চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব পর্ব ৮

0
243

চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]

[০৮]

ডিএসপি.
ধর্মসাগর পাড় কুমিল্লা শহরের বিশাল জলধারা। এটি শহরে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। বিশাল জলধারার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে কাঠগোলাপ গাছ আকাশ ছুঁয়ার উপক্রম। বিভিন্ন কাঠগোলাপ ফুলের স্নিগ্ধতা মুখরিত হয়ে থাকে পরিবেশ। চারপাশে সবুজ গাছ-গাছালির সৌন্দর্যে ধর্মসাগর পাড় আরো মুগ্ধকর। পার্কে এসে আড্ডা জমায় বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সময় কাটানোর জন্য এখানে আসা তাদের। ধর্মসাগর পাড়ের রাতের দৃশ্য আরো মনোরম। দুজনের মাঝে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে পাশা-পাশি হাটছে রিফাত আর অর্ষা। ছয় মাসের সম্পর্কে তাদের প্রথম দেখা আজ। অর্ষার মনে ভয় আর জড়তা একইসঙ্গে কাজ করছিলো। আসতে চায়নি সে। কিন্তু রিফাত নাছোড়বান্দা। এতোদিনের পরিচয়ে এখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। সে বেশ কিছুদিন ধরেই অর্ষাকে রিকুয়েস্ট করছিলো মিট করার জন্য। বাধ্য হয়ে অর্ষা অর্পন কে সব বললে অর্পন সুযোগটা করে দেয়। আপাতত এক পাশে ইটের তৈরি ব্যাঞ্চির মাঝে বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছে অর্পন। আর অর্ষা? সে এখানে আসার পর থেকেই রিফাতের সাথে লাপাত্তা। ঘুরাঘুরি করছে পার্কের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে।

রিফাত পকেটে হাত গুঁজে হাটছে। বারবার আড়চোখে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে সে। আর অর্ষা লজ্জায় নিশ্চুপ হয়ে আছে। বেশ কিছুসময় পর রিফাত নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো, ‘এতো চুপচাপ আছো কেন? কথা হারিয়ে ফেললে নাকি?’

প্রতিত্তুর করলো না অর্ষা। লজ্জা পেলো আরো। অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো। রিফাতও মৃদু হাসলো নিঃশব্দে। বললো, ‘ডিএসপি এতোদিন ভিডিওতে দেখছিলাম। আজ সরাসরি দেখছি। বাস্তবে আরো সুন্দর।’

অর্ষা বললো, ‘বিকেলের পরিবেশ যেমন সুন্দর তার থেকেও বেশি রাতে সুন্দর লাগে।’

– ‘সমস্যা নেই। বিয়ের পর তো কুমিল্লা যাওয়া আসা হবে। তখন না হয় বউকে নিয়ে দেখবো।’

মৃদু আওয়াজে হাসলো অর্ষা। রিফাত তাকে দাঁড় করিয়ে দূর থেকে একটা পড়ন্ত সাদা কাঠগোলাপ নিয়ে আসলো। তারপর অর্ষার খোলা চুলে কানের পাশে কাঠগোলাপ এটে দিয়ে বললো,

‘কাঠগোলাপের স্নিগ্ধতা আর আমার প্রেয়সী, দুইজনই অসম্ভব সুন্দর।’

এই দৃশ্যটা দূর থেকে দুজন ছেলের চোখে পরে। অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যখন অর্ষাকে দেখলো তারা। কুমিল্লার এই এক সমস্যা! ডিএসপিতে বফ-গফ নিয়ে ঘুরাঘুরি করবে আর সেটা পরিচিত কারোর নজরে আসবে না তা কখনোই হবে না। ছেলে দুটো একে অপরের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। একজন বললো, ‘এটা অর্ষা না? পাশের ছেলেটা কে?’

অপর ছেলেটি শুধাল, ‘মনে তো হচ্ছে প্রেমিক। দেখ চুলে ফুল গেঁথে দিলো।’

প্রথম ছেলেটি আবারো বললো, ‘দাঁড়িয়ে না থেকে ভাইকে ফোন লাগা। আমার ব্যালেন্স নাই তুই তাড়াতাড়ি দে।’

এক সেকেন্ডও দেড়ি করলো না ছেলেটি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে ডায়াল করলো। পরপর কয়েকবার রিং পরার রিসিভ হলো কলটি।

‘ভাই গরম খবর আছে।…..”

নিজের চোখে দেখা সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললো দুজন। মোবাইলের অপর পাশে থাকা ব্যক্তিটির চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো তাদের কথা শুনে। কপালের রগ ফুলে নীল বর্ণ ধারন করলো তার। হাতে থাকা পানির কাচের গ্লাস ফ্লোরে স্বজোড়ে আছাড় মারলো। কাচ ভাঙ্গার আওয়াজে এপাশে থাকা দুইজন ছেলে ভয়ে মৃদু কেঁপে উঠলো। ভাই ক্ষেপেছে মানেই আজ কেলেঙ্কারি হবে। শুকনো ঢুক গিললো দুজন। অতঃপর নিদিষ্ট কাজের আদেশ আসতেই দুজন বাঁকা হাসে কল কেটে দিলো। তারপর কল লাগালো অন্যদের। মানে আজ! আজ ছেলেটির কপালে দুঃখ আছে…!!

রাতের পরিবেশ অন্ধকার। আকাশের চাঁদে আলোতে আলোকিত ধরনী। এখন ঘড়ির ঘন্টার কাটা এগারোটার ঘরে। আর মিনিটের কাটা পঁয়তাল্লিশের ঘরে। অর্ষা বারবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলাচ্ছে। মোবাইল হাতে নিয়ে রিফাতকে আবারো কল দিলো। অপর পাশ থেকে একটা মেয়ের মোলায়েম কন্ঠ জানান দিলো নাম্বার বন্ধ। ভয় আরো বেড়ে গেলো অর্ষার। রুম থেকে বেড়িয়ে দেখে অর্পন সোফায় আধশোয়া হয়ে টিভিতে খেলা দেখছে। অন্যান্য রুমের লাইট অফ মানে সবাই ঘুমাচ্ছে। অর্ষা অর্পনের পাশে বসে ভয়ার্ত গলায় বললো, ‘অর্পন? রিফাত এখনো কল দেয়নি। বন্ধ বলছে মোবাইল। আমার টেনশন হচ্ছে। এতোক্ষনে তো বাসায় চলে যাবার কথা। এখনো যায় নি? ঝামে:লায় পরেনি তো আবার।’

অর্পন স্বাভাবিক ভাবেই বাদাম ছিঁলে মুখে দিয়ে উত্তর দিলো, ‘দেখ গিয়ে তোর পরে আবার অন্য কারোর সাথে ডেইটে গেছে।’

চেহারায় বিরক্তি এনে বলল অর্ষা, ‘ইয়ার্কি করিস না।’

মৃদু হাসলো অর্পন। আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘রিলেক্স ইয়ার! হয়তো মোবাইলে চার্জ নেই। টেনশন নিস না। পৌছে গেছে এতোক্ষনে।’

চিন্তা মুক্ত হলো না অর্ষা। ঠোঁট কামড়ে ভাবছে সে। আবারো দেয়াল ঘড়ির দিলে তাকালো। রিফাত পৌঁছালে এখনো জানায় নি কেন? উফফ!

অর্পন টিভি থেকে চোখ ফিরিয়ে অর্ষার দিকে তাকিয়ে দেখলো অস্থির মুখখানা। অর্ষা যখন মন খারাপ করে তার কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা বলেছিলো তখন অর্পনের মনে হয়েছিলো অর্ষার মন খারাপ করতে নেই। যে করেই হোক অর্ষার মন ভালো করা চায় তার। সেই জন্যই তো অর্ষাকে ডিএসপিতে নিয়ে গিয়েছে অর্পন। অর্ষার হাসিমুখ খানি দেখে তার নিজের কাছে অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করেছিলো। সে চায়, অর্ষা সবসময় হাসুক।
.

অন্ধকার কক্ষ! মাথার উপর সোডিয়ামের হলদে বাতি মিটমিট করে জ্বলছে। তার আবছা আলোতে মেঝের মাঝখান কেবল আলোকিত। সেখানে চেয়ারে হাত, পা ও মুখ বাধা অবস্থায় বসে আছে রিফাত। চোখে-মুখের অবস্থা বেহাল। ডান গালের এক পাশ লাল হয়ে থেঁতলে আছে। ঠোঁটের পাশে রক্তকণিকা চিকচিক করছে। এক দফা মা:র খেয়েছে সে। সন্ধ্যার পর যখন কুমিল্লা শহর অন্ধাকারে ঢেকে গিয়েছিলো তখুনি বাসস্টপ থেকে তাকে কেউ তুলে নিয়ে আসে। তারপর কয়েকজন মিলে কিছুক্ষন মে:রেছে যার কারনে সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে এখন চেয়ারে বাধা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। বাধা হাত ছাঁড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলো কিছুক্ষন। তখন পাশ থেকে একটা তাচ্ছিল্যের কন্ঠ কানে এলো রিফাতের।

‘ভাই গা:ঞ্জা খাইছোস? দেখছ না দড়ি দিয়া হাত পা বাধা তাও ক্যান কৈ মাছের মতো তেড়েং-বেরেং করতাছোস?’

রিফাত আশেপাশে চোখ বুলালো। লাইটের আলোতে শুধুমাত্র তার জায়গায় আলোকিত আর বাকিসব অন্ধকার তাই তার নজরে এলো না কেউ। তখন পায়ের গটগট শব্দে রিফাতের কানে এলো। চুপচাপ বসে রইলো রিফাত। একজন যুবক চেয়ার টেনে রিফাতের সামনে বসলো। মাক্স আর কালো চশমা পরা তাই চেহারা দেখে নি রিফাত। যুবকটি রিফাতের মুখের কাপড় খুলে প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘নাম কি তোর?’

রিফাত নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। উত্তরে শুধাল, ‘খন্দকার রিফাত!’

যুবক পায়ের উপর এক পা তুলে প্রশ্ন করলো, ‘এখানে কি করছিস?’

-‘গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি।’ বলতে দেড়ি গালে স্বজোড়ে থাপ্পড় পরতে দেড়ি হয়নি। থাপ্পড়ের চুটে ঠোঁটের এক পাশ কেটে গেছে রিফাতের। যুবক দাঁতে দাঁত পিষে আবারো প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘গার্লফ্রেন্ড? শা:লা গার্লফ্রেন্ড মারাছ তুই? তোর সাহস কি করে হয় অর্ষার সাথে প্রেম করার? কত দিনের রিলেশন তোদের?’

অবাক হলো রিফাত। বললো, ‘আপনি অর্ষার কে হন?’

যুবক হুংকার দিয়ে রিফাতের চুল মুঠ করে ধরে বললো, ‘অর্ষার নাম মুখে নেওয়ার চেষ্টা করবি না। ঠোঁট ছিঁড়ে ফেলবো একদম।’

চুল ছেঁড়ে চেয়ারে আবারো পা তুলে বসলো যুবক। বললো, ‘অর্ষার দিকে আজ পর্যন্ত কারোর চোখ তুলে তাকানোর সাহস অব্ধি হয়নি। আর তুই কই থেকে টপকালি বলতো? তোকে তো কুমিল্লার মনে হচ্ছে না। বাড়ি কই তোর?’

ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে আছে রিফাত। কুঁচকালো মুখেই উত্তর দিলো, ‘রাজশাহী! এখন ঢাকা থাকি।’

– ‘অর্ষার সাথে পরিচয় কিভাবে? কত দিনের পরিচয়?’

– ‘ফেসবুকের মাধ্যমে। পরিচয় এক বছরের, সম্পর্ক ছয় মাসের।’

দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংযত রাখার প্রয়াস করলো যুবক। পারলো না। রাগান্বিত হয়ে রিফাতের মুখ বরাবর একটা ঘুষি মারলো। তারপর এক হাতে চুল ধরে অপর হাতে গাল চেঁপে ধরলো। রাগান্বিত গলায় বলে উঠলো, ‘তোকে মে:রে রাস্তায় ফেলতে ইচ্ছে করছে। শা:লা এতো সাহস হয় কিভাবে তোর? যেই অর্ষাকে দূর থেকে আমি দেখে যাচ্ছি, তাকে ছোট থেকে প্রোটেক্ট করেছি সেই আমার অর্ষার সঙ্গে তোর এক বছরের সম্পর্ক? তোকে তো আমি..”

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। একপাশে একটা অর্ধ ভাঙ্গা ইট দেখে সেটা হাতে নিয়ে রিফাতের মাথায় বাড়ি দেওয়ার উপক্রম হলো সে। তখুনি একজন এসে হাত ধরে ফেলে তার। বলে উঠে, ‘পাগল হয়েছিস? ফেল এটা। এমনিতেই অনেক মার খেয়েছে। আসল কথা বলে ছেঁড়ে দে।’

হাতে থাকা ইট ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করলো যুকব। চুল গুলো পিছে ঠেলে রিফাতের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ব্রেক’আপ করবি তুই।’

আতকে উঠলো রিফাত। চোখ বড়বড় করে নাঃকোচ করলো, ‘ইম্পসিবল! আমি অর্ষাকে ভালোবাসি। ব্রেকআপের কোনো প্রশ্নই আসে না।’

যুবকটি পকেট থেকে ছু:ড়ি বের করে রিফাতের এক হাতের শিরা বরাবর টান দিয়ে বললো, ‘যেভাবেই হোক ব্রেক’আপ করবি অর্ষার সাথে। নাহলে তোর লা:শ পরবে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছি আমি। আমার খারাপ রূপ টা বের করতে বাধ্য করিস না। এমন একটা ব্যাপার ক্রিয়েট করবি যেন অর্ষা তোকে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করে। মাইন্ড ইট??’

অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো রিফাত। প্রতিত্তুর করলো না। এমনিতেই সে ব্রেকআপ করতো। সেটা নাহয় এখুনি করা যাক। এমন মা:র কপালে জুটবে জানলে জীবনেও এই প্রেম করতো না সে। যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গ দের ইশারা করলো। আদেশ পেয়েই তারা উঠে রিফাতের আপ্যায়ন করতে লাগলো। যুবক তার বন্ধুর সাথে বের হয়ে এলো এই নির্জন বাড়ি থেকে। চুপচাপ এগিয়ে যাচ্ছে সামনে দুজন। তখন পাশে থাকা ছেলেটি বললো, ‘অর্ষাকে বলে দিলেই তো পারিস।’

যুবক চুপচাপ এগুচ্ছে। শুধাল, ‘আমি প্রেম নয় বিয়ে করতে চাই অর্ষাকে। বিয়ের পর প্রেম হবে আমাদের।’

চলবে..??

নোট : রিফাতের এই হাল করলো কে? অনুমান করতে পেরেছেন কেউ? ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। হ্যাপি রিডিং!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here