হিংস্রপ্রেম পর্ব ২৯

0
456

#Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ২৯
লেখাঃ Israt Jahan
.
.
মেহের আর ফালাক বিবাহের পর এই প্রথম দুজন একসাথে গোসল করেছে।গোসলের সময় ফালাক ওকে এমন ভাবে জাপটে ধরে দুজনের শরীরে পানি ঢেলেছে যে মেহের লজ্জাতে ফালাকের চোখের দিকে তাকাতে পারে নি।ফালাকের নির্দেশে মেহের ওর পুরো দেহের শুকিয়ে যাওয়া হলুদ ঘষে ঘষে উঠিয়েছে আর এদিকে ফালাক মেহেরের কিছু বলার অপেক্ষা না করে নিজেই ওর শরীর থেকে হলুদ ঘষে পরিষ্কার করে দিয়েছে।ঠিক সেই সময়টাতেই মেহের যেন লজ্জাতে মরে যাচ্ছিল।স্বামীর থেকে কোনোদিন এমনভাবে আদর পাবে তা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।অন্যদিকে ইরানি ওর ভাই আর ভাবীজির সঙ্গে ফালাকের বিষয়ে তিনজনে আলচোনাতে বসেছে।
মিরাজঃ তোমরা সম্রাটকে যেমনটা ভাবছো উনি কিন্তু ঠিক সেই আগের মতো নেই।আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে ওনার মাঝে।আর তাও সেটা রাজকন্যা মেহেরুনের জন্যই।
ইরানিঃ ভাইজান, আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেনো বলুন তো? আপনার সম্রাটকে খেয়াল করে দেখবেন যে সে এখন তার বিবির প্রতি একদম-ই দুর্বল নয়। তাকে পূর্বের ন্যায় বিবি ভেবে থাকলে কখনোই তিনি দাসীদের সঙ্গে তাকে পাকঘরে খাবার পাক করতে পাঠাতেন না।হতে পারে সে এখন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।কিন্তু পুরোপুরি নয়।সে তার বিবির সাথে রাতটুকু থাকেন।আর সারাটা দিন তার বিবির সঙ্গে এক দন্ড কথা পর্যন্ত বলেন না।
মিরাজঃ তুমি কি বলতে চাইছো তা আমাকে সরাসরি বলো।
ভাবীজিঃ আপনার বোন নিজের বিবাহের কথা নিজ মুখে কিভাবে বলতে পারে? আপনি বুঝতে পারছেন না সে কি বলতে চাইছে?
মিরাজঃ বিবাহ? কাকে?
ভাবীজিঃ আপনার সম্রাট কে।
মিরাজঃ তোমাদের কি বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আমি তার সামান্য একজন সেনাপতি।আর তাকে আমি আমার বোনের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব দেব?এমন দুঃসাহস আমার নেই।তোমাদের এমন চিন্তা করার দুঃসাহস হলো কিভাবে?
ইরানিঃ ভাইজান আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনার সম্রাট আজীবন বিপত্নীক থাকবে? আর দুঃসাহসের কি হলো এখানে? আজ সে শুধুমাত্র আপনার করুণায় বেঁচে আছে।আর তা নিশ্চই সে ভুলে যায়নি আর যাবেও না।তার মতো একজন চরত্রহীন সম্রাটের সঙ্গে কোন রাজ্যের রাজা তাকে কন্যা দেবে?আপনি এত স্বল্পবুদ্ধি নিয়ে কি করে চলতে পারেন ভাইজান? আমি যদি আপনার সম্রাটের রানী হতে পারি তাহলে আল্লাহ্ করুক এই সাম্রাজ্য আপনার হাতে চলে আসতে পারে।এমন বিবেচনা কি আপনি করে দেখেন নি?
ভাবীজিঃ হ্যা।আর তাছাড়া আপনার বোন ওই রাজকন্যা মেহেরুনের থেকে কম কোথায়?যথেষ্ট রূপবতী ও।আমার মনে হয়না আপনার এই প্রস্তাবে সম্রাট রাগান্বিত হবেন।
মিরাজ বেশ হতভম্ব হয়ে তার স্ত্রী বোনের দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর বোনের ডাকে তার হতভম্বের ঘোর কাটল।
ইরানিঃ ভাইজান? কি দেখছেন এভাবে?
মিরাজঃ দেখছি তোমাদের কুরুচিপূর্ণ চিন্তাচেতনাকে।কোন কথা থেকে শুরু করলে তোমাদের বোঝাতে সক্ষম হবো সেটাই ভাবছি।
প্রথমে তার নিকট আমার ঋণ সম্পর্কে বলি।সেদিন তার প্রাণ বাঁচিয়ে সে আমার কাছে যতোটা ঋণী হয়েছিল, সেই ঋণ তিনি দ্বিগুণ পরিমাণে শোধ করে দিয়েছেন আমাকে।কিভাবে এখনো বুঝতে পারো নি না? আমি একজন জলদস্যু ছিলাম।হঠাৎ যদি কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে মরে যেতাম তাহলে তোমাদের কি হতো তা কি কখনো ভেবে দেখেছো? কিভাবে কি উপায়ে বাঁচতে তোমরা?আজ সে শুধু আমার একার জানের নিরাপত্তা নয় সঙ্গে আমার স্ত্রী পুত্র এমনকি বোনের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও সে করেছে।রাজরানীদের মতোই তোমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে এখন।আর তার বিপত্নীক থাকার কথা বললে না? বাহিরের কতটুকু খবর জানো তোমরা? তার সুনাম এখন চারপাশে সকল রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।দুহাত ভরে সে এখন দান করে।তাকে কন্যা দেওয়ার জন্য কত রাজা ব্যাকুল তা কি তোমরা জানো?জানোনা।সে চাইলে তোমার থেকেও হাজার গুণ রূপসী কন্যাকে নিজের পাটরানী করে রাখতে পারে।সবশেষে বলব, আমি আজ যতটুকু পেয়েছি ততোটুকু পাওয়ার যোগ্যতা ও আমার নেই।কিন্তু আমি পেয়েছি।অনেক সুখে আছি, অনেক তৃপ্তিতে আছি।যে তৃপ্তি আমি দস্যু থাকাকালীন পাই নি কখনো।এর থেকে বেশি চাইলে সেই সুখ আর সেই তৃপ্তি আমি পাবোনা। আর তা যদি আরো বিশ্বাসঘাতকতা করে পাওয়ার চেষ করি তাহলে তো এসব কিছুর ছিটেফোঁটা ও আমি পাবোনা।আমি এতটুকুতেই তুষ্ট।আর তোমাদের ও বলছি।তার জন্য দু হাত তুলে আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করো।লোভ লালসা মানুষকে কেবল কষ্ট দেয় আর পরিণামে ধ্বংস করে।
ভাবীজিঃ তারমানে আপনি আপনার বোনের বিবাহ নিয়ে একবারও ভাববেন না?
মিরাজঃ আমি কি তা…….
ইরানিঃ থাক ভাবীজি।আমাকে নিয়ে ভাইজান কে কিচ্ছু ভাবতে হবে না।
ইরানি রেগে ভাই ভাবীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। মিরাজ খুব দ্বিধা দ্বন্দের মাঝে পড়ে গেছে।সন্ধ্যা লাগতেই মেহের কক্ষে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে ঢুকল।তখন ফালাক কক্ষের বাহিরে।মেহের ওর বিছানার পাশের ফুলদানীতে তা সুন্দর করে রেখে সাজিয়ে গুছিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।কিছুসময় পর ফালাক কক্ষে ঢুকেই কক্ষের ভেতরে চারপাশে এত লাল গোলাপ দেখে চমকে গেল।
ফালাকঃ সেদিন তো ইরানি কক্ষে গোলাপ দিয়ে গিয়েছিল।তবে আজ ও কি……?
পুরোটা কক্ষ লাল গোলাপের ঘ্রাণে মেতে আছে। সবগুলো গোলাপ-ই তাজা।ফালাক ভেবে নিয়েছে যে এটা ইরানি’র কাজ।ইরানি’র এমন কর্মকান্ডগুলো ফালাক স্বাভাবিক ভাবে দেখছে না। ওর মাঝে একটা বিশেষ গুণ আছে।আর সেটা হলো ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে নিয়ে কোন নারী কি ভাবে তা ও বেশ ভালো বুঝতে পারে তাদের চোখ আর ভাব ভঙ্গী দেখে।যদিও এই লাল গোলাপ দিয়ে কক্ষ সাজিয়ে রাখার ব্যাপারটা ফালাকের মন যথেষ্ট উৎফুল্ল করেছে।তাই আপাদত ইরানির চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে-ই দিলো।বিছানার কোণায় পা নামিয়ে বসে আসবাবের উপর থেকে ফুলগুলো হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরে এক মনে ঘ্রাণ গ্রহণ করল ফালাক।ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি আর লাল গোলাপ যা ফালাক কে সবসময় আকৃষ্ট করেছে।আর এখনো করে।শত মন খারাপের মাঝে এই দুটে জিনিস ওর সামনে থাকলে কিছু সময়ের জন্য অন্তত সকল দুঃখ-কষ্ট, চিন্তাভাবনা ভুলে থাকতে পারে।ফুলগুলো আবার সুন্দর করে সাজিয়ে ফুলদানীতে রেখে দিলো। বিছানা থেকে উঠে গা থেকে জামাটা খুলতেই কক্ষে মেহের প্রবেশ করল।
মেহেরঃ সম্রাট? আপনার জন্য হালকা খাবারের ব্যবস্থা করব?
ফালাকঃ হুম।শুধু ফল।
মেহেরঃ ঠিক আছে।
মেহের কক্ষে আসতেই ওর শরীর থেকেও গোলাপের সুগন্ধ আসছিল।কিন্তু ফালাক সেটা বুঝতে পারেনি।তবে ফালাক একটা জিনিস খেয়াল করেছে।লাল গোলাপের মতোই মেহেরের পরোণে
ও আজ লাল গোলাপের রঙের মতোই একটা লাল জামা।দেখতেও বেশ অপূর্ব লাগছে।মেহের কিছুক্ষণের মাঝেই হাতে কালো আঙ্গুর,
আপেল, কমলা আর মিষ্টি শরবত নিয়ে কক্ষে এল।
ফালাক বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে হাত মুখের পানি মুছছিল। ওর পাশে এসে আসবাবের উপর ফলের থালাটা রাখতেই মেহেরের শরীর থেকে গোলাপের ঘ্রাণটা ভেসে এল ফালাকের নাকে।এমনিতেই পুরো কক্ষ জুড়ে গোলাপের ঘ্রাণ মিশ্রিত।তারউপর মেহেরের শরীর থেকেও একই ঘ্রাণ।কিন্তু ওর শরীরের ঘ্রাণটা কেমন যেন মাতাল করা ঘ্রাণ। ফালাক ওর দিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে কিছু সময়ের জন্য ঘ্রাণটা টেনে নিচ্ছিল নাকে।মেহের ফলগুলো কেটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই ফালাক ওর হাত টেনে ধরল।মেহের দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল-” কিছু বলবেন সম্রাট?”
ফালাক নিশ্চুপ থেকে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানাতে গিয়ে বসে পড়ল।মেহের কথার উত্তর না পেয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।একটু একটু করে ফলের টুকরো গুলো মুখে তুলছে আর মেহেরের শেষ চাহনির দৃশ্য ভাবছে।ফালাক যখন মেহেরের হাতটা টেনে ধরে তখন মেহের অনেকটা অদ্ভুত চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়েছিল।যে চাহনির মানে ছিল ও জানত যে ফালাক পিছু ডাকবে।কিছু ছিল ওই চাহনির মাঝে। কিছু দিতে চাই ও ফালাককে।কি দিতে চাই? ফালাক যা ভাবছে সেটাই কি?খুব ভাবাচ্ছে ওকে মেহেরের আবেগি চাহনি।শরবতটুকু মুখে দিতেই কেমন মাথা ঝিম ধরানো মিষ্টি মনে হলো ওর কাছে।অনেকটা নেশা ধরনের।কিন্তু খেতে খুব ভালো লাগছে।এক নিঃশ্বাসে পুরো শরবতটুকু খেয়ে নিলো।আর এক পাত্র এই পানীয় ওর চাই। কিন্তু বলার মতো শক্তি ও শরীরে পাচ্ছেনা।টলমল করছে ওর শরীর, চারপাশ ঘুরছে ওর।চোখটা বন্ধ করেই শুয়ে পড়ল বিছানাতে।হঠাৎ মেহের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কক্ষের বাতি নিভিয়ে ধীর পায়ে ওর কাছে এগিয়ে আসছে।ওর মুখের উপর ঝুকে পড়ে ওকে দেখছে।আবার সেই মাতাল করা ঘ্রাণ ফালাক উপলব্ধি করতে পারছে।খুব কাছে এই ঘ্রাণ।মেহেরের বাহুদ্বয় দুটো হাতের মাঝে বন্দী হয়ে এগিয়ে নিয়েলো একদম ফালাকের বুকের মাঝে।যতটুকু দূরে ছিল মেহের ফালাকের। একটানে একদম ওর সাথে মিশে গেল।মেহেরের হৃদপিন্ড ওঠা নামা করছে।সেই ধ্বনি ফালাক শুনতে পাচ্ছে, অনুভব করতে পারছে।
ফালাকঃ কি ছিল শরবতের মাঝে?
মেহের ফিসফিস করে বলল-” নেশা।” ফালাক মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল-” কিসের নেশা?” মেহের সেই আগের মতোই ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো-” মেহেরের নেশা। যে নেশায় আপনি এখন পুরো মাতাল।” ফালাক মেহেরকে আরো শক্ত করে ধরে আরো কাছে নিয়ে আসল।বলল-” কি চাই সে?”
মেহেরঃ তার নেশার মাঝে আপনাকে ডুবিয়ে রাখতে চায়।
এতটায় কাছে ওরা যতটা কাছে থাকলে দুজনের নিঃশ্বাস দুজনের মুখে ছড়িয়ে পড়ে।ফালাক নিজের শরীরের উপর থেকে নামিয়ে মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল-” আজ তো তার মরণ।” মেহের উত্তর দিলো-” না। আজ তার নেশায় ডুবে মরবে ফালাক….তাজ।”
ফালাক ভ্রুদুটো কিঞ্চিত উঁচু করে বলল-” হুম….??”
মেহের স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো।-” হুম।”
মেহের ফালাক কে খুব শক্ত করে নিজের বাহুডোরে আটকে রেখেছে।ফালাক হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে কক্ষ পুরো অন্ধকার।চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখতেই বুঝতে পারল রাত ভারী। মেহেরের শয্যার দিকে তাকিয়ে দেখল মেহের একদম ঘুমিয়ে নির্জীব।উঠে বসে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখল ভালো করে।শরীরে কোনো জামা নেই।পাশে রাখা আসবাবের উপর তাকিয়ে দেখল ফলের থালাটা যেখানে ছিল সেখানেই।শুধু ঢেকে রাখা।এবার সে স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারল যে এটা শুধুই স্বপ্ন ছিল।মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে
ফালাক।” এতটা বাস্তবের মতো হয় একটা স্বপ্ন? আজকাল আমার স্বপ্নের মাঝে এসেই বিচরণ করছেন আপনি।” ফালাক বিছানা থেকে নেমে গিয়ে মেহেরের মুখের সামনে গিয়ে বসল।এক কাত হয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে ও।কানের ঝুমকো টা একটু বড়।কাত হয়ে শোয়ার কারণে গালের মাঝে এসে পড়েছে ওটা।ফালাক গালের উপর থেকে ঝুমকোটা সরিয়ে দিয়ে কানের পাশে গুজে রাখা চুলগুলো নাড়াচাড়া করছিল।এত আলত স্পর্শে ও মেহের ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল।ফালাক হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল-” স্বপ্নটা দারুণ ছিল।” উঠে চলে গেল নিজের শয্যাতে।তারপরই মেহের আচমকা চোখ দুটো খুলে ফালাকের দিকে তাকিয়ে খুবই আস্তে স্বরে বলল-” স্পর্শ ও দারুণ ছিল।”
সকালে ফালাক বাহিরে বেরিয়ে যাবে বলে মেহের খুব দ্রুত সব খাবার তৈরি করে ওর কক্ষে নিয়েসেছে।খাবারগুলো খেয়ে ফালাক মেহেরকে বলছে-” আমি দুপুরে গ্রামেই থাকব।খাওয়ার নিয়ে বসে না থাকলেও চলবে।”
মেহের মাথা নিচু করে জবাব দিলো-” আচ্ছা।”
কারুকার্য করা গোলাকার একটি কাঁচের শিশি থেকে ফালাক সুগন্ধি শরীরে মাখছে আর পিছু হয়েই মেহেরকে বলছে-” অভ্যাসটা দারুণ হয়েছে।”
মেহের বুঝতে পারলো না ফালাক কোন অভ্যাসের কথা বলছে।সুগন্ধি মাখা শেষে মেহেরের কাছে এসে বলল-” সুগন্ধি আর লাল গোলাপ।” মেহের মনেমনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছিল।মুখে হাসি না থাকলেও মুখের ভাবটা এমন হয়েছে যে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কতটা খুশি হয়েছে।মাথার কাপড় ঠিক করে উঠিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফালাক কে বলে গেল-” আমার সম্রাট ও যে অনেক দারুণ।”কথাখানা শেষ করে মেহের আর এক মুহূর্ত দাঁড়াইনি ফালাকের উত্তরের জন্য। ফালাক বেশ স্বাভাবিক চোখে ওর যাওয়া দেখল। আজ মেহের অনেক ফুরফুরে মেজাজে।আজ যেনো ওর পাক কাজ শেষ-ই হচ্ছে না এত পদ পাক করছে।বিকাল হয়ে গেছে সেদিকে মেহেরের হুঁশ নেই।এর মাঝে নূরি কাউকে গালাগাল করতে করতে পাকঘরে ঢুকল।
নূরিঃ শয়তান মেয়েমানুষ, ছুঁচোমুখি,অসভ্য বেহায়া মেয়ে একটা।
পদ্মাঃ আরে এই নূরি, তুই কাকে এত গালাগাল দিচ্ছিস?
নূরিঃ কাকে আবার?ওই ছুঁচোমুখি ইরানি কে।
মেহেরঃ কেনো? ও কি করেছে?
নূরিঃ কি কি করবে আরো সেটাই ভাবছি।
মেহেরঃ পরিষ্কার করে বলো।কি করেছে?
নূরিঃ আমার বলার থেকে আপনি নিজে চোখে গিয়ে একবার দেখে আসুন রানীসাহেবা।
পদ্মাঃ এই নূরি এত হেয়ালি না করে বল কি হয়েছে?
নূরিঃ সম্রাট বাহির থেকে ফিরে কারিগর, মেরামতকারীদের সঙ্গে কথা বলছিল।ওরা বাগানে ঝর্ণা ওঠানোর কাজ করছিল।সম্রাট বাগানে যাওয়ার পরই ইরানি হাতে অনেকগুলো গোলাপের চারা নিয়ে বাগানে ঢুকল।তারপর বলা নেই কওয়া নেই চারা লাগাতে শুরু করল?
পদ্মাঃ কি?
নূরিঃ হ্যা।আর সম্রাট সেটা দেখে ওর কাছে গিয়ে কি করছে জিজ্ঞেস করতেই সম্রাট কে বলল ওকে চারা লাগাতে সাহায্য করতে।আমি তো পুরো অবাক।ওর দেহে কি একটুও ভয় কাজ করেনা?
মেহেরঃ তো সম্রাট কি বলল?
নূরিঃ সম্রাট বলল যে বাগানে অফুরন্ত গোলাপের চারা আছে।আর প্রয়োজন নেই।সাথে সাথেই জবাব আসল এ সবগুলোই লাল গোলাপের চারা। আর খুব উন্নত জাতের।দু, চারটা চারা নিজেই লাগাল।তার মাঝে ওর হাতটা কেটে গেল।ব্যস কাটা হাত নিয়ে চারা লাগিয়ে চলেছে বলে সম্রাট ওকে উঠতে বললেও উঠল না।তাই বাধ্য হয়ে নিজেই ওর সঙ্গে চারা লাগাতে শুরু করল।আমি গিয়ে বললাম, সম্রাট আমি সহযোগীতা করছি আপনি উঠুন।সম্রাট উঠতে গেলে ওই ইরানি কি বলল জানেন?
মেহেরঃ কি বলল?
নূরিঃ বলল, এমন কোনো সম্রাট কি নেই যে নিজের কাজ নিজে করেনা? সবসময় দাস দাসীদের উপর-ই কেনো নিজের শখের কাজ ছেড়ে দেয়।কথাটা শোনার পর সম্রাট আর উঠল না।ওর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চারা লাগিয়ে চলেছে।অন্যান্য দাসীরা তা দেখে কানাকানি করছে, বিভিন্নরকম কথা বলছে।
মেহেরের যেন ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে ইরানির মাথাটা কেটে চুলার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে।রেগে গিয়ে নূরিকে বলল-” এতে কানাকানির কি আছে? কি এমন করছে দুজনে? চারা-ই তো লাগাচ্ছে বাগানে। অন্যকিছু তো আর করছেনা।”
নূরিঃ রানীসাহেবা আপনি নিজে চোখে চারা লাগানোর দৃশ্য দেখলে আপনারও ওদের মতোই মনে হতো।
মেহের আর দেরী করল না।রেগে বেগে উঠে পাকঘরের বাহিরে চলে গেল।কক্ষের ভেতরে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে, ইরানি ফালাকের হাতের উপর হাত রেখে মাটি চাঁপা দিচ্ছে চারাগাছের শেকড়ে।ফালাকের কানের নিচে কাঁদা মাটি জড়িয়ে গেছে তা দেখে ইরানি খিলখিল করে হাসছে।ফালাক অন্য হাত দিয়ে তা মুছছে আর ওর হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসছে।মেহের আর বেশি সময় এই দৃশ্য দেখতে পারল না।পাকঘরে গিয়ে দাসীকে উঠিয়ে দিয়ে চুলার কাছে বসে আনমনেই হাতা দিয়ে কড়াইয়ের তরকারি নাড়ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।কোনো দাসী কিছু বলতে এলে তাকে ধমক দিয়ে পাকঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে।কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে ফালাক আর ইরানির ওই দৃশ্যগুলো ভাবছে।চুলার মাঝে যে লম্বা কাঠের টুকরো ছিল সেটার সামনের বেশিরভাগ অংশ চুলার মাঝে পুড়ে শেষের অংশ কিছুটা বাহিরের দিকে বেরিয়ে এসেছে।চুলার ভেতরের দিকে অংশটুকু ঠেঁলে ঢুকিয়ে না দিলে সেটা নির্ঘাত পায়ের উপে এসে পড়বে মেহেরের।নূরি বলল-” মহারানী, তরকারি পাক হয়ে গেছে।আমি এসে চুলা থেকে নামিয়ে দিই?” মেহের নূরির কথা শুনে ওর দিকে যখনই ঘুরে তাকাল তখনই জলন্ত কাঠের টুকরোটি বেরিয়ে এসে ওর পায়ের উপর পড়ল। মুহূর্তের মাঝে মসলিন কাপড়ের তৈরি ঢোলা পাজামা তে আগুন ধরে গেল।মেহেরের চিৎকারে সারা প্রাসাদের লোক ছুটে আসতে শুরু করল পাকঘরের দিকে।ততক্ষণে ফালাক ও হাত ধুঁয়ে ইরানির সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রাসাদে ঢুকেছে। সবার ছুটে যাওয়া অনুসরণ করে পাকঘরে আসতেই দেখতে পেল মেহের চিৎকার করে কাঁদছে আর ছাটাছাটি করছে মাটিতে।ওর শরীরে পানি ঢেলে দাসীগুলো আগুন নিভিয়েছে।কিন্তু পায়ের উপরে যতটুকু অংশ পোড়ার তা পুড়ে গেছে।মেহেরের এমন অবস্থা দেখে ফালাক পুরো দিশেহারা হয়ে গেছে।ওখান থেকে ছুটে মেহেরের কাছে গিয়ে ওকে ধরে একবার চিৎকার করে বলছে-” কবিরাজ ডাকো, রাজচিকিৎসক কে খবর জানাও।” আবার বলছে-” ওর শরীরে পানি ঢালো।”
মিরাজঃ সম্রাট আপনি শান্ত হউন।মহারানীকে কক্ষে নিয়ে যান।ওনাকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে আপাদত।
মেহেরের চিৎকার আর ছাটাছাটি দেখে ফালাকের নিজেরই পাগল পাগল লাগছে।কি করবে না করবে কিছু ভেবে পাচ্ছেনা।মেহেরের শরীরে মোটা কাপড় পেঁচিয়ে ফালাক কোলে তুলে কক্ষে নিয়ে গেল। পোড়া অংশে ডিমের সাদা অংশ মেখে দিচ্ছে দাসীগুলো।চিৎকার করতে করতে মেহের জ্ঞান হারিয়েছে।জ্ঞান হারানো দেখে ফালাক ভয় পেয়ে চিৎকার করে মেহেরকে ডাকছে।এর মাঝে কবিরাজ এসে কক্ষ থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে পায়ের পোড়া অংশ দেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। ফালাক মাত্র পোড়া অংশ তাকিয়ে লক্ষ্য করল। এতক্ষণ মেহেরের চিৎকার আর আর ছাটাছাটি দেখেছে কিন্তু পোড়া অংশ দেখেনি।পোড়া চামড়া দেখে ফালাক এবার কেঁদেই ফেলল।কবিরাজ ওকে কাঁদতে দেখে বলল-” সম্রাট।অনেক খানি পুড়ে গেছে।ব্যাথার যন্ত্রণায় রানীসাহেবা জ্ঞান হারিয়েছে। আমি চিকিৎসা চালাচ্ছি তো।আপনি চিন্তা নিবেন না।”
কবিরাজকে ফালাক আজ আর ফিরতে দেয়নি। প্রাসাদে থেকে যেতে বলেছে।অনেকক্ষণ পর মেহেরের জ্ঞান ফিরেছিল।কিন্তু জ্বালা পোড়ার কারণে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।মেহের যখন ওর আম্মাকে বার বার ডেকে কাঁদছিল তখন ফালাক মেহেরের কাছে যায়নি।দাসীরা ওর কাছে ছিল।আর ও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওর কান্নার আওয়াজ শুনে কাঁদছিল।ও সহ্য করতে পারছিল না মেহেরের ওই কান্নার আওয়াজ।ওর পাশে বসে পায়ের ওই পোড়া অংশের দিকে তাকিয়ে নিরবে কেঁদেই চলেছে।
ফালাকঃ এই কষ্ট যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আমি অনুভব করতে পারি।তুমি যখন কষ্টে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলে তখন আমার মনে হচ্ছিল আগুনটা যেন আমার শরীরে ধরেছে।এই কষ্টটা যেন আমি পাচ্ছি।পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আল্লাহ্ পাক তোমাকে কেনো দিলো?এই যন্ত্রণা তো আমার ছিল। তুমি কেনো পেলে এই যন্ত্রণা? আমি কোনোদিনও তোমাকে এমন যন্ত্রণা দিতে চাইনি।সেদিন তোমার শরীরে চাবুকাঘাত করে সারাটাদিন আমি যে পরিমাণ কষ্ট ভোগ করেছি সেই কষ্ট আমি আর দ্বিতীয়বার পেতে চাইনি।কিন্তু আজ আমার যে পুরো শরীরের ভেতরে বাহিরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট তোমাকে কেনো দেওয়া হলো।এ যে অসহ্যকর যন্ত্রণা।
ফালাক হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল কথাগুলো বলে। ওর আজ কষ্টটা একটু বেশি-ই হচ্ছে।কারণ এমন যন্ত্রণা যে ওকে ও পেতে হয়েছিল সেই ছোট্টসময়ে।কাশেম ওকে এই যন্ত্রণা দিয়েছিল।তাই ও জানে ও অনুভব করতে পারে পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা কতোটা অসহনীয়।
.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here