শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৩

0
237

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৩
#হালিমা রহমান

অন্তুর কলেজ শুরু হয় দশটায়।রাতভর উপন্যাস গিলে শেষ রাতে ঘুমায়।সকালে নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে গোসল করে, নাকে-মুখে দুটো গুজে এক দৌড়ে কলেজে।সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা ওর এখনো হলো না।ঘুমে ঢুলে ঢুলে কোনোরকমে ফজরের নামাজটা পড়ে আবার ঘুমায়। নয়টার আগের সকাল অন্তুর জন্যে না।তাই আজ সকাল সকাল বসার ঘরে অন্তুকে দেখে সত্যি বলতে অবাকই হলো লাবনী।শান্তকে বিদায় করে ছেলে-মেয়েকে তুলতে যাচ্ছিলো মাত্রই।সোফার উপরে কাঠ হয়ে বসে থাকা ভাবুক অন্তুকে দেখে কপাল কুঁচকে গেল।

” সূর্য তো এখনো ওঠেনি জমিদার অন্তু। গর্ত থেকে মুখ বের করলে হঠাৎ?”

মাতৃসম বড় ভাবির কথা গায়ে মাখে না অন্তু।ভীষণ ভিন্ন গলায় গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে, ” ভাইয়া কি চলে গেছে?”

” হুম।”

” আলহামদুলিল্লাহ। শোনো,আজ থেকে আমরা সকাল-বিকাল দুই বেলা ভাইয়ার পা ধোয়া পানি খাব।ভাইয়া অফিসে যাওয়ার আগে তুমি তার কাছ থেকে এক জগ পা ধোয়া পানি নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবে।সেখান থেকে তোমার অর্ধেক, আমার অর্ধেক।এতেও যদি আমরা মানুষ না হই তাহলে ডোজ বাড়বে।প্রয়োজনে তিনবেলা করে খাব।”

” পাগলের ভাই ছাগল,মাথাটা কি পুরোপুরি গেছে ?”

” জ্বি না,মাথা আমার ঠিক আছে।এতোদিন শতভাগ খারাপ ছিল।নইলে এতো কান্ড ঘটতো না।জাস্ট একটা ভুল।যাকে সাহায্য করা উচিত ছিল না তাকেই করেছি।একটু মানবিকতা এখন সারাজীবনের কান্না।”

অন্তুর কথার কেন্দ্রে অন্তরালে যে সূচি বসে আছে তা বেশ বুঝলো লাবনী।চিন্তার সাথে জাগে কৌতূহল, আবার কী হলো?

” মেজ ভাবি কল করেছিলো সকালে।ফয়সালের অবস্থা খারাপ।কে যেন কুপিয়েছে কাল রাতে।জ্ঞান ফিরছে না এখনো তাই বরিশালে রেফার করেছে ভোলা হাসপাতাল থেকে।এই খবর শুনে চাচীমার অবস্থাও খারাপ।বেশ কিছুদিন ধরেই ফয়সালের সাথে কিছু একটা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিলো।তাই ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করেনি।এখন ছেলের এই অবস্থা দেখে মাথা-টাথা ঘুরে অবস্থা খারাপ।জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বারবার। কাল রাত থেকে স্যালাইনের উপরে আছে।”

” কে কুপিয়েছে তা জানতে পারেনি?ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল নাকি কোনো?”

” আক্রোশ যদি থেকে থাকেই তো আছে সূচির ফ্যামিলির। সূচি ঐ গ্রামে মৃত।সবাই জানে ফয়সালের অত্যাচারে সূচি নদীতে ঝাপ দিয়েছে।মেয়ের মৃত্যুটা তো এখনো তাজা।তাই নিরানব্বই ভাগ সম্ভাবনা,ফয়সালের হত্যাচেষ্টার পিছনে সূচির ফ্যামিলির কারো হাত আছে।অবশ্য,সন্দেহের তীরটা সূচির বাবার দিকেই যায়।উনি ছাড়া ওদের ঘরে অন্য কোনো পুরুষ নেই।”

বোঝা গেল মমিন শেখের অসুস্থতার খবর অন্তুর কানে আসেনি।হয়তো হুমায়রাও এখনো জানে না,তাই অন্তুকে বলেনি।

” অন্য কোনো শত্রু নেই ফয়সালের? এমনও তো হতে পারে অন্য…

” ভাবি, এতোদিন তো আক্রমণ হলো না।যেই সূচির মিথ্যা খবরটা ছড়ালো ওমনি ওর উপরে আক্রমণ হল! মাথা খাটাও,পৃথিবীতে কিছু এমনি এমনি ঘটে না।সবকিছু বুঝেও চোখ বন্ধ করে থাকা তো ঠিক না।না আমি সূচিকে আনতাম আর না এসব ঘটতো।অথবা ঢাকায় আসার পরে ফয়সালকে যখন ফোনে পাইনি তখন যদি মেজ ভাবিকে কল করে সব বলে দিতাম! তুমি নিষেধ করলে তাই আমিও বোকার মতো বললাম না।এখন দেখো তো সূচির মিথ্যা আত্মহত্যার ঘটনার জের কতদূর গড়ালো।”

প্রশ্নটা অনেক্ষণ যাবৎ ধরেই মাথায় ঘুরছিলো লাবনীর।তাই অন্তুর কথা শেষ হতেই বেলুনের হাওয়ার মতো ফস করে প্রশ্নটা ছেড়েই দিলো,
” তুমি আবার সূচির বেঁচে থাকার কথাটা হুমায়রাকে বলে দাওনি তো? গ্রাম থেকে কেউ আসবে ওকে নিতে? এখানে সিনক্রিয়েট হবে অন্তু?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তু।মাথা নেড়ে কপাল চাপড়ে বলে, ” এখানেই তো ভয়।যেই মেয়ে উদয়পুরের নাম শুনলেও আঁতকে উঠে, সেই মেয়েকে এখান থেকে নেওয়া একপ্রকারের অসাধ্য। এর উপরে আছে আবার তোমার আর ভাইয়ার সিনক্রিয়েটের ভয়।হাহ! শালার আমি আর তুমি যদি মানবিকতা না দেখাতাম তাহলে এতোকিছুই হতো না। এজন্যই ভাইয়ার মতো হওয়া উচিত। আজকালকার দিনে চোখ খুলেছো তো মরেছো।যতোক্ষণ তুমি চোখ বন্ধ করে রাখবে ততোক্ষণই তুমি…

” আপু, শিলা হিসু করেছে।এখন ঘুম থেকে উঠছে না।”— সূচির হঠাৎ আগমনে চুপ মেরে গেল অন্তু।মেয়েটা আগের চেয়ে একটু বদলেছে।এখন আর সারাদিন ঘরের মাঝে লুকিয়ে থাকে না।শান্ত আসার আগ পর্যন্ত একটু-আধটু বেরোয়।লাবিব-শিলার সাথে আস্তে আস্তে টুক টুক করে কথা বলে।মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ফিরলে অন্তুর চোখ পড়ে সূচির উপরে।রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে সাহায্য করে লাবনীকে।অথবা কখনো কখনো দেখা যায় লাবনীর লাইভের সময়ে সূচি পাশে বসে হা করে গিলে লাবনীর সাজানো-গোছানো কথা,তার হাত-পা-মুখের স্টাইল।

কপাল অবধি টানা ঘোমটার নিচে সূচির নিরুদ্বেগ মুখ।বাঁদরের মতো গলায় ঝুলে আছে শিলা।আজকাল সূচির সাথে তার বেশ ভাব।মেয়েটা মিশুক।সূচিও এই ছোট্ট সঙ্গীটাকে খুব গুরুত্ব দেয়।মাঝে মাঝে গল্প শোনায়।তাই রাতে পাতানো খালামনির কলিজায় না ঢুকে ঘুমাতে পারে না শিলা।
সূচির কোলে চড়ে দু-হাতে তার গলা জড়িয়ে মাথাটা খালামনির কাঁধে গুজে দিয়েছে শিলা।পা দুটো হাতের মতোই সূচির কোমড়ে জড়ানো।সূচির বাম হাত আদুরে ভঙ্গিতে শিলার নরম চুল ছুঁয়ে দিতেই বিড়াল ছানার মতো আরেকটু মাথা গুজে দিল মেয়েটা। আরেকটু আদরের আশায় ঝিমানো গলায় আবদার ঢেলে বললো, ” ও খালামনি,আরেকটু ঘুমাব।”

” ঘুম তোর পিঠের উপরে দেব বেয়াদব।প্রতিদিন তোমার মুতুর জামা-প্যান্ট আমি ধুতে পারব না।দুইটা ছেলে-মেয়ের একই স্বভাব।এই দামড়া বয়সে এসে বিছানা ভিজায়।সূচি,ওকে ছুঁড়ে ফেলে দাও তো।একদম বাপ-চাচার মতো হয়েছে।”

” বাপ-চাচারা বিছানা ভিজায় না।ছেলে-মেয়ে দুটোই হয়েছে মায়ের মতো।এটা কোনো কাজ করলি শিলা? মায়ের ভালো গুণ না পেয়ে পেয়েছিস খারাপটা।ছিঃ! ভেরি ব্যাড।”

লাবনীর চোখ রাঙানি দেখে ফিক করে হেসে ফেললো সূচি। অন্তু কিছুই বললো না।মাছি মারার মতো ভঙ্গি করে আলগোছে নজর বুলিয়ে নিলো সূচির উপরে।সোজা মেরুদন্ডটাকে আরো সোজা করে নিলো।চেহারায় একটা আলগা গাম্ভীর্যের মুখোশ টেনে কন্ঠ করে ফেললো গুরুগম্ভীর।

” তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে সূচি।পরে বলা যাবে না, এখনি বলতে হবে।শিলাকে কোলে নিয়ে দাঁড়াতে পারবে? নাকি বসবে? না থাক, বসা লাগবে না।সোজা হয়ে দাঁড়াও,আমার দু’মিনিট লাগবে শুধু।দুপুরে ভাত খাওয়ার পরে রেডি হয়ে থাকবে।আমরা বেরোবো। আমি আর তুমি শুধু।পাঁচটায় লঞ্চ।তিনটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব নয়তো আবার কেবিন পাওয়া যাবে না।তোমার জামা-কাপড়গুলোও নিয়ে নিও।আমি কলেজ থেকে একদিনের ছুটি নেব।তোমাকে নিরাপদে উদয়পুরে পৌঁছে দেওয়ার পরেই আমার স্বস্তি।বেঁচে যখন আছো তখন আর এভাবে গা ঢাকা দেওয়ার কোনো মানে হয় না।যেটা তোমার স্থায়ী ঠিকানা সেখানেই যাও।এখানে অযথা পড়ে থাকা কেন? এভাবে চেয়ে আছো যে? চিন্তা করো না কিছুই হবে না।আমি সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বলব।আশা করছি কোনো ঝামেলা হবে না।এরপরে বাকিটা তোমার দায়িত্ব। জীবন তোমার,সিদ্ধান্ত তোমার।বাবার বাড়ি থাকবে নাকি অন্যকোথাও থাকবে তা তোমার ব্যাপার।তবে মাঝে যদি কোনো বিপদে আটকে বুদ্ধি কমে যায় তাহলে এই অধমের কাছ থেকে পরামর্শ নিও।আশা করছি ভালো পরামর্শ দিতে পারব।আমি উঠছি এখন।তাহলে এই কথাই রইলো,বিকাল তিনটায় সদরঘাট আর কাল সকালে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে উদয়পুর।ভুলেও ভুলে যেও না কিন্তু।”

একদমে কথাগুলো বলে ঘর ছাড়লো অন্তু।পিছনে ফেলে গেল রক্তশূন্য ফ্যাকাসে সূচিকে।মেয়েটার চেহারার সব রক্ত কে যেন চুষে নিয়ে গেছে মুহূর্তেই।শিলাকে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আলগা হতেই আরো শক্ত করে সূচির গলা জড়িয়ে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচলো শিলা।সূচির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো, ” তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে খালামনি? তোমার বাড়ি কই? আম্মুর কাছে বলে আমাকে নেবে? আমিও যাব।”

কথা বলার শক্তি খুঁজে পায় না সূচি। মাথাটা ঝিমঝিম করে। বুঝে গেছে অন্তু আজ আর অনুরোধ শুনবে না।আগেরবার শুনেছে বলেই যে সবসময় শুনবে –এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।লাবনীর দিকে চেয়েও কিছু বলার সাহস হয় না।কথা বলার জন্যেও অধিকার লাগে।সূচির সেই অধিকার কোথায়? এই অচেনা শহরে ওর আবদার বা অনুরোধের কোনো মূল্য নেই তা বেশ বুঝে গেছে এতোক্ষণে।তাই বাজ পড়া মানুষের মতো চুপ মেরে থাকে।দৃষ্টি মেঝের টাইলসে।চুপচাপ হয়তো ভাবে কিছু,ক্ষণে ক্ষণে শিলাকে জড়িয়ে রাখা হাতদুটো শক্ত হয়।

” শিলাকে নামাও সূচি।ফ্রেশ হয়ে এসো, নাস্তা খাই একসাথে।আবার কবে না কবে দেখা হবে!”

শিলাকে কোল থেকে নামিয়ে ঘরে যাওয়ার সময় হেলেদুলে পড়েই যাচ্ছিলো সূচি।ভাগ্যিস দু’হাতের মধ্যে লাবনী ছিল।এগিয়ে যেয়ে শক্ত হাতে ধরে ফেললো।টেনেহিঁচড়ে অর্ধ মূর্ছিত মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে খাটের উপরে বসিয়ে ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো লাবনী।

” আমি উদয়পুরে যাব না আপু।কখনো যাব না,কোনোদিন যাব না।”

সূচির বুজে আসা খ্যানখ্যানে গলা।শরীরটা হয়তো সত্যিই হুট করে খারাপ হয়ে গেছে মেয়েটার।বসে থাকার ঝক্কি না পেরিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো বালিশ ছাড়া।ঘনঘন শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে মরার মতো পড়ে রইলো বিছানায়।
লাবনী বোঝে সব।যেই মেয়েটা বিশ-একুশ দিন আগে তীব্র ঘৃণা ও ভয় নিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়েছে তার পক্ষে আবার সেই গ্রামে পা রাখা কঠিন।এই কয়েকদিনের মাঝে এমন কিছুই ঘটেনি যার ভিত্তিতে সূচির মন থেকে ভয় মুছে যাবে।একুশ দিন আগের সূচি আর আজকের সূচি একই।একইরকম বেপরোয়া, হয়তো আবার বিপদ দেখলে মরার জন্য দু’পা বাড়িয়ে দেবে নিঃসংশয়ে।
ছোটবেলা থেকেই খুব দরদি বলে লাবনীর ভিতরটা কাঁদে হু হু করে।সূচির উপরে ওর বিদ্বেষ নেই, রাগ নেই,অভিযোগ নেই,ক্ষোভ নেই বরং আছে এক সূক্ষ্ম ভালোলাগা।সারা শরীরে যন্ত্রণার যে ছাপছোপ নিয়ে মেয়েটা ওর ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল,সেই সূচি এখনো চোখে ভাসে।কতটা অসহায় হলে একটা মেয়ে অন্তুর মতো অপরিচিত একটা পুরুষের হাত ধরে রাতের আঁধারে আজন্ম পরিচিত গ্রাম ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক শহরে ঠাই খোঁজে, তাই ভাবতো এতোদিন।নিজেকে বারবার সূচির জায়গায় দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতি ভাবতো বলেই আজও দুর্বল সূচিকে দেখে ওর মায়া হয় প্রচুর।অন্তু সূচিকে নিরাপদে পৌঁছে দেবে তা ঠিক জানে লাবনী।কিন্তু তারপরে? উদয়পুরে সূচি মৃত।একটা মৃত মানুষ হুট করে বেঁচে ফিরলে গ্রাম জুড়ে একটা হিড়িক পড়ে যাবে না? তল্লাটের মানুষেরা দলে দলে আসবে, বড় বড় চোখ মেলে সূচিকে দেখবে,প্রশ্ন করবে,অন্তুর সাথে সূচির আসা-যাওয়ার খবর শুনে হয়তো বাঁকা চোখে তাকাবে দুজনের দিকে।একেকজন একেক রকম।চরিত্রের উপরে প্রশ্ন এলেও কিছু করার নেই।চুপচাপ মেনে নিতে হবে সবকিছু।অন্তু তো ঢাকা এসে বেঁচে যাবে কিন্তু এই মেয়েটা? এতোকিছুর পরেও বেঁচে থাকা যায়?
হয়তো এরকম ভাবনা সূচির মনেও এসেছে বলে আচমকা এমন মুষড়ে গেছে সূচি।হয়তো নতুন বিপদের মুখ থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে খুঁজতে অসুস্থ হয়ে গেছে মেয়েটা।শরীর দোলানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে লাবনীর।সূচির সামনে থাকতে ইচ্ছা করে না।বেরিয়ে যায় মাথা নিচু করে।মুখ ভার করে ঘর ছাড়ার আগে মিনমিনে গলায় শোনা যায় তার আফসোস, ” তুই যদি আমার আপন বোন হতি সূচি! আমি তোকে কোনোদিন আমার কাছ থেকে যেতে দিতাম না।”
___________________________________

সকাল গড়িয়ে দুপুরের পিঠে ঢলে পড়ার আগেই সাহিদা বানু ইশতিয়াকের পিঠের উপরে ভর করে চলে এলেন ভোলা সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ইউনিটের পুরুষ ওয়ার্ডে।কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা চার নং বেড।এই জায়গায় এসে দাঁড়ানোর জন্য কাল রাত থেকে অনেক সাহস জোগাতে হয়েছে।বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে এভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় দেখার চেয়ে মৃত্যু ঢের ভালো।নিজের দাম্পত্য জীবনের বয়স আঙুলে গোনেন।মাত্র সাড়ে সাতাশ বছর। এতুটুকু বয়সে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিটাই চোখে বাজে আজ।
ভেবেছিলেন রায়হান সকালে বাড়িতে যাবে তারপরে ওর সাথে হাসপাতালে ছুটে আসবেন।কিন্তু চাতকের মতো অপেক্ষা করতে করতে সকালে দেখা গেল ইশতিয়াকের মুখ।ঘরের জামাইয়ের ঘুমে জর্জরিত নেতানো মুখটা দেখে মনটাই খিঁচড়ে গেল।ইশতিয়াকের চেয়ে রায়হানের উপরে ভরসা বেশি।রায়হান তো ছেলের মতোই সেখানে ইশতিয়াক বাইরের মানুষের মতো পুরোই অচেনা।কথা বলতে বাধ বাধ ঠেকে।ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছেও খুঁজে পান না,আগ্রহও খুঁজে পান না সাহিদা বেগম।কেবল নিম পাতা খাওয়া রোগীর মতো মুখটাকে বিরস করে ঘরের কোণ নিলেন।
আধা বেলা অফিস করার আগেই একদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছুটে এলো ইশতিয়াক।পরের চাকরি,ছুটি নেওয়ায় বসের কালো মুখ ও দুটো কঠিন কথা শুনে আঁতে লাগলেও আপাতত কিছু করার নেই।সময় খারাপ।বাড়ি ছুটে গা ধুয়ে আবার হাসপাতালে ছুটলো শ্বশুরের খাবার নিয়ে।বেরিয়ে যাওয়ার আগে শাশুড়িকে ডেকে বললো, ” আম্মা, হাসপাতালে যাবেন? গেলে চলুন।আপনাকে দেখলে আব্বা খুশি হবেন।তার এখন মানসিক শান্তি বেশি জরুরি।”

ছেলেটা যেন ঘরের ছেলে।কি সুন্দর মুখ দেখেই বুঝে ফেললো মনের বাসনা।সাবান ফেনার গলগলিয়ে একগাদা দোয়া বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।এতোকাল দূরে ঠেলে দেওয়ার পরেও কি সুন্দর বিপদের সময়ে দৌড়ে এলো! ইশতিয়াককে আজ জ্বলজ্বলে হীরে মনে হয়।তার পাশে নিজেকে অমানুষের মতো লাগে।ওদেরও তো বিপদ ছিল।মেয়েটা একা একা হাসপাতালে লড়েছে।কই কখনো তো মা হয়েও তিনি এক নজরের জন্য দেখতে যাননি!

মমিন শেখ ঘুমিয়ে আছেন চোখ বন্ধ করে।কাল রাতে খিঁচুনি উঠেছিলো।পরে একটা ইনজেকশন পুশ করায় সব শান্ত।রতন পাটোয়ারী ও লতিফ সারা রাত থাকার পরে একটু আগে চলে গেছে।এখন রায়হান আছে।কিছুক্ষণ পরে সেও বেরিয়ে যাবে।

” আম্মা আপনি বসেন এখানে।আব্বা তো ঘুমায়। উঠলে খাবার দিয়েন।”

” আচ্ছা।”

” রায়হান ভাই, যাবেন নাকি বাসায় এখন? গেলে চলেন।আমিও বাইরে যাব।কিছু খাবার নিয়ে আসি।আম্মারও খাওয়া হয়নি,আমারও খাওয়া হয়নি।”

হাত নেড়ে নিষেধ করেন সাহিদা বেগম, ” তুমি খায়া নাও।আমার লেগা কিছু আইনো না ইশতিয়াক।খিদা নাই।”

” আমি বুঝবনি।চলেন রায়হান ভাই।”

ইশতিয়াকের পিছু পিছু রায়হান চলে গেল।আশপাশে নজর বুলান সাহিদা বেগম।হাসপাতালের সাথে তার পরিচিতি কম।বিছানায় শুয়ে থাকা রোগীদের চেহারা দেখেন চেয়ে চেয়ে।কত কষ্টই না হয় এদের!
মিনিট কয়েক চারপাশের পরিবেশ দেখে স্বামীর দিকে তাকান সাহিদা বেগম।নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে থেকে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেন।মুখের উপরে ঝুলে থাকা নেকাবের আড়ালে জ্বিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে।রুগ্ন হাত দুটো বাড়িয়ে স্বামীর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, ” সূচির বাপ,এই সূচির বাপ।উঠেন।”

ঘুমাতে ঘুমাতে চোখের পাতা দুটোও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে আছে।এখন আর ঘুম জেঁকে বসে না চোখে।দু’টো ডাক দিতেই চোখ মেললেন মমিন শেখ।আড়মোড়া ভাঙার সাধ্য নেই,স্ত্রীর মুখখানি দেখেই ছেলেমানুষের মতো কেঁদে বুঝিয়ে দিলেন- তিনি ভালো নেই।
সাহিদা বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়ায় না।কালকেও ও দুটো শুকনো ছিল,আজও আছে।দু-আঙুলের মাথায় মমিন শেখের চোখ বেয়ে পড়া পানিটুকু মুছে নিলেন তিনি।শান্ত গলায় প্রশ্ন করেন,
” কাঁনদেন ক্যান? কাঁন্দার কিছু হয় নাই।”

মমিন শেখের জ্বিহ্বা ভারী।কয়েক টন ওজনের জ্বিভটাকে নেড়ে কথা বলতে পারেন না।কেবল মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো অদ্ভুত শব্দ করেন।তার সাধ্য এখন এতটুকুই।

“ভূমি কইলো, ডাক্তারে কইছে আপনের স্টোক নাকি টেনশনের থেকা হইছে।আপনের ডায়বেটিস, পেশার বা এই জাতীয় কোনো সমস্যা নাই।সমস্যা যে নাই এইটা তো আমিও জানি।আপনের তো কখনো ভারী কোনো রোগ হয় নাই।এতো বছরের রোগ সব এখন হানা দিছে।সূচির বাপ, কী নিয়া এতো টেনশন করছেন আপনে? কালকে বিকালেও দেখছি। জিগাইলাম,কাজের কথা কিছুই কন নাই।কইছেন যতো আকামের কথা।কালকেও যদি সব খুইল্লা কইতেন তাইলে এতোকিছু হইতো? চিরকাল আপনে এমন।এই বুড়া বয়সেও আমারে এতো কষ্ট দিতে মন চায়?”

কথা বলতে না পেরে গোঙানির মতো গলায় অদ্ভুত শব্দ করলেন মমিন শেখ।পাশ দিয়ে একটা নার্স হেঁটে যাচ্ছিলো।শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায়।সাহিদা বেগমকে ডেকে বলে, ” চাচী কোনো সমস্যা?”

” না।কথা কইতে পারে না তো তাই।”

” আচ্ছা।”

ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে চলে গেল নার্সটা।সাহিদা বেগম আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেন।সাবধানে,ধীরে মাথাটা পেতে দিলেন স্বামীর বুকের উপরে।নজরে নজর মিলিয়ে বলেন, ” ব্যাথা পান? বেশি ভার দেই নাই।একটু ব্যাথা পাইলে কিছু হইব না।একটা গোপন কথা কই আপনেরে।গোপন কথা কইতে হয় চুপে চুপে।আমি বেশি জোরে কমু না।আপনে মনোযোগ দিয়া শুনবেন।”

একটা ঢোক গিলে সত্যিই ফিসফিস করে কথা শুরু করলেন সাহিদা বেগম।
” কালকে রাইতে যখন খাওন খায়া পিছনের বারিন্দায় শুইলেন তহনই আমার কলিজায় কেমন একটা কামড় দিলো।নিষেধ করতে চায়াও করি নাই।কারণ আপনে তো কখনো আমার কথা শোনেন না।শুইতে গেছি কিন্তু ঘুম আহে না।সাড়ে দশটার একটু আগে চোখটা লাইগা আইলো,হঠাৎ কইরা খুট খুট শব্দ শুনলাম। তাড়াতাড়ি কইরা উইঠা মাঝের ঘরে ঢুকার সময়ে দেখি আপনে পিছের বারিন্দার দরজা খুইলা মাঝের ঘরে আয়া দাঁড়াইছেন।খাটের তলা থেকা বিকালের দাওটা নিতাছেন।আমি কিন্তু চুপ কইরা দাঁড়ায়াই আছিলাম।তহন কিছু বুঝি নাই কিন্তু তবুও কেমন যেন লাগতাছিলো।আপনেরে আমি বুঝাইতে পারুম না।কের লেগা যে আপনেরে কিছু জিগাই নাই তা এখনো বুঝি না।আপনে এতোই অমনোযোগী আছিলেন যে আমারে দেখলেনই না।আমার চোখের সামনে দিয়া সুপারি বাগানের মাঝ দিয়া আপনে গেলেন গা।ঘরে আইসা বেকুবের মতো বইসা রইলাম।বিছনায় বইসা রইলাম আপনের আশায়।আপনে আইলেই আপনের লগে কথা কমু।কিন্তু আপনে তো আর আহেন না।বইসা থাকতে থাকতে কখন শুইয়া ঘুমায়া পড়লাম তা আর বুঝি নাই।হঠাৎ কইরা রাইতে ঘুম ভাইঙ্গা গেল,তাড়াতাড়ি কইরা পিছনের বারিন্দায় গেলাম।যায়া দেহি পইড়া রইছেন।কহন পড়ছেন তা জানি না। কিন্তু আপনেরে দেখার লগে লগে মনে হইল আসমানটা আমার মাথায় ভাইঙ্গা পড়ছে।ক্যান করলেন এমন?”

কথার শেষে লেজুড়ের মতো একটা নালিশ জুড়ে দিলেন সাহিদা বেগম।মমিন শেখের চোখে বৃষ্টি নেমেছে।এখন আর গলায় কোনো শব্দ করছেন না।চুপচাপ ঘোলা চোখে চেয়ে আছেন।

” আমার সূচি কি আর কোনোদিন ফিরা আইব? ক্যান এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে গেলেন কন তো? সূচি মরার পর থেকাই আপনে খুব টেনশন করেন।ক্যামনে প্রতিশোধ নিতে পারবেন তাই ছিল আপনের চিন্তা।এই কয়েকদিন ধইরা যে আপনে বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতেন তারও একটা কারণ খুঁইজা পাইছি আমি।আপনে নিশ্চয়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন,তাই না? ঐ অমানুষটার উপরে নজর রাখতেন।সবশেষে কালকে বিকালে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করলেন।এইখানেও চিন্তা,পুলিশের চিন্তা ছিল মাথায়।বিকাল থেকা খালি চিন্তা করছেন আপনে জেলে গেলে আমি ক্যামনে থাকুম।তাই না? আমার তো মনে হয় বিকালের জ্বরটাও এই টেনশন থেকা আইছে।আচ্ছা,টেনশনে কি মাইনষের জ্বর আসে?”

স্বামীকে কোনোদিন এতো কাঁদতে দেখেননি সাহিদা বেগম।চোখের কোল বেয়ে দরদর করে নামা পানির স্রোত দেখে ভিতরে কাঁপন ধরে।মুখের উপরের নেকাব তুলে লোকচক্ষুর আড়ালে টুপ করে একটা চুমু খেলেন মমিন শেখের বুকে।

” কলতলায় নিয়া দাওটা আমি নিজের হাতে ধুইছি। কালকে রাইতে সবার আগে ঐটা লুকাইছি।আল্লাহ ছাড়া কেউ কিছু দেখেও নাই,টেরও পায় নাই।অমানুষের একেক ফোঁটা রক্ত ঠিক কাঁটার মতো ফুটছে আমার হাতে।আর টেনশন কইরেন
না।আপনের এইটুকু পাপ যদি মাইনষের চোখের আড়াল করতে না পারি তো ক্যামন বউ হইলাম?
জেলে যাওয়ার চেয়ে বিছনায় পইড়া থাকা ভালো।বিশ্বাস করেন আপনেরে দেইক্ষা আমার একটুও কষ্ট হইতাছে না।আপনেরে যদি পুলিশে ধইরা নিতো তাইলে আমি মনে হয় মইরাই যাইতাম।যেমনেই থাকেন আমার চোখের সামনেই থাকেন।মাইয়া হারাইছি কিন্তু আপনেরে হারাইলে আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারুম না।সুস্থ হওয়া লাগব না,আপনে আমার চোখের উপরে শুধু বাঁইচ্চা থাকেন সূচির বাপ।”

কাল রাত থেকে জমিয়ে রাখা এক সাগর অশ্রুর এক ফোঁটা টুপ করে ঝরে পড়লো মমিন শেখের বুকের উপরে।সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি নেই।তাই বউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদেন তিনি।আজ তাদের কান্না দিবস।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here