দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ২৪

0
404

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৪

রাসেলের লা*শটা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। পুলিশের ঝামেলা আছে তাই নামানো হয়নি। তাছাড়া রাসেলের নামে অভিযোগ আছে ওকে জেল থেকে এখানে ভর্তি করা হয়েছিল। বাইরে পুলিশ পাহারা থাকলেও জেলার ছাড়া লা*শ নামানো যাবেনা। তাছাড়া রাসেলের বাবা ভয়ানক চটে আছেন। উনি উল্টো কেস করবেন বলে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। হাসপাতাল থেকে কিভাবে রোগীর গলাই ফাঁস লাগিয়ে মারা যায় উনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাসেলের হাতে পায়ে বেড়ি ছিল। কিন্তু কিভাবে জানি ছেলেটা টাউল ছিড়ে লম্বা দড়ির মতো করে সিলিং ফ‍্যানের সঙ্গে গলাই ফাঁস নিয়েছিল। নিয়তি হয়তো ছেলেটাকে এই পযর্ন্ত সঙ্গ দিয়েছিল তাই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রাণ পাখি শরীর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। আবির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গে হৈমন্তী আছে। ওকে কিছুতেই বাড়িতে রেখে আসা যায়নি। আবির আর জোরজবরদস্তি করেনি সঙ্গে নিয়েছে কিন্তু মেয়েটার হঠাৎ জ্বর বেশি হতে শুরু হয়েছে। আবির ওকে সঙ্গে নিয়েই পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিলো। মাঝেমাঝে হৈমীর কপালে হাত রেখে জ্বরটা দেখে নিচ্ছে। আশেপাশে অনেকেই ওদের দিকে অবাক হয়ে দেখছে সে নিয়ে আবির চিন্তিত না। ওর আসল চিন্তা ফুপিকে নিয়ে। কিভাবে সহ‍্য করবে আল্লাহ্ ভালো জানে। তাছাড়া রাসেল ওদের বাড়িতে থেকে মানুষ। পাঁচ বছর দেশের বাইরে ছিল তবুও দেশে ফিরে বাড়িতে যায়নি ওদের বাড়িতেই উঠেছে। আবিরের বাবা মা চাচা চাচি ওকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। হঠাৎ ওর মৃ*ত্যুর কথা শুনে নিজেদের মেয়ের কথা মনে পড়ছে। মানুষ যতই দোষ করুর তাঁর মৃ*ত্যুর পরে সেই দোষটা আর কারো চোখে পড়ে না। সকলে আফসোস করছে। মনে হচ্ছে রাসেলের সঙ্গে এরকম না করলেই ভালো হতো। কিন্তু আবিরের একদম সেসব মনে হচ্ছে না। এরকম যে হতে পারে ওর হয়তো ধারণা ছিল। তাছাড়া নিজের বোনের লাশ নিজের হাতে কে*টে টুকরো টুকরো করেছিল সেদিনই ভেবেছিল ওর খুনীর লা*শটাকেও এভাবে টুকরো টুকরো করবে। পাপ করলে শাস্তি পেতে হয়। হয়তো দুদিন দেরী হয় কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কাউকে ছাড় দেন না। ধৈর্য্য ধরলে ফল পাওয়া যায়। আবিরের ধ‍্যান ভাঙলো হৈমন্তীর হাতের স্পর্শ পেয়ে। আবিরের মুঠোয় হৈমন্তীর হাতটা শক্ত করে ধরা আছে। মেয়েটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আবির কি করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটাকে এখানে আনা ঠিক হয়নি। ওকে হয়তো সারারাত এখানেই থাকতে হবে। হৈমন্তীর চোখেমুখে ভয় আর আতঙ্ক খেলা করছে। জীবনে প্রথমবার ঝুলন্ত অবস্থায় কোনো পরিচিত ব‍্যাক্তির লাশ দেখলো। সেটা দেখেই শরীর কেঁপে উঠেছে। পা ঠকঠক করে কাঁপছে। আবির বিষয়টা ঠিক পেয়ে চাপা কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,

> জিদ দেখিয়ে চলে আসলে এখন ভয় পাচ্ছো। জ্বরটা বেড়েছে। আমার এখানে অনেক কাজ আছে। লাশ নামিয়ে ময়নাতদন্তের পরে থানায় নিতে হবে। সেখানে থেকে বাড়িতে পাঠাতে হবে। বুঝতে পারছো কত ঝামেলা? চলো তোমাকে এখানে ভর্তি করি। সঙ্গে কাউকে রাখবো। যাবে?

আবিরের বলতে দেরী হলো কিন্তু হৈমন্তীর ওকে জড়িয়ে ধরতে দেরি হলো না। ও দ্রুত কন্ঠে উত্তর দিলো,

> কখনও না। আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না। আমার ভয় করছে। কৌতূহল ছিল তাই এসেছি। আমি চোখ বন্ধ করলেই রাসেল ভাইয়ার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে উনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

হৈমন্তী কেঁদে ফেলল কথাটা বলে। আবির দুহাতে ওকে আগলে নিয়ে বলল,

> এসব ভাবছো কেনো এমন কিছু হবে না আমি আছি তো? আমারই ভূল তোমাকে আগে জানানো উচিৎ ছিল লাশ ঝুলছে। শুনো আমি বাসাই ফোন করি তোমাকে কেউ এসে নিয়ে যাবে।

> আপনাকে ছাড়া আমি ফিরবো না। আমার মাথা ঘুরছে বমি পাচ্ছে। আমি বাথরুমে যাবো।

হৈমন্তী কথাগুলো বলতে বলতেই বমি করে ভাসিয়ে দিলো। আবির দ্রুত ওকে নিয়ে বসে পড়লো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সিস্টারকে ডেকে নিলো। ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে ফ্লোর পরিস্কার করিয়ে নিতে বলল। হৈমন্তী অচেতন হয়ে পড়েছে। আবির ওকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের চেম্বারের গিয়ে ঢুকলো। সদর হাসপাতালে চাকরি করার সুবাদে এখানে ওর একটা কেবিন আছে। যেখানে ও সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পযর্ন্ত রোগী দেখে। আবিরের এখানে অনেক চেনাজানা লোকজন আছে। হৈমন্তীর খালাতো ভাই দুদিন আগেই বদলি হয়েছে ও থাকলে আরও সুবিধা হতো। বমি করে মেয়েটার শরীর একেবারেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। আবির দ্রুত ওকে ইনজেকশন দিয়ে দিলো। জীবনে প্রথমবার ইনজেকশন দিতে গিয়ে ওর হাত কেঁপে উঠলো কিন্তু মেয়েটা একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না।। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবিরের ডাক পড়বে। কিন্তু মেয়েটাকে ফেলে কিভাবে যাবে বুঝতে পারছে না। এর মধ্যেই আরাফাতের ফোন পেয়ে আবির ভ্রু কুচকে ফেলল। কিছু না ভেবেই ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই আরাফাত বলে উঠলো,

> আমি আর অরিন হাসপাতালে। রাসেলের লাশ নামানো হয়ে গেছে তুমি কোথায়?

আবির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,

> হৈমীর শরীর খারাপ হয়েছে। মেয়েটার জ্ঞান নেই। আমার কেবিনে আসো। খুব ঝামেলায় পড়েছি। হঠাৎ জ্বর বেড়েছে।

আবির কথাটা শেষ করতেই আরাফাত ফোন কেটে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে অরিনকে নিয়ে আবিরের কেবিনের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও গেলো। ও দ্রুত গিয়ে বোনকে দুহাতে আগলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> কি দরকার ছিল ওকে এখানে আনার? স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও ও লাশ দেখেনা আর তুমি এই রাতের বেলায় ওকে ঝুলন্ত লাশ দেখিয়েছো। আমার বোনের কিছু হলে কিন্তু খবর আছে।

আরাফাত রীতিমতো আবিরকে হুমকি দিচ্ছে। আবির সেসব নিয়ে ভাবছে না। ওর দৃষ্টি অরিনের দিকে। মুখটার মুখটা কেমন ফ‍্যাকাসে হয়ে গেছে। ও দ্রুত নিজের বোনের হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পানির গ্লাসটা ওর সামনে দিয়ে বলল,

> নিজের বোনের উপরে দর‍দ ষোলো আনা। এদিকে যে অন‍্যর বোনের দুঃখ সে বুঝতে পারে না। সবাই স্বার্থপর অরিন। তুই কেনো এসেছিস রাত করে?

অরিন ভয়ে চুপসে ছিল হঠাৎ ভাইয়ের আদর পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

> রাসেল ভাইয়া কেনো এমন করেছিল ভাইয়া? আমার বোনটাকে মেরে ফেলে এখন নিজেও মরে গেলো। আমার বোনটার কি দোষ ছিল ভাইয়া? ওকে মেরে ফেলল।

অরিনের কান্না শুনে আরাফাত দ্রুত হৈমন্তীকে রেখে এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

> একদম কান্নাকাটি করবে না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কাকে ফেলে কাকে সামলাবো। চরম ভূল হয়েছে তোমাকে নিয়ে এসে।

অরিন ঠোঁট চেপে কান্না আটকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> আমি ঠিক আছি। আপনি হৈমীকে নিয়ে বাড়িতে চলুন। ওর শরীর খারাপ।

আবির ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে হৈমন্তীর জ্বর চেক করে নিলো। মেয়েটার মাথায় পানি দেওয়া দরকার। রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। যদি ভাইরাস জনিত সমস্যা থাকে। মৌসুম চেঞ্জ হচ্ছে জ্বর হওয়া স্বাভাবিক তবুও কোনো রিস্ক নেওয়া ঠিক না। আবির খুব আলতো হাতে হৈমন্তীর হাত থেকে এক সিরিজ রক্ত তুলে নিয়ে আরাফাতকে বলল,

> আমি ওকে গাড়িতে রেখে আসছি। তোমরা ওকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাও। মাকে আমি ফোন করেছি। হৈমন্তীর জন্য মাকে দরকার। আমি যেতে পারবো না অনেক ঝামেলা আছে।
আরাফাত চুপচাপ ও কথায় সাড়া দিলো। অরিনকেও এখন বাড়িতে থাকা জরুরি। ওর বাবা মা কান্নাকাটি করছে। আবির হৈমন্তীকে তুলতে গেলে কিন্তু আরাফাত ওকে বাধা দিয়ে বলল,
> আমি পারবো তুমি এদিকটা সামলে বাড়িতে ফিরে এসো।
আরাফাত কথা শেষ করে হৈমন্তীকে তুলে নিয়ে অরিনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অরিন ওর শার্টের কোনা ধরে হাটছে। অনেক রাত হওয়ার জন্য হাসপাতালে লোকজন কম। আবির আসবো না ভেবেও কিছুদূর ওদের পেছনে পেছনে এসে চলে গেলো। রাসেলের পোস্টমটেমের জন্য ওকে ডাকা হয়েছে। রিপোর্ট তৈরী করতে হবে। রাসেলের মাথায় সমস্যা ছিল। সুইসাইড করেছে একটা সাধারণ ডাইরি করা হয়েছে। তাছাড়া একজন ধর্ষকের কেস নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করতে নারাজ হচ্ছে পুলিশ। আবির গিয়ে সাইন করে দিয়ে লাশ কাটা ঘরে ঢুকে পড়লো। যদিও ওকে কিছুই করতে হবে না। ভেবেছিল আসবে না তবুও এসেছে। চোখের দেখা দেখতে।এর জন্য হাসপাতাল অথরিটিকে রিকুয়েস্ট করতে হয়েছে।
___________________
জুলাখা কাজী ছেলের শোকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কাজীদের হয়েছে বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো অবস্থা। একদিকে বোন অন‍্যদিকে মেয়ের খুনীর মা। কিভাবে কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। রাসেল তো মরে গিয়ে বেঁচেছে কিন্তু যারা জীবিত আছে তাদের অবস্থা টাইট হচ্ছে। জুলাখা কাজীর স্বামী মুরাদ হাওলাদার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিবেন এই সেই বলে গালিগালাজ করছে। উনার ভাষামতে উনার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। অরুনীর দোষ ছিল। অরুনী ইচ্ছে করে উনার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে। মেয়েটা রাসেলের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেতে এসব করে যখন দেখেছে সবাই জেনে যাবে তখন নিজে ভয়ে সুইসাইড করেছে। তাছাড়া রাসেল তো সত্যিকারেই ওকে ভালোবাসতো। মেয়েটা ওর সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে আরেক প্রেমিক জুটিয়েছিল। এক সঙ্গে দুই নৌকায় পা রাখতে গিয়ে স্লিপ খেয়েছে। উনার আজেবাজে কথাবার্তা শুনে আনোয়ার কাজী চুপচাপ বাড়িতে ফিরে এসেছে। কোনো ইচ্ছে নেই ওই বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করার। মেয়ের সমান ভাইজির নামে এসব শুনতে উনি নারাজ। মেয়েটার সঙ্গে অন‍্যায় করেছেও কেমন গলাবাজি করছে। চোরের মায়ের বড়গলা কথাটা এই লোকটা বারবার প্রমাণ করছে। আবির লাশ মর্গে থেকে সোজা রাসেলদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলো। গ্রাম থেকে অনেকেই এসেছে। রাসেলের বাবা চাচারা অনেকেই। কিন্তু কেউ আবিরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে না। সকলের রাগ কাজীদের উপরে। আবির ওসব পাত্তা দিচ্ছে না। চুপচাপ দায়িত্ব পালন করেছে। লাশ পাঠিয়ে দিয়ে ও ভোরবেলায় বাড়িতে ফিরে আসলো।
☆☆☆☆

হৈমন্তীর জ্বর কমছে না। আসমা বেগম একভাবে মেয়েটার মাথায় পানি দিচ্ছেন। বারবার ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছেন। জ্বরের ঘোরে বারবার ভুলভাল বকছে। ভয় পাচ্ছে। অরিন ওর হাত ধরে বসে আছে। আরাফাত আবিরকে কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু ধরেনি। আবির এসে হৈমন্তী এমন অবস্থা দেখে আর সময় নষ্ট করলো না। আসার সময় দরকারি ওষুধপত্র নিয়ে এসেছে । ওকে ইনজেকশন দিয়ে সবাইকে ঘরে যেতে বলল। আসমা বেগম পানির পাত্র রেখে বেরিয়ে গেলেন। বাড়িতে এখন শোক চলছে। গোলনাহার বানুর শরীর তেমন ভালো নেই। রাসেলের খবরটা শুনে চুপচাপ হয়ে গেছে। এদিকে আদরের মেয়ে হাসপাতালে। কোনদিকে যাবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। এভাবে চললে আবারও হার্ট এটাক হবে তখন আর বাঁচানো যাবে না। আবির অরিন আর আরাফাতকে রুমে পাঠিয়ে হৈমন্তীর পাশে বসে পড়লো। মেয়েটা ফিসফিস করে ভুলভাল বকছে। আবির একভাবে মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। জ্বরে মেয়েটার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। তবুও ওর মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াময় মেয়েটি ওর সামনে অবস্থান করছে। প্রথমদিনের কথাগুলো বারবার মনে হলো। কেনো যে সেদিন এভাবে দেখেতে পারেনি এখন আফসোস হচ্ছে। সেদিন ভেবেছিল নিতান্তই একটা বাচ্চা মেয়ে। বউবউ কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। হয়তো দিনদিন ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া মোমের কাছে আগুন বেশিক্ষণ থাকলে গলে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। আবির আনমনে কথাগুলো ভেবে চলছে। হৈমন্তীর জ্বর ছাড়ছে। মেয়টা আস্তে আস্তে চোখ খুলে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে চিৎকার করতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির ওর মুখে হাত লাগিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,
> বড়দের কথা না শুনলে এটাই হয়। কতবার বললাম বাড়িতে থাকো।জিদ করে গেলে এখন বুঝতে পারছো কত সমস্যা হবে? একা একা বাথরুমে পযর্ন্ত যেতে পারবে কি সন্দেহ আছে। আম্মাকে বলছি সঙ্গে নিয়ে যেতে। আমি এই গাধার দায়িত্ব নিতে পারবো না।

আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো।এখানে কখন এসেছে ওর মনে পড়ছে না। হাসপাতালে ছিল হয়তো সেটুকু মনে আছে। আবির ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে নিয়ে বলল,

> কিছু খাবে? ওষুধ আছে খেতে হবে। জ্ঞান ছিল না তাই দুটো ইনজেকশন দিতে হলো। আবারও যদি নিতে চাও তাহলে আর খেতে হবে না। দিবো?

আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল,

> একদম না। আম্মাকে একটু ডাকুন না। আমি উনার কাছে যাবো। কতদিন দেখিনি।

আবির মলিন হেসে বলল,

> শাশুড়ির আদর খাওয়া আপাতত হচ্ছে না। বাড়ির অবস্থা ভালো নেই। মা দাদিজানের কাছে আছেন। এতক্ষণ তোমার কাছেই ছিলেন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
আবির উঠতে গেলো কিন্তু হৈমন্তী ওকে উঠতে দিলো না। দ্রুত হাত ধরে অনুরোধ করলো,
> আমাকে একা রেখে যাবেন না। আমি সুস্থ আছি। আপনি আমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ুন। একটু ঘুমিয়ে নিন ভালো লাগবে।
আবির বুঝলো বিষয়টা তাই আর ঝামেলা করলো না। অরিনকে ফোন দিয়ে বলে দিলো রুমে খাবার দিয়ে যেতে। খালি পেটে থাকলে শরীর আরও খারাপ হবে তখন সামলাতে কষ্ট হবে।

☆☆☆☆☆☆
সিলিং ফ‍্যানে দড়ি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হৈমন্তী। দড়ির এক প্রান্ত সিলিংএ অপর প্রান্ত নিজের গলাতে ফাঁস লাগানো আছে। পায়ের নিচে চেয়ারটা টলমল করছে যেকোন সময় পড়ে যেতে পারে। ওর সামনে মহিত আবিরের কপালে রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তীর চোখে পানি আর আবিরের চোখেমুখে আতঙ্ক। মহিতের শর্ত হৈমন্তী নিজের ইচ্ছেতে সুইসাইড না করলে ও আবিরের কপালে গুলি করবে। নিজের জীবন বাঁচাতে চাইলে স্বামীর জীবন হারাতে হবে। আবির মনেপ্রানে চাইছে মহিত ওকে গুলি করুক হৈমন্তী যেনো ওর কথা না শুনে। কিন্তু হৈমন্তীর মনে অন‍্য কিছু চলছে। ও পারবে না নিজের ভালোলাগা ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু দেখতে। লোকটাকে নিজের মুখে কখনও ভালোবাসি কথাটা ও বলতে পারেনি। যতবার কাছাকাছি এসেছে ততবার ঝগড়া নয়তো তর্কাতর্কি হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক সম্পর্ক ওদের ছিল না। ভেবেছিল এবার সবটা ঠিক করে নিবে। হৈমন্তী লোকটার সঙ্গ খুব করে চেয়েছে। এখনো চাই আর সেটা পরকালেও চাইবে। কিন্তু তার আগেই কঠিন এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মহিতের লোকজন আবিরকে ধরে রেখেছে। ছেলেটা চিৎকার করছে। বারবার হৈমন্তীকে নিষেধ করছে এসব না করতে। ও মরলে কিছুই হবে না কিন্তু হৈমন্তীর কিছু হলে ওর অনেক কিছুই হবে। হৈমন্তী কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না বরং। মলিন হেসে বলল,

> ডাকাত ডাক্তার ভালো থাকবেন। আপনি ছিলেন আমার জীবনে অনাকাঙ্খিতভাবে আসা প্রথম পুরুষ। আমার সকল অনুভূতি ভালোবাসা ভালোলাগা শুধু আপনাকে ঘিরে। আমি পারবো না আমার ভালোবাসার মৃত্যু নিজের চোখের সামনে দেখতে। জীবনের শুরুতেই যদি আপনাকে হারিয়ে ফেলি তবে শেষটা কিভাবে কাটবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে। আমি নিজের মৃত্যু অনায়াসে মানতে পারবো। চলে যাচ্ছি ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন। যাওয়ার সময় খুব করে আফসোস হচ্ছে কখনও স্ত্রীর ধর্ম পালন করতে পারলাম না ভেবে।

কথাটা বলে হৈমন্তী ফুপিয়ে উঠলো।
আবির চিৎকার করে মহিতকে বলল,

> ভাই আমার,তুই আমাকে যা ইচ্ছা কর প্লিজ ওকে ছেড়ে দে। আমি কথা দিচ্ছি আমার মৃত্যুর পরে কেউ তোকে কোনো বিরক্ত করবে না। তুই প্লিজ আমার বউকে ছেড়ে দে। দেখ ভাই প্লিজ আমি অনুরোধ করছি। ওকে ছেড়ে দে।

আবিরের গলা কাঁপছে। হৈমন্তীর কিছু হলে ও বাঁচতে পারবে না। কিন্তু ওর অনুরোধ শুনে মহিত বেশ করে হাসলো। ওর হাসি পাচ্ছে এই দুজনের নাটক দেখে। এটা রঙ্গ মঞ্চ নয়। এটা ওর ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের মঞ্চ। মহিত মুখটা কঠিন করে বলল,

> ভাই ও মারা গেলে তুই আবার বিয়ে করতে পারবি। ধুমধাম করে আবার তোর বিয়ে হবে। নিজের পছন্দসই মেয়ের সঙ্গে। তোর উপরে আমার কোনো রাগ বা অভিযোগ নেই। আছে ওর উপরে। ওর ভাইয়ের উপরে। ওর ভাই আমাদের বোনকে ট্রাপে ফেলে প্রেম নিবেদন করেছিল। অরুনি না বুঝে আমার ভাইকে ফেলে ওর ভাইয়ের সঙ্গে মন নেওয়া দেওেয়া করে বসে। ওর ভাই এই দুটো মানুষের মধ্যে না আসলে দুজনই বেঁচে থাকতো। নিজেদের দোষ মির্জারা কখনও দিয়েছে বলে তোর মনে হয়? শোন ভাই আমি এই মেয়েটার লাশ দেখতে চাই। ওর ভাই যখন নিজের কাটাছেড়া বোনের শরীরটা দেখবে তখন আমি পার্টি দিয়ে আনন্দ করবো। চরম হবে সেই পার্টি। ভাই তুই ওর ময়নাতদন্তের দায়িত্ব নিবি। ওর কলিজাটা আমাকে দিবি আমি যত্ন নিয়ে রাখবো।। আরাফাত বোনের শোকে আমাদের মতো জ্বলবে। আমি মজা করবো।

আবিরের ইচ্ছে করছে মহিতের গালে থাপ্পড় লাগাতে। ছেলেটা উন্মাদ হয়ে গেছে। কিভাবে হৈমন্তীকে বাঁচাবে ওর মাথায় আসছে না। এর মধ্যেই হৈমন্তী চরম পাগলামি করে ফেলল। পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা লাথি দিয়ে ফেলে দিলো। আবির হতভম্ব হয়ে গেছে নিজের চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে। কিভাবে কি করবে । পাগল পাগল লাগছে।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। কয়েক পর্বের মধ্যে গল্পটা শেষ করতে চলেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here