শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৪

0
211

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-৪
#হালিমা রহমান

” আপনার বোনের নাম?”

” সূচনা আক্তার সূচি।”

” বয়স?”

” উনিশ।”

” ওর স্বামী কি আগেও ওর গায়ে হাত তুলেছিল?”

সংকুচিত ভঙ্গিত মাথা নাড়ে রায়হান।অস্বীকার করে বলে, ” আমরা কখনো শুনিনি।”

” কালকে যে এতো অত্যাচার করেছে তা জানলেন কী করে?”

” ও একটা চিঠি লিখেছিল।সেখানে লিখেছে।”

” সুইসাইড নোট? চিঠি দেখান।”

পুলিশ কর্মকর্তার সামনে আরো বেশি সংকুচিত হয়ে গেল রায়হান। আমতা-আমতা করে বললো, ” ওটা হারিয়ে গেছে স্যার। ”

” মেরেছে যে সাক্ষী আছে?”

” জ্বি না,কেউ ছিল না বাড়িতে।কিন্তু আমাদের বোন কখনো মিথ্যা বলে না।”

” আমরা প্রমাণে বিশ্বাসী,আপনার কথায় না।আচ্ছা, অপেক্ষা করুন।একটা জরুরি কল এসেছে, কথা বলে নেই।”

এই ছিল অফিসার শাহাবুদ্দিনের সাথে শেষ কথা।গুনে গুনে পৌনে এক ঘন্টা কেটেছে এর মাঝে।এতোক্ষণে তার কথা শেষ হয়নি।একটার পর একটা কল আসছে,হাসিমুখে খোশ-গল্প করছে।সামনে বসে থাকা রায়হান যেন তার কাছে অদৃশ্য।থানা-পুলিশ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নেই রায়হানের।হয়তো এখানে এমনই হয়,হয়তো নিয়মটাই এমন।তাই মুখ বুজে চুপচাপ বসে আছে মাথা নিচু করে।
আজমত আলীর সাথে কথা বলার পর পাক্কা এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে অফিসার শাহাবুদ্দিনের মুখদর্শনের জন্যে।স্যার রাজকার্য শেষ করে এসেছেন,অতএব চা পানের বিরতি দরকার।এখানে আরো আধঘন্টা।দেড় ঘন্টা পর মাত্র দু-চার বাক্য শেষে আবার তার ব্যস্ততা।এই হয়রানির বুঝি শেষ নেই।
ঠিক তিন ঘন্টা পর রায়হান বেরোতে পারলো থানা থেকে।হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।কানে ধরেছে, মরে গেলেও আর উদয়পুর থানায় আসবে না।তবে রায়হানের মনটা এখন একটু ভালো।দু-দুটো ভাল খবর পাওয়া গেছে।ভূমির একটা ছেলে হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।মা-বাচ্চা দুজনেই সুস্থ।তবে বাচ্চাটার ঠান্ডা নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। অবশ্য ডাক্তার বলেছে নিউমোনিয়ার ভয় নেই।আরেকটা সুসংবাদ দিয়েছে ঘুষখোর অফিসার শাহাবুদ্দিন। রায়হানকে আশ্বাস দিয়েছে যেভাবেই হোক অপরাধীকে আজকের মধ্যেই আইনের আওতায় আনবে।
আশ্বাসের সত্যতা আছে।বেলা গড়াতেই শোনা গেল ফয়সাল ধরা পড়েছে।শিবচরে ওর মামা, রমিজ শিকদারের বাড়ি।পাশাপাশি গ্রাম।সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল ফয়সাল।সূচির আত্মহত্যা এখন হট টপিক।খবর বাতাসে ভাসে।ফয়সালকে পুলিশ পাকড়াও করতেই সারা গ্রামে রটে গেল, কাজী বাড়ির ছোট ছেলেকে পুলিশে ধরেছে।হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে গেছে থানায়।রোমেলা বানু বুক চাপড়ে কেঁদেছেন। চিৎকার করে বলেছেন,তার ছেলে নির্দোষ। ওরা ফাঁসানোর জন্য এমন করছে।
কিন্তু কাজ হয়নি।কেউ তার কথায় কান দেয়নি।
এতো তাড়াতাড়ি কাজ হবে তা ভাবেনি রায়হান।ফল লাভের জন্যে ঘুষখোর অফিসারকে কত মোটা খাম দিতে হয়েছে সেই আলোচনাটা গোপন থাক।দুর্নীতি দেশ মায়ের গায়ের কলঙ্ক।কিছু কলঙ্কের কথা খুলে না বলাই ভালো।
_____________________________

ঢাকায় ইদানীং খুব গরম পড়ছে।গায়ে জ্বালা ধরানো বৈশাখের হতচ্ছাড়া গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ।দূষণের শহরে যে কয়টা গাছ আছে,তার পাতা নড়ার দৃশ্যও আজকাল দুর্লভ ঠেকে।রাস্তার দু’ধারে দাঁড়ানো বিশাল বিশাল দালানগুলো সারাটা সকাল জ্বলজ্বলে সূর্যের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অন্যের গায়ে।তাই তো ঘরের দেয়ালগুলোও গরম হয়ে থাকে।চুইয়ে চুইয়ে ভিতরে ঢুকে তীব্র তাপ।গনগনে আগুনের মতো তাপ দেয় ঘরের ভিতরেও।দিন-রাত অবিরাম বনবন করে ঘুরতে থাকা যান্ত্রিক ফ্যানের নিচেও শান্তি মিলে না।

স্কুল থেকে ফিরে এসে গায়ের জামা খোলার সময় হলো না শিলার।বছর ছয়েকের চঞ্চলা হরিণীর কাছে অজ্ঞাত সূচি নতুন মানুষ।সকালে ঘুমিয়ে ছিল বলে সূচিকে আগে দেখেনি।স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রাখতে রুমে ঢুকতেই নজর গেল সূচির উপরে।এই ছোট্ট রুমটা তাদের পড়ার রুম। পড়ার ঘরের ছোট খাটে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ! বিষয়টি অবশ্যই অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। ঘামে ভেজা জবজবে জামার কলারে সজোরে একটা টান মেরে খাটের কাছে যেয়ে নিচু হয়ে চেয়ে রইলো সূচির দিকে।মিনিট কয়েক গভীর পর্যবেক্ষণ করে নিচু স্বরে বললো,
” অ্যাই, অ্যাই, কে তুমি?”

নরম ছোট্ট আঙুলের স্পর্শ বিশেষ ব্যাঘাত ঘটালো না সূচির গভীর ঘুমে।সে পরম শান্তিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।আরো দু-তিনবার খোঁচাখুঁচি করেও অতিথির ঘুম ভাঙাতে না পেরে বসার ঘরে ছুটে এলো শিলা।লাবনী ভিডিও করছে,এখন ওকে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না।মাকে খুব চেনা আছে শিলার।কাজের সময় বিরক্ত করলেই ধুমধাম কিল বসিয়ে দেয় পিঠের উপরে।পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে লাবিব।এক বাক্স ভাঙা রঙ- পেন্সিল নিয়ে কর্মব্যস্ত মায়ের একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছে।কিন্তু হচ্ছে না।লাবনীর বোঁচা নাকের আকৃতিটা খুব ভোগাচ্ছে তাকে।কিছুতেই ঠিকঠাক আঁকা যাচ্ছে না।

” অ্যাই ভাইয়া”

” ভালো করেছিস এসে।এদিকে দেখ তো শিলা,আম্মুর নাকটা কি ঠিকঠাক হয়েছে? একটু বেশিই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে না? নাকের মাথাটা আরেকটু উঁচু করতে হবে,নারে? আম্মুর নাকটা আরেকটু খাড়া হলে ভালো হতো। বোঁচা নাক আমার বিশ্রি লাগে।”

এতো আলাপের দরকার নেই শিলার।ভাইয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বললো, ” এসো আমার সাথে।তাড়াতাড়ি এসো।”

” ইশ,ছাড়। আঁকতে দে।”

শিলার জোরজবরদস্তিতে অগত্যা উঠতে হলো লাবিবকে।সূচির কাছে পৌঁছেই আগ্রহ সহকারে প্রশ্ন করলো শিলা, ” এটা কে ভাইয়া?”

” একটা খালামনি, চাচ্চুর সাথে এসেছে।”

” কখন?”

” সকালে।”

” উঠবে না এখন?”

” জানি না। আম্মু বলেছে বিরক্ত করতে না।তুই চল আমার সাথে।”

যাওয়ার আগে আরেকটু পর্যবেক্ষণ করলো শিলা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বিজ্ঞের মতো ভাইকে বললো,
” বাজে দেখতে, তাই না ভাইয়া? আম্মুর মতো সুন্দর না। চোখগুলো, গালগুলো,নাকটা কেমন ভূতের মতো ফোলা ফোলা।উঠলে আমি মেকাপ করে দেব।”

মুখখানা সহসা খুব গম্ভীর করে ফেললো লাবিব।বোনের হাত টেনে বেরিয়ে যেতে যেতে খুব জ্ঞানীর মতো বললো, ” আম্মু কী বলে শুনিসনি?পৃথিবীর সবাই সুন্দর।আমি সুন্দর,তুই সুন্দর,চাচ্চু সুন্দর,আম্মু-আব্বু সুন্দর,খালামনিটাও সুন্দর।মানুষকে অসুন্দর বললে আল্লাহ পাপ দেয়।পাপ করলে জাহান্নামে যেতে হয়।জাহান্নামে আগুউউউন আর আগুন।তুই সেখানে যেতে চাস? আগুনে পুড়ে মুরগীর মতো ভাজা ভাজা হতে চাস?”

আঁতকে উঠে ঘন ঘন মাথা নাড়ে শিলা, ” একদমই না।”

” তাহলে দুই গালে দুই থাপ্পড় মেরে তওবা বল।মনে মনে আল্লাহর কাছে বলবি তুই আর কোনোদিন কাউকে অসুন্দর বলবি না।”

নিজের দুই গালে কষে কষে দুটো চড় লাগালো শিলা।

” তওবা, তওবা।আমি আর কোনোদিন কাউকে অসুন্দর বলব না আল্লাহ।খালামনিও অনেক সুন্দর,পরীর মতো সুন্দর।”

সন্তুষ্ট হয়ে বোনের হাত টেনে আবার বসার ঘরে ছুটলো লাবিব।দুই ভাই-বোন মিলে এখন লাবনীর নাক আঁকার চেষ্টা করবে।সাথে চলবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, মায়ের নাকটা ঠিক কতখানি বোঁচা।আর কতটুকু খাড়া হলে লাবিব আরো সহজে মায়ের ছবি আঁকতে পারতো।
_____________________________

ভিডিও করা শেষ।একটা মাখন রঙা চমৎকার পাকিস্তানী জামার ভিডিও শেষে টপাটপ দু-তিনটে ছবি তুলে ফেললো লাবনী।ওর ছবিগুলো খুব একটা ভালো হয় না।এদিকে আবার সৌরভের ছবিগুলো দারুন হয়। দোকানে নতুন প্রোডাক্ট তুললেই চট করে ছবি তুলে ফেলে।ফটোগ্রাফার হিসেবে ছেলেটা একদম পার্ফেক্ট।
সদ্য তোলা ছবিগুলো একে একে সৌরভের আইডিতে পাঠানোর মিনিট কয়েকের মাঝেই কল এলো।সৌরভ কল দিয়েছে।

” হ্যালো সৌরভ,ছবিগুলো দেখেছো? পেজ বা গ্রুপে দেব?”

” না আপু, দিয়েন না।ছবিগুলা অস্পষ্ট। গলার কাজটা বুঝা যায় না।বর্ডারের কাজগুলা ঝাপসা।ভিডিওটাও ভালো হয় নাই।দোকানে সেইম প্রোডাক্ট আরো আছে।আমিই ছুবি তুলে দেবনি।”

” ঠিকাছে। বাড্ডায় একটা ড্রেস দেওয়ার কথা ছিল আজকে।দিয়েছো?”

” হ্যাঁ, আপু।একটু আগেই দিলাম। একটা মেয়ে নেগেটিভ রিভিউ দিয়েছে কালকে,দেখেছেন আপু?”

বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো লাবনী।হতাশার সুরে বললো, ” দেখেছি।আমি বুঝি না কাস্টমার বোকা নাকি আমি বোকা।এক মাস ইউজ করার পরে জামা ছিঁড়লে আমার দোষ?বলে কি না কাপড় বাজে! আজব! সেইম আরেকটা জামা আমি নিজে ইউজ করছি আজ ছ’মাস যাবৎ।ছবিটা দেখেছো? আমার কেন যেন মনে হয় কিছুর সাথে লেগে ছিঁড়ে গেছে।নয়তো কাপড়টা এতো দুর্বল ছিল না।এখন ওটা ফিরিয়ে দিয়ে আরেকটা নিতে চাচ্ছে।চিন্তা করো,কত বেকুব।আমি কি গ্যারান্টি দিয়ে সেল করি?”

” মন খারাপ করবেন না আপু।আমার সাথে কালকে মেয়েটার কথা হয়েছে।আমিও এগুলাই বললাম।ইশ! এরপরে ধুয়ে দিছে আমারে।”

” কত্ত বেয়াদব দেখো এবার।”

আরো দু-চারটে ব্যবসায়িক কথা-বার্তার শেষে ফোন রাখার আগ মুহূর্তে আমতা-আমতা করে কথাটা বলেই ফেললো সৌরভ,
” আপু একটু আগে আপনি যে ভিডিওটা দিয়েছিলেন পেজে,তার কমেন্ট সেকশনে ভাইয়া কমেন্ট করে ঝড় তুলে ফেলছে।দেখে আসেন শিগগির।”

তড়িঘড়ি করে কল কেটে নোটিফিকেশন দেখলো লাবনী।সকালের পরে শান্তর নম্বরটা ব্ল্যাক্ললিস্টে ফেলে রেখেছে।স্বামীকে চেনে সে।অফিসে থাকাকালীন সময়টুকুতেই নয়তো পাগল করে দেবে।সকাল থেকে ম্যাসেজও দিয়েছে অনেকগুলো।লাবনী দেখেনি।এবারে নোটিফিকেশন দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। লাবনীর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রোডাক্টের ভিডিওতে গোটা পাঁচেক কমেন্ট করেছে।সবগুলো প্রায় একইরকম। পাঁচটাতে একই হুমকি, ” বাড়ি ফিরে ঐ মেয়েটাকে দেখলে তোর খবর আছে লাবনী।”

বিরক্তির পারদটা ঠিক কোথায় পৌঁছে গেছে তা খুঁজে দেখার সময় মিললো না।চটজলদি কমেন্টগুলো ডিলেট করতে করতে কানে এলো অন্তুর প্রশ্ন, ” কার মাসিক আয় বেশি ভাবি? তোমার না ভাইয়ার?”

অন্তুর ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। তীব্র গরমে বিছানায় গড়াগড়ি করতে ভালো লাগলো না।তাই লাবনীর সাথে গল্প করতে চলে এলো।লাবনীর মন-মানসিকতার সাথে অন্তুর অগাধ মানবিকতা খাপ খায়।তাই দুজনের মাঝে মিলের অন্ত নেই।

” সচরাচর আমার বেশি হয়। তোমার ভাইয়ার তো ধরা বেতন।আমার ব্যবসা।অবশ্য কিছু কিছু মাসে আবার আমার লস হয়।”

” ভাইয়া তোমাকে খরচা করতে দেয়?”

” উঁহু, ঘরের কিছুতে খরচ করাই লাগে না।আমার ব্যয় হয় তোমার ভাইয়ার পিছনে। তার শপিংয়েই শুধু কিছু টাকা খরচ হয়,বাকিটা হাতেই থাকে।তোমার ভাইয়াকে তো চিনোই।হাতখোলা মানুষ।আমাদেরকে একটার উপরে তিনটা কিনে দেয়,নিজের বেলায়ই সব কিপ্টামি। ঈদ-টিদেও কিনতে চায় না।এমনই পিচাশ।”

অন্তু হাসে।মাথা নেড়ে বলে, ” সব সংসারী পুরুষই বোধহয় এমন হয় ভাবি।আমাদের আব্বুকেও দেখতাম এমন করতো। নিজের জন্য না কিনে আমাদেরকে অতিরিক্ত দিয়ে সাজিয়ে রাখতো।লাবিব আজকে স্কুলে গেলই না?”

” না,মেরেও নিতে পারিনি।যাবে না বলেছে যাবেই না।ছেলে-মেয়ে দুটোই বাপ-চাচার মতো ঘাউড়া।ঘাড়ের রগ তিনটা ত্যাড়া।যেটাতে না বলবে সেটা নাই থাকবে।তোমাদের বংশের নাম রাখতে পারবে এই বদমায়েশগুলো।”

টুকটাক কথা-বার্তা,হাসি-ঠাট্টার পরে রান্নাঘরের পাশের ছোট রুমের ভেজানো দরজার দিকে নজর দিলো অন্তু।আঙুল হেলিয়ে ওদিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলো, ” ঘুম ভাঙেনি এখনো?”

” না।শান্তিতে ঘুমাচ্ছে দেখে আমিও আর ডাকলাম না।”

” জ্বর এসেছিল আর?”

” এতোক্ষণ ছিল।এখন একটু কমেছে।আমি একটু আগে মাপলাম,বেশি নেই।”

” খেয়েছে কিছু?”

” রুটি খেতে পারেনি, ওর নাকি দাঁত ব্যাথা।না খেয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছিলো, আমি জোর করে পাউরুটি আর দুধ খাইয়ে জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দিলাম।একটু পরেই ঘুম থেকে তুলে দেব।পাতলা খিচুড়ি রান্না করেছি ওর জন্যে।দুই টুকরা পাউরুটিতে পেট ভরেনি তখন।”

একটু পরের কথা বললেও সূচিকে ডাকতে মন চাইলো না লাবনীর।অসুস্থ শরীরের ক্লান্তি বিদায় করার জন্যেও এরকম একটা ঘুম দরকার।সূচি নিজেই উঠলো আজানের সময়।হুট করে ঘুম ভাঙায় পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝতে পারছিলো না কিছু।অগোছালো শাড়ি সামলে গুটিসুটি মেরে নির্বিকার চোখে সবকিছু দেখছিল চোখ ঘুরিয়ে।এমন সময় লাবনী এলো।স্নিগ্ধ হেসে বললো, ” ঘুম ভাঙলো?”

” আমি একটু পানি খাব।আপনাদের ওয়াশরুমটা যেন কোনদিকে?”

সূচির জড়ানো কন্ঠ।বোঝা গেল জ্বর এখনো ছাড়েনি,ঘোলা মস্তিষ্ক থেকে কাটেনি ঘুমের রেশ।সে সামাজিকতা,ভদ্রতার ঊর্ধ্বে। ওয়াশরুম দেখিয়ে দিতেই এলোমেলো পায়ে হাঁটা ধরলো।ঘুমের ঘোরে পরেই যাচ্ছিলো প্রায়,খপ করে ধরে ফেললো লাবনী।

” একা যেতে পারবে?”

” জ্বি।”

” চোখে-মুখে একটু পানি দিয়ে এসো। ভালো লাগবে।”

চোখে,মুখে,মাথায় পানি দেওয়ার পরে সত্যিই খানিক ভালো লাগছে সূচির।লঞ্চে ও কোনোদিন ওঠেনি।এই প্রথম।এই বস্তুর দুলানো ভাবটা মাথায় গেড়ে বসেছে।মনে হচ্ছে এখনোও লঞ্চে,পানির ঢেউয়ে নাচছে ওর সারা শরীর।ঘুমের রেশ পুরোপুরি না কাটলেও অস্বস্তি ভাবটা একটু কমেছে।এতোক্ষণ মাতাল মাতাল লাগছিলো নিজেকে,এখন পানির স্পর্শে এই ভাবটা কমেছে।
রুমে পা দিয়েই লাবনীকে দেখলো সূচি।খাটের উপরে বসে আছে পা ঝুলিয়ে।দরজার কাছে দুটো বাচ্চা উঁকিঝুকি দিচ্ছে।ফুটফুটে বাচ্চা দুটো অথবা লাবনী,কেউ মনোযোগ কাড়তে পারলো না। সূচির স্থির দৃষ্টি লাবনীর সামনের খাবারের প্লেটের দিকে।হাজার দুঃখ-কষ্টের পরেও ক্ষুধা-তৃষ্ণার সীমাবদ্ধতা আছে বলেই সে রক্ত-মাংসের মানুষ।ধোঁয়া ওঠা খাবার দেখেই পেটে মোচড় দিলো সূচির।মনে পড়লো এই দু’দিনে পেট পুরে খেয়েছে গতকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটার দিকে ভূমির বাড়িতে। গত চব্বিশ-পঁচিশ ঘন্টার মাঝে আজ সকালের পাউরুটি-দুধ ছাড়া আর কিছুই খায়নি।ক্ষুধা-তৃষ্ণার কাতরতায় ওর ঘুম ভেঙেছে হয়তো।নয়তো এতো তাড়াতাড়ি জাগতো না।লাবনীর দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে খাবারের সামনে বসে পড়লো সূচি।এমনভাবে পাতলা খিচুড়ির প্লেটটা টেনে নিলো যেন ও আগে থেকেই জানতো এটা ওর জন্যেই। পেটের রাক্ষসী ক্ষুধাকে শান্ত করতেই গবগব করে দু-তিন চামচ খেয়ে নিলো।

” তোমার খুব খিদে পেয়েছিল, তাই না?”

খেতে খেতে উপর-নিচে মাথা নাড়ায় সূচি।

” তুমি মরিচের আচার খাও? একটু দেব?”

” দিন।”

কাচের বয়াম থেকে একটুখানি আচার ঢেলে দিয়ে সাবধান করে লাবনী বললো, ” বেশি খেয়ো না পেটে ব্যাথা হবে।প্রচুর ঝাল।একটু একটু মেখে খাও,জ্বরের মুখে ভালো লাগবে।”

সূচির অবচেতন মস্তিষ্ক একটু যত্ন,একটু ভরসা খুঁজছিল।পেয়েও গেল কিছুক্ষণের মাঝে।অসুস্থ সূচির মনে এভাবেই একটু একটু করে জায়গা করে করে নিলো লাবনী।তার ব্যবহার যত কোমল,মুখের ভাষা তার চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ। শান্ত মাঝে মাঝেই বলে লাবনী মানুষ বশ করার মন্ত্র জানে।কথাটা অবশ্য খুব একটা মিথ্যা না।অন্যকে বশ করার জন্যে একটু ভালো ব্যবহার ছাড়া আর কী লাগে?

” তোমাকে আরেকটু দেব?”

” উঁহু।”

” তুমি কি আবার ঘুমাবে?”

” জ্বি।”

সূচির আগাগোড়া সচেতনী দৃষ্টি ফেলে রয়ে-সয়ে,ধীরে-সুস্থে প্রশ্ন করে লাবনী, ” তোমার গলায় ওটা কীসের দাগ? গলায় ব্যাথা পেয়েছো কীভাবে?”

সূচির গলায় আঙুলে দাগ স্পষ্ট। বোঝাই যায় কেউ গলা টিপে ধরেছে।বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো লাবনী।সব ওর পেট থেকে কথা বের করার ধান্দা।

” কী হলো? বললে না যে?”

” আমাকে ও মেরেছে।”

” তা তো দেখছি।কিন্তু গলায় কেন? তোমাকে মেরেছে খুব সম্ভবত বেল্ট দিয়ে।গলার দাগটা বেল্টের না।তোমার গলা টিপে ধরেছিল কেন?”

লাবনীর আগ্রহী চোখের সামনে সহসা খুব উদভ্রান্ত হয়ে পড়লো সূচি।কাল রাতের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে গেল একে একে।কিছু বাজে দৃশ্য, এই ছবির সাক্ষী দুনিয়াতে নেই।ফয়সাল ছাড়া আর কোনো মানুষ জানে না কাল সন্ধ্যায় ঠিক কী ঘটেছিল।কাল তো কেউ ছিল না।কাজী বাড়ি খা খা করছিল নির্জনতায়।সূচির হাত ধরে ঘরে ঢুকলো ফয়সাল।সশব্দে দরজা আটকে দিলো।ওকে ঠেকে ফেলে দিলো মেঝেতে।তারপরে? তারপরে খুব কাছে এসে নিজেও লেপ্টে বসে পড়লো মাটিতে।কড়া ঘামের গন্ধে বমি পাচ্ছিলো সূচির।স্বামীর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই ফয়সাল ওর হাত দুটোকে মুঠোতে পুরে নিলো।টকটকে লাল চোখ দুটো মেলে চেয়ে ছিল সূচির দিকে।তারপরে?

” আচ্ছা থাক,না বলতে চাইলে বলো না।তুমি পানি খাও।”

” আমি বলব,বলব।কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে?”–ভাবগ্রস্তের মতো যেন নিজেকেই শোনায় সূচি।

ভরসা মাখা হাত দুটো দিয়ে সূচির বামহাতটা আঁকড়ে ধরলো লাবনী।চোখের ইশারায় জানিয়ে দিলো ও বিশ্বাস করবে।

” কাল সন্ধ্যায় মুখোমুখি বসে ও আমাকে কী বললো জানেন? ”

” কী বললো?”

” বললো, ও মুক্তি চায়। মুক্তি তো আমিও চাই।ও বললো, আমাকে তালাক দেবে।আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। এই কথা শোনার সাথে সাথে আমার হাত ছেড়ে গাল চেপে ধরলো।বললো,এতো খুশি হতে না।ও এমনভাবেই আমাকে তালাক দেবে যেন আমি সারাজীবন মনে রাখি।এরপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝট করে আমার গলা চেপে ধরলো। চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো,আমি বড় আপার বাড়িতে কেন গেলাম? কেন ভরা মজলিশে ওদের অপমান করলাম? আমার তখন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।গলার উপরে ওর পাথরের মতো কঠিন হাত।সরাতে চেয়েও পারছি না।কিছুক্ষণ পর আবার নিজেই ছেড়ে দিলো।তারপর আবার গাল চেপে ধরে বললো, ও আমাকে মারবে না কিন্তু অনেক যন্ত্রণা দেবে।তারপরে চেঁচিয়ে তিনবার তালাক বললো।কানের কাছে এতো জোরে বললো যে আমার কানে তালা লেগে গেল।মনে হচ্ছিলো একটা বাজ পড়েছে আমার কানের উপরে।আমি আর কিছু শুনতেই পারব না।”– দৃশ্যটা যেন চোখের উপরে ভাসছে।আনমনে কেঁপে উঠলো সূচি।তারপর আবার খাটের দিকে চেয়ে বললো, ” এরপর আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ও বেল্ট খুলে মারলো।ও কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলেনি।আমি কখনো ভাবিনি ও আমাকে মারবে।”

” তুমি ফ্যামিলির কাছে যাওনি কেন? তোমার ওকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করেনি?”

” না,মোটেও না।আমাকে যারা মারে তারা তো শাস্তি পায় না।আব্বা কোনোদিন শাস্তি পায়নি।কাল আমার শাশুড়ি আমার দিকে জুতো ছুঁড়ে মারলো,সেও তো কোনো শাস্তি পায়নি।শাশুড়ির হাতে মার খাওয়ার পরে তার ছেলের হাতেও আবার মার খেলাম।বিকালে বড় আপার বাড়িতে আব্বাও আবার মারলো।আমিই শুধু মার খাই।ওরা কেউ তো কোনো শাস্তি পায় না।”.

” তুমি মরতেই কেন গিয়েছিলে?যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা ছিল না?তোমার বড় ভাই-বোন নেই?”

” আছে তো, আমার বড় আপা।আমাকে এতো ভালোবাসে,আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না।আপা অসুস্থ।আমার ঝামেলায় বিকালেই খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো। আবার আব্বা আপাকেও মারলো।আমি আপার কাছে গেলে আবার ঝামেলা হবে।আবার ওরা আমাকে নিয়ে যাবে।আব্বা আমাকে হাতের কাছে পেলে এবারে মেরেই ফেলতো।আমার তালাক তার সহ্য হতো না।ওরা আমাকে জন্মই দিয়েছে কিন্তু কখনো ভালোবাসেনি।”

খাওয়া-দাওয়ার শেষে জ্বর মেপে,ঔষধ খাইয়ে,সূচিকে শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো লাবনী।কিছুটা উদাসীন সে,চেহারায় চিন্তার ভাব।মনটা খারাপ।এ হয়তো ওর স্বভাব।প্লেট,গ্লাস রান্নাঘরে রাখতে রাখতে মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো।নিজস্ব অভিলাষের কথা মনে জাগতেই তৃপ্তি মিললো।এখন শান্তর অপেক্ষা কেবল।
__________________________________

শান্ত বাড়ি ফিরলো সাড়ে নয়টায়।এতো দেরি কখনো করে না।একগাদা কাঁচাবাজার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অন্তু এগিয়ে গেল ভাইয়ের দিকে।বড় ভাইয়ের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ টেনে নিতে নিতে বললো, ” এতো দেরি হলো যে ভাইয়া?আমি সেই কখন থেকে বসে আছি তোমার জন্যে।”

উত্তর দিলো না শান্ত।মুখখানা ভয়াবহ গম্ভীর করে চলে গেল রুমে।রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রাখার সময় চোখ টিপে দিলো লাবনী।ইশারায় প্রশ্ন করলো,
” কথা বললো না?”

” একটুও না।তাকিয়ে দেখলো না অবধি।এমনই খাটাশ।”

” আহা! কাল সকালের জন্যে অপেক্ষা করো।হঠাৎ ধাক্কা তো তাই সামলাতে পারছে না।”

” কাল সকালে কথা বলবে?”

” অবশ্যই।আজ রাতে ব্রেইন ওয়াশ করে দেব।দেখবে কাল আর কিছু মনেই থাকবে না।”

” পারবে?”

” হুহ! এ খুব শক্ত কাজ নাকি?”

মৃদু হেসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘোষণা দিয়ে গেল অন্তু, ” মেড ফর ইচ আদার।”

বাবা বাড়ি এলে শিলার কলিজাটা ফুলে দশ হাত হয়ে যায়।বাবা তার সব অর্থহীন বকবকানির সঙ্গী। শান্ত বাড়ি ফিরলেই ওর পড়া শেষ।লাবিব এতোটা আহ্লাদ করতে জানে না যতটা শিলা জানে।ছেলের চেয়ে মেয়ের প্রতি যেন একটু বেশিই দুর্বল শান্ত।
বাবার গন্ধ পেয়েই শোবার ঘরে ছুটে এলো শিলা।চোখ-মুখ ঘুরিয়ে, হাত-পা নাচিয়ে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে সারাদিনের খবরাখবর বাবার কানে ঢেলে দিলো।

” বাবা জানো,একটা খালামনি এসেছে আমাদের বাড়িতে।সারাদিন ঘুমায়।মরার মতো ঘুমায়।উঠেই না।আমি কতবার যেয়ে ঘুরে এলাম,নাক টিপে দিলাম,চুল টেনে দিলাম–তবুও উঠে না।খালি ঘুমায়।খালামনির মুখটা এতো ফোলা,কপালটা…

” চুপ করবি তুই? পড়ালেখা নাই? ফাজিল।দূর হ এখান থেকে।চেনা নেই,জানা নেই,খালামনি পাতাচ্ছে।বেয়াদব,মায়ের মতোই অসভ্য হয়েছিস।”

বাবার থমথমে মুখ দেখে থমকে গেল শিলা।শান্তর মুখে ধমক খাওয়ার অভ্যাস নেই বলেই মনটা ভেঙে গেল।ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে মাথায় তুললো সারা ঘর, ” তুমি খারাপ।আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না।তোমার সাথে ঘুমাবও না।আজকে আমি চাচ্চুর সাথে ঘুমাব।”

রাতে কেউ খুব একটা কথা-বার্তা বললো না শান্তর সাথে।সেও বললো না।লাবিব,শিলা,অন্তু একসাথে খেয়ে ঘুমাতে চলে গেল।সূচির জ্বরটা বেড়েছে আবার।ওকে তুলে খাবার,জ্বর আর ব্যাথার ঔষধ খাইয়ে আবার শুইয়ে দিলো লাবনী।জ্বরটা হয়তো ব্যাথার জ্বর।তাই ছাড়ছেই না।
সব কাজ শেষ করে লাবনী যখন রুমে গেল তখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে দশটা বাজে।খাটের উপরে কাঠের মতো শক্ত হয়ে শুয়ে আছে শান্ত।খায়নি রাতে।ফ্রেশ হয়ে সেই যে শুয়েছে আর চোখও খুলেনি।লাবনীর সাথে কথাও বলছে না।সে যে জেগে আছে তা বেশ জানে লাবনী।লাইট বন্ধ করে মুখ টিপে হেসে খাটে উঠে গেল।শান্তর স্বভাব আগাগোড়া মুখস্ত।ছেলেটা খুব রাগ করতে পারে না।মুখ ফুলিয়ে রাগের ভান করে ঠিকই কিন্তু ভয়াবহ রাগ করার সাধ্য তার নেই।একটু আহ্লাদ করে কথা বললেই গলে জল হয়ে যায়।
এই রুমে ডিম লাইট লাগে না।বাইরের স্ট্রিট লাইটের মাথাটা দো-তলার কাছাকাছি।বারান্দা দিয়ে রাস্তার আলো আসে কিছুটা।আধো আলো, আধো অন্ধকারে স্বপ্নপুরীর রূপে সাজে ওদের শোবার ঘর।
পরম স্নেহে দশটি আঙুল স্বামীর চুলে গুজে দিলো লাবনী।আদুরে গলায় বললো, ” ঘুমের ভান ধরেছো?”

ঝট করে বউয়ের হাত দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিলো শান্ত।

” বাবারে,এতো রাগ! খাবে না শান্ত?”

” লাবনী,মাথাটা গরম করে দেবে না।আমি খুন করে ফেলব।”

” তোমার জন্যে জান কোরবান ময়নার বাপ।খুন করবে,করো।একটু ভালোবেসে খুন করো প্রিয়।তোমার হাতের মরনেও সুখ।”

লাবনীর ফিল্মি ডায়লগে গা-পিত্তি জ্বলে গেল শান্তর।লাফ দিয়ে উঠে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে আঙুল নেড়ে বললো, ” ফাইজলামি করো আমার সাথে? আমাকে মানুষ মনে হয় না? আমার কোনো দাম নেই তোমার কাছে? আমার কোন কথাটা শুনেছো এ অবধি? যা ইচ্ছা হয় তাই করছো।আমি মানুষ নাকি জন্তু জানোয়ার, তা নিজেই বুঝি না।মানুষ হলে অন্তত আমার একটা দাম থাকতো।”

” অবশ্যই তোমার দাম আছে।তোমার দাম সোনার দামের সমান।না,না, কম হয়ে যায়।তোমার দাম আর ডায়মন্ডের দাম এক।তোমাকে বাজারে তুললে খাবলা-খাবলি করে মানুষ নিয়ে যাবে।তুমি অমূল্য ধন।”

” হাহ, লাবনী!”

অকারণেই খিলখিলিয়ে হেসে স্বামীর গায়ে ঢলে পড়লো লাবনী।কিছুক্ষণ হেসে সহসা খুব গম্ভীর হয়ে গেল।প্রকৃতস্থ হয়ে গম্ভীর গলায় বললো, “আচ্ছা, এবার সিরিয়াস আমরা।কী শুরু করেছো বলো তো? তুমি কি বাচ্চা? এমন শুরু করেছো কেন? ঘরে মেহমান আর তুমি কিনা এরকম মুখ ফুলিয়ে রেখেছো। সূচির কথা বাদ দাও।অন্তুর কী দোষ? সে তো কখনো তোমার কাছে এসে পড়ে ছিল না।সেই সাড়ে সতেরো বছর বয়স থেকে ছেলেটা হলে হলে থাকে।আজ প্রায় নয়-দশ বছর পরে আমাদের কাছে থাকতে এসেছে।প্রথম দিনেই
তুমি এমন করছো।এটা কি মানায় শান্ত?”

” ওকে যে থাপড়ে দেইনি এটাই অনেক।কি কাজটা করলো! ঐ মেয়েটাকে না আনলে তো আমি এমন করতাম না।তুমি সবসময় এমন করো।আমার দোষ ছাড়া আর কিছু চোখেই দেখো না।”

” পরিস্থিতি মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? অন্তুর বোধ-বুদ্ধির উপরে তোমার ভরসা না থাকলেও আমার আছে।চোখ বন্ধ করে ছুটে আসতে পারেনি বলেই এনেছে।তুমি মেয়েটাকে দেখেছো?”

” দেখার দরকার নেই আমার।তোমার এসব ঢং আমার ভালো লাগে না লাবনী।আমি ঢাকার রাজা-বাদশা,মস্ত বড় দানবীর হয়ে যাইনি যে রাজ্যের সব অসহায় মানুষকে আমার ঘরে জায়গা দেব।তুমি এই মেয়েটাকে চেনো? চেনো না।শুধু চোখের দেখায় বিশ্বাস করে নিলে। মেয়েটা এখন আমার ঘরে।আশ্চর্য! আমি ওকে চিনি না, জানি না।আমি যদি তোমার মতো বিশ্বাস করতে না পারি তো আমার দোষ কোথায়? তোমার মতো এতো ঢং আমার নেই।সরো,ঘুমাব।তোমার সাথে কথা বলা বৃথা।”

ঘুমাতে দিলো না লাবনী।নরম গলায় বললো, “অনেক অভিযোগ করে ফেললে।এবার আমি বলব,তুমি শুনবে।কথার মাঝে একটা কথাও বলবে না।”

আগেই বলেছি লাবনীর মুখে মধুর অভাব নেই।অন্তুর মুখে,সূচির মুখে যা শুনেছে তাই নতুন করে শান্তকে বললো।দরদ ঢেলে, মধু মেখে গুনগুনিয়ে বললো এক বিরহিণীর গোপন কথা।সব শেষে লেজুরের মতো প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিলো, ” এবার তুমিই বলো,মেয়েটার কোনো দোষ আছে?তোমার চাচাতো ভাইয়ের কাজটা কি ঠিক হয়েছে?”

” না।”

” সেটাই।মেয়েটার বয়স কম।আঠারো-উনিশ হবে হয়তো। ও মরতে না গেলে কী আর করতো? সামলানোর জন্যে একটা বয়স লাগে তো।একটু বয়সী,গম্ভীর হলেও হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিতো না।একটা এইটুকুনি মেয়ে এতোবড় ধাক্কা সামলাতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। ”

” সব মানলাম।কিন্তু এর মাঝে আমি কেন জড়াব লাবনী? দোষ করেছে আমার চাচাতো ভাই।আমি তো করিনি।আজকে আছে থাকুক।কালকের লঞ্চেই অন্তুকে দিয়ে মেয়েটাকে আবার উদয়পুরে পাঠিয়ে দেবে।এবার ও দোষীর সাথে কামড়াকামড়ি করুক।”

স্বামীর চুলগুলো ঘেটে দিলো লাবনী।ভর্ৎসনার সুরে বললো, ” ছিঃ! ছিঃ! এ কেমন কথা?যেই অবস্থা মেয়েটার,এই অবস্থায় আমি কীভাবে দূর করে দেই মেয়েটাকে? ও বাঁচার জন্যে কালকে মরতে গেছে। তো পাঠিয়ে দিতে গেলে মরবে না?”

” এসব ভাবনা তো তোমার না।”

” অবশ্যই আমার।যে আমার কাছে এসেছে তাকে আমি ফেলে দিতে পারি না। অন্তত যতদিন সুস্থ না হয় ততোদিন তো আমি ওকে ছাড়বই না।সুস্থ হোক,তারপরে ভাববো কী করা যায়।”

বউকে চেনে শান্ত।যা বলেছো তাই করবে।তাই হতাশ হয়ে গেল খুব।হতাশ চোখে অন্ধকারে চেয়ে রইলো স্ত্রীর মুখের দিকে।

” আচ্ছা, তুমি ওর জায়গায় আমাকে দাঁড় করাও তো শান্ত।আল্লাহ না করুক, আমার সাথে যদি এমন হতো তখন কেমন লাগতো তোমার? অথবা ধরো,ও তোমার ছোট বোন।ওর বয়সী একটা ছোট বোন যদি তোমার থাকতো? সে যদি সারা গায়ে এমন চিহ্ন নিয়ে তোমার কাছে আসতো! ফেলে দিতে পারতে? এমন ব্যবহার করতে পারতে?”

” অফিসে আসা-যাওয়ার পথে আমি অনেক অসহায় মানুষ দেখি লাবনী।তাদের সবাইকে কি আমি নিজের মা-বোন ভাববো? অবশ্যই না।জগতে সুখী-দুঃখী মানুষ থাকবেই।তাদের সবাইকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আমার না।সবার নিজস্ব গন্ডি আছে।এই গন্ডির বাইরে নাক না গলালে কেউ নিন্দা করবে না।”

মালার মতো নিজের নরম হাতদুটো স্বামীর গলায় জড়িয়ে দিল লাবনী।ভীষণ আদুরে গলায় বললো,
” সবাইকে উদ্ধার করার দায়িত্ব তোমার না তা ঠিক।কিন্তু যে তোমার ঘরে নিজে থেকেই চলে এসেছে তাকে ফেলে দেওয়াও তো কর্তব্য না।মেয়েটার কপালে আত্মহত্যা লেখা নেই।তাই হয়তো কাল মরতে পারলো না।ধরেই নাও না,খোদা তোমার ঘরেই ওকে বাঁচিয়ে রাখবে।আমরা ওর বেঁচে থাকার উপলক্ষ্য মাত্র।তাছাড়া, সারাজীবন যে থাকবে তাও তো না।সুস্থ হওয়া অবধি থাকুক।এমন করো না শান্ত।মানুষ মরে যায়,বেঁচে থাকে তার ব্যবহার।আমি আমার শান্তকে চিনি।সে খুব আত্মকেন্দ্রিক কিন্তু অমানবিক নয়।তাই না?

কিছুক্ষণ থেমে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভিন্ন কথা বললো শান্ত।বউয়ের পিঠে হাত ঠেকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, ” তুমি আর কখনো আমার গলা জড়িয়ে ধরবে না লাবনী।ঘরের বউ ভয়ংকর জিনিস।এরা গলা জড়িয়ে ধরলে আর রক্ষা নেই।পুরুষ তখন আর পুরুষ থাকে না।”

” তাহলে কী হয়ে যায়?”

” বীরপুরুষ। বউয়ের সব অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে তাকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করে তখন।এই যেমন আমি এখন তোমাকে দিচ্ছি।

কান এঁটো করা চওড়া হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো লাবনীর সারা মুখ।মাথা ঝাকিয়ে বললো,
” আমি জানতাম তুমি মানবে।ঘুমিয়ে যেও না,বসো।খাবার নিয়ে আসি।একটু রাগ হলে নিজেও খাবে না,আমাকেও খেতে দেবে না।এমন কেন তুমি?”

আনন্দের আতিশয্যে ভেসে ঘর ছাড়লো সে।মনে পড়লো, শান্ত কখনো ওর আবদার ফেলে না।

চলবে….,

,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here