্য এর চেয়ে বেশি কারণ আর লাগে না।

” তুমি জানো তোমার এই মিথ্যেমিথ্যি মরার জন্য কত অঘটন ঘটে গেছে?”

” কী হয়েছে?”

” ফয়সালকে কে যেন কুপিয়েছে।সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।পুরো রক্তারক্তি অবস্থা।”

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি সূচি একটুও চমকে উঠলো না।বরং পর্যবেক্ষক লাবনী লক্ষ করলো আচমকা মেয়েটার মুখের পেশিতে টান ধরেছে।চোখ-মুখে ভর করেছে একরাশ কাঠিন্য।

” মরেছে?”

” না।”

” কে কুপিয়েছে? আব্বা?”

” জানি না এটা।গত দু’দিন ধরে হুমায়রার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না অন্তু।তাই কোনো খোঁজখবর নেই ওদিকের।”

” হুহ! এখন কেন? আমি জানতাম এমনটাই হবে।আমি মরার পরে যে ওদের আদর বাড়বে আমার জন্য তা আমি খুব ভালো ভাবেই জানতাম।থাকতে কে মূল্য বোঝে বলুন?”

অবাক না হয়ে পারে না লাবনী।গলায় বিস্ময়ের রেশ টেনে প্রশ্ন করে, ” তুমি এতো স্বাভাবিক!!”

” অবশ্যই।অস্বাভাবিকতার তো কিছু নেই।”

” তোমার বাবার জেল হতে পারে এজন্য।তুমি বুঝতে পারছো সূচি? হত্যাচেষ্টা, এর শাস্তি বোঝো? মানে তুমি কী করে এতো সহজ…

লাবনীর কথার মাঝে হুট করেই একটা প্রশ্ন করে সূচি।উদাস গলায় বলে,” আপু চব্বিশে এপ্রিল রাতে যদি অন্তু ভাইয়ের সাথে আমার দেখা না হতো তাহলে কী হতো বলুন তো?”

” সত্যি সত্যি আত্মহত্যা।”

” ঠিক তাই।ফিরে আমি যেতাম না।সেদিন রাতে প্রায় আধঘন্টার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম নদীর পাড়ে।আমি আর মুখোমুখি ভয়াল মেঘনা নদী।এই সেই নদী যার নাম তুলে ছোটবেলা থেকে আব্বা ভয় দেখাতো।কিছু থেকে কিছু হলেই বলতো কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে।অন্তু ভাই না এলে কী করতাম জানেন? আমি হয়তো আরো অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম।অন্ধকার রাতে চুপচাপ ঐ ভয় দেখানো নদীর দিকে চেয়ে থাকতাম।তারপরে টুপ করে লাফ দিতাম।তারপরে কোথায় থাকতাম আমি?”

লাবনী জবাব দেয় না। কেবল শান্ত চোখে চেয়ে থাকে সূচির দিকে।সূচির দৃষ্টি তখন সামনের রেলিঙের গায়ে।দৃষ্টি ও স্বরে সমান তালের উদাসীনতা।যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে।

” আপনি আমার ওটাকে হত্যাচেষ্টা বলবেন না? আমাকে কেন সেদিন সেই নদীর পাড়ে দাঁড়াতে হয়েছে? কেন এই অচেনা শহরে আসতে হয়েছে? কেন এই বয়সেই আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি? কেন আমি আমার নিজের গ্রামকে ভয় পাই? কেন আমি আমার বড় আপার কাছে থাকতে পারলাম না? কেন আমার ছোট ছোট প্রত্যেকটা স্বপ্নকে ওরা গলা টিপে মারলো? এগুলো কি হত্যাচেষ্টা না আপু? নাকি রক্তারক্তিটাই দেখেন আপনারা? আমাকে যাদের জন্য এতো হারাতে হয়েছে তারা কি অপরাধী না? আমি কি সিনেমার নায়িকা যে সব ভুলে যাব? সবাইকে ক্ষমা করে দেব এটাই কি আশা করেন আপু?”

” তোমার দিক থেকে কোনো দোষ ছিল না সূচি? তালি তো এক হাতে বাজে না।”

” জানেন এই কথাটা আম্মাও বলতো।আম্মা বলতো তিনি আমাকে জন্ম দিয়েই আমাকে সহ্য করতে পারে না।তো মানুষ কীভাবে করবে? কিন্তু আমি না ঠিক আমার দোষটাই খুঁজে পেতাম না।বড় আপার বিয়ের পর থেকে কপালে জুটেছে অতিরিক্ত শাসন।মাত্রাতিরিক্ত শাসন যাকে বলে আরকি।যেদিন আমাকে ওরা দেখতে এসেছিল তার দু’দিন আগেও আমার জ্বর ছিল গায়ে।আব্বা এমন মার মেরেছে যে জ্বরে ভুগেছি।অপরাধ কী ছিল জানেন? পৌষ মেলায় গিয়েছিলাম না বলে।এরপরে আমার বিয়ে।আপনার দেবর আমাকে পছন্দ করতো না শুরু থেকে।কিন্তু আমি শুরুতে বুঝতে পারিনি।আপনার চাচী শাশুড়িকে আমি তখনো জমের মতো ভয় পাই।তার মুখ তো মাশাল্লাহ। কিছু থেকে কিছু হলেই আমার চৌদ্দ পুরুষ ধরে টান দেয়।আমার মা-বাবাকে নিয়ে যা বলতো তা শুনলে আপনি তাজ্জব বনে যাবেন।আমাকে তো বেজন্মা ছাড়া কথাই বলতো না।বাড়ির উপরে বড় ভাবি কিন্তু তার সাথে কথা বলা মানা।আপনার দেবরের রঙ-ঢঙ তখনো বুঝি না।আমি যখনি তাকে বলতাম একটু আম্মাকে বুঝিয়ে বলতে তখনি সে উলটো আমাকে বকতো আমি নাকি অভিযোগ করি।আমার নিজের মায়ের সাথে কিছু বললে মা উলটো আমাকে চাপতো।বলতো মেনে নিতে।মেনে নিচ্ছিলাম।মাঝে মাঝে যে রাগ উঠতো তা অস্বীকার করব না।আপনার দেবরের সাথেও চোটপাট করেছি কিছুদিন।কিন্তু এরপরে পহেলা বৈশাখে একটা বিশাল ঝামেলা হলো।সেদিন বুঝলাম আমার পাশে কেউ নেই। কারণ সেই রাতে আম্মা নিজে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলো,আমি মরলে তাদের হাড় জুড়ায়।আর এর কিছুদিন পরেই তো আসল ঝামেলা।ঝামেলার সূত্রপাত সারা রাত জ্বরে ভুগে দেরি করে উঠেছিলাম বলে।এতোকিছুর পরে দোষটা যে ঠিক কোথায় তাই আমি ভেবে পাই না আপু।হয়তো আরেকটু মানিয়ে নিতে পারতাম।কিন্তু আমি আর পারছিলাম না আপু।ওখানে থাকলে হয় আমি ওদেরকে নিজ হাতে খুন করতাম আর নয়তো নিজে মরতাম।”

” আগের কথা বাদ দাও।আমি যদি এখন গ্রামে জানিয়ে দেই তখন কী হবে? বাড়ির লোক এলেও যাবে না?”

” উঁহু, যাব না।আমি যখন বলেছি আমি যাব না তখন যাবই না।”

” এটাই তোমার মত?”

” চোখ বন্ধ করেও বলতে পারি এটাই আমার শেষ মত।”

চায়ের কাপটা দিয়ে ফ্লোরে ঠুকঠুক শব্দ করে লাবনী।বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ” আমি গ্রামে জানাইনি কেন জানো?”

” না।”

” কারণ আমি জানি তুমি যাবে না।উলটো উদয়পুর থেকে মানুষ আসবে,একটা টানাহেঁচড়া হবে,এদিকে সবাই জানবে আমার ঘরে মেয়েঘটিত একটা ব্যাপার ঘটেছে।বিষয়টা যথেষ্ট বিব্রতকর। তাই আগ বাড়িয়ে বলিনি কাউকে।”

” আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আপু।গ্রামে আবার বেঁচে ফিরলে কী দুর্নাম ছড়াবে জানেন?”

” কী?”

” সবাই ভীড় করে আমাকে দেখতে আসবে আর কানাকানি করে বলবে,স্বামী দিয়ে দিন চলছিলো না।তাই ভাসুরের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।এখন..

” ছিঃ! সূচি থামো তুমি।”

ভাবগ্রস্তের মতো হাসে সূচি।মলিন সুরে বলে, ” এটুকু শুনেই এমন করছেন আপু? বড় আপা যখন পালিয়ে গিয়েছিলো লোকে তখন ওকে নষ্টা ছাড়া কথা বলেনি।জানেন আমার মাকেও বলতো এই কথা। আমার কোনো বিয়ের সম্বন্ধ আসেনি এই কারণে।বলতো নষ্টার বোন..

” একটা চাকরি করবে সূচি?”— আরেকবার কান বাঁচাতে সূচিকে না থামিয়ে পারে না লাবনী।অবশ্য এইবারে অবাক হয় সূচি।প্রশ্ন করে না কিছুই।কেবল মুহূর্তেই আনন্দে চিকচিক করে ওর বড় বড় দুটো চোখ।

” বৃদ্ধাশ্রমের হেল্পিং হ্যান্ড।বুড়ো মানুষদের চাকরি যাকে বলে।একটু পরিশ্রমের তবে তোমার জন্য সেফ।একটা আশ্রয়ও হবে,আয়ও হবে।আমার ছোট মামার বিশাল টাকা-পয়সা।ফুল ফ্যামিলি ইতালিতে
থাকে।শখ করে গাজীপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম করেছে।ওখানে কয়েকজন লাগবে।মামা সাধারণত শখের ব্যাপারে সচেতন।তাই খুব বেছে বেছে লোক নেয়।আমি তোমার কথা বলেছি সেদিন।বলেছে তোমারটা কনফার্ম। কিন্তু একটু সময় লাগবে।মামা জানুয়ারিতে আসবে,তোমাকে দেখবে তারপরে হয়তো নতুন চাকরি।কিন্তু ততোদিন….

সূচি শ্বাস আটকে আসে।জানুয়ারির এখনো ঢের বাকি।তাহলে বাকি দিনগুলো?

” শুনেছি পড়াশোনায় তুমি খুব একটা ভালো না।অন্তু বললো অপদার্থ স্টুডেন্ট। কিন্তু যতই অপদার্থ হও,ক্লাস ফোর আর ওয়ানের স্টুডেন্ট পড়তে পারবে না? একটা ইন্টার পাশ করা মেয়ে আর কিছু না পারুক নিশ্চয়ই এই বাচ্চাদের পড়াশোনা পারবে।গত দুদিন দেখলাম তোমার পড়া খুব উপভোগ করছে ওরা।মুখে মুখে যেভাবে পড়াও সেভাবে আসলে আমি পারি না।ধৈর্য হয় না।তাই চাইলে তুমি এখানেই থাকতে পারো। জানুয়ারি অবধি লজিং মাস্টারের মতো।গ্রামে দেখেছো এমন? পড়ানোর বিনিময়ে এখানে থাকবে তারপর জানুয়ারিতে মামা দেশে এলে নতুন চাকরি।চলবে সূচি? এর চেয়ে ভালো আর কোনো ব্যবস্থা আমার জানা নেই আসলে।এই চুক্তিতে রাজি?”

সূচির বড় বড় চোখ দুটো তখন পানিতে টসটস করছে। মাছের চোখের মতো ঘোলা ওর চোখ দুটো।কৃতজ্ঞতার আতিশয্যে কথা বলতে পারে না।ভিতর থেকে সাবান ফেনার মতো উগলে আসে একেকটা বাষ্প।বহুক্ষণ পরে বহু কষ্টে লাবনীর গা ঘেঁষে বসলো সূচি।ততোক্ষণে ওর চোখের কোল ভিজেছে নব বর্ষায়।শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো থেমে থেমে অদ্ভুত একটা আবদার করে সূচি।মিইয়ে যাওয়া গলায় প্রশ্ন করে, ” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি আপু? আপনাকে ঠিক আমার বড় আপার মতো দেখাচ্ছে।”

চলবে….

( আসসালামু আলাইকুম। শুকতারা প্রথম পরিচ্ছেদ পড়ে অনেকেই বলেছেন এতে নাকি বাস্তবতার স্বাদ পেয়েছেন।হয়তো অনেকে সেই লোভেই অধিক প্রত্যাশা নিয়ে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটা পড়ছেন।কিন্তু একটা সত্যি এখনি জানিয়ে দিচ্ছি।দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে কোনো বাস্তবতা নেই।বিন্দুমাত্র বাস্তবতার ছোঁয়া নেই এখানে।এটি আমি লিখছি সম্পূর্ণ আমার প্রত্যাশা ও কল্পনা থেকে।এখানে চরম নাটকীয়তা থাকবে।তাই যারা বাস্তবতার স্বাদ নেওয়ার জন্য পড়ছেন তারা চাইলে প্রথম পরিচ্ছেদকেই সমাপ্তি হিসেবে মেনে নিতে পারেন।কারণ আগেই বলেছিলাম প্রথম পরিচ্ছেদ আমার দেখা একটি জীবনের সাথে প্রায় নব্বই শতাংশ মিলে গেছে ( পুরোটা না।)কিন্তু শুধু বাস্তবের উপরে ভিত্তি করে লিখলে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আসতো না।কারণ বাস্তবের সূচি একটা জায়গায় থেমে আছে।তার সাথে করা অন্যায়ের কোনো শাস্তি আমি এখনো দেখিনি অথবা বাস্তবের সূচি এখনো কোনো স্টেপ নেয়নি।আমার এটা ভালো লাগে না আসলে।তাই বাস্তবের সূচির জীবনটাকেই ইচ্ছেমতো উলটে পালটে আরেকটা অংশ সৃষ্টি করছি আমি।এখানে না আছে কোনো বাস্তব, না আছে কোনো শিক্ষা। স্রেফ পাবেন স্তরে স্তরে নাটকীয়তা। এগুলো মেনে নিতে পারলে পড়ে আনন্দ পাবেন। এছাড়া হয়তো প্রথম পরিচ্ছেদের স্বাদ পাবেন না এখানে।
সবশেষে, রি-চেক করিনি।টাইপিং মিস্টেক আছে হয়তো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here