প্রেমানুরাগ পর্ব ১৭

0
490

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-১৭

সৌখিনতায় মুখরিত পুরো বাড়ি। গুছানো সব আসবাবপত্রের মাঝে রয়েছে অভিজাত্যের ছোঁয়া। বসার রুমের ঠিক মাথার উপরে একটা ঝাড়বাতি। তার মাঝে থাকা সাদা পুথি গুলো মুক্তের মতো চিকচিক করছে। সার্ভেন্ট কফির কাপ দিয়ে যাওয়ার পর তাতে চুমুক বসালো সোহরাব। কফির কাপ সোফার সামনের টি টেবিলের উপর রেখে সামনে তাকালো। তার সামনে বসে আছে রোজিনা চৌধুরী। পরনে তার হাল্কা গোলাপি পারের সাদা শাড়ি। গায়ের উপরে একটা পাতলা কালো শাল দেওয়া। চুল গুলো হাত খোঁপা করে রেখেছে। তার ফাকে কয়েকটা সাদা চুল ভেসে আছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা যার দু পাশে স্বর্ণের চেইন লাগানো। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বয়স খুব বেশি নয়। যদিও চেহারা দেখে বয়স ধরা সম্ভব না। সোহরাব তার গরনের দিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না। তার মাথায় একটা কথা ঘুরছে এখন। এই মহিলা দেখতে খুব কড়া। রিনা খানের মতো কি দা’জ্জা’ল শাশুড়ির রুল পালন করবে? গাল ফুলিয়ে নিশব্দে ‘উফফ!’ বলে নিশ্বাস ছুঁড়লো সোহরাব। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বললো, ‘ওইদিনের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আপুনার ছেলেকে শশীর পাশে দেখার কারণে রেগে গিয়েছিলাম। তার জন্য আমি অনুতপ্ত।’

এতোক্ষণ চুপচাপ কাপ হাতে নিয়ে বসে ছিল রোজিনা। অবশেষে কফির কাপ টেবিলে রাখলো সে। ঠিক হয়ে বসে শুধাল, ‘ব্যাপার না। আমি জানি সব। শশী খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।’

প্রতিত্তুরে সোহরাব মৃদু হাসলো। রোজিনা তার তীক্ষ্ণ চোখে বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো দেখতে লাগল সোহরাবকে। মাথার আধপাকা চুল, মেদহীন পেটে উজ্জ্বল ফর্শা গায়ের রঙ। শশী তাহলে তার বাবার রঙ পেয়েছে। দেখতেও দুজনে একদম এক। হাসলো রোজিনা। বললো, ‘দেখুন মিঃ! রবি আর শশী একে অপরকে ভালোবাসে। আমার মনে হয়না তাদের পছন্দের বিরুদ্ধে যাওয়া আমাদের উচিত হবে। আমি কিন্তু শশীকে প্রথম দেখাতেই রাজি তাকে আমার পুত্রবধূ করার। এবার আপনার মতামত।’

‘আমি চাই আমার মেয়ে সুখে থাকুক। আর সে যদি তার ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে চায় তাহলে আমি দ্বিমত করবো না। আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ। আমার মেয়েকে ভালো রাখবেন।’

রোজিনা হেসে আশ্বাস দিয়ে শুধাল, ‘চিন্তা করবেন না। শশী আমার ছেলের কাছে ভালো থাকবে। তাছাড়া আমি পুত্রবধূ না বরং আমার ঘরের জন্য একটা মেয়ে আনতে চাইছি। দিবেন না আপনার মেয়েকে?’

ঠোঁট প্রসারিত করলে সন্তুষ্টির হাসি দিল সোহরাব। মাথা উপর নিচু করে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। রোজিনা বললো, ‘মিষ্টিমুখ করা যাক তাহলে?’

আরো কিছুক্ষন আলাপ আলোচনা হলো তাদের মাঝে। এবার একে অপরের সাথে বেশ ভালো সখ্যতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলছে। বিকেলের প্রায় শেষাংশে পর্যায়ে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে যেন। দুপুরের ভ্যাঁপসা গরম শেষে এখন মৃদু শীতলতা প্রভাহমান। শত ক্লান্তি শেষে অফিস থেকে রবি বাড়ি ফিরলো। গাড়ি গ্যারেজে রেখে অলস শরির টেনে ভিতরে প্রবেশ করলো। এক হাতে গলার টাই ঢিলে করে হাটছে। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে কপালে পরে আছে। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময় অফিসে ফাইলের ভিতর কাটাতে হয়। এই জন্যই বোধহয় রবি অফিসে যেতে চায়নি। ড্রয়িংরুমে এসে সোহরাবকে দেখে তিলে চমকে উঠে সে। চোখ জোড়া তার বড়বড় আকার ধারন করেছে আপনা আপনি। তাকে দেখে সোহরাব সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রবি আতংকে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আঙ্কেল বিশ্বাস করেন আজকে আপনার মেয়ের সাথে দেখা করি নাই। কাল রাতে রেগে ব্লক মারছে। মানে ব্রেক’আপ। আমি নির্দোষ, অসহায় একটা পোলা। প্লিজ আমাকে মা’র’বেন না।”

হতভম্ব হয়ে গেল সোহরাব। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে রবির দিকে। রোজিনা ভ্রুঁ জোড়া উঁচিয়ে তাকালো রবির দিকে। দুজনের এমন দৃষ্টিতে রবি ভ্যাবাচেকা খায়। আমতা আমতা করে বলে উঠে, ‘না মানে। আঙ্কেল আমাকে দেখলেই ডিরেক্ট একশন মা’রে। তাই আগেই সতর্ক হয়ে গেলাম। এই আরকি।’

রবির পিছু পিছু মোর্শেদও এসেছিল। সে এগিয়ে রোজিনার পাশে যেতে যেতে বলল, ‘আর ব্রেক’আপের কাহিনী টা বলো?’

চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকালো রবি। উপস্থিত সকলে নিশব্দে হাসলো। সোহরাব তার জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধাল, ‘ওইদিনের ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত রবি।’

আপনা আপনি ভ্রুঁ কুঁচকে আসলো রবির। মানে কিভাবে কি? কেমনে সম্ভব? এই লোকের ভয়ে শশীর সঙ্গে দুইদিন আগেও লুকিয়ে দেখা করেছে সে। আর এই দুই দিনের ভিতরে এমন কি হলো যে এতো পরিবর্তন।

সোহরাব আবারো বলতে লাগলো, ‘তোমাকে শশীর পাশে দেখে মাথা ঠিক ছিল না আমার। তাই তখন রেগে গায়ে হাত দিয়েছিলাম। তবে এখন আর এমন হবে না। সব ঠিক করার জন্যই আমি এসেছি।’

রবি উপরে দাত কেলিয়ে হাসলেও মনে মনে বলতে লাগলো, ‘আপনার মাথা কোনো কালেই ঠিক ছিল না। নিজের মেয়ের জামাই তো ঠিকই বানাবেন। হুদাই কেন আমারে মা’ই’র গুলা দিলেন?’

কিন্তু সামনা সামনি হাসি দিল। তারপর এগিয়ে সোহরাবের সাথে হাত মিলালো। অতঃপর আবারো আলোচনায় মশগুল হলো সবাই।
______________

রাত্রীর প্রথম ভাগ। বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিদ্যমান। চারপাশ সতেজতায় মুখরিত। হয়তো বৃষ্টি হবে কিছুসময় পর। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। পাশাপাশি চাঁদ টাকেও তাদের সাথে ঘামটি মেরে লুকিয়ে রেখেছে। পরিবেশ নিরব, আবহাওয়া শীতল। বারান্দায় বসে মোবাইল টিপছে রবি। ফেসবুকে নতুন একাউন্ট ক্রিয়েট করলো একটা। তারপর ‘আরিয়ানা ইমতিয়াজ শশী’ আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়ে ম্যাসেজ দিলো।

– শশী জান, প্লিজ আনব্লক করো! আজ সারাদিন একটুও কথা হয় নাই তোমার সাথে। আমার আত্মা শরির থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই নির্দোষ পোলার উপ্রে তোমরা বাপ মেয়ে অত্যাচার আর সয্য করা যায় না। মানতে পারছি না আমি। ইয়া আল্লাহ, তোমার কাছে বিচার দিলাম। (কান্না ইমুজি)

মোবাইলটা সামনের টি-টেবিলের উপরে রাখলো। টেবিলের উপর থাকা কনকনে ঠান্ডা বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে চুমুক বসলো। রাজিব বাবু আর রবি আজ রাতে একসাথে থাকার প্ল্যান করেছে। তাই আপাতত তিনজন রবির রুমের বারান্দায় বসে চিল করছে আর গেমস অফ থন্স দেখছে। বেশ কিছুসময় পর শশীর ম্যাসেজের টোন বেজে উঠলো। রবি তড়িঘড়ি করে মোবাইল হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করে দেখলো।

– ওকে, ৪০ শার দাওয়াত দিও। (সেন্টি ইমুজি)

হাসিমুখে মোবাইল হাতে নিলেও ম্যাসেজ দেখে মুখ হাসিখুশি থাকেনি। অন্ধকার নেমে এলো মুখে। রাজিব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ম্যাসেজ দিছে?’

রাজিবের দিকে তাকালো রবি। প্রতিত্তুর করলো না। বাবু হঠাৎ রবির হাত থেকে কেঁড়ে নিলো মোবাইলটা। ম্যাসেজ দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সে। তাকে হাসতে দেখে রাজিব মোবাইল নিয়ে দেখতেই একি অবস্থা হলো তার। অপমানে রবির মুখখানি এইটুকু হয়ে এলো। রাজিব হাসতে হাসতে মুখ খিঁচে বলল, ‘ভাই আমাদেরও দিয়া ম-রিস।’

চোখ মুখ কালো করে কাজুবাদাম চিবুতে লাগলো রবি। বললো, ‘ভাই, রিলেশনে যাবার পর থেকে নিজের নামের পাশে ছ্যাঁচড়া উপাধি লাগতে হয়েছে।’

রাজিব হেসে প্রতিত্তুর করলো, ‘প্রেম করলে একটু আধটু ছ্যাঁচড়ামি করতেই হয়। নাহলে প্রেম টিকে না।’

বাবু চেয়ারে হেলান দিয়া আড়মোড় ভেঙ্গে বলে, ‘তোরা ছ্যাঁচড়ামি কর। আমি ফ্রি থাকি। সিঙ্গেল লাইফ ইজ বেষ্ট। কোনো প্যারা নাই। খালি চিল আর চিল।’

রাজিব বাবুর কাধে চাপড় মেরে বললো, ‘শা:লা, তোরে কেউ চয়েজ করে না তাই তুই সিঙ্গেল। এখন ভাব মারতে আসিস না।’ বাবু ঠোট দিয়ে আফসোসের সুর তুললো। রবি হাসলো। আরো কিছুক্ষন আড্ডা মাস্তি হলো। তখন শশী কল দিলো। রবি সবাইকে ইশারায় চুপ হতে বলে কল রিসিভ করে, ‘হ্যালো?’

অপর পাশ থেকে শশীর কাটকাট গলার আওয়াজ ভেসে এলো, ‘সমস্যা কি তোমার ম্যাসেজ দিন করে রিপ্লে দিচ্ছো না কেন?’

অবাক হলো রবি। কিছুক্ষন আগের দেওয়া ম্যাসেজটারই তো রিপ্লে দেয়নি। ওই রকম ম্যাসেজের কিবা রিল্পে দিবে? আফসোস হলো তার। নিজের উপর নিজেরই দয়া হতে লাগলো। কেন প্রেম করতে গেল? বললো, ‘সব কিছু থেকে ব্লক দিলে কেন?

‘ইচ্ছে হয়েছে তাই দিয়েছি।’

এবার রেগে গেলো রবি। রাগে দাত চিবিয়ে বললো, ‘সব কিছুর মাঝে নিজের ইচ্ছেটাকেই বেশি প্রায়োরিটি দাও তুমি। যা ইচ্ছে তাই করো। আর এইদিকে আমি ছ্যাঁচড়ার মতো তোমার পিছে পরে থাকি।’

হতবাক হলো শশী। ফিচেল গলায় বললো, ‘আমি একটু পরেই আনব্লক করে দিতাম।’

‘জাস্ট শাট আপ! প্রত্যেক মানুষেরই সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। সারাটা দিন অফিসে থেকে সন্ধ্যার পর সময় পাই তোমার সাথে কথা বলার। আর এই টুকু সময়ের মাঝেও তুমি এইসব ফালতু প্যাঁচাল করো। কাজের প্রেশার, তোমার এইসব জাস্ট আমাকে টায়ার্ড করে দেয়। এমন হলে আমি এই সম্পর্কে থাকতে পারবো না।’

শশীর প্রতিত্তুর না শুনেই রবি কল কেটে দিল। টেবিলের উপর মোবাইল ছুঁড়ে মারলো রবি। চোখে মুখে তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। রাজিব বাবু ফাজলামোর মুড ছেড়ে সিরিয়াস হয়ে বসলো। রবি কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘কাল দেখে হবে তোদের সাথে।’ কারোর প্রতিত্তুর শুনার আগেই রবি রুমে চলে আসে। বাবু রাজিব ব্যাপার টা বুঝতে পেরে চুপচাপ রবিকে বিদায় দিয়ে বেড়িয়ে যায়।

অপর প্রান্তে মোবাইল কানে নিয়ে স্বব্ধ হয়ে আছে শশী। তার কানে এখনো বাজছে রবির বলা শেষ কথাটি। ভুল বুঝলো রবি? এতো সহজে? রবিকে প্যারা দেই? আসলেই তো! সারাদিন অফিসে কাজ করে বিকেলের পর ফ্রি হয়। আর আমি ঝগড়া করি। উফফ! ক্ষুন্ন হলো তার মন। রবিকে কল দিলো কয়েকবার। কিন্তু প্রতিবার কল কেটে দিয়েছে রবি। আবারো ট্রায় করলো কিন্তু এবার বন্ধ পেলো নাম্বার। কান্না পেলো শশীর। চোখ লাল হয়ে এলো তার। নাক টেনে শুয়ে পরলো। চোখ থেকে অঝরে পানি ঝড়তে লাগলো।

চলবে ??

নোট : তাদের রিলেশনশিপ সুন্দর চলছিল। তাই ব্রেকআপ করাই দিলাম। ? কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ, ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here