চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]
[০৯]
আজকের সকালের শুরু টা সূর্যের স্মিতি আলোতে হয়েছে। সকাল থেকে এখন অব্ধি দিনটা কেমন যেন মনমরা লাগছে। পুরোটা দিন বিষাদের উপর কেটে গেলো অর্ষার। কাল রাত থেকে এখন অব্ধি মনে হয় হাজার খানেক ম্যাসেজ কল দিয়েছে অর্ষা। কিন্তু এখনো রিফাতের কোনো জবাব এলো না। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো অর্ষা। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেলো সে। আকাশের এক মনে তাকিয়ে রইলো। রাস্তায় চলিত গাড়ির আলো মিটমিট জ্বলিত। কোলাহলমুক্ত রাত্রীর শহর! মাঝে মাঝে প্রয়োজনে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ। সেই আওয়াজের পাশাপাশি বিষন্ন অর্ষার মন। হঠাৎ ম্যাসেজের টোনে ধ্যান ভাঙ্গে তার। মোবাইল তড়িঘড়ি করে হাতে নিলো রিফাত ম্যাসেজ দিয়েছে ভেবে। কিন্তু না! রিফাত নয় বরং রিফাতেরই একটা মেয়ে ফ্রেন্ড ম্যাসেজ দিয়েছে। অর্ষা ম্যাসেজ দেখে একদম স্বব্ধ হয়ে গেলো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ম্যাসেজে পাঠানো ছবি গুলোর দিকে। তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রিফাতের ফ্রেন্ড মৃত্তিকার সাথে বেড শেয়ারের কয়েকটা ছবি। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রিফাত খালি গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে আর মৃত্তিকা তার বুকের উপর। মৃত্তিকার শরিরেও কাপড় নেই। কিভাবে সম্ভব এটা? রিফাত তাকে এভাবে ঠকালো? চোখ ভিজে এলো অর্ষার। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো সে।
চায়ের দোকানের সামনে এনার্জি বাল্বে আলোকিত রাস্তা। দোকানে বসে আছে কয়েকজন আধবয়সী লোক। তারা চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে আর ছেলেদের হাসি, খেলা দেখছে। তাদেরই সামনে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ছেলে। মূলত তারা ক্যারামবোর্ড খেলায় ব্যস্ত। নিরব আর অর্পন এক টিমে। বিপরীত টিমে আমজাত আর হাবিব। টানটান উত্তেজনা সবার মাঝে। জিততে পারলে আগামীকালের লাঞ্চের দায়িত্ব বিপরীত টিমের। অর্পন বড় ঘুঁটিতে আঙ্গুল দিয়ে টুকা দিয়ে কুইন অর্থাৎ রেড ঘুঁটি টা গর্তে ফেলে দিলো। টিমের সবাই ‘ওহ’ বসে উল্লাসিত হলো। হাসলো অর্পন। পরপর কয়েকবার সাদা ঘুঁটি নেওয়ার পর শেষ বার পারলো না। তার পর হাবিবের চান্স এলো। তখুনি মোবাইলে ‘রকস্টার’ গানের রিংটোন বেজে উঠলো অর্পনের। দুই হাত ঝামটা মেরে ময়দা ফেলে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো সে। স্কিনে অর্ষার হাস্যউজ্জল চেহারা ভেসে উঠলো। কিন্তু নামের জায়গায় লিখা ছিল ‘মাথা ব্যাথা!’ ক্যারামবোর্ডের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নিরবের নরজে এলো তা। নিকনেম দেখে আলতো করে হাসলো সে। অর্পন কল রিসিভ করার পর অর্ষার কান্নামিশ্রিত কন্ঠ ভেসে আসলো। হতভম্ব হয়ে গেলো অর্পন। অস্থির হয়ে উঠলো তার মন। উত্তেজিত কন্ঠে নিচু গলায় বললো, ‘অর্ষা? কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’
হাবিবের পর নিরবের ঘুঁটি মারার পালা এলো। নিরব ঘুঁটি মারছে আর আড়চোখে অর্পনকে দেখছে। অর্পনের আবারো বললো, ‘অর্ষা?’
অর্ষা কান্নায় ভাঙ্গা কন্ঠে কোনো রকমে অর্পনের নাম উচ্চারণ করলো। আর কিছু বলতে পারলো না। অর্পর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। খেলা ফেলেই কাউকে কিছু না বলে বাসার উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো। তাকে এভাবে অস্থির হয়ে যেতে দেখে অবাক হলো সবাই। চেঁচিয়ে ডাক দিলো, ‘কিরে খেলা ফেলে কোথাই যাচ্ছিস?’
উত্তর নেই অর্পনের। সে দৌড়ে চলে গেলো। নিরব কিছু বললো না। চুপচাপ কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাবিব বললো, ‘কি হল এটা? খেলার মাঝে চলে গেলো কেন এভাবে?’
একজন ছেলে বললো, ‘অর্ষা কল দিলো দেখলাম। কিছু হয়েছে নাকি?
আমজাত অস্থির কন্ঠে বললো , ‘কিরে নিরব কিছু বলছিস না কেন?’
ঠোঁট কামড়ে বড় ঘুঁটিটা হাতে নিলো নিরব। সাদা ঘুঁটির উদ্দেশ্যে তাক করে শুধাল, ‘রিলেক্স! তেমন কিছু হয়নি। খেলায় মনোযোগ দে।’
কেউ কিছু বলল না। চুপচাপ খেলায় মশগুল হলো। অর্পনের জায়গায় একজন ছেলে এসে খেলতে লাগলো। তবে অর্পনের মতো এতোটা পাকাপোক্ত নয় সে খেলায়।
এতোটা রাস্তা দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো অর্পন। ঘেমে গেছে প্রায়। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পরে আছে। উষ্কখুষ্ক হয়ে এলো তার চেহারা। কলিং বেল বাজানোর পর হেনা দরজা খুলে তার এই অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠলো, ‘তোমার এই অবস্থা কেন অর্পন? কি হয়েছে?’
অর্পন রিলেক্সে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে শুধাল, ‘আরে মামি নিরব ভাইয়ের সাথে ক্যারাম খেলছিলাম। বাহিরে প্রচুর গরম ছিল তাই এমন দেখাচ্ছে।’
– ‘ঠিক আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার টেবিলেই বাড়া আছে। আসো আমি দিচ্ছি।’
– ‘টেবিলে থাকলে সমস্যা নেই আমি নিজে নিয়ে খেতে পারবো। সন্ধ্যায় সিঙ্গারা খেয়েছিলাম তাই এখন ক্ষিদে নেই। আপনি শুয়ে পরেন।’
হেনা কথা বাড়ালো না। খেয়ে নিতে বলে রুমে চলে গেলো। সে যেতেই অর্পন স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো। তারপর এগিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে অর্ষার রুমে প্রবেশ করলো। পুরো রুম খালি দেখে বারান্দায় পা রাখলো সে। দেখলো অর্ষা বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে বসে আছে। অর্পন গিয়ে নিশব্দে তার পাশে বসলো। মলিন চোখে তাকালো অর্ষা।
‘কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’
ঠোঁট ভেঙ্গে এলো অর্ষার। মোবাইল বের করে অর্পনের হাতে দিলো। ছবি গুলো দেখেই অর্পন নাক কুঁচকে হাত থেকে মোবাইল সরিয়ে ফেললো। বিড়বিড় করে বলল, ‘তোকে শুধু বারোভাতারি ভাবছিলাম। এখন দেখছি তুই লুইচ্চা নাম্বার ওয়ান। লম্পট কোথাকার।’
কেঁদে ফেললো অর্ষা। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এমন করলো কেন আমার সাথে? এতোদিনের পরিচয়ে একটা মানুষ এতোটা নিকৃষ্ট কিভাবে হতে পারে? দেখ কাল বিকেলেও প্রথম মিট করেছি আমরা। আর আজ? তার ফ্রেন্ড বলে পরিচয় দেওয়া মেয়েটা জানালো তাদের মাঝে ইন্টিমেট হয়েছে। তাও অনেক বার।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্পন। এক হাতে অর্ষাকে টেনে কাছে বসালো। অর্ষা অর্পনের কাধে মাথা রেখে বসলো। অর্পন বুঝাতে লাগলো, ‘যে ধোকা দিয়েছে তার জন্য কাঁদবো কেন আমরা? চোখের জলের অনেক দাম। কিছু নিকৃষ্ট বেইমানদের জন্য এই মূল্যবান জিনিসের অপচয় করতে নেই।’
আরো কিছুক্ষন বুঝালো অর্ষাকে। এক পর্যায়ে কান্না থামালো সে। অর্পন তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে রিফাতকে সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়ে দিলো। গ্যালারি ঘেটে রিফাতের সকল ছবি ডিলেট দিলো। কোনো প্রকার প্রতিত্তুর করে নি অর্ষা। চুপচাপ অর্পনের কাধে মাথা রেখে মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে ছিলো। কেঁটে গেলো দীর্ঘসময়! অর্পন বললো, ‘আমি তখন বলেছিলাম বিশ্বাস করিস নি আমার কথায়। যাই হোক! যে তোকে ভালোবাসে নি তার জন্য খামোখা মন খারাপ রেখে লাভ নেই। তুই এখন কাঁদছিস আর ওই দিকে গিয়ে দেখ লুইচ্চা ডেটিং এ বিজি। বাদ দে! ভালো ছেলে পাবি। এমনিতেও মামা রিলেশন মেনে নিতো না। শুকরিয়া আদায় কর আগে আগেই ঝামেলা থেলে বেঁচে গেছিস বিধায়। এবার আঙ্কেল একটা ভালো ছেলে দেখে তোকে বিয়ে দিতে চাইলে চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতো রাজি হয়ে যাবি।’
নিরবে মলিন হাসলো অর্ষা। চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে বসলো। বললো, ‘মানুষ ঠিকই বলে জীবনের প্রথম প্রেম কখনোই টিকে না। আমি তো যতেষ্ট এডাল্ট ছিলাম। তাহলে ভুল মানু্ষকে কিভাবে বিশ্বাস করলাম? বিশ্বাস কর ভাই রিফাত যদি এখন সামনে থাকতো তাহলে আমি তাকে বাথরুমের জুতা দিয়া পি’টাই’তাম।’
হেসে ফেললো অর্পন। বললো, ‘জুতা পি:টার কথা পরে ভাব। আপাতত কেঁদে কেটে জুয়ার ভাসাতে হবে না। তোর এই অবস্থায় একদম পেত্নি লাগছে। যা মুখ ধোয়ে আয়! অন্ধকারে আমার ভয় লাগছে।’
অর্ষা অর্পিনের পিঠে চাপড় বসালো একটা। অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘ক্ষুদা লাগছে। তোর লাগে নাই? আয় টেবিলে! আমি মুখ দিয়ে আসছি।’
রুমে এসে ওয়াশরুমে চলে গেলো অর্ষা। নির্জনে একা বসে রইলো অর্পন। ভাবতে লাগলো কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। হয়তো রিফাতের সাথে ব্রেক’আপ হওয়ায় তার খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু না! সে খুশি হয়নি। অর্ষার কান্নামিশ্রিত মুখ দেখে তার ভালো লাগেনি। উল্টো রিফাতের উপর রাগান্বিত হলো সে। এই মুহূর্তে রিফাতকে কাছে পেলে মাটিতে পু:তে ফেলতো। কেবলমাত্র অর্ষাকে কাঁদানোর অপরাধে। অর্ষা কখনোই কাঁদবে না! কেবল হাসবে! প্রাণ ভরে হাসবে!
.
স্নিগ্ধ সকাল! পাখিদের কোলাহলে পূর্ণ চারপাশ। তাদের সুমধুর কিচিরমিচির ডাক কেবলমাত্র ভোরের সময় সুভা পায়। ভোরে যখন সূর্য আস্তে আস্তে পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়ে আকাশ করে হলুদ লালচে বর্ণ। তখন সূর্যোদয় দেখার মতো অসাধারন মুহূর্ত দ্বিতীয় কিছু নেই। মসজিদে ফজরের সালাত শেষ করে বের হলো অর্পন। এক হাত পকেটে গুঁজে পর হাত উঠিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করে হাটছে। পিছনে অর্ষার বাবা আর নিরবের বাবা কথা বলতে বলতে হাটছে। অর্পন তাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। তখুনি ডাক পরলো নিরবের। দাঁড়ালো অর্পন!
‘কি অর্পন তখন খেলা ছেঁড়ে পালালে কেন? তোমার জন্য কাল আমার পকেট খালি হয়ে গেছে।’
মৃদু হাসলো অর্পন। নিরব এগিয়ে অর্পনের সাথে হাটা ধরলো। অর্পন হাটার মাঝেই শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলো। তারপর মলিন কন্ঠে বললো, ‘আসলে তখন অর্ষা কল দিয়েছিলো। ইমার্জেন্সি ছিলো তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। সরি ভাই!’
নিরব পকেটে দুই হাত গুঁজে হাটছে। পরনে তার সাদা শার্ট। অবাধ্য কিছু চুল কপালে আঁচড়ে পরে আছে তার। পকেট থেকে হাত বের করে চুল পিছে ঠেলে শুধাল, ‘ইট’স ওকে! অর্ষার কি হয়েছে? মানে তখন তোমাকে খুব অস্থির লেগেছিল তাই জিজ্ঞেস করা।’
– ‘তেমন কিছু না। অর্ষার মন খারাপ ছিলো। দ্যাট’স ইট!’ অর্পনের কথায় শুনে নিরব কিছু জিজ্ঞেস করলো না আর। চুপচাপ মাথা দুলালো। অন্য টপিকে কথা বলতে লাগলো দুজন।
চলবে??
নোট : রিফাতের উপর যাদের মায়া হয়েছিলো তাদের নিষ্পাপ মুখখানি একটু দেখতে চাই ?? ওকে হ্যাপি রিডিং। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। ?