#মন_প্রাঙ্গনে_এলে_যখন
#লেখনীতেঃ #আলফি_শাহরিন_অর্পা
#পর্ব_২৪
একটা অন্ধকার রাতের সমাপ্তি ঘটলো। কিন্তু অন্ধকার যতই থাকুক না কেনো সূর্যের একটু খানি আলোই যথেষ্ট তাকে গ্রাস করার জন্য। সকাল হয়ে গেছে। পাখির কিচিরমিচির শুনা যাচ্ছে কিন্তু যানবাহনের শব্দ তা গ্রাস করে ফেলছে। স্নিগ্ধা আর জয় বাহিরে এসেছে সকলের জন্য নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করতে। প্রথমে জয় চেয়েছিলো রুদ্ধকে সাথে আনতে কিন্তু স্নিগ্ধা মানা করে দেয়। কাল প্রায় সারারাত রুদ্ধ জেগে ছিলো ভোরের দিকে চোখটা তার লেগেছে তাই স্নিগ্ধা তাকে জানাতে বারন করে। আর নিজেই এসে পড়ে জয়কে সাহায্য করতে।
সকাল এখন ১০ টা। কিছুক্ষণ আগে পরশি জ্ঞান ফিরেছিলো কিন্তু হাই ডোজের ঔষধ দেওয়ার কারণে সে এবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তার এসে বলে গিয়েছিল পরশির জ্ঞান ফিরছে সেটা শুনে সকলের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। রুদ্ধ তো বোনের সাথে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে গেছিল কিন্তু ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেখা করতে পারলো না। মামনি আর জয়াও তাদের সাথে সারারাত এখানে ছিলো কিন্তু যখন শুনেছে পরশি ঠিক আছে তখন জয় তাদের জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয় এবং ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে।
_________________
রুদ্ধ কিছু কাজের জন্য হসপিটালের বাহিরে গিয়েছিল কিন্তু আসার সময় স্ট্রেচারের সাথে ধাক্কা খেয়ে তার হাতটা কেটে যায়। রক্ত’পা’ত প্রচুর হচ্ছিল কিন্তু তার কাছে এসব কোনো ব্যাপার না, এর চেয়ে বেশি র’ক্তা’র’ক্তি সে তার জীবনে দেখেছে তাই এসবে অতটা পাত্তা দিলো না।
স্নিগ্ধা খেয়াল করলো রুদ্ধের হাতে একটা সাদা রুমাল বাঁধা এবং তার ভিতর থেকে লাল রঙের রঞ্জিত তরল পদার্থ বের হচ্ছে যা নিমেষে সাদা রুমালকে লাল রঙে রুপান্তরিত করছে। স্নিগ্ধা দৃশ্যটা দেখে আঁতকে উঠেছিলো কিন্তু নিজেকে কোনো রকম সামলে দৌড়ে গেল নার্সের কাছে ফার্স্ট এড কিট চাওয়ার জন্য। নার্সের ব্যবহারটা খুবই খারাপ ছিলো তাও তাকে কিছু বললো না। দাঁতে দাঁত চেপে তার কথা গুলো হজম করলো। অতঃপর যখন কিটটা হাতে পেল সেখানে আর একমুহূর্তের জন্যও সে দাঁড়ায় নি।
রুদ্ধ থেকে কিছুটা দূরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্নিগ্ধা। ভিতরে অনেক ইতস্ততা কাজ করছে। যাবে কী যাবে না এটাই ভাবছে? প্রথমে ভেবছিল নার্সকে বলবে তার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিতে কিন্তু পরে মনে পড়লো নার্সকে নিজের ধারের কাছে রুদ্ধ আসতে দিবে না। নার্সকে সরানোর জন্য তার চোখ রাঙানোই যথেষ্ট। নিজেকে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে রুদ্ধের দিকে গেল কিন্তু ভয়ে তার বুকটা ধরফর করছে। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে ভাবলো সে যদি রুদ্ধের চোখের দিকে না তাকায় তাহলে তার ভয় করবে না। মনে মনে নিশ্চিত করে ফেললো এটাই করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
চোখটা বন্ধ করে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলো রুদ্ধ। আকস্মিক নিজের হাতে টান অনুভব করলে তার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। দ্রুত নিজের চোখ দুটো খুলে দেখলো স্নিগ্ধা তার হাতটায় মলম পট্টি করছে, এতে সে খানিকটা নয় অনেকটাই বিস্মিত হলো। যে মেয়ে তারা ছায়া দেখলেও দূরে সরে যায় সে আজ তার এত নিকটে এসেছে শুধু তার কষ্ট সয্য করতে না পেরে। যখনই সে স্নিগ্ধাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে ঠিক তখনই স্নিগ্ধা দৌড়ে সেখান থেকে পালালো।
___________________
নার্সের কাছে যখন শুনলো পরশির জ্ঞান ফিরছে তখন সবার হুরমুর করে ওর কেবিনে ঢুকলো। পরশিকে এমন নিস্তেজ অবস্থায় দেখে জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো। তাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অতীতের একটা স্মৃতি স্বরণ হয় তার। যখন সে পরশিকে ভালোবাসে না বলে রিজেক্ট করেছিলো তখন সে প্রায় ৩ ঘন্টার মত ঝর্ণা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফলে সে প্রচুর অসুস্থ হয়ে যায় এবং তাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়।
–কী হয়ে..ছে ভা..ইয়া? তো..মার মুখটা এতো মলিন কেনো? অসুস্থতার জন্য মুখে জড়তা এসে পড়েছে তাই খানিকটা তুতলাচ্ছে পরশি।
–আমি একদম ঠিক আছি। আমার আবার কী হবে? কিন্তু ১৯ বছরে পা রেখে এত বড় গাধামি কেমনে করলি তুই। কাপড়চোপড় না শুকিয়ে বের কেনো হলি? আচ্ছা যা এটাও বাদ দিলাম অন্ধকারের মধ্যে হাঁটাচলা কেনো করছিলি তুই। খানিকটা চিৎকার করে কথাগুলো বললো রুদ্ধ। রুদ্ধের এমন কথা শুনে পরশির চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। বকা খেয়েছে এই জন্য নয় তার ভাইয়ের তার জন্য চিন্তা দেখে।
–ভাই.. আসলে.. অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তুমিও ছিলে না তাই ভেবেছিলাম তাড়া..তাড়ি বাসায় চলে আ..সা.র জন্য। তাই এ..মন তাড়াহুড়ো।
–তোর কী আমাকে এতটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে যে তোদের কথা আমি ভুলে যাবো। তাছাড়া আমি যদি নাও আসতাম মামনি তো ছিলো সেখানে কাল রাত সেখানে পার করতি। এরপর আরও কিছু বলতে যাবে তখনি নার্স এসে রোগীকে বিশ্রাম দিতে আর জোরে আওয়াজ করতে না করে গেল। অতঃপর কেউ কিছু বললো না।জয়ও পরশিকে দূর থেকে দেখে চলে গেছে। পরশিও জয়কে খেয়াল করেছে কিন্তু কিছু বলেনি।
_______________________
জয়া বাসা থেকে সবার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মিসেস চৌধুরী আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ তার বিপি লো হয়ে যায় ফলে তাকে সবাই আসতে বারন করে দেয়। তাই সে জয়াকে বলে সবার জন্য খাবার নিয়ে যেতে। জয়াও যাওয়ার বাহানা খুঁজছিলো অবশেষে তা পেয়েও গেলো।
প্রায় সবাই খেয়ে ফেলেছে। পরশি অসুস্থ তাই বাহিরের খাবার তার জন্য নিষিদ্ধ। এখন শুধু রুদ্ধের খাওয়া বাকি আছে। পরশি ধীমে ধীমে খাবারের থালাটা নিয়ে রুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। রুদ্ধ তখন ফোন টিপছিল। কারো পায়ের পদচারণ শুনে রুদ্ধ মোবাইল থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে সেই ব্যক্তিটির দিকে তাকালো।
–কী হয়েছে? গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো রুদ্ধ।
–আসলে আপনি কাল রাত থেকে কিছু খাননি তাই আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম।
–আমার ক্ষুদা নেই। নিয়ে যাও।
–বললেই হলো ক্ষুদা নেই। মানুষ কী এত সময় না খেয়ে অতিবাহিত করতে পারে। আর খাবার না খেলে মানুষের মাথা কাজ কর না। আপনার তো অনেক কাজ আছে। না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। পরে পরশি আপু আমাকে বকবে। সে বলবে স্নিগ্ধা আমি অসুস্থ কী হলাম তুমি আমার ভাইয়ের ঠিক মত যত্ন নিতে পারলে না? তখন আমি জবাবে কী বলবো যে তার ঘাড়ত্যাড়া ভাই খাবার খেতে অস্বীকার করেছিল। অত্যন্ত চঞ্চলতার সাথে কথা গুলো বলে ফেলল স্নিগ্ধা। সাথে সাথে দাঁতে দাঁত চেপে ফেললো কার সামনে কী বলেছে সেটা এখন তার মাথায় ঢুকলো। আর রুদ্ধ তো হা হয়ে তাকিয়ে আছে।
আজ মনে হয় প্রথমবার স্নিগ্ধা কোনো প্রকার জড়তা ছাড়া তার সাথে এতক্ষণ কথা বললো। নিজেকে কোনো রকম সামলে তাকে জিজ্ঞেস করলো-
–মহারানী! সব দিকে তো আপনার খেয়াল আছে কিন্তু আমার যে হাত কা’টা সেটা কী আপনি ভুলে গেছেন? এই আধ ভাঙা হাত দিয়ে আমি খাবো কীভাবে?
রুদ্ধের এমন কথা শুনে আসলেই তার খেয়াল হলো সে তো ভুলেই গিয়েছিল রুদ্ধের হাত কা’টা। এখন কী মানুষটা এর জন্য না খেয়ে থাকবে? স্নিগ্ধাকে কিছু বলতে না দেখে রুদ্ধ আবার ফোনের মধ্যে নিজেকে মনোনিবেশ করলো। ঠিক তখনই স্নিগ্ধা ধীর পায়ে এসে তার পাশে এসে বসলো এবং কাঁপা কাঁপা হাতে ভাত শাক দিয়ে মেখে তার মুখের সামনে ধরলো। রুদ্ধ ও তাকে কিছু বললো না। সে চাইতো স্নিগ্ধা তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিক। আর তেমনটাই হলো। রুদ্ধকে এমন শান্ত ভাবে খেতে দেখে তার মনের ভীতিটা দূর হলো।
চলবে…