শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৩

0
305

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-৩
#হালিমা রহমান

বিশাল আকাশে ঝুলে থাকা সূর্যের তাপ আজ অনেক।কুমড়ো ফুলের মতো ঝলমলে রোদ উঠেছে।এতোদিনের অবিরাম বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটিকে একদিনেই খরখরে শুকনো করার চেষ্টা।কাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছে।বোঁটা খসা আম আর ঝরা পাতার স্তূপের পাশে উঠোনে প্যাচপ্যাচে কাদা।সেই কাদা মাটির একধারে বসে আছে কেউ।কেউ কেউ আবার ময়লা মাটিতে না বসে বসেছে সূচিদের পুরোনো বারান্দায়,সিঁড়ির কোণে।জয়া,মনি, চম্পা,রত্না,লিলি,মনি ঘরের ভিতরে।কান্নার একঘেয়ে গুনগুনানি ভেসে আসছে ওখান থেকে।ঘরের সামনের পুরোনো খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন আলেয়া বানু।বুড়ো কালের সঞ্চিত শক্তি খাটিয়ে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বিলাপ করছেন।সূচির সাথে ওনার বনিবনা কোনোদিন ছিল না।ছিল দাদী-নাতনীর একটা খোঁচাখুঁচির সম্পর্ক।সূচিকে কথা শোনাতে ছাড়তেন না, আবার সূচিও বেয়াদবের মতো তর্ক না করে পারতো না।এরকম খাপছাড়া সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো এক কথা,বুড়ো বয়সে নাতনীর মৃত্যু সংবাদ সহ্য করা আরেক কথা।একই বংশের তারা।মমিন শেখের মা মারা যাওয়ার পর থেকে আলেয়া বানুই ক্ষেত্রবিশেষে ভূমি,সূচির দাদীর দায়িত্ব পালন করেছেন।সেদিনের সূচি,বলতে গেলে হাতের উপরেই মানুষ।অষ্টপ্রহর চোখের উপরে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানো,কথায় কথায় তর্কে জড়ানো মেয়েটাকে সবসময় বখে যাওয়া উশৃঙ্খল মনে হতো।মাস কয়েক আগে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার বেলায়ও ওতোটা কষ্ট হয়নি।বিশ্বাস ছিল,সূচি তো কিছুদিন পরপরই বেড়াতে আসবে।কিন্তু আজ? স্বামীর অত্যাচারে সেই উশৃঙ্খল মেয়েটাই ডুবে মরেছে, বারান্দার একাধারে তার পরনের আধোয়া ধূসর রঙা শাড়িটা পড়ে আছে।ধীরে ধীরে পানি শুকিয়ে মাটির মতোই খরখরে হচ্ছে তা।শাড়ির দিকে নজর বুলিয়ে আরেকবার উচ্চস্বরে বিলাপ করে উঠলেন আলেয়া বানু, ” আমার বুবু গো,না জানি কত কষ্ট পায়া মরছে! শাড়িটা যহন শইল্যে প্যাঁচাইছে তহন ক্যামন লাগছে আমার সোনার? ভরা মেঘনার পানিতে ক্যামনে আছিলো?কত কষ্টে মরছে গো!তুমি যহন নিবাই তহন এতো কষ্ট দিয়া ক্যান নিলা খোদা? আরেকটু সহজ মরন দিতা।আমার এট্টুখানি নাতনী,আমার ছোট্ট সূচি।ও মমিন,ও রায়হান,ও লিলির বাপ, তোরা আরেকবার খুঁইজ্জা দেখ।আমার সূচি মরে নাই,আমারে থুইয়া আমার নাতিন যায় নাই।সূচিরেএএএ……

ঘরের ভিতরে কারা যেন সূরা ইয়াসীন পড়ছে।চিনচিনে গলার একটা মিষ্টি সুর ছড়িয়ে পড়ছে সব ছাপিয়ে।আগরবাতি,গোলাপ জলের ভুরভুরে গন্ধে মশগুল মরা বাড়ি।কারো মুখে হাসি নেই,কথা নেই।একটা আফসোস হৃদয় জুড়ে, লাশটা যদি হাতে পাওয়া যেতো!
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে চম্পাকে ডাকলো রায়হান।সে এতোক্ষণ বাইরে ছিল।তার চোখ দুটো ফুলে আছে,গলার স্বর ভাঙা।চম্পার অবস্থাও একই।ভাবি মহলের বুকেও তীব্র আর্তনাদ।সূচি ছিল তাদের আদরের ধন,অসমবয়সী সই।সহসা তার মৃত্যু সংবাদ মেনে নেওয়ার মতো মনের জোর তারা কোথায় পাবে?

” চম্পা,কাকির জ্ঞান ফিরেছে?”

” আগের মতোই।কতক্ষন পরেপরেই অজ্ঞান হয়া যায়।”

” মমিন কাকা?”

” কাকায় সূচির ঘরে যায়া যে ঢুকছে আর বাইরায় নাই এহনো।খাটের লগে ঠেস দিয়া বয়া আছে।”

” কান্নাকাটি করছে?”

” কাকি কান্দে,কাকায় কান্দে না।পাথরের মতো একদিকে চায়া আছে।”

” আচ্ছা,একটু খেয়াল রেখো।দর্জি বাড়ি থেকে আজকে দুপুরের খাবার পাঠাবে।একটু পরে সবাইকে বেড়ে-টেড়ে দিও।সকাল থেকে সবাই না খাওয়া।”

বউয়ের সাথে গুটিকয়েক কথা বলে চলে যাচ্ছিলো রায়হান,পিছন থেকে ভেসে আসা চম্পার আর্তনাদে পা থেমে গেল।চম্পার ভেজা কন্ঠে আকুল আর্জি,
” আরেকটু খুঁইজ্জা দেখেন না,এমনও তো হইতে পারে সূচি মরে নাই।”

বউয়ের চোখের কোলের পানি দেখে আবারও চোখ ভিজে এলো রায়হানের।চোখ ঘুরাতেই দৃষ্টি আটকে গেল সূচির শাড়িটাতে।কিছুটা রয়ে-সয়ে,কিছুটা সামলে বললো, ” আর লাভ আছে? আমাদের বোন সাঁতার জানতো না।”

জানা কথা,তাই চুপ করতে হয়।রায়হানের গলায় ফের শোনা যায় সান্ত্বনার বাণী, ” কেঁদো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

” সূচির মরা খবর মসজিদে কইব না?”

” না,আত্মহত্যার খবর মসজিদে বলে না।কাকির কাছে যাও।কিছু লাগলে ফোন দিও।”

বেরিয়ে গেল রায়হান।চোখের পানি মুছে আবার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মাটিতে অযত্নে পড়ে থাকা সূচির শাড়িটার দিকে নজর গেল চম্পার।নিচু হয়ে বসে চরম আদরে তা তুলে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।এই সম্বল,সূচির শেষ চিহ্ন।
ঢাকা যাওয়ার পথে বুদ্ধি করে শাড়িটা মেঘনার পানিতে ছুঁড়ে ফেলে ভালোই করেছে অন্তু।মেয়ের লাশ খুঁজে না পাওয়া হতভাগ্যেরা বুকে জড়িয়ে ধরার মতো কিছু একটা তো পেয়েছে।
_______________________________

সবকিছুর একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে।থাকে একান্ত আপন একরকমের পরিবেশ।হাসপাতালের গন্ধটা কেমন যেন।মাথা ধরানো,হৃদয়ে ভয় জাগানো।মেডিসিন না কীসের যেন এক উগ্র গন্ধ অনেক্ষণ আগেই তীরের মতো ঢুকে গেছে বুকের ভিতর।তারপর থেকেই একটা শিরশিরে যন্ত্রণা ছড়িয়ে যাচ্ছে সবটা জুড়ে।একটা চেনা ভয়,জানা অস্থিরতা।চরম মন খারাপের দিনে ঘোলাটে মাথায় চলে কেবল প্রিয়তমাকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা।
সকালের দিকে ভূমির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।জ্ঞান ফিরছিল না সহজে।দু-একবার যখনই চোখ মেলেছে,চিৎকার-চেঁচামেচি করতে করতে লাফিয়ে উঠতে চেয়েছে শুধু।ও সূচির কাছে যাবে।কাছে ছিল ইশতিয়াক। সে আটকাতে গেছে বলে বউয়ের দুর্বল হাতের কিল-ঘুষিও খেয়েছে।স্বামীকে গালাগাল করতে ছাড়েনি ভূমি।উদয়পুর হাসপাতালে রাখলো না ওকে।ছুটে আসতে হল ভোলায়।কিছুক্ষণ আগে আবারও জ্ঞান ফিরেছে ভূমির।মনে মনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ইশতিয়াক। এই বুঝি পাগলামি শুরু করে দেয়,এই বুঝি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ব্যাথা পায়,এই বুঝি ডাক্তার খারাপ খবর দেয়।সকাল থেকে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে এখন শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে গেছে দয়াময়ের নাম।সর্বশক্তিমান দয়াময় তাঁর বান্দাদেরকে ফিরিয়ে দেন না।বিপদ কাটলো।কালো মেঘ ভেদ করে যেভাবে সূর্যকিরণে উদ্ভাসিত হয় সবটা,তেমনি ইশতিয়াকের দুশ্চিন্তা কেটেও স্বস্তি এলো।ভূমি শান্ত হয়েছে।একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে,এখন আর পাগলামি করছে না।
আজকেই অপারেশন। ধাক্কা যখন একটা এসেছে তখন এর মাঝেই সব হয়ে যাক।মন শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বটে কিন্তু কথাটা মনে জাগতেই কেমন একটা ভয় পেয়ে বসেছে ইশতিয়াককে।ডাক্তার যখন কাটাকুটি করবে তখন কেমন লাগবে ভূমির? ইশতিয়াকের জীবনে নারী চরিত্রের দেখা মিলেছে কম।দেখার মাঝে এক দেখেছে মাকে, এক দেখছে বউকে।স্বাভাবিকভাবেই মেয়েলি ব্যাথা-বেদনা সম্পর্কে ওর ধারণা নেই। এ সম্পর্কে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই,পাশে বসে দুটো সান্ত্বনার কথা বলার কেউ নেই। এক ছিল হুমায়রা আর লিলির বাবা লতিফ।তারা দুজনে নিচে গেছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে।বাড়ি থেকে কিছুই আনার সুযোগ মেলেনি, তোয়ালে-টোয়ালে অনেক কিছুই কিনতে হবে।বউয়ের পাশে বসে থাকতে পারছে না ইশতিয়াক।ভূমির ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালেই ওর বুক ভাসিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

” আপনার ওয়াইফ আপনাকে ডাকছে।কিছুক্ষণের মাঝেই ওনাকে ওটিতে নেওয়া হবে।তার আগে একবার কথা বলে আসুন।”

মাঝ বয়সী নার্সটা ব্যস্ত স্বরে কথা বলে আরেক দিকে চলে গেল।এদের ব্যস্ততার শেষ নেই।সুস্থ-অসুস্থ,জীবিত-মৃত মানুষদের পাশে থাকতে থাকতেই এদের বেলা গড়ায়।
কেবিনের দরজায় পা রাখতেই চোখ পড়লো ভূমির উপর।চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।ঘামে ভিজে জবজব করছে গায়ের জামা।মুখের পেশিগুলোতে নেই টানটান ভাব।সারা মুখ জুড়ে ক্লান্তি,অবসন্নতা, বিষন্নতার ছাপছোপ।চুলের অবস্থা বিশ্রী।রুক্ষ চুলগুলোকে একদিকে পড়ে আছে অযত্নে।ঐ রুগ্ন, গোলগাল মুখটাই ইশতিয়াকের সবচেয়ে প্রিয়।

আলগোছে পাশে যেয়ে বসতেই টের পেল ভূমি।চোখ মেলে স্বামীর দিকে ক্লান্ত দৃষ্টি ফেলে বলল,
” এতো দেরি হলো যে আসতে?”

” কই দেরি হলো? দশ সেকেন্ডও লাগেনি।”

” ওহ,আমার কাছে মনে হলো আধ-ঘন্টা।”

হৃদয়ের সবটুকু আবেগ, ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে ডান হাতের পাঁচটি আঙুল ভূমির এলোচুলে গুঁজে দিলো ইশতিয়াক।সূচির মৃত্যুটা ভূমিকে কতখানি আঘাত করবে তা ওর খুব জানা আছে।তা নিয়েই যত ভয়। ভূমি মোটেও ব্যাথাকাতুরে মেয়ে নয়।মনের দিক থেকে ভেঙে না পড়লে হাজার যন্ত্রণা ওকে ভাঙতে পারবে না।সকাল থেকেই ভাবছে ইশতিয়াক।সূচির মৃত্যুর পিছনে ওর নির্লিপ্ততা কি একটুও দায়ী না?কাল ফয়সাল যখন সূচিকে জড়িয়ে নোংরা ইঙ্গিত দিয়েছিল,তখন কেন থমকে গিয়েছিল ইশতিয়াক? দুর্নামের আশঙ্কায় চুপ করে না থাকলেই চলতো।জোর করে বড় ভাইয়ের অধিকারে সূচিকে নিজের কাছে রাখলেই পারতো।মাত্র আঠারো পেরোনো সূচিটা তো ওর ছোট বোনের মতোই।বিপদকালে বড় ভাইয়ের মতো শক্ত হাতে ছোট বোনের দুর্বল হাত ধরলে কে কী বলতো? এখানে আর কী বলার আছে?

” শুনছো?”

” হুম”

” কথা রাখবে?”

” রাখব,একবার বলেই দেখো।”

” আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি বাঁচব না।”

শশব্যস্ত ভঙ্গিতে ভূমির মুখে হাত চাপা দেয় ইশতিয়াক।শক্ত কন্ঠে বলে, ” ছিঃ! এসব বলে না।ভয় পাচ্ছো? ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমরা আসার পরেও এখানে একটা অপারেশন হয়েছে।হাজার হাজার মেয়ে যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে আছে।তুমিও বাঁচবে।”

কথার মাঝে বাধা আসায় বিরক্ত হলো ভূমি।কপাল কুঁচকে বললো, ” কথার মাঝে কথা বলো না।আমি শুধু আমার ভাবনাটা বলছি।শোনো এবার,আমি যদি মরেই যাই তো কান্নাকাটি করবে না।আমার কিছু হলেই তুমি কাঁদো।এবারে কাঁদবে না।বাবুকে শক্ত হাতে সামলাবে।একা একা পারবে না জানি।কিছুদিন গেলে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। অবিবাহিত অথবা ডিভোর্সি, একটা ভালো মেয়ে হলেই চলবে।নতুন বউকে তুমি সহজে মেনে নিতে পারবে না।তাই বিয়ের সময় মেয়েপক্ষকে আগেই বলে নেবে,তুমি আমার বাবুর মা…

” চুপ করবে তুমি? কসম,আমি এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাব।আর কখনো তোমার মুখ দেখব না।”

” ছিঃ! রাগ করছো কেন? তুমি বলেছো আমার কথা রাখবে।তুমি বোকাসোকা মানুষ।আমি বুঝিয়ে না বলে গেলে কে বলবে তোমায়? আমাদের আর কে আছে?”

গলার ভিতরে কে যেন একটা হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে।আর কোনো শব্দ করতো পারলো না ইশতিয়াক। কেবল বউয়ের মুখের উপরে আলতো করে ডান হাতটা চেপে ধরে রাখল যেন ভূমি আর কথা না বলতে পারে।
কিন্তু চেষ্টাই তো সব নয়।ভূমিকে আজ কথার রোগে পেয়েছে। থামতেই পারছে না।মুখের উপর থেকে স্বামীর হাত সরিয়ে স্নিগ্ধ গলায় বললো, ” অতিরিক্ত ভালোবাসা ক্ষতিকর।এতো কেন ভালোবাসো?”

স্বামীর মলিন মুখ দেখে খানিক অনুতপ্ত হলো ভূমি।কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, ” আচ্ছা যাও, দরকারি কথা আর বলব না।একটু হালকা-পাতলা আবদার করি।আমি সুস্থ হলে কিন্তু আর উদয়পুরে ফিরব না।বুঝেছো?”

” কোথায় যাবে?”

” যেখানে তুমি নিয়ে যাবে।ভোলা, বরিশাল অথবা অন্য কোনো নতুন গ্রাম।”

” আচ্ছা।”

” বাপের ভিটা ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু বিশ্বাস করো,ঐ ঘরে ফিরলে আমি আর বাঁচব না ইশতি।রান্নাঘর,মাঝের ঘর,উঠোন,শোবার ঘর আমাকে খুঁচিয়ে মেরে ফেলবে।স্বার্থপরটা কালকে অনেক্ষণ ঐ ঘরে ছিল।”

স্বার্থপর বলতে যে কাকে বোঝানো হয়েছে তা বেশ বুঝলো ইশতিয়াক। মনে মনে অবাক না হয়ে পারে না সে।আদরের বোনকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার মতো মানুষ না ভূমি।তবে কি মেয়েটা হঠাৎ আসা শোকে পাগল হয়ে গেল?

” কী করে পারলো বলো তো? ওর চিন্তা-ভাবনা এতো নিচে নেমে যাবে তা আমি কোনোদিন ভাবিনি। কাল রাতে ও আমার কাছে এলেই আমি অসুস্থ হয়ে যেতাম! আর আমাকে ছেড়ে চলে গেলেই আমি সুস্থ থাকব! কি অদ্ভুত! একবার এসেই দেখত।আমি কি ওকে কোনোদিন ফেলে দিতাম ইশতি? কোনোদিন কটু কথা বলতাম? ওর মন না চাইলে পুলিশের কাছেও যেতাম না।আমার ছোট্ট সূচিকে বুকে আগলে চুপচাপ ঘরে পড়ে থাকতাম।ও তা করলো না।ও আসলে আমাকে কোনোদিন চিনতেই পারেনি।”

ভূমির দু-চোখ ছাপিয়ে উপচে পড়া নোনা সাগরের জল দু-আঙুলে মুছে দিলো ইশতিয়াক।হাতের উল্টো পিঠে গলা,নাক,মুখের ঘাম মুছে দিলো।

” এই দেখো,আমি আবার কাঁদছি।এতোক্ষণ নিজেকে বহুবার বুঝিয়েছি আমি আর কাঁদব না।একটা স্বার্থপরের কথা আর মনেই করব না।অথচ এখন দেখো! আমি আসলে জাত বেহায়া।”

” আরেকটু কাঁদো।”

” উঁহু, আর না।”

সত্যিই আর কাঁদলো না ভূমি।নোনাপানির দেখাও মিললো না আর।স্বামীর হাতটা দু-হাতে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইলো বিছানায়।কিছুক্ষণ পর আবার ফট করে চোখ মেললো।ইশতিয়াক চেয়েই ছিল ওর দিকে,চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো।

” এতোক্ষণ একটা কথা ভাবলাম জানো।
একটু ভালবাসার অভাবে কাল একজন মেঘনায় ডুবে মরলো।আর এদিকে আমি এতো ভালোবাসা পেয়েও বাঁচব না।আমাদের দু’বোনের ভাগ্য দু-রকম।আমি অঢেল পেয়েছি,ও একফোঁটাও পায়নি।আমরা কিন্তু একই মায়ের পেটের।অথচ দুজনের অমিল দেখেছো? অদ্ভুত না? তোমাকে ছেড়ে যেতেই আমার সবচেয়ে কষ্ট হবে।”

” আবার! ”

এতোকিছুর পরেও কেউ খিলখিল করে হাসতে পারে? ভূমি সত্যিই হেসে গড়িয়ে পড়লো।নুপুরের ঝংকারের মতো সুন্দর হাসির চোটে কেঁপে উঠলো ওর শরীর।কৌতুকে ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” তুমি এমন কেন? এতো কেন ভালোবাসো? তোমার মতো দুর্বল পুরুষ আমি আর একটাও দেখিনি। আমার চেয়েও বেশি দুর্বল তুমি। তোমার চেয়ে আমি বেশি শক্তিমান।”

অর্থহীন প্রলাপের শেষে আবার চোখ বুজলো ভূমি।ইশতিয়াক ঠায় চেয়ে রইলো ওর দিকে।এতোক্ষণের আশঙ্কা গাঢ় হলো।ভূমি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে।বউয়ের মুখে এরকম অসংলগ্ন কথা-বার্তা ইশতিয়াক কোনোদিন শোনেনি।বুকের ভিতরে অস্থিরতা আসন গেড়েছে।সারা শরীর থেকে চুইয়ে পড়ছে ঘাম। একমনে চেয়ে থাকতে থাকতেই বিষয়টা নজরে এলো।ভূমির শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি খুব ধীরে চলছে।বুকের উঠা-নামা এতোটাই অস্বাভাবিক যে খট করে চোখে বাজে।আঁতকে উঠলো ইশতিয়াক।চিৎকার করে ডাক্তার ডাকার কথা মাথায় এলো না। আলুথালু বেশে ভূমির দিকে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কাতর গলায় ফিসফিসিয়ে ডাকলো, ” ভূমি,ভূমি।”

” আছি, এখনি যাচ্ছি না।ভয় পেয়ো না।”

ভীত চোখে চেয়ে রইলো ইশতিয়াক।ভূমির চোখ দুটো আগের মতোই বন্ধ।কিন্তু ওর নরম দুর্বল হাত দুটো ইশতিয়াকের ডান হাতের উপরে চেপে বসেছে।দু-হাতে স্বামীর হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মরার মতো চুপচাপ শুয়ে আছে মেয়েটা। মরেনি এখনো,বোধহয় ঘুমানোর চেষ্টা করছে।কাল রাত থেকে ভূমি ঘুমাতে পারছে না।
_________________________________

” হ্যালো রায়হান ভাই”

” হুম বলো ইশতিয়াক। ভূমির কী খবর? অপারেশন শেষ?”

” না,চলছে।ওদিকের কী অবস্থা? সূচির লাশ কি পেয়েছো?”

” এ কি সম্ভব ভাই? নদীর স্রোত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তা কে জানে।”

” আফসোসে আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে রায়হান ভাই। মনে হচ্ছে আমার জন্যেই মেয়েটা মরেছে।কাল কেন আমি নিজের কাছে রাখলাম না ওকে? জোর করে রাখলে আর অঘটনটা ঘটতো না।”

অটো থেমেছে থানার সামনে।ফোনটা কানে চেপে ধরে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে ইশতিয়াককে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলো রায়হান, ” যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।এখন আর এসব বলে লাভ কী? মেয়েটার বয়স কম বলেই ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি।এখন যা করার তা আমাদেরকেই করতে হবে।কাকার হুশ-জ্ঞান নেই। আমি একাই এলাম থানায়।তোমাকে একটা দরকারে ফোন দিয়েছি ইশতিয়াক। সূচি নাকি একটা চিঠি লিখেছিল?”

” হ্যাঁ, ভূমির জন্যে ছিল ওটা।”

” চিঠিটা কোথায় এখন? তোমার কাছে?”

ওদিক থেকে উত্তর আসতে সময় লাগলো।ইশতিয়াকের কন্ঠ না পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল রায়হানের।রাস্তার একপাশে সরে এসে বললো,
” হ্যালো,হ্যালো ইশতিয়াক। হ্যালো,শুনছো?”

” পকেটে খুঁজলাম রায়হান ভাই। চিঠিটা নেই।ওটা মনে হয় কাজী বাড়িতেই ফেলে এসেছি।”

” কি বলছো!”

” হ্যাঁ, সত্যিই।ভূমি এরপরে অসুস্থ হয়ে গেল,ওকে নিয়েই তো দৌড়াদৌড়ি তারপর থেকে।ঐ ঝামেলায় মনে হয় চিঠিটা হাতছাড়া হয়ে গেছে।”

দু-আঙুলে কপাল চেপে ধরলো রায়হান।

” এবার?”

” আচ্ছা শোনো,চিঠির কথাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে।আমি একে একে বলছি।তার ভিত্তিতে অভিযোগ করো।শোনো,সূচি প্রথমে লিখেছিল….

উদয়পুর থানায় কোনোদিন আসেনি রায়হান।কখনো ভাবেনি থানায় আসার দরকার পড়বে।ভাবনার বাইরে কতকিছু হয়! দু-পাশে সারি সারি গাছের মাঝে পরিষ্কার পাকা রাস্তা।খান তিনেক সিঁড়ি পেরিয়েই মূল ভবন।লম্বা বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক অপরিচিত মুখ চোখে পড়লো।কেবল মুখগুলোই অপরিচিত, গায়ের পোশাক-জুতো সব পরিচিত।এতোদিন টিভিতে দেখেছে, আজ বাস্তবে দেখছে।ভীত মনে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতেই পিছন থেকে ডাক পড়লো, ” তুমি রায়হান না?”

এ হলো উদয়পুরের উত্তরের বাসিন্দা।মাঝবয়সী হাবিলদার আজমত আলী।রায়হানের ফার্মেসীর নিয়মিত কাস্টমার।এতোগুলো অপরিচিত মুখের মাঝে পরিচিত মুখ দেখে একগাদা স্বস্তি মিললো মনে।প্রায় উড়ে এসে ভদ্রলোককে লম্বা এক সালাম দিলো রায়হান,
” আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।এখানে যে?”

” একটু দরকারে এসেছি।”

” এখানে সবাই দরকারেই আসে।ছুটি কাটাতে আসে না।তোমার দরকারটা কী?”

” আমার এক বোন আত্মহত্যা করেছে। সে জন্যেই এসেছি।”

রায়হানের হাত চেপে চওড়া বারান্দার একপাশে চেপে দাঁড়ালেন আজমত আলী।গলা খাটো করে বললেন, ” বাড়ি চলে যাও।আত্মহত্যার গল্প পুলিশকে বলা বুদ্ধিমানের কাজ না।পুলিশ ওখানে যাওয়া মানেই বেচারির লাশটা পোস্টমর্টেম করতে পাঠাবে।ওহ,অসহ্য কাটাকুটি! এই জিনিসটা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি।”

” ভুল বুঝছেন,স্যার।লাশটাই আমরা হাতে পাইনি।পানিতে ডুবে মরেছে,ডেড বডি খুঁজে পাওয়া যায়নি।শুধু শাড়িটাই পেয়েছি।”

” ব্যাপার কী? খুলে বলো তো।”

একটু একটু করে পুরোটা খুলে বললো রায়হান।পরিচিত মানুষের খোঁজ পাওয়ায় সাহস বেড়েছে।
সব শুনে মাথা নাড়লেন আজমত আলী। মাথা নেড়ে বললেন, ” সবই বুঝলাম।সুইসাইড নোট-টোট কিছু লিখে যায় নাই? এসব কেসে ওগুলো ভালো কাজ দেয়।”

” একটা চিঠি লিখেছিল।কিন্তু আমাদের হাতে নেই ওটা।”

রায়হানের নির্বুদ্ধিতায় মুখ বাঁকালেন আজমত আলো।মুখ বিকৃত করে বললেন, ” বেকুব নাকি তোমরা? এসব ছাড়া কেউ থানায় আসে।”

মাথা চুলকে আমতা-আমতা করে রায়হান,
” আসলে আমরা ওটা হারিয়ে ফেলেছি।”

” আলহামদুলিল্লাহ, উত্তম কাজ।কোনো সাক্ষীও নাই,সুইসাইড নোটও নাই।বেকুব।”

তাচ্ছিল্যটুকু গায়ে মাখলো না রায়হান।বিনীত গলায় বললো, ” এটা ছাড়া উপায় নাই স্যার? আসামী যাতে শাস্তি পায় তার জন্যে সব করতে পারব আমরা।”

তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন আজমত আলী।তারপর আগের মতোই গলা খাটো করে বললেন, ” আমাদের দারোগা বাবুর সুখ্যাতি শুনেছো আগে? স্যার আমাদের খালি ভান্ড।যত ঢালবে ততো ভরবে,ততো ফল পাবে।আর কিছু না দিলে ফলও পাবে না।তোমার অভিযোগ আমাদের ফাইলের নিচেই চাপা পড়ে যাবে।দারোগা বাবুকে চেয়ার থেকে তোলার জন্যেও খাম দিতে হবে।খালি কথায় চিড়া ভিজবে না।বলি বুঝতে পারছো কিছু? তুমি চেনা-জানা গ্রামের মানুষ, তাই সব খুলে বললাম।কাউকে আবার বলো না যেন।”

চুপচাপ মাথা নিচু করে ভাবে রায়হান।আজমত আলীর ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট।তার ইঙ্গিতের কাছে পকেটটা খালি খালি ঠেকে।দারোগাকে গতিশীল করার জন্যে কত ভারী খাম দিতে হবে তা আল্লাহ মালুম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here