কঠিন প্রেমের গল্প পর্ব 9

0
908

কঠিন প্রেমের গল্প (নবম পর্ব)
ফারাহ তুবা

আমার ঘাড়ের ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। তার সাথে পিঠেও ব্যথাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এবার কেন যেন মনে হচ্ছে নীতুর সাথে মিল হবেই। সে নিশ্চয়ই ঘাড় পিঠ এসব টিপে দিবে। এইসময় আমি মনে করিয়ে দিবো যে কয়েকদিন আগেই আমার জ্বর হলো। এরপর ভাব করবো যে আমার হয়তো বড় কোন অসুখ হয়েছে। নীতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে আর আমি ওকে জড়িয়ে ধরবো। ব্যাস! আমাদের মধুর মিলন হয়ে গেলো। সিনেমা হলে এই পর্যায়ে একটা গানও হয়ে যেতো। মনে করেই বারবার আমার মনটা খুশিতে কেমন আনচান করছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। ব্যথা এত বেশি যে বেশিক্ষণ প্রেমের চিন্তা করা যাচ্ছে না। অফিস থেকে প্রায় পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছি। সারাদিন কোঁ কোঁ করেই কাটিয়ে দিচ্ছি।

অফিস থেকে অবশ্য ব্যথার জন্য ছুটি নেইনি। লিটা ম্যাম মানে হাফসা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেই ভয়ে ছুটিতে আছি। আমি কয়েকদিন আগে আমার এক কলিগের কাছ থেকে বেশ অদ্ভুত কিছু তথ্য পেয়েছি আমার প্রাক্তন সম্পর্কে। হাফসা ওরফে লিটা ম্যাম আমার ডিপার্টমেন্ট হেড সাব্বির ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ছিলো। সময়কাল শুনে বোঝা যাচ্ছে আমার সাথে যে সময় সম্পর্ক ছিলো সেই একই সময়ে সে উনার সাথে সম্পর্কে লিপ্ত ছিলো। অফিসে বিষয়টা বেআইনি বিধায় উনারা ঘটনা চেপে গিয়েছিলো। এরপর বেশ ভালো কয়েকটা আইডিয়া দেওয়াতে উনার ভালো প্রমোশন হয়। সাথে তাগড়া বোনাস পায় এবং কানাডায় চাকরি নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় বিয়ে করে লিটা ম্যামকে নিয়ে যায় এবং কোম্পানির বেশকিছু শেয়ার কিনে ফেলে তারা। আমার এই ঘটনা শোনার পর থেকে নিজেকে কীট পতঙ্গ মনে হচ্ছে। এখন আর হাফসাকে এত ধার্মিক নামে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। লিটা নামটাই ওর জন্য ঠিক।

আট বছর আগে হঠাৎ একদিন আমি লক্ষ্য করলাম আমার আর সাব্বির ভাইয়ের একই চিন্তা ভাবনা। আমি যা ভাবি, সাব্বির ভাই আগেই তা করে ফেলে। ফলে উনার সাথে আমার সখ্যতা বাড়লো। সেই সময় আমি জানতাম না আইডিয়ার সাথে প্রোমোশন বোনাসের সম্পর্ক আছে। ভাবছিলাম কাজ করবো, বাৎসরিক যা পাওয়ার তাই পাবো। আমি মনে মনে খুশি হতাম যে বসের সাথে আমার চিন্তা ভাবনার মিল আছে। অপরদিকে লিটা ম্যাম ওরফে হাফসা সাব্বির ভাইকে দেখতেই পারতো না। তাই ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে এসবের পেছনে সে আছে। আমি ভাবতাম যে এই মেয়েটার জন্যই আমি একইসাথে কাজের কথা বলছি আবার রোমান্টিক একটা সম্পর্কে থাকতে পারছি। নীতুকে খুব তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও ঘরকুনো মনে হতো।

আমার এখন ইচ্ছা করছে নীতুকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। এমন কোথাও যেখানে অফিসের কেউ নেই। লিটা ম্যামের সাথে সম্পর্কটা আসলে অফিসের কেউ জানে না। কিন্তু সমস্যা হলো ওর প্রতি আমার দুর্বলতা সবাই জানতো। আড়ালে সবাই ওকে আমার ডার্লিং বলে সম্বোধন করতো। আমারও শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যেতো। কিন্তু এখন সেটা চিন্তা করে অসহ্য লাগছে।

আজকে অনেকদিন পর রাতে নীতু সেজেগুজে বই পড়তে বসেছে। আজকে মোমবাতি জালিয়েছে কয়েকটা। সামনে দুই কাপ চা রাখা আর মাঝখানে রজনীগন্ধার মালা রাখা আছে। দূর থেকে কয়টা মালা আছে গুণতে পারছি না। আমি কেন যেন মালা গোণার জন্যই বারান্দায় ঢুকলাম। নীতু বই থেকে চোখ না তুলে বললো,

“বসো।”

বলে বইটা উল্টো করে রেখে দ্বিতীয় কাপ চায়ের ঢাকনা তুলে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমার অসুস্থতা ছাড়া কোন সমস্যা হয়েছে। কি সমস্যা আমাকে বলা যাবে?”

বলে উত্তর দেওয়ার আগেই থামিয়ে বললো,

“না বলতে চাইলে এখানে বসে থেকো না অকারণে। বই পড়ার সময় কেউ বিরক্ত করলে আমার ঘাড় ব্যথা করে।”

আমি ঠিক করলাম শুধু নীতুর পাশে বসে এক কাপ চা খাওয়ার জন্যই আমি বলবো আমার সমস্যাটা। এই সুযোগ বার বার আসে না।

“হাফসা দেশে এসেছে। সে কানাডায় থাকে। ওর নাম এখন লিটা মানে আগেও ছিলো একই নাম। ওর স্বামী আছে সে আবার সাব্বির ভাই। তুমি হয়তো সাব্বির ভাইকে চিনবে………”

“কি হড়বড় করে বলছো। থামো তো। লিটা আপা দেশে সেই তথ্য আমি জানি। উনি আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছেন। আমরা সামনের সপ্তাহে একসাথে খেতে যাচ্ছি। মানে আমাদের ফটোগ্রাফি এসোসিয়েশনের গ্রুপের ব্রাঞ্চ বাফেতে উনি যাবে। উনি কানাডায় থাকেন, উনার স্বামী সাব্বির ভাই এসব তথ্য জানি। এত বাসায় আসতো আমি এগুলো জানবো না?”

“তোমাকে বলতো আর তুমি শুনতে? কখনো বলোনি তো? তুমি কি জানো আমার সব কথা সে গিয়ে লাগিয়ে দিতো সাব্বির ভাইয়ের কাছে?”

“তুমি কি জানো যে হাফসা ওর আসল নাম না। অফিসে ধার্মিক ছেলেদের বোকা বানাতে এই নাম চালু করেছিলো। ওর আসল নাম লিটা সরকার। অফিসে একটা ডাকনাম বলে চালিয়ে দিয়েছে। কাগজে কলমে শুধু আসলটা ছিলো।”

আমি এই প্রথম অনেক দিন পর নীতুর হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে স্পট স্বরে বললাম,

“নীতু, তুমি এত কিছু জানো আমাকে কেন বলোনি কোনদিনো?”

নীতু হাসতে হাসতে বললো, “আমিও ঠকছি তুমিও ঠকছো এটা দেখতে ভালো লাগছিলো। আমরা হলাম ঠকা পরিবার। কিংবা আমাদের নাম দেওয়া যায় ঠকাশ দম্পতি।” বলে নীতু হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

আমি অবাক হয়ে নীতুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত!! কি অদ্ভুত!!!”

হাসি একটা ছোয়াচে রোগ। একারণে বোধহয় একসময় আমিও হাসতে শুরু করলাম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here