শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৬

0
201

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব–৬
#হালিমা রহমান

আজকের আবহাওয়াটা কেমন যেন।বাতাসহীন গুমোট পরিবেশে পাতা দোলা বন্ধ।ভ্যাপসা গরমে অন্যরকম একটা অস্বস্তি জাগে শরীরে।বিষন্ন হাওয়ার ভাব-গতি দেখে বোঝার উপায় নেই এতোদিন এই জায়গাটাই বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টিতে মুখরিত ছিল।বিশাল অন্ধকার উঠোনে পা দিতেই ভিন্ন একটা ভয়ে গা শিরশির করে উঠলো রোমেলা বানুর।বারো-তেরো বছর বয়স থেকে এ বাড়িই তার ঠিকানা।গাছগুলো হাতে বোনা।হাতে গড়া পরিবেশটাই আজ বড্ড অচেনা,অজানা। ঠিক স্বস্তি জাগছে না এখানে। গা ছমছমে ভয়ে শিউরে উঠছে পা থেকে মাথার তালু অবধি।
উঠোনটা অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো, যেমনটা কাল সন্ধ্যায় ছিল।কুমড়োফালি চাঁদও আজ খুব কিপ্টে।কিছুতেই এই অভিশপ্ত বাড়িতে আলো দেবে না।মায়ের হাত শক্ত মুঠিতে পুরে নিকষ কালো আঁধারের বুক চিড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললো ফয়সাল,যেমনটা কাল গিয়েছিল।শুধু পার্থক্য হচ্ছে কাল মুঠিতে ছিল বউয়ের হাত,আজ মায়ের হাত।কাল পৃথিবীটা চেনা ছিল,আশেপাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষ ছিল।আজ কেউ নেই।সে নেই,মামা নেই,গ্রামের মানুষ নেই।হয়তো অপরাধের কথা শুনলে বন্ধু-বান্ধবেরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে।অদ্ভুত! মাত্র চব্বিশটা ঘন্টার এপাড়-ওপাড়ের ফয়সাল আগাগোড়া ভিন্ন।আজ ওর পাশে এক মা ছাড়া আর কেউ নেই।কালকের মতো আজকেও উঠোনের লাইট জ্বালানো হয়নি।সামান্য একটা সুইচ টেপার মানুষও নেই।গোয়ালঘরের কাছে আসতেই গরু দুটোর আকস্মিক চিৎকারে আঁতকে উঠলেন রোমেলা বানু।মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই নিজ নিজ স্বরে ডেকে উঠেছে ওরা।মনিবের কান্ডজ্ঞানহীতায় হয়তো ক্ষুব্ধ এরা।কাল সকালে সেই যে সূচি খাবার দিয়েছিল এদেরকে, এরপর থেকে এক গামলা পানিও আর দেওয়া হয়নি।ভুসি নেই,ভাতের মাড় নেই, হয়তো কাঁচা ঘাসও শেষ।ক্ষুধার যন্ত্রণা এদের কন্ঠ ফুটে বেরোচ্ছে যেন।
কোনোদিকে একটুও নজর না দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকলো ফয়সাল।দরজায় তালা দেওয়া ছিল না,হাট করে খোলা ছিল।সুইচ টিপে লাইট জ্বেলে দিল।নজরে এলো বসার ঘরের চিত্র।রোমেলা বানুর বহুল ব্যবহৃত সোনালী রঙা পানের কৌটাটা গড়াচ্ছে একদিকে।কালকে সন্ধ্যায় পানিতে ভেসে গিয়েছিল ফ্লোরের একাংশ।আজ অবশ্য পানি নেই, শুকিয়ে গেছে।সোফার কুশনগুলো কালকের মতোই ছড়ানো-ছিটানো।কালো ফ্লোরের এমাথা-ওমাথা লম্বা লম্বা জুতোর ছাপ।বৃষ্টির দিন,জুতোর তলায় কাদা ছিল।এখানে-ওখানে কাদা ছড়িয়ে আছে।কাদার দাগ চলে গেছে দরজা পেরিয়ে ভিতর অবধি।বোঝা যাচ্ছে এক দল ক্ষুব্ধ মানুষ আসামীকে খুঁজতে এসেছিল।দরজা খোলা পেয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে চিরুনি তল্লাশি করে গেছে।ফয়সালের ভাগ্য ভালো ওরা ওকে পায়নি।

” ওরা আমাকে খুঁজতে এসেছিল আম্মা।সূচির আব্বা আমাকে সামনে পেলে নিশ্চিত জবাই দিতো।”– ফয়সালের নির্বিকার কন্ঠ, সহজ ভাব-ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি মাত্রাতিরিক্ত সরল।সূচির মৃত্যুর কথা শোনার পর থেকে মনটা কেমন করছিল রোমেলা বানুর।ছেলের কথা শুনে ভয় বাড়লো চক্রবৃদ্ধি হারে। ফয়সালটাও আজ অচেনা খুব।
সোফার এক কোণে আঙুল হেলিয়ে নির্দেশকরলো ফয়সাল।

” কাল ঠিক এসময়ে ও এখানে পড়েছিল আম্মা।আমিই ফেলে দিয়েছিলাম।শক্তি খাটিয়ে মেরেছি খুব।তালাকও দিয়েছি।তুমিই তো কাল বিকালে বলেছিলে।অবশ্য তুমি না বললেও দিতাম।আমার একটু শান্তি দরকার ছিল খুব।অসভ্য মেয়েটা সবসময় অভিযোগ করতো ও শান্তি পায় না এই সংসারে।একটু শান্তি চাইতো ও।কিন্তু তুমিই বলো তো শান্তি কি আমার কাছেই ছিল? তোমরা দুজন আমাকে কখনো ভালো থাকতে দিয়েছো?”

ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে ফয়সালের কন্ঠ।এই কন্ঠ অপরিচিত।এই চব্বিশ ঘন্টার ধকল একদম ঘেটে দিয়েছে ছেলেটাকে।রোমেলা বানু কথা খুঁজে পেলেন না।ছেলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন, ” তুই একটু খায়া ঘুমা বাপ।”

” আমাদের এই ভিটেটা খুব অভিশপ্ত আম্মা।এখানে কেউ শান্তি পায় না। প্রথমে দাদা,এরপরে বাবা, এরপরে আফজাল ভাই আর সবশেষে আমি।একটা পুরুষও শান্তি পেল না।যে এই ঘর থেকে বেরিয়েছে সেই বেঁচেছে।পাশেই আফজাল ভাইয়ের কুঁড়েঘর। আমি থাকি দালানে,ভাইয়া থাকে টিনের ঘরে। তবুও দেখো তো তার কত সুখ! দূর দেশে বসেও কি সুন্দর বউ নিয়ে সংসার করছে।অথচ আমি! আজ আমার কিছুই নেই।না আছে আত্মীয়,না আছে বউ আর না আছে সংসার। একে কী বলে আম্মা? দুর্ভাগ্য?”

ভীষণ ক্লান্ত দেখায় ফয়সালকে।আজ সারাটাদিন দু-পায়ের দশটা আঙুলের উপর আর মনের জোরের উপরে ভর করে চলেছে।আর পারছে না।শরীরও চলে না,মনের মাঝেও আর ছিটেফোঁটা জোর নেই।দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব।একটা শান্তির ঘুম দরকার খুব।দুর্লভ শান্তির ঘুম, যার দেখা বহুদিন মিলেনি।নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগে আবার কথা বললো মায়ের সাথে,

” ভেবেছিলাম আমার রাগ-গোস্বা কিছুই নাই। এতোদিন জানতাম তোমার আদেশই সব।তোমার কথার উপরেই নির্ভর করে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা,সাধ-আহ্লাদ। ভাবতাম আমার মেরুদন্ড নেই।তোমার কথার বাইরে তাই এক পা-ও নড়তে পারব না।কাল বুঝলাম এই ভাবনাগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।কালকেই বুঝলাম আমারও রাগ আছে,ভালো থাকার ইচ্ছে আছে,নিজের কথা ফলানোর ক্ষমতা আছে,অধিকার আছে।বিয়ের পরপরই যদি নিজের এই ক্ষমতাগুলোর কথা জানতাম তো এতো অশান্তি হতো না।সারাদিনে আমার আফসোস হয়নি।কিন্তু এখন হচ্ছে।সংসারের রাশটা তোমার হাতে না দিয়ে যদি নিজেই টেনে ধরতাম! যদি সবসময় নিজের মতো চলতাম! খুব ভালো হতো, তাই না?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কোঁকড়া চুলগুলোকে ডান হাতের শক্ত মুঠোতে আঁকড়ে ধরলো ফয়সাল।তারপর সহসা চোখ-মুখ খুব কঠিন করে বললো,
” আমার উপরে আর কখনো ভুল করেও কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না আম্মা।জীবন আমার,রুচি আমার,ইচ্ছা আমার,চাহিদা আমার,সিদ্ধান্তও আমার।তাই আজকেই বলে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আর কখনো আমার কোনো সিদ্ধান্ত তুমি নিয়ে দেবে না।আমি সেটাই করব যেটা আমার ইচ্ছা।আরেকটা কথা,আমাকে রাগিয়ে দিও না আম্মা।রাগলে আমি মানুষ থাকি না,জানোয়ার হয়ে যাই।নমুনা তো দেখলেই।রেগে গেলে আমি মানুষ খুন করতে পারি।তাই সাবধান।”

রোমেলা বানু মানুষ হিসেবে খুব কর্তৃত্বপরায়ন।এ শুধু তার স্বভাব নয়, এ তার অস্তিত্ব। এই এক কারণে সুখ হয়নি এ সংসারে।একসাথে থাকতে পারলো না হুমায়রা,চলে যেতে হলো সূচিকে।আজ সেই অস্তিত্বের গায়েই ঘা মেরে বসার ঘর ছাড়লো ফয়সাল।সে আজ ভিন্ন মানুষ।বাধন হারা, অবাধ্য,শক্ত-পোক্ত পুরুষ।গলা উঁচিয়ে তার দুঃসাহসের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাধ্য কোথায়?

ঘরটা গোছানো। কাল সকালে অন্তু যাওয়ার পরে সূচিই গুছিয়েছিল নিজ হাতে।নিজের চোখে দেখেছে ফয়সাল।খামারে যাওয়ার আগে দুজনে মিলে ছিল এই ঘরে।একান্ত নিরিবিলিতে,মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। জানালার পাল্লা হা করে খোলা।বাইরে তাকালে কেবল তারায় ঘেরা আকাশ আর ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়ানো উঠোনের কাঁঠাল গাছের অবয়বটা বোঝা যায়।ঘরে টাঙানো দড়ির উপরে সূচির পরশু দিনের লাল সুতি শাড়িটা মেলে দেওয়া।পাশেই নিতান্ত অবহেলায় ঝুলছে গামছাটা।বৃষ্টির দিনে ভেজা কাপড়গুলো ঘরেই মেলে দিতো।পরশু দিনেও মেলে দিয়েছিল।শুকনো শাড়ি ভাঁজ করে ওয়ারড্রবে তোলার সুযোগ পায়নি।ড্রেসিংটেবিলের উপরে সবসময়ের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা চিরুনি,চুলের কাঁটা,পাউডার, স্নো,ক্লিপ,মেয়েদের সব হাবিজাবি জিনিস।চিরুনির গায়ে জড়ানো ছেঁড়া চুলগুলোও ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেখল ফয়সাল।দেখে আর দেখে- যেন পৃথিবীতে এটাই এখন অষ্টম আশ্চর্য। দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ ঘুরিয়ে সারা রুমটা দেখে।এ ঘরের দেওয়ালগুলোও অনেক কিছুর সাক্ষী।কিছু তিক্ত-মধুর স্মৃতি,কিছু অভিমান,কিছু অভিযোগ আর কিছু উদ্দাম ভালোবাসা–এই তো।ওয়ারড্রব, বেডসাইড টেবিল,ড্রেসিংটেবিল, বিছানা এমনকি ফ্লোরের দিকে চেয়ে হঠাৎ খুব হাহাকার জেগে উঠলো তার মনে।প্যান্টের পকেটটা ভারী ঠেকছে খুব।হাত চালিয়ে চার ভাঁজ করা কাগজটা বের করলো।ধীরে ধীরে মেলে ধরলো কাগজটা।সকালে ইশতিয়াক পড়েছিল,এখন ও পড়লো।আগাগোড়া পুরোটা পড়লো।পিঁপড়ার মতো ছোট ছোট অক্ষর, খুবই বাজে লেখা।তবুও কষ্ট করে পুরোটা পড়লো।এই সেই চিঠি,সূচির চিঠি।সকালে ইশতিয়াক ভুল করে ফেলে গিয়েছিল।পালানোর আগে ফয়সাল পকেটে নিয়ে নিয়েছে।নিয়েছিল প্রমাণ লোপাটের জন্যে।এখন সেই প্রমাণটাই দু-তিনবার পড়লো।কয়েকবার পড়ার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ভাঁজ করে ফেললো চিঠিটা।ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার খুলে পুরোনো কাপড়-চোপড়ের নিচে খুব গোপনে লুকিয়ে ফেললো চিঠিটা।কিছু স্মৃতি থাকুক একান্ত গোপনে।একটি শেষ স্মৃতি।
লাইট নিভিয়ে এক লাফে খাটে উঠে বসে পড়লো জানালা ঘেঁষে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চেয়ে রইলো দূর আকাশে।পরিচিত শুকতারা আর চাঁদ বাদে সব অচেনা।চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করলো মনে মনে, ” আর কেউ না জানলেও তুমি জানো খোদা।তোমার কসম, আমি বিচ্ছেদ চেয়েছি কিন্তু তার মৃত্যু চাইনি।ভুল করেও কখনো চাইনি।”
________________________

” তুমি এখনো বাসায় যাওনি? তুমি কি পাগল হুমু?”

” হ, পাগল।আমি তো আপনেরে সকালেই কইছি আমি আর কাজী বাড়িতে যামু না।যামু না মানে যামুই না।”

” এরকম পাগলামি করে না লক্ষ্মী।বাড়িতে যাও।আমি দূরে থাকি, এরকম টেনশন দিলে চলে? তুমি জানো না সারাটাদিন আমার কীভাবে কেটেছে।আমার ছটফটানি দেখে বস আজ ছুটি দিয়েছে।ইচ্ছে করছে উড়াল দিয়ে চলে আসি।ফয়সালের ফোনটাও বন্ধ।এতোগুলো কল করলাম ধরলোই না।”

ভূমির কেবিনের সামনের করিডরে চেঁচিয়ে উঠলো হুমায়রা।
” মাইয়াডারে মাইরা আপনের ভাই পলাইছে।একটা জানোয়ার জন্মাইছে ঐ বাড়িতে।শোনেন আর কোনো কথা না।আজকে সূচির গায়ে হাত তুলছে কালকে আমার গায়ে হাত তুলব।এমনেই আপনের মা আমার উপরে চ্যাতা।আমি কোন সাহসে ঐ বাড়িতে পাও দিমু?আপনেই কন।আমার কি ভয় করে না? হেরা একবার মাইরা সাহস পাইছে।নিশ্চিত থাকেন আমার গায়েও হাত তুলব।”

” ছিঃ! এসব কী কথা? তুমি এতোদিন ছিলে না?”

” হ আছিলাম।সূচিও আছিলো।কিন্তু আজকে আর নাই।মইরা গেছে নদীতে ডুইব্বা।বুঝতে পারেন কিছু?একটা মাইয়া আপনেগো বাড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যা করছে।একরত্তি একটা মাইয়া।আপনে ওরে চোখে দেখলে বুঝতেন।”

বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো হুমায়রা।মনের পাতায় খেলে গেল সব স্মৃতি।সূচির বিয়ের পর থেকে গত চারটে মাসে খুব মিল ছিল দুজনের মাঝে।এখনো আছে শুধু ভাব জমানোর মানুষটা নেই।
বউয়ের বিকৃত কন্ঠে চঞ্চল হয়ে উঠলো আফজাল।দূর দেশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সাধ্য নেই।বউকে চেনে খুব।ও যাকে ভালোবাসা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে জানে।তাই ধাক্কাটা ঠিক কতখানি লাগলো তা জানা আছে।সুদূর মালয়েশিয়া বসে যথাসাধ্য চেষ্টা করলো বউকে সান্ত্বনা দেওয়ার,
” কেঁদো না হুমু।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি আসছি আগামী মাসে।এবার যেয়ে সব ঠিক করে দেব।ফয়সালকে কঠিন শাস্তি দেব।কাঁদে না লক্ষ্মী,এভাবে কাঁদলে তপ সব ঠিক হয়ে যাবে না।বাড়ি যাও সোনা,তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।আমার কথা শোনো প্লিজ।”

তেতে উঠলো হুমায়রা।গলা শক্ত করে বললো, “হাসপাতাল থেকা বাইরায়া আমি আমগো বাসায় যামু।কাজী বাড়িতে ভুলে যামু না।আপনেগো বংশরে আমার আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই।বাড়িতে যাওয়ার কথা আর বলবেন না।খবরদার।”

কল কেটে কেবিনে ঢুকতেই নজর পড়লো ভূমির উপরে।ঘুমাচ্ছে চুপচাপ।চোখের কোল এখনো ভেজা।বাম গালে পানির শুকনো দাগ।অপারেশনে ঝামেলা হয়নি,মেয়েটা সুস্থই আছে।অবশ্য তা কেবল শরীরের ব্যাপার।মনের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা তা আল্লাহ মালুম।কেবিনে দেওয়ার পর থেকেই কেবল কাঁদছে।বিলাপ করছে না,হাহাকার করছে না,বুক চাপড়াচ্ছে না।শুয়ে শুয়ে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে শুধু।মাঝে মাঝে ফোপাঁচ্ছে। আবার ঠোঁট টিপে বন্ধ করে ফেলছে আওয়াজ।এই চলছে সারাটাদিন।
ইশতিয়াক বাবুর পাশে বসা।চোখে উদভ্রান্তের দৃষ্টি, মুখে কথা নেই।বউকে থামায় না,সান্ত্বনা দেয় না।শুধু কিছুক্ষণ পরপর ভূমির এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দেয় আর তোয়ালেতে প্যাঁচানো একটা পুতুল ছানার দিকে চেয়ে থাকে।সর্বত্র একটা নিঃশব্দ শোক।বাচ্চাটাও ঘুমাচ্ছে।মায়ের মতোই ঠোঁট টিপে,চোখ বুজে ঘুমাচ্ছে।

” লতিফ ভাই কই ইশতিয়াক ভাই?বাসায় যাইব না?”

” যাবে।একটু নিচে গেছে।আপনিও কি লতিফ ভাইয়ের সাথেই যাবেন আপু?”

” হ ভাই।রাইত হয়া যাইতাছে।যাইগা এহন।আবার কালকে সুযোগ পাইলে আসুমনি।”

” আচ্ছা।”

আচ্ছা বললো বটে তবে মুহূর্তেই মুখের রঙ উবে গেল ইশতিয়াকের।মনের কোণে জোর খুঁজে পাচ্ছে না।সত্যি বলতে আজ হুমায়রা ছিল বলে এতোক্ষণ খুব সাহস ছিল মনে। কিন্তু এখন ভয় হচ্ছে।মেয়েলি অসুখ-বিসুখের সাথে পরিচিত নয় ও।আনাড়ি মানুষ কীভাবে কী করবে তা জানা নেই।বাচ্চার দিক দিয়েও এক ধাপ এগিয়ে সে।কোলেই তুলতে পারে না, এমনই আনাড়ি সে।মাঝে মাঝে ভয় হয়।মনে হয় যেন ছেলেটার শরীরে হাড়গোড় কিছু নেই।হাড় ছাড়া থলথলে মাংস নিয়ে জন্মেছে শুধু।হাতে নিলেই গলে পড়ে যাবে,এমনই নরম ছানাটা।রাতে কোনো সমস্যা হলে কীভাবে কী করবে ও? বাচ্চা কাঁদলে কোলে তুলবে কীভাবে? কোলেই তো নিতে পারে না এখনো।অথবা যদি ভূমিই কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যায়! তখন? কী করবে? বউ না বাচ্চা, কাকে সামলাবে? চিন্তার মাঝে থই পায় না ইশতিয়াক। সত্যি বড়ই দুর্ভাগা ও।

” বাবু কি হিসু করছে ইশতিয়াক ভাই?”

” না,দেখলাম মাত্র।”

” ভূমির কাপড়-চোপড় আনছেন কিছু?”

” না, সময় কোথায় পেলাম?”

” তাইলে লতিফ ভাইয়ের সাথে যায়া নিয়া আসেন।টাকা-পয়সাও তো আনেন নাই বেশি।নিয়া আসেন সব।আসার পথে একটা কাজলও আইননেন।বাবুর ভ্রু ছাড়া ভাল্লাগতাছে না।

” আমি গেলে থাকবে কে আপু? যাওয়া তো দরকার কিন্তু উপায় নেই।”

” আপনে যান,আমি আছি।ভাবতাছি আজকে থাকুম।আপনে একা ক্যামনে কী করবেন? এহনকার নার্সগুলির ব্যবহারও খুব একটা ভালো না দেখতাছি।সকালেরগুলি ভালো আছিলো।সমস্যা হইলে সামলাইতে পারবেন না।চিন্তা কইরেন না,আমি আছি।”

অভয় দিল হুমায়রা।ইশতিয়াকের চিন্তিত মুখ দেখেই হয়তো মায়া জেগেছে মনে।এখানে থাকার দায়বদ্ধতা নেই,প্রয়োজন নেই।কিন্তু প্রয়োজনই কি সব? মানবিকতা বলতেও একটা শব্দ আছে।মানুষ সবসময় একে এড়িয়ে যেতে পারে না।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ইশতিয়াক।বুকের উপর চেপে থাকা ভয়ের পাথরটা নামলো।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কৃতজ্ঞতায় উঠে দাঁড়াল।চরম খুশিতে, পরম কৃতজ্ঞতায়, স্বস্তিতে ভিতর থেকে উপচে আসা চোখের জল ঠেলে বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো,
” আমি আপনার ঋণ কখনো ভুলব না আপু।কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।তাই ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না।শুধু দোয়া করি আমার নিষ্পাপ ছেলেটা যেন আপনার মতো বিশাল একটা মন আর অগাধ মনের জোর পায়।”

আর কিছু বলতে পারলো না সে।কৃতজ্ঞতায় ঠেলে আসা কান্না ঠেলতে ছুটে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
_______________________

সময়টা শেষ রাত।আশেপাশে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা।চূড়ান্ত নিঃশব্দে টিনের ও-ধারের মানুষের নিশ্বাসের শব্দ কানে আসছে।যেন ধাক্কা দিচ্ছে পুরোনো টিনের গায়ে।কানের কাছে বিরক্তিকর মশার ঘ্যানঘ্যানানিতে উঠে বসলেন মমিন শেখ।সূচির ছোট্ট রুমের ছোট্ট জানালাটা খোলা।রাজ্যের মশা ঢুকেছে ঘরে।এতোক্ষণ মেয়ের অব্যবহৃত খাটে জবুথবু হয়ে শুয়ে ছিলেন মমিন শেখ।সেই কোন সকালে ঢুকেছিলেন এই ঘরে,আর বের হননি।মাঝখানে একবার রায়হান এসে জোর করে খাইয়ে গেছে।এরপরে কোনদিক দিয়ে বেলা গেছে,কোন দিক দিয়ে রাত এসে চলে যাচ্ছে তার খবরই ছিল না।বসে থাকতে থাকতেই কখন ঘুমিয়ে গেছেন তাও অজানা।
চোখ মেলেই আবিষ্কার করলেন ঘরে কবরের অন্ধকার।হাওয়া আছে একটু একটু কিন্তু আলোর ছিটেফোঁটা নেই।হাতড়ে হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে চুপচাপ বসলেন।এঘরে সূচি নেই আজ অনেকদিন যাবৎ।আজও নেই।কিন্তু আজকের সাথে এতোদিনের নেইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।সূচির টেবিল, টেবিলের উপরের একগাদা পুরোনো বই,আলনা ভর্তি কাপড়,খুঁটিতে ঝোলানো আয়না,এমনকি টেবিলের উপরে বিছানো লাল রেক্সিন— সব যেন আজ জীবন্ত।চোখ মেলে কী এক অভিযোগে মত্ত সবাই।এক নিশ্চুপ অভিমানে হা করে গিলে ধরছে মমিন শেখকে।দম আঁটকে আসে তার।বুক জ্বালাপোড়া করছে।শিরায় শিরায় রক্তের সাথে ঢল নেমেছে মেয়ে হারানোর যন্ত্রণার।মেয়ের ঘরে থাকতে পারলেন না মমিন শেখ।দম নিতে বেরিয়ে এলেন বাইরে।ছুটে গেলেন স্ত্রীর কাছে।তাদের শোবার ঘরের খাটে শুয়ে আছেন সাহিদা বেগম।আজ সারাদিন শুয়েই ছিল।কখনো জ্ঞান ছিল,কখনো ছিল না।এখন ঘুমাচ্ছে।রায়হান কী যেন একটা ইনজেকশন দিয়েছে তখন, তার অবদানেই মুখ হা করে ঘুমাচ্ছেন তিনি।স্ত্রীর ফুলে উঠা বদ্ধ চোখের পাতা দুটো আরেক বিষাদ।স্ত্রীর ক্লান্ত চোখ-মুখও যেন আজ আঙুল তুলছে মমিন শেখের দিকে।সবার অভিযোগ একই,তার দোষেই মেয়ে মরেছে।তিনিই মেয়ের খুনী।কেন তিনি কখনো মেয়ের সুখ-দুঃখে আমল দেননি? কেন তিনি ঐ একটুখানি মেয়েটার কথা কোনোদিন শোনেননি? কেন সমাজের ঠুনকো লোক-লজ্জার ভয়ে তিনি মেয়ের পাশে দাঁড়াননি।দু-দুটো মেয়ে ছিল তার।আজ নেই।বড়টাও নেই,ছোটটাও নেই। এই না থাকার দুঃখটাই আজ হাড়ে হাড়ে বাজে।মেয়েদের না থাকার পিছনে কি তার একটুও অবদান নেই? নিজের সন্তানের চেয়ে রাগ-ক্ষোভ-লোকলজ্জা বেশি? কখনো না।এতোদিনের ভন্ডামি আজ এই শেষ রাতে চোখে পড়লো তার।ঘরের সংকীর্ণ গুমোট বাতাসে দম বন্ধ হয়ে এলো।ছিটকে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।দুয়ারে দাঁড়িয়ে হা করে শ্বাস নিলেন মাছের মতো।ভুরভুর করে একগাদা অক্সিজেন নিয়ে চেয়ে রইলেন আকাশের দিকে।বিশাল আকাশের শুকতারাটা চেনা খুব।সেদিকে চেয়েই রইলেন।এতোক্ষণের দমবন্ধ ভাবটা কমেছে।তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে অদ্ভুত এক প্রতিশোধস্পৃহা।রক্তে রক্তে বইছে রক্তের নেশা।হুট করেই তরুণ বয়সের সেই দুর্লভ তেজ ফিরে পেলেন।রক্তেরা টগবগ করে ফুটছে শরীরের ভিতর।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের সাথেই প্রতিজ্ঞা করলেন,
” খোদার কসম, আমি ওরে টুকরা টুকরা করুম।আমার মাইয়ার শরীরে যতগুলা দাগ ফালাইছে তার চেয়ে বেশি দাগ ফালামু ওর শরীলে।ওর মায়ের কোল খালি করুম। এতে আমি বাঁচি অথবা মরি,এর শ্যাষ দেইক্ষা ছাড়ুম।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here