দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ২৫

0
458

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৫

মানুষের পাপের ভার যখন অতিরিক্ত হয়ে যায় তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। ধরণীতে তাঁর মতো হতভাগ্য আর কে আছে। মহিত ভাই হারানোর শোকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। বারবার ওর মনে হচ্ছে সকল কিছুর জন্য আরাফাত দোষী। কিন্তু বিষয়টা তো এরকম না। আরাফাত আর অরুনীর মধ্যে রাসেল এসে ঝামেলা শুরু করেছিল। মোটকথা রাসেল নিজের ভুলে একটা জীবন নষ্ট করেছে সেই সঙ্গে নিজেকেও ধ্বংস করেছে। অরুনী যখন বলেছিল ও আরাফাতকে পছন্দ করে তখন ওর মাথায় আগুন লেগে গিয়েছিল। ও আক্রমণ করে বসে নিজের ভালোবাসার মানুষের উপরে। ভেবেছিল এরকম হলে অরুনী বাধ্য হবে রাসেলকে ভালোবাসতে কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। অরুনীর নরম মনে ওর এই জঘণ্য কাজটা গভীরভাবে দাগ কাটে। ও নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করে। ভয় ঘৃণা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। বিষয়টা কাউকে বলতে পারেনি তাই সুইসাইড করে ফেলে। কিন্তু মহিত ভাবছে অন‍্যকিছু। ভাই বোনের আত্মহত্যার পেছনে আরাফাতকে দোষী ভেবে প্রতিশোধের নেশায় হৈমন্তীকে কিডন‍্যাপ করেছে। রাসেলের সুইসাইডের দুদিন পরে হৈমন্তীর ফোনে হঠাৎ একটা টেক্সট আসে। হৈমন্তী কিছু না ভেবে সেই ঠিকানাতে গিয়ে হাজির হয়। আর ওদিকে আবিরকেও সেম টেক্সট পাঠিয়ে বলা হয় হৈমন্তীকে বাঁচাতে হলে দ্রুত সেই ঠিকানাতে যেতে হবে। আবির হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে দেখে সত্যিই হৈমন্তীকে ওরা ধরে রেখেছে। মহিত এরকম একটা কাজ করবে আবির বুঝতে পারেনি। ছেলেটা নিজের ধ্বংস যে নিজেই ডেকে এনেছে এটা বোঝাই যাচ্ছে। তারপর এতকিছু হলো।

বতর্মানে, হৈমন্তীতে ঝু*লে পড়তে দেখে আবির চিৎকার করে উঠলো। মহিত একটুর জন্য হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাঁকাতেই রাবার বুলেট এসে ঠিক ওর হাত সোজাসুজি লাগলো। সেই সঙ্গে অসংখ্য বুলেট এসে ওর সারা শরীরে বিদ্ধ করলো। মহিত লুটিয়ে পড়লো তবে প্রাণ আছে। মর*লো না। রাবার বুলেটের জন্য কারো তেমন ক্ষতি হলো না। যেহেতু আবির হৈমন্তী আছে তাই এই বুদ্ধি করা।। ধুপধাপ শব্দে সারা রুমে অসংখ্য পুলিশে ভর্তি হয়ে উঠলো। আরাফাত দৌড়ে গিয়ে হৈমন্তীকে উঁচু করে ধরলো। আবির গিয়ে ওকে সাহায্য করলো। পুলিশের লোকজন মহিত আর ওর সঙ্গে থাকা পঙ্গদেরকে ধরে নিয়ে চলে গেলো। হৈমন্তী অনবরত কেশে চলেছে। ওর গলাই ভালো করেই লেগেছে। ভেবেছিল এতোটা লাগবে না। একটুর জন্য মনে হয়েছিল এই বুঝি শরীর থেকে প্রাণ বের হয়ে গেলো। কিন্তু হলো না বেঁচে গেলো। তবে আবির ভয়াবহভাবে রেগে আছে হৈমন্তীর উপরে। আরাফাত যত্নসহকারে বোনকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। তাছাড়া জানালার ওপাশ থেকে পুলিশের বড় দারোগা অলিয়ার হোসেন ওকে ঝু*ল দিতে ইশারা করেছিল। হৈমন্তী ভরসা পেয়েই এমন কাজটা করেছে যেটা আবির জানেনা। এতগুলো গোলাগুলির শব্দে হৈমন্তীর ভড়কে গেছে। কাশতে কাশতে ও অচেতন হয়ে পড়লো। আবির পালর্স চেক করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। আবির ফিসফিস করে বলল,
> ওকে নিয়ে বাড়িতে যাও আমি থানায় যাচ্ছি। কিছু হয়নি ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
আবির কথাটা বলে আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত অলিয়ার সাহেবের সঙ্গে চলে গেলো। আরাফাত দ্রুত বোনকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলো। একবার ভেবেছিল আবির‍দের বাড়িতে নিয়ে যাবে কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে বোনকে নিজের সঙ্গে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কাজীদের নিজেদের মধ্যে শত্রুর অভাব নেই। লোকে বলে বাইরের শত্রুতে কিছুই করতে পারেনা ঘরের শত্রুতে যতটা ক্ষতি করতে পারে। আরাফাতের বেশ আফসোস হচ্ছে বোনের জন্য। তার থেকে নিজের উপরে বেশি রাগ হচ্ছে। প্রথমবার মনে হচ্ছে অরুনীকে ভালোবাসা ওর ঠিক হয়নি। মেয়েটা এতদিন বেঁচে থাকতো। না পেরেছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে রক্ষা করতে আর এখন না পারছে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় বোনকে রক্ষা করতে। কিভাবে কি করবে মাথায় খেঁলছে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও হৈমন্তীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলো। বাড়িতে ফিরে হৈমন্তীকে রুমে রেখে রাজীব আর মাসুদকে ও সবটা খুঁলে বলল। হৈমন্তী টেক্সট পেয়ে যাওয়ার সময় আরাফাতকে সেই টেক্সটটা পাঠিয়ে সবটা বলে দিয়েছিল। আরাফাত সময় নষ্ট করেনি পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছে। ওদের উদ্দেশ্যে ছিল মহিত আর ওর দলবলকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে দেওয়া। সবটা পরিকল্পনা মতোই ঘেটেছে। যেটা আবির জানেনা। আমেনা বেগম মেয়ের মাথায় পাশে বসে আছে। অরিন ওর মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। চয়নিকা ওর হাতের তালু ডলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিটপিট করে হৈমন্তী চোখে খুলে তাকিয়ে চমকে উঠে বসে পড়লো। রাসেলের ঘটনাটা না ভুলতেই আবার নিজে এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো। হৈমন্তী গলাতে হাত দিয়ে বারবার ডলছে। তীক্ষ্ণ ব‍্যাথাই সারা শরীর অবস হয়ে আসছে। চয়নিকা দৌড়ে গিয়ে গরম দুধ নিয়ে আসলো। হৈমন্তী খাবেনা বলেও পার পেলো না। চয়নিকা ওকে জোর করে খাওয়ায়ে দিয়ে ওষুধ দিয়ে দিল। হৈমন্তী আশেপাশে আবিরকে খোঁজ করলো কিন্তু পেলো না। ওর মন খারাপ হচ্ছে। চয়নিকা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> তুমি খুব জঘন্য একটা কাজ করেছো। এরকম পাগলামী কেনো করলে হৈমী? যদি কিছু হয়ে যেতো কি করতাম বলো?

হৈমন্তী মলিন হেসে বলল,

> কিছু হতো না ভাবি। আমি জানতাম তখুনি এটাক হবে। তাছাড়া আমি যেটা করেছি সবটা সাজানো ছিল। আমি এমন না করলে মহিতের লক্ষ উনার মাথার দিক থেকে সরতো না।

চয়নিকা আর কিছু বলতে পারলো না। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। একজন স্ত্রীর কাছে নিজের প্রাণের থেকেও নিজের স্বামীর জীবন প্রিয় হয়। কথাটা ভেবে ওর বেশ ভালো লেগেছে। হৈমী যে আবিরকে ভালোবাসে এটাইতো অনেক। এদের ছন্নছাড়া সম্পর্কটা এবার মজবুত হবে ভেবেই মনে প্রশান্ত খেলা করছে।
___________________
দুদিন আবিরের খোঁজ নেই। মহিত আর ওর সঙ্গে থাকা কয়েকজন কথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।ওর নামে নারী পাচার সেই সঙ্গে কয়েকটা খুনের কেস ছিল। কাজীদের বাড়িতে আবারও শোকের ছায়া নেমে আসলো। আবিরের ফুপা রাগে ক্ষোভে জুলেখা কাজীকে ত‍্যাগ করলেন। একদিকে দুই দুটো ছেলেকে হারানোর শোক তারপর আবার স্বামীর এমন আচরণ ভদ্রমহিলা সহ‍্য করতে পারলেন না। হার্ট এটাক করলেন দ্বিতীয় দফায়। যদিও সেটা আবির সামলে নিলো কিন্তু ধরা পড়লো আরেক সমস্যা। কিডনিতে সমস্যা। যতই যা হোক ফুপিকে তো পর করতে পারবে না। তাছাড়া গোলনাহার বেগম মেয়ের জন্য পাগলামী করছেন। মায়ের মন বলে কথা। যারা হারিয়ে গেছে তাদেরকে তো আর ফিরে পাবে না কিন্তু যারা আছে তাদের যত্ন নিতে হ‍বে। জুলেখা কাজীর জ্ঞান নেই। আবির সেসব নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। তাছাড়া হৈমন্তীর উপরে রাগ থাকার দরুণ ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো না। হৈমন্তী বাধ্য হয়ে আবিরকে ফোন করলো কিন্তু ধরলো না। এক সময় বন্ধ আসতে লাগলো। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত বাড়ির গাড়ি নিয়ে আবিরের ক্লিনিকে গিয়ে হাজির হলো। কিন্তু দারোয়ান বললো সেখানে ও নেই। হৈমন্তী টাইম দেখে নিলো। সকাল বারোটা বাজে। আবির হাসপাতালে আছে ভেবে সেখানে গিয়ে পড়লো মহা বিপদে। লম্বা সিরিয়াল চলছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। হৈমন্তী নিরাশ হলো না। ধৈর্য্য নিয়ে ওর কেবিনের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলো। দীর্ঘ তিন ঘন্টা পরে আবির বেরিয়ে আসলো। আবিরকে দেখে হৈমন্তী দ্রুত ওর সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> দুদিন আপনার খোঁজ নেই। আপনার ফোন কোথায়? একবার ফোন ধরলে কি এমন ক্ষতি হতো?

হৈমন্তীর চোখেমুখে হাজারো অভিযোগ।কিন্তু আবির ওর কথার উত্তর দিলো না। ভ্রু কুচকে বলল,

> আমার কর্মক্ষেত্রে এসে বিরক্ত করা বন্ধ করো হৈমন্তী। তুমি আমার কথা শুনো যে আমি তোমার কথা শুনবো? বাচ্চাদের মতো আচরণ আমি পছন্দ করছি না। এভাবে আর আমাকে বিরক্ত করবে না।

আবিরের ধমক শুনে হৈমন্তীর চোখ ফেঁটে পানি আসলো। লোকটাকে ও বিরক্ত করছে কিন্তু কিভাবে? বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো। ওর হঠাৎ এমন আচরণ হৈমন্তীকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। লোকটা সব সময় ওকে আগলে রাখে। আজ হঠাৎ এমন কেনো করছে ও মেনে নিতে পারছে না। তাই জোর করে ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> এরকম কেনো করছেন? বললাম তো সেদিনের জন্য সরি। আমার ভুল হয়েছে।

> কিসের ভুল? তুমি আমার কথা কখনও ভেবেছো? আমি সব সময় তোমাকে ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার বয়স কতো জানো? আমার একজন ভরসাস্থল জায়গার দরকার আছে হৈমন্তী। বারবার মনে হয় কর্মব্যস্ততা শেষে যখন বাড়িতে ফিরবো আমার স্ত্রী আমাকে একটু ভালোবাসুক। আশেপাশের ঘুরঘুর করুক। না চাইতেই পাশে বসে হাত ধরে আমার ক্লান্তি দুর করে দিক।কিন্তু তুমিতো এসব জানো না। তুমি জানো কিভাবে আমার অবাধ‍্য হওয়া যায়। আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। সুখের অভিনয় করতে গিয়ে হাপিয়ে গেছি। পরিবারের ঝামেলা সেই সঙ্গে তোমার ঝামেলা। মাথায় কাজ করছে না। পাগল হয়ে যাচ্ছি।তুমি তো বাচ্চা, সকলের আদরের দুলালি। কিছু হলে ভাইয়েরা পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করবে। আর আমি একটা ভেঙে পড়া গোষ্ঠীর দায়িত্ব নিয়েছি। সবাইকে বোঝাতে ভালো রাখতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। প্লিজ দয়াকরে আমাকে একটু শান্তি দাও। বাড়িতে ফিরে যাও। আমার মন ভালো হলে গিয়ে নিয়ে আসবো। তাছাড়া বারবার আমার পরিবার থেকে তোমার উপরে আক্রমণ হচ্ছে। কিছু হলে তখন আমাকে দোষারোপ করা হবে।

আবির একদমে নিজের রাগক্ষোভ হৈমন্তীর উপরে ঝেড়ে দিলো। পরিবারের ঝামেলা তারপর হৈমন্তীর প্রতি রাগ সব মিলিয়ে আবির আগেই রেগে ছিল। হৈমন্তীকে পেয়ে সবটা উগড়ে দিতে সময় লাগলো না। যা ইচ্ছে এলোমেলো হৈমন্তীকে দোষারোপ করে ছেড়ে দিয়ে নিজে হালকা হয়ে গেলো। রাগের মাথায় কি না কি বললো। হৈমন্তীর ছোট মাথায় সেটা বিশালাকার জটলা পাকিয়ে গেলো। ওর চোখে ভারি বর্ষণ নেমে আসলো। কন্ঠ রোধ হয়ে কিছুই বলতে পারলো না। অন‍্যদিন হলে ভ‍্যা ভ‍্যা করে কাঁদতো কিন্তু আজকে আর পারলো না। ওকে আবির বাচ্চা বলে কটাক্ষ করেছে যেটা হৈমন্তীর গায়ে লেগেছে। একজন মেয়ের শরীর মনে ভালোবাসা বা প্রেমের ধারণা আসতে কতটুকু বয়সের প্রয়োজন হয়? আঠারো বছর মেয়েদের বিয়ের বয়স কিন্তু বহুকাল আগে থেকেই মেয়েরা দশ বছরেই স্বামীর সংসার করে আসছে। মফস্বলের মেয়েদের বয়স আঠারো হতে কেউ অপেক্ষা করে না। কোনোমতে পনেরো হলেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। ওর বয়সি অনেকের বাচ্চা আছে যারা চুটিয়ে সংসার করছে। শাশুড়ি ননদের সঙ্গে গলাবাজি করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে আছে। সেখানে আবির ডাক্তার হয়ে কিভাবে বলতে পারে হৈমন্তী স্ত্রী হিসেবে বাচ্চা। আর দশটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মতো ওদের সম্পর্ক ছিল না তাই বলে কি সব সময় থাকবে নাকি?সময় দিলে স্বাভাবিক হয়ে যেতোনা?।আবির এলোমেলো ভাবে বুঝিয়ে দিলো হৈমন্তী ওর যোগ্য না।কথাগুলো ভেবে হৈমন্তী চোখের পানি মুছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> সরি,আমার আসা ঠিক হয়নি।

হৈমন্তী কথাটা শেষ করে আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গিয়ে গাড়ি উঠলো। আবির যখন বুঝতে পারলো মেয়েটাকে খুব করে রাগিয়ে দিয়েছে ওকে থামানো দরকার ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। হৈমন্তীর গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আবির হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের উপরেই বিরক্ত হলো। মেয়েটার রাগ ভাঙানো দরকার ভেবে ফোন দিলো কিন্তু ফোন বন্ধ। ওর বাড়ির দিকে যাওয়া দরকার ভেবে গাড়িতে উঠতেই ফোন বেঁজে উঠলো। গোলনাহার বানু দ্বিতীয়বার হার্ট এটাক করছে। অবস্থা ভালো না। আবির আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো নিজের ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে। ভাবলো পরে হৈমন্তীকে বুঝিয়ে বলবে।
____________________
এক সপ্তাহ হৈমন্তী কারো সঙ্গে কথা বলে না। চুপচাপ পড়াশোনা করছে। রাজীব বোনের এমন পরিবর্তন দেখে হতবাক। আরাফাত চিন্তা করছে। মাসুদ এটা সেটা বলে ওকে হাসানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। হৈমন্তীর ফোন বন্ধ আছে। আবির মাদ্রাজ গেছে গোলনাহার বানুকে নিয়ে। হার্ট অপারেশন করতে হবে। সেখানেই অপারেশন হবে। যাওয়ার আগে হৈমন্তীর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। সুযোগ হয়নি। ক্লিনিকে গিয়ে দাদিজানের অবস্থা খারাপ দেখে সেদিনই টিকিট কেটেছে। আগে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাই ব‍্যবস্থা আগে করেছিল। যেতে ওদের কোনো অসুবিধা হলো না। হৈমন্তী অরিনের থেকে সবটা শুনেছে তবুও কিছু বলেনি। যেই লোকটা ওর উপরে বিরক্ত হৈমন্তী তাঁকে আর নতুন করে বিরক্ত করবে না। ওর মাথায় অন‍্য কিছু ঘুরছে। সেই অনুযায়ী বড় ভাইয়ের রুমে গিয়ে হানা দিলো। রাজীব গভীর মনোযোগ দিয়ে ফাইল চেক করছিল। দুদিন পরে সংসদ। সেখানে কি কি উপস্থাপন করবে সেটা লিপিবদ্ধ করছিল এমন সময় হৈমন্তীর গম্ভীর মুখ নিয়ে রাজীবের পাশে গিয়ে থপ করে বসে পড়লো। বোনের মুখের দিকে তাঁকিয়ে রাজীব ভ্রু কুচকে বলল,

> মাদ্রাজ যাওয়ার ব‍্যবস্থা করবো নাকি? ডাক্তারের জন্য মন পুড়ছে?

রাজীবের কথা ওর কাছে বিষাক্ত লাগলো। রাজীব ভেবেছিল হৈমন্তী লজ্জা পাবে। মজার ছলে কথাটা বলে ফেঁসে গেলো। হৈমন্তী লজ্জার বদলে রেগে গিয়ে বলল,

> আমাকে বাল‍্য বিবাহ দিয়ে তুমি অন‍্যায় করছো ভাইয়া। তোমার জন্য একটা জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুমি নিজে অপরাধি হলে সেই সঙ্গে আমাকেও অপরাধী বানিয়ে দিলে। কেনো করলে ভাইয়া? আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তুমি জানো ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা কতটা কষ্টের?

হৈমন্তী কথাগুলো বলে কান্নাই বেঙে পড়লো। এতগুলো দিন নিজেকে কঠিন করে রাখতে পারলেও আজ আর পারলো না। রাজীব দ্রুত বোনকে নিজের বুকের সঙ্গে নিয়ে মাথায় হাত রেখে ব‍্যস্ত হয়ে বলল,

> আবির তোকে কিছু বলেছে? ওকে আমি খু*ন করবো।আমার বোনের চোখে পানি ঝরিয়েছে। ওর সাহস হয় কিভাবে রাজীবের কলিজাতে আঘাত করে। ওর মতো হাজারটা ছেলে আমি আমার বোনের জন্য নিয়ে আসতে পারি।

রাজীব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে বোনের চোখে পানি দেখে। চয়নিকা স্বামীর উপরে বিরক্ত হলো। একেতো নাচনে বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ি। দুজনের মধ্যে ঝামেলা মেটানোর চিন্তা না করে আরও উস্কানি দিচ্ছে। হৈমন্তী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

> ভাইয়া উনি কিছুই করেননি। উনি ভালো মানুষ। আমি উনার উপযুক্ত না। তুমি চাও তোমার বোন এরকম থেকে যাক? উপযুক্ত হতে হবে না,বলো?

রাজীব কিছুই বুঝলো না। বোনকে ও এভাবেই পছন্দ করে। উপযুক্ত হতে আরও কি দরকার ও ভেবে পাচ্ছে না। তবুও বোনকে শান্ত করতে বলল,

> একদম চাই। আমার বোন উপযুক্ত হয়ে সবাইকে চমকে দিবে। পৃথিবীর সব মেয়েদের চাইতে বেশি উপযুক্ত হবে আমার বোন। তাছাড়া তুই এমনিতেই উপযুক্ত। আরও কতো?

হৈমন্তী ভাইয়ের বুকে আকিবুকি করে নাক টেনে বলল,

> এরকম না ভাইয়া আরও ভালো হতে হবে। ডাকাত ডাক্তারের চাইতে ভালো। আমি উপযুক্ত হয়ে ডাক্তারের সামনে ঘুরঘুর করবো। লোকটা দেখবে আর আফসোস করবে। কেমন হবে বলো?

রাজীব বুঝতে পারলো এদের কিছু একাট নিয়ে ঝামেলা চলছে। যাই ফিসফিস করে বলল,

> কি করতে হবে বল? আমার বোনের জন্য আমি সব করতে পারি। শুধু একবার বল কি চাই?

> অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার অনুমতি আর ভিসা টিকিট চাই। সময় এক সপ্তাহ। এবার দেখবো তুমি কেমন এমপি হলে। সংসদে তোমার কতো ক্ষমতা হলো। কাজটা করতে ক্ষমতা লাগাবে না পারলে টাকা খাওয়াবে। আমি কোনো না শুনবো না। সেখানে ফুপি আম্মা আছে না? উনাকে বলো ব‍্যবস্থা করবেন।

রাজীব ভ্রু কুচকে ফেলল। বোনকে এতোটা রেগে যেতে ও আগে কখনও দেখেনি। কিভাবে না করবে বুঝতে পারছে না।
☆☆☆☆
একদিকে হৈমন্তী অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য তোড়জোড় লাগাতে শুরু করলো। অন‍্যদিকে আবির গোলনাহার বানুকে নিয়ে হাসপাতালে যুদ্ধ করতে লাগলো। হৈমন্তীর জন্য প্রাণ উথলা হলেও নিজেকে বোঝালো বাড়িতে গিয়ে সবটা মিটিয়ে ফেলবে। নিজের উপরে প্রচণ্ড রাগ হয় ওর সেদিনের জন্য। হৈমন্তীর অল্প বয়স, এই বয়সে মেয়েদের আবেগ বেশি হয় এটা ভেবে শঙ্কিত হলো। তবে সে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না এটা সেটা ভেবে নিজেকে বুঝিয়ে দাদিজানের চিকিৎসা করতে লাগলো। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে অঘটন একটা ঘটে যাবে এটা ওর ভাবনাতেও আসলো না।

(চলবে )

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here