চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব পর্ব ১১

0
308

চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]

[১১]

রোজকার দিনের মতো আজকের দিনটাও ব্যস্ততায় কেটেছে অর্পনের। বড়বড় বইয়ের মাঝেই সারাটা দিন ডুবে ছিলো। ক্লান্ত শরির টেনে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরলো অর্পন। ঘামে ভিজে শার্ট গায়ে লেপ্টে আছে। চুল গুলো হাল্কা ভিজে কপালে পরে আছে।উষ্কখুষ্ক চেহারা। মলিনতা ভাস্যমান। আজ একটু বেশিই ক্লান্ত সে। বাসায় এসে ঘন্টা-খানেক সময় নিয়ে গোসল করলো। ঘুম পাচ্ছে তার। ঠান্ডা পানি খেতে রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গেলো। ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে ফেললো সে। ফিরে যাওয়ার পা বাড়াতেই তার মা আফসানা ডাক দিলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখে আফসানা বসে আছে। অর্পন এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘ডাকলে কেন?’

আফসানা খুশিতে গদগদ করে বলে উঠলো, ‘অর্ষার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের সাপ্তায় বিয়ে ফাইনাল। আমাদের এই সাপ্তায় যেতে হবে কুমিল্লা।’

বিস্মিত হলো অর্পন। তবে সেটা প্রকাশ করলো না। বিচলিত হলো না একটুও। বরং উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। প্রশ্ন করলো সে, ‘কার সাথে?’

‘তুই তো এতোদিন কুমিল্লা ছিলি। এহসান ভাইকে চিনিস না? উনার এক মাত্র ছেলে নিরব। খুব ভালো ছেলে। ওকে আমি কাছ থেকেই চিনি। ওর সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে অর্ষার। যদিও আগে এমন কথা হয়েছিল আমরা জানতাম। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো তোর মামা। শুন! তুই সব গুছিয়ে নিস। দুইদিন পর কুমিল্লা যাবো আমরা।’

অর্পন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে শুধাল, ‘আমি এখন যেতে পারবো না। তোমরা যাও। আমি পরে বিয়ের দিন যাবো। আমার কাজ আছে এইদিকে।’

রুমে এসে ধিরিম করে দরজা লাগিয়ে দিলো অর্পন। বিষাদ লাগছে তার। ভালো লাগছে না। অর্ষার বিয়ের খবর পেয়ে তো তার খুশি হওয়ার কথা ছিল। তাহলে? খু্শি হলো কেন সে?

কুমিল্লা.
বিকেলের পরিবেশ স্নিগ্ধ। মুগ্ধকর বাতাস প্রভাহমান। হাল্কা উড়ুঁ বাতাসে সিল্কি কালো চুল গুলো উড়ছে। একরাশ ভালোলাগার স্নিগ্ধতা কাজ করছে মনে। রেলিং’এ হাতের কুনই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে অর্ষাকে দেখছে নিরব। তার পাশে বসেই অর্ষা আমলকী লবন মরিচ দিয়ে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে এটা ওটা বলছে। যেহেতু তারা পূর্ব পরিচিত ছিলো সেহেতু দুজনের মাঝে জড়তা নেই। তবে অর্ষার ক্ষেতে একটি অস্বস্তি, একটু জড়তা কাজ করছে। নিরব কে ভাই বলেই চিনে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে নিরবের নাম শুনলে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে তার কাছে। এখন নিরবের পাশে বসেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করছে অর্ষা। তাই তো এটা ওটা বলছে। মাঝে মাঝে কথার ফাকে তোতলাচ্ছে। কথার ঝুড়ি ফুরিয়ে এলো। চুপ রইলো অর্ষা। নিরবতা নেমে দুজনের মাঝে। বেশ কিছু সময় পর নিরব প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এই বিয়েতে রাজি? সমস্যা হলে বলতে পারো আমি ম্যানেজ করে নিবো।’

অর্ষা স্বাভাবিক ভাবে শুধাল, ‘না সমস্যা নেই। আমি মন থেকেই রাজি।’

নিরব আবারো প্রশ্ন করলো, ‘রিলেশন আছে তোমার? আই মিন সব মেয়েরাই করে তাই জিজ্ঞেস করা।’

– ‘যেহেতু আপনি আমার হবুবর সেহেতু আমার সব জানার অধিকার আছে। তাই বলছি। একটা লু’ই’চ্চার সাথে রিলেশন ছিলো। ভাগ্যিস ব্রেকআপ হইছে। তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাথরুমের স্যান্ডেল দিয়ে জুতা পি:টা করতে।’

নিরব ঠোঁট চেপে নিশব্দে হাসলো। অর্ষার কথায় প্রচুর হাসি পাচ্ছে তার। অর্ষার বলা প্রত্যেকটা কথা তার কাছে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কিছুসময় পর অর্ষা খেয়াল করলো সাদাত ছাদে এসেছে। ডাক দিলো অর্ষা। সাদাত চুপচাপ এক পাশে বসার উপক্রম হলে অর্ষার ডাক কর্ণপাত হয় তার। চোখ ঘুরিয়ে তাকালো সে। অর্ষাদের ছাদে নিরবকে বসে থাকতে দেখে সাদাত ভয় পেলো। সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে চলে যেতে পা বাঁড়ায়। তখন আবারো চেঁচিয়ে উঠে অর্ষা। দৌড়ে রেলিং’য়ের পাশে আসে।

‘সাদাত ভাই? খবরদার আজকে পালাবেন না। নয়তো আপনার মন্ডু উড়িয়ে দিবো। দাঁড়ান বলছি।’

পা থামিয়ে দাঁড়ালো সাদাত। শুকনো ঢুক গিলে অর্ষাদের ছাদের কাছাকাছি আসলো। অর্ষার পিছনে নিরবের দিকে তাকালো একবার। নিরব পকেটে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ষা প্রশ্ন করলো, ‘সমস্যা কি? আমাকে দেখে ইদানীং এভাবে পালাই পালাই করেন কেন?’

সাদাত বোকা বোকা হাসি দিলো। কুঁকড়ানো চুল গুলো বাতাসে আরো এলোমেলো হয়ে গেল তার। ফিচেল গলায় শুধাল সাদাত, ‘আসলে আমার পালাই পালাই রুগ হয়েছে। তাই আরকি।’

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অর্ষা। হাসতে হাসতে দাঁত খিঁচে বললো, ‘বাহ্ বেশ তো। বিয়ের পর আবার বউকে দেখে পালিয়ে যাবেন না আবার। আচ্ছা কবিতা লিখা হয় এখন? এতোদিনে নিশ্চয় অনেক কবিতা লিখেছেন?’

– ‘হ্যাঁ ওনেক গুলো লিখা হয়েছে।’

সাদাত বার বার চোখ ফিরিয়ে নিরবের দিকে তাকাচ্ছে। না জানি কখন এই অপরাধে তাকে পরপার করে দেয়। অর্ষা সাদাতের ভয়ার্ত চোখ দেখলো। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে নিরবের দিকে তাকালো। বুঝতে পারলো সে। অর্ষার মনে হলো সাদাত নিরব কে ভয় পায়। তাই কথা বাঁড়ালো না। বললো, ‘আপনি মনে হয় অনেক তাড়ায় আছেন। যেতে পারেন। অন্যসময় কবিতা শুনবো।’

এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না সাদাত। দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো। অর্ষা সাদাতের কান্ডে তব্দা খেয়ে আছে। নিরব ভাইকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? তাছাড়া ভয় পাওয়ারই কথা। পলিটিশিয়ান কিনা। ক্ষমতা তো তার হাতেই। নিরব এসে অর্ষার পাশে দাঁড়ালেই অর্ষা বলে উঠলো, ‘আপনাকে মনে হয় ভয় পায়। এখন দেখলাম কেমন ভয় ভয় চোখে আপনার দিকে তাকাচ্ছে।’

নিরব অর্ষা চোখের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। অর্ষাকে যতো দেখছে তার ততোই দেখতে ইচ্ছে করছে। তার দিকেই তাকিয়ে ধীর কন্ঠে শুধাল, ‘ওসব কিছু না। বাদ দাও।’

হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠলো নিরবের। কিঞ্চিৎ পরিমান বিরক্ত হলেও প্রকাশ করেনি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল রিসিভ করে কানে দিলো। অর্ষা নিশ্চুপ থেকে রেলিং’এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। নিরব তার পাশেই। নিরবকে এক মনে দেখতে লাগলো অর্ষা। সিল্কি চুল গুলো বাতাসে উড়ছে তার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। চোখের ভ্রুঁ গুলো একটু মোটা। ঘন চোখের পাপড়ি। ঠোঁট গুলো হাল্কা গোলাপি। চোখের বাম পাশে একটা ছোট কুচকুচে তিল। কপালের ডান পাশে ছোট একটা কাটা দাগ। কাছ থেকে দেখলে স্পষ্ট। এর আগে কখনো নিরবকে এভাবে দেখে নি অর্ষা। আজ দেখতে লাগলো। কেন জানি ইদানীং নিরবকে দেখতে ভালো লাগে তার। বিয়ে হবে বলে? হয়তো! সারাজীবন যার সাথে কাটাবে তার জন্য নিজের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। অর্ষার ক্ষেত্রেও তাই। নিরবের কাছাকাছি থাকতে তার বেশ লাগে। ভালোলাগা কাজ করে মনে। এমন প্রশান্তির অনুভূতি আগে কখনো অনুভব করেনি অর্ষা। আনমনে মুচকি হাসলো সে। পাশে দাঁড়ানো পুরুষটা আজ বাদে কাল তার স্বামী হবে। পথচলার জীবনসঙ্গী হবে ভাবতেই গায়ে হিমশীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে মনে।

নিরব চুপচাপ মোবাইলের অপর পাশের ব্যক্তিটির কথা শুনছে। বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সে। এক হাত উঠিয়ে চুল ঠিক করতে করতে নিরব প্রতিত্তুরে বললো, ‘বেঁধে রাখ ওকে। সরকারের দেওয়া ত্রাণ চু:রি করার মজা বুঝাবো। আমি আসছি।’

লাইন কেটে মোবাইল পকেটে রাখলো। অর্ষার দিকে ঘুরে বললো, ‘আমাকে যেতে হবে অর্ষা।’

অর্ষা তার দিকে তাকিয়েই শুধাল, ‘এভাবে মা’রা’মা’রি করেন কেন?’

মৃদু হাসলো নিরব। বললো, ‘রাজনীতি করলে একটু আধটু এমন করতে হয়।’

অর্ষা ফিচেল গলায় বললো, ‘হ্যাঁ, আবার না জানি বিয়ের পর কখন আমাকেই মে:রে বসেন।’

আওয়াজ করে হেসে ফেললো নিরব। কিছুসময় হেসে অর্ষার দিকে আবেগী চোখে তাকালো। তার দুই দিকে দুই হাত রেখে একটু ঝুকে দাঁড়ালো নিরব। দুজনের দূরত্ব কয়েক আঙ্গুল মাত্র। চোখে চোখ রেখে নেশাক্ত কন্ঠে শুধাল, ‘মা:রবো না। তবে খুব করে অত্যাচার করবো। ভালোবাসার অত্যাচার। সয্য করতে পারবে না?’

লজ্জা পেলো অর্ষা। গাল লাল হয়ে এলো তার। মাথা নুইয়ে ফেললো। নিরব সূক্ষ্ম চোখে দেখতে লাগলো অর্ষাকে। ঠোঁটের পাশে ডান গালে একটা ছোট তিল। এই প্রথম নজরে এলো তার। আগে কখনো অর্ষাকে এতো কাছ থেকে দেখেনি সে। আজ কাছে পেয়ে মনটা বড্ড অবাধ্য হতে চাইছে। নিজেকে সংযত রাখলো নিরব। অর্ষার লজ্জা মাখা মুখশ্রী দেখে মৃদু হাসলো। টুশ করে ডান গালের তিলটার উপর চুমু খেয়ে নিল একটা। আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেলো অর্ষা। চোখ বড়বড় করে নিরবের দিকে তাকালো। প্রতিত্তুরে নিরব মুচকি হাসি উপহার দিলো। প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে নিশব্দে ছাদের রেলিং টপকে পাশের ছাদে চলে গেলো নিরব। পিছে ফিরে তাকালে বোধহয় রমনীর আষ্টর্য মাখা মুখখানি নজরে আসতো তার।

সন্ধ্যার পর অর্ষা অর্পনকে কল দিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু রিসিভ করেনি অর্পন। ক্ষুন্ন হলো তার মন। ফুপির কাছ থেকে শুনেছে অর্পন তাদের সাথে আসতে পারবে না। তার বিয়েতে অর্পন দেড়ি করে আসবে মানতে পারলো না অর্ষা। কলে না পেয়ে ম্যাসেজ দিলো কয়েকটা। মোবাইল রেখে টেবিলে বসলো পড়ার জন্য। এইসব চিন্তা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মন দিলো।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here