#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১৮
আদিবের বিয়ের খবর সব আত্মীয় স্বজনরা জেনে গেছে।তাই সকাল থেকে কেউ না কেউ এসেই চলেছে।দিলারা তাই আনোয়ারা বেগমকে যেতে দেন নি।একা হাতে সব সামলাতে পারবেন না।তিনি কারো জন্য নাস্তা বানাচ্ছেন আবার কেউ দুপুরে খেয়ে যাবে তার জন্য রান্না করছেন।আদিবের চাচা চাচীরা গাজীপুরের থাকে ওরাও সবাই চলে এসেছে।বেশ বিয়ে বাড়ি ভাব এসেছে।আত্মীয় স্বজনদের এভাবে আসা দেখে আনোয়ার সাহেব ভেবেছেন নতুন করে আর বিয়ে উপলক্ষে কোনো আয়োজন করবেন না।একদিন সময় করে শুধু তার অফিসের কিছুলোক কে দাওয়াত করবেন।তবে বেশ ভালোও লাগছে।ছেলের বিয়ের আমেজটা এবার একটু বুঝতে পারছেন।তিনি গাল ভরে নতুন বউমার প্রশংসা করছেন।
মেঘলা শ্বাশুড়ি আর ফুফু শ্বাশুড়ির এতো কষ্ট দেখে নিজেও সাহায্য করতে এসেছিলো কিন্তু দুজনের কেউই তাকে কোনো কিছুতে হাত লাগাতে দেয়নি।মেঘলা ভেবে পায় না,নতুন বউ হয়েছে জন্য কাজ করা যাবে না কেন?চোখের সামনে এতো কাজ দেখে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়?এমন না যে সে কোনো কাজ পারে না।সে তো সবধরনের কাজ মোটামুটি ভালোই পারে।মামির সংসারে এতো কাজ করতে পেরেছে অথচ নিজের সংসারে এসে করতে পারছে না।নিজের সংসার কথাটা ভাবতেই মেঘলার অন্তরে ভালোলাগায় ছেয়ে গেল।একপলক বিছানার ওপর রাখা শাড়ি গহনা গুলোর দিকে নজর বুলিয়ে গোসলে ঢুকলো।বাসা ভর্তি নতুন মেহমান।নতুন বউ দেখতে এসেছে সবাই তাই এখন তাকে একটু সাজগোজ করতে হবে।দিলারা বেগম কাজের ফাঁকে এসে তাকে এগুলো দিয়ে পরতে বলে গেছে।তাই ভাবলো গোসলটা সেড়ে আমরিনের সাহায্য নিয়ে পরবে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আদিবকে নিয়ে।সেও একি সময় গোসল করতে চলে এলো।মেঘলা অসস্তিতে পড়ে গেল।আদিবকে বলতেও পারছে না তার গোসলটা আগে করা দরকার।কারণ বাড়ি ভর্তি মেহমান আছে।তাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে।তাকে দেখার উদ্দেশ্যেই তো সবাই এসেছে।দেরি করলে কেউ কিছু খারাপ ভাবতে পারে।আর মেঘলা সেটা কখনো চায়।তার সামান্য কোনো ভুলের জন্য এ পরিবারের মানুষগুলোর মানহানি হোক।
মেঘলাকে ওয়াশরুমের দরজা থেকে সরতে না দেখে আদিব ভ্রু কুঁচকালো।সে মেঘলার হাবভাব বুঝে উঠতে পারছে না।তাই প্রশ্নটা করেই ফেললো,
তোমার কি আমার সাথে গোসল করতে ইচ্ছে করছে? কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো।
মেঘলা চোখজোড়া বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো। কান দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেল তার।এই ছেলে যে এতো বদজাত তা তো আগে বুঝতে পারেনি!সে লজ্জায় মিনমিন করে বললো,বাজে কথা একদম বলবেন না?মা আমায় তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে বললো।তাই গোসলটা আমি আগে করতে চাইছি।আপনি কিসব বলছেন?
সেটা এতোক্ষণ মুখে বলতে পারো নি?আমি ভাবলাম তোমার বুঝি আমার সাথে গোসল করার শখ জেগেছে।
মেঘলার কান দুটো ঝা ঝা করতে লাগলো লজ্জায়।সে দ্রুত জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
আদিব তা দেখে বাকা হাসলো।সে ঠিক করেছে মেঘলাকে লজ্জা দিয়ে শাস্তি দেবে।তার এত শখের,সাধনার বউকে তো কঠিন শাস্তি দিতে চায় না মনটা।তাই মেঘলার একমাত্র শাস্তি হলো লজ্জা! ঠিক এক ঢিলে দু পাখি মারা হবে।শাস্তি দেয়াও হবে মেঘলার লজ্জায় রাঙা মুখটাও দেখতে পারবে।উফ!এইবার মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে ভালোই হয়েছে।তাকে এতোদিন ধরে জ্বালানোর শাস্তি মেঘলাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে,হু।
৩৯.
খয়েরী রঙের জামদানী শাড়িটা পরে আয়নায় তাকানোর পর মেঘলার মনে হলো সে আসলেই এতো সুন্দর! সত্যি যেন রাঙা বউয়ের মতো লাগছে।মেয়েদের শাড়িতে আসলেই সৌন্দর্য ফুঁটে ওঠে!মেঘলা কখনো এর আগে শাড়ি পরেনি।ওর মতো অনেকে শখের বশে শাড়ি পরে বা স্কুল কলেজের অনুষ্ঠানে পরে। পরবেই বা কি করে।তার তো এসব শখ করার সময়ছিলো না।বিয়ের দিন শাড়ি পরলেও তেমন ভাবাবেগ ছিলো না।ফয়সালের সাথে বিয়ে হওয়া নিয়ে তো মনে কখনো আনন্দ ছিলো না।ভাবনা জুড়ে শুধু আদিব ছিলো।কে কেমন ভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলো সে কিছুই খেয়াল করেনি সে ভাবে।
মেঘলার ভেজা চুল গুলো আমরিন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।ভাবছে আজ তার ভাইয়া ভাবীকে দেখে নির্ঘাত হার্টঅ্যাটাক করবে!চুল শুকানো হলে গহনা গুলোর পরিয়ে দিলো সে।দিলারা বেগম একটা চিকন চেন আর দুটো সোনার চুড়ি দিয়েছেন।কানের দুল এখনো বানান নি দিলারা বেগম।এসব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পরপরই বানিয়ে দেবেন।তাই এন্টিকের একজোড়া দুল দিয়েছেন।মেঘলার নাকে আগে থেকেই স্বর্নের নাক ফুল ছিলো।মেঘলার জন্মের পরপর তার বাবা খুব শখ করে জন্য বানিয়েছিলেন তার জন্য। কিন্তু আফসোস বাবা দেখে যেতে পারেননি।চুলের খোঁপায় বেলীফুলের মালা গেথে দিতে দিতে আমরিন বললো,এই মালাটা কিন্তু ভাইয়া এনেছে।মা হুকুম করেছে মালা না আনলে ভাইয়াকে দুপুরের খাবার খেতে দেবে না।
মেঘলা শুধু হাসলো।কিছু বললো না।
আদিব ঘরে ঢুকে থমকে গেল তার শাড়ি পরিহিতা নববধূকে দেখে।আচ্ছা, গতকাল থেকে মেঘলাকে দেখলেই তার চোখ দুটো ঝলসে যেতে চাচ্ছে কেন?এমন অন্যরকম মেঘলাকে কখনো তো দেখেনি সে!সাদামাটা মেঘলাকে দেখে প্রেমে পরে গেছিলো সে। এখন তো মেঘলার অন্যরূপ দেখে পুরো টাসকি খেয়ে চিৎপটাং হয়ে চলেছে।আদিবের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে।
আমরিন দেখলে তার ভাই হা করে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে।সে পারফিউমের বোতলটা নিয়ে ভাইয়ের গায়ের স্প্রে করে দিলো।আদিব ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলো।সে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল এতোক্ষণ। আমরিনের এমন কান্ড বুঝতে পারনি তাই।
আমরিন মিটিমিটি হেসে বললো, এটা নতুন কিনেছি ভাইয়া।সুন্দর না গন্ধটা?তোমার বউকে লাগিয়ে দেই কি বলো?
আদিব কটমটে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।আমরিনটা দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। বড় ভাইয়ের সাথে মজা করা বের করবে সে।সবসময় মেঘলার সামনে কাকতাড়ুয়া বানায়।সেবার যখন পেট খারাপ হওয়ার মিথ্যা কথা গুলো মেঘলার সামনে বলছিলো কি লজ্জাটাই না পেয়েছিলো সে!
মেঘলা শুধু তার সম্পর্কে দাদি শ্বাশুড়িকে খাবার বেড়ে দিলো।পৌঢ়া মহিলাটিকে বেশ ভালো লেগেছে তার।মেঘলাকে জোর করে খেতে বসিয়েছেন ওনার পাশে।এই নিয়ে আদিবের চাঁচি মেঘলাকে বললেন,তুমি খেতে বসলে কেন?নতুন বউ সবাইকে বেড়ে খাওয়াতে হয়।তোমার মা এগুলো শিখে পাঠায়নি?
দিলারা, আনোয়ার সাহেব খুব লজ্জায় পরে গেলেন।মেঘলার খারাপ লেগেছে নিশ্চয়ই!
কিন্তু মেঘলা তা বুঝতে দিলো না।চুপচাপ উঠতে চাইলো আদিবের দাদি টেনে বসালেন।এরপর বললেন,ও যদি আমার কথায় খেতে না বসতো তাহলেও বলতে মুরুব্বিদের কথা শুনো না,বেয়াদবি শিখে এসেছো! তুমিও তো একদিন নতুন বউ ছিলে।আমি কি তোমায় কোনো কাজে হাত লাগাতে দিয়েছিলা?
এরপর থেকে আদিবের চাঁচি মুখ ভার করে রইলেন সারাক্ষণ। বারবার স্বামিকে তাড়া দিতে থাকলেন চলে যাওয়ার জন্য।
আদিব চুপচাপ সবটা দেখলো,শুনলো।তবে সে নিজের মা আর চাঁচির মধ্যে তুলনা করে মনে মনে গর্বিত হলো।মেঘলাকে দিলারা বেগম এ দুদিনে যেভাবে আপন করে নিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। দেখতে হবে তো কার মা!
আনাফকে দুপুরে ডাকলেও কিছু কাজ থাকায় সে আসলো রাতে।আজ রাতটা থেকে আগামীকাল মাকে নিয়ে ফিরবে সে।
আমরিন চা নিয়ে এসে দিলো আনাফের হাতে।আনাফ একটু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।কারণ আমরিন এতো ভালোমানুষি হজম হচ্ছে না তার।গতকাল কি বাগড়াটাই না দিলো তাকে!আমরিনের জন্য জেরিনের কাছে বকা শুনতে হয়েছে।আনাফ একটু ভালভাবে তাকিয়ে দেখলো আমরিনকে। বটল গ্রীন টপসের সাথে সাদা লং স্কার্টে আমরিনকে মিষ্টি লাগছে দেখতে।কপালের কাছে ছোটো ছোটো চুলগুলো সুন্দর ভাবে ছড়িয়ে আছে। আমরিনের কপালের একপাশে একটা ছোট কালো তিল আছে। আচ্ছা, আমরিনকে এখন সত্যি বড়বড় লাগে কেন?আনাফের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
আমরিন ঠোঁট কামড়ে হাসলো।আনাফ মুগ্ধ দৃষ্টি তার চোখে ঠিকই ধরা পরেছে। সে আজ ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করলো না।হালকা হেসে বললো,ভাইয়া তোমায় ডাকছে, এসো।
আদিব কোথায়?
ছাঁদে আছে বোধহয়। তুমি চা টা খেয়ে নাও।
আনাফ নিরবে মাথা নাড়লো।
আমরিন বেরিয়ে যেতে ধরলে আনাফ হালকা স্বরে ডাকলো।
কিছু বলবে, নাকি?
তোর বয়স কত হলো রে?
কেন, তুমি জানো না?
জানি কিন্তু তাও শুনতে চাচ্ছি।
আমরিন বাঁকা হেসে বললো, আমায় এখন বড় বড় লাগে তাই না, আনাফ ভাই?
আনাফ চোখ মুখ কপাল সব এক সাথে কোঁচকালো।আমরিনটা আসলেই পাঁজির পা ঝাড়া।ঠিক বুঝে গেছে।সে বিরক্তি নিয়ে বললো,তোকে কেন বড় লাগবে খুকি?আমার তো মনে হয় তুই এখনো বিছানা ভেজাস!
আমরিন চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো।আনাফ ভাই তাকে এতবড় অপমান করলো?
ফয়সাল আদিবকে বাজারে দেখতে পেয়েছে।সন্ধ্যা বেলা প্রায়ই সে এসে আড্ডা দেয় বাজারে।আদিবকে দেখতে পেয়ে মাথায় রক্ত চড়ে গেল তার।বাজারের কিছু বখাটে ছেলেকে গিয়ে কানে কানে কিছু বলে তাদের পকেটে টাকা গুঁজে দিলো।এরপর সে তার ওকানে দাড়ালো না।দূর থেকে তামাশা দেখার জন্য রাস্তার অন্যপাশে যেতে থাকলো।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! উল্টো পাশ থেকে আশা একটা মাইক্রো বাস এসে ধাক্কা দিলো। ফয়সাল রাস্তায় পড়ে গেল রক্তাক্ত হয়ে।বখাটে ছেলে গুলো আদিবের কাছে পৌঁছানোর আগেই আদিব ফয়সালকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসলো।আদিবের ভাবনাতেও ছিলো না এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে!
চলবে..