জোনাকিরা ভীড় করেছে part 19

0
431

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১৯

৪০.
রাত দশটা বাজার পরেও যখন আদিব ফিরলো না তখন সবাই খুব চিন্তায় পরে গেল।আনাফ অনেকবার ফোন করেছে আদিবকে কিন্তু আদিব ফোন তুলেনি।দিলারা বেগম ছটফট করছেন।মেঘলা সোফার এক কোণে বসে আছে। তার আসলেই খুব চিন্তা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সবাই সবার বসার ঘরে আছে।আনোয়ার সাহেব বারবার বলছেন এতো চিন্তা না করতে,আদিব চলে আসবে।

মেঘলা তোকে আদিব কিছু বলে বেরিয়েছে?দিলারা বেগম এই নিয়ে বেশ কয়েকবার একি কথা জিজ্ঞেস করলেন।

মেঘলা বুঝতে পারছে, দিলারা বেগমের মনের অবস্থা আসলেই খারাপ।সে বরাবরের মতো বললো,না তো মা,আমায় কিছু বলে যায় নি।উনি যখন বের হন তখন আনাফ ভাইয়াও তো ছিলো, ওনাকেও বলেন নি।

উফফ!এই ছেলেটা যে কেন এমন?আমার মনটা কেমন যেন করছে! আজ আসুক কান ছিড়ে ফেলবো একদম।

ভাবী তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।তোমার না আবার প্রেশার বেড়ে যায়!আনোয়ারা বেগম দিলারাকে শান্ত করতে চাইলেন।

বেড়ে তো যাবেই।দেখছো না ছেলেটার কেমন কান্ড।নতুন বউ রেখে বাইরে গেছে সেই কখন অথচ ফেরার নাম নেই।আমাকেও তো কিছু বলে যায় নি।ফোনটাও ধরছে না।কেমন লাগে বলো?এরা বাপ, ছেলে মিলে আমায় জ্বালিয়ে মারে।

আমি আমার কি করলাম দিলারা?তোমার ছেলে বাড়ি ফিরছে না এতে আমার দোষটা কোথায়?আনোয়ার সাহেব অসহায় হয়ে বললেন।

ওহ,এখন আমার ছেলে হয়ে গেল, তাইনা?তোমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই ছেলেকে নিয়ে, তাহলে বসে আছো কেন? যাও ঘুমাও গিয়ে নাক ডেকে।

আনোয়ার সাহেব কিছু বলতে গেলেই মেঘলা আটকালো তাকে।সে পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,বাবা চুপ করে থাকুন।মায়ের মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন।চিন্তায় অস্থির হয়ে এমন রাগ দেখাচ্ছেন।

ঠিক বলেছ,চুপ থাকাই শ্রেয়।তা না হলে দেখা যাবে সম্পূর্ণ ঝড়টাই আমার ওপর দিয়েই যাবে।

শ্বশুরের কথা শুনে এতো চিন্তার মাঝেও হাসি পেল মেঘলার।খুব কষ্ট করে তা চেপে রাখলো।

কলিংবেলের আওয়াজে সবাই চমকালো।পাখি দ্রুত দরজা খুলে দিলো।আদিব বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে বসে পরলো ধপ করে মায়ের পাশে।

সবাই অবাক হয়ে গেছে আদিব কে দেখে।বুঝতে পারছে না কি হয়েছে?আদিবকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

মেঘলা উঠে গিয়ে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি এনে দিলো আদিবকে।এতক্ষণে তার মনে স্বস্তি লাগছে। আদিবের মেঘলার হাত থেকে পানিটা নিতে গিয়ে মনে হলো তার সমস্ত ক্লান্তি চলে যাচ্ছে। মেঘলার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বুঝলো, চিন্তা, কৌতুহল সব একসাথে জোট পাকিয়ে আছে।আদিব পানি খেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিললো।বেশ বুঝতে পারছে মা আজ তাকে আজ খুব বকবে!

তোমরা সবাই খুব চিন্তা করছিলে, তাইনা?

আদিব এমন গা জ্বালানো কথা শুনে দিলারা বেগম ফুঁসে উঠলেন।

নাহ,আমরা তোর জন্য চিন্তা করবো কেন?আমরা তো সবাই মিলে টিভি দেখছি।তুই কে যে তোর জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে?নিজেকে এতো বাহাদুর মনে করার কারণ নেই।

আদিব বুঝতে পারলো মা খুব রেগে গেছে।তার উচিত ছিলো জানানো।কিন্তু এমন একটা অবস্থায় পরেছে শুনলে সবাই আরও বেশি চিন্তা করতো।বিশেষ করে মেঘলা ভয় পেত ফয়সালের কথা শুনলে।তবে এখন তাকে তাড়াতাড়ি সবটা বলতে হবে তা না হলে দেখা যাবে মা তার কান দুটো ছিঁড়ে ফেলবে।

আমি সত্যি একটু অসুবিধায় পড়ে ছিলাম মা।বাজারে গিয়ে দেখি ফয়সাল এক্সিডেন্ট করেছে।অবস্থা খুব খারাপ।আমি আসলে ওকে ওভাবে রেখে চলে আসতে পারিনি।হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দু ব্যাগ রক্ত দিয়ে সবটা সামলাতে এতরাত হয়ে গেল।

আদিব কথাগুলো বলে মেঘলাকে আঁড়চোখে দেখলো একবার।

তুই দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছিস ওই ছেলেটাকে!এই জন্যই তোকে এমন লাগছে,যদি নিজে অসুস্থ হয়ে যেতি?

এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না, মা।ফয়সালের অবস্থা বেশি ভালো নয়।চার ব্যাগ রক্ত লেগেছে।ওই সময় সে ভাবে খোঁজ করার উপায় ছিলো না।বাধ্য হয়ে আমি দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছি আর ওর একজন পরিচিত ভাই দিয়েছে।

এত কান্ড তুই একবার আমাদের জানাবি না?

আহ দিলারা!সব তো শুনলেই।তুমি আর ওকে এত প্রশ্ন না করে কিছু খাবার আনো।খাওয়ার পর একটু জুস করে দিও।আর আদিব তুই একদম ঠিক কাজ করেছিস বাবা।ফয়সালের জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও তুই একি কাজ করবি।এখন ছেলেটা কেমন আছে?

খুব বেশি ভালো না।বেশ কয়েক জায়গায় ইনজুরি হয়েছে। অবশ্য ভাগ্য ভালো যে মাথায় কোনো আঘাত পায়নি।ডাক্তার বললো,অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের জন্য ফয়সালের অবস্থা একটু ক্রিটিকাল।

ইশ! রোড এক্সিডেন্ট গুলো ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।প্রতিনিয়তই ঘটছে অহরহ।যাই হোক,দিলারা তুমি ওকে খেতে দাও তাড়াতাড়ি।

আদিব বললো ও গোসল করবে তারপর এসে খাবে।

আদিবের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে মুচকি হাসলো মেঘলা।মানুষটাকে চেনার বাকি আছে এখনো তার।আদিব এত ভালো কেন?এতটা ভালো হতে নেই যে, তাতে খারাপেরা হিংসেয় জ্বলেপুড়ে যাবে।সে দিলারা বেগমকে বললো,মা তুমি তরকারি গুলো গরম করো।আমি জুসটা বানাচ্ছি।

৪১.
ছাঁদে একা দাঁড়িয়ে আছে আমরিন।ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ।আকাশ ভরা জোছনা। তাঁরা গুলোর দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় তাঁরা গুলো বড্ড আপন,কাছের। শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার এলো চুল গুলো।কেন যেন মনটা আনমনে হয়ে আছে।কিছুই ভালো লাগছে না।আগামীকাল ফুপি আর আনাফ ভাই চলে যাবে।এরপর আনাফ ভাই এর সাথে কবে দেখা হবে জানা নেই তার।কি করে বোঝাবে আনাফের প্রতি তার অনুভূতি গুলো ছেলে খেলা নয়, মিথ্যা নয়। তার কাছে এই গাঢ় অনুভূতির নাম ভালোবাসা! একতরফা ভালোবাসা,যার কোনো রূপ নেই গন্ধ নেই,নেই কোনো স্বাদ শুধু আছে মন উথাল-পাতাল করা তিব্র অনুভূতি। সেই অনুভূতি অপর মানুষটার কাছে পৌঁছাতে পারে না।কখনো হয়ত পারবেও না। এই অব্যক্ত ভালোবাসা কখনো ব্যক্ত হবার নয়।

আমরিন এত ভাবনার মাঝে খেয়ালই করেনি যাকে নিয়ে ভাবছে সে তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আনাফ আমরিনকে ছাঁদে একা দেখে এগিয়ে এসেছিলো।আমরিনের পাশে এসে দাঁড়ানোর পরও আমরিনের কোনো ভাবান্তর হলো দেখে কপাল কুঁচকালো সে।আরও একটু ঝুঁকে এলো আমরিনের দিকে।কাছে আসতেই আমরিনের শরীরের মিষ্টি একটা গন্ধ তার নাকে এলো।অল্প বাতাসে ওড়া চুলের আগা গুলো আনাফের চোখ মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আনাফের মনে হলো ধীরে ধীরে তার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে!
মনের ভেতর অচেনা অনুভূতি তিব্র হচ্ছে। আনাফ আধো আলো আধো অন্ধকারে আমরিনের মুখের একপাশটা দেখতে পাচ্ছে।হঠাৎ যেন তৃষ্ণা জাগলো মনে আমরিনের পুরো মায়াবী মুখটা দেখতে।আনাফ আমরিনের কানের পাশের চুল গুলো কাঁপা হাতে সরিয়ে দিলো।আমরিন চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল।আনাফের মুখটা,চোখ তার খুব কাছে।আনাফের চোখের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সে নিজেকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।দুজনে নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল।কয়েক মিনিটের মধ্যে আনাফের ঘোর ভেঙে গেল।আসলে ফোনের কর্কশ আওয়াজ দুজনেরই কল্পনার ব্যাঘাত ঘটালো।দু জোড়া দৃষ্টির বিচ্ছেদ হলো।সরে গেল নিজের মতো করে।আনাফ ফোন কানে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।পেছন ফিরে একবার তাকালে হয়ত আমরিনের চোখের পানিটুকু দেখতে পেত।

৪২.
মেঘলা জুস নিয়ে বসে আছে বিছানায়।অপেক্ষা করছে আদিবের ওয়াশরুম থেকে বের হবার।আদিব মুখে না বললেও আদিবকে বেশ দূর্বল মনে হচ্ছে। অনেক ধকল গেছে শরীর আর মনের ওপর দিয়ে।ফয়সালের ব্যাপার এমন ভাবে ঘটে যাবে তা কি আর কেউ কখনো ভেবেছিলো?আজ আদিবের প্রতি সম্মানটা দ্বিগুন বেড়ে গেছে মেঘলার।নিজেকে আজ সত্যি ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আদিব শুধু তার জীবন সঙ্গী নয় তার আত্মার সঙ্গী হয়ে গেছে।

আদিব বের হয়ে মেঘলার হাত থেকে জুসটা নিয়ে বিছানায় বসলো মেঘলার থেকে একটু দুরত্ব রেখে।গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,তোমার ভার্সিটি ভর্তি নিয়ে ভেবেছ কিছু?

এই সময় এই কথা বলার মানেটা বুঝলো মেঘলা।আদিব চাচ্ছে না ফয়সালকে নিয়ে তাদের মাঝে কোনো কথা হোক।অবশ্য মেঘলাও চায় ফয়সালের বিষয়ে কিছু না বলতে।সে ফয়সালের চ্যাপ্টার টা শেষ করতে চায়।এ বিষয়ে আদিবের সাথে কথা বলা মানে একরাশ অসস্তির সম্মুখীন হওয়া।

এখনো কিছু ভাবিনি,আপনি কি বলেন?

আদিব একবার চট করে তাকালো মেঘলার দিকে।এরপর চোখ সরিয়ে বললো,সব কাগজ ঠিক রেখ।আমার কিছু বই আছে লাইব্রেরিতে আর কিছু আগামীকাল এনে দেব।পড়া শুরু করে দাও।আমার মনে হয় কোচিংয়ের থেকে তুমি বাসায় ঠিক ভাবে পড়তে পারবে।যদি কোনো সমস্যা হয় আমি তো আছি।ভর্তি পরিক্ষা হতে এখনো তিনমাস বাকি আছে।আশা করি এ কয়মাসে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে।

মেঘলার চোখ ভিজে এলো।সে কখনো ভাবতে পারেনি ভার্সিটি পরতে পারবে। আশা ছিলো মনে কিন্তু তা কখনো পূরন হবে এতটাও আশা করেনি।এই মানুষটা এত ভালোবাসে কেন তাকে?মেঘলা যে তার বউ হয়েছে সেটা যেন মাথাতেই নেই।স্বামীর অধিকার বোধ থেকে কখনো তার হাতটাও ধরেনি।কেন এমন মানুষটা,ধরে তো দেখতে পারে মেঘলা বারণ করে কিনা?এতটা সুপুরুষ প্রেমিক পুরুষ হয় কি করে?

আদিব সোফায় ঘুমাতে গেলে মেঘলা বাধা দিয়ে বললো,খাটটা তো অনেক বড় দুজনের ঠিক হয়ে যাবে।

আদিব একটু ঝুঁকে আসলো মেঘলার দিকে।ফিসফিসিয়ে বললো,আমাকে এত ভালো ভাবার কিছু নেই।নিজেকে যখন পুরোপুরি ভাবে উন্মুক্ত করবো তখন বলবে আমি খুব খারাপ।বিছানায় ঘুমোতে গেলে যদি খারাপটা বেরিয়ে আসে তখন তুমি ঠিক খাট থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। তার চেয়ে বরং আমি সোফাতেই ঠিক আছি।

আদিব সরে আসলো মেঘলার থেকে।মেঘলা বুক ভরে নিশ্বাস নিলো।একটু হলেই সে মরেই যেত!আদিবের এমন কথা শুনে লজ্জায় নুয়ে গেল।তাড়াতাড়ি কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পরলো।আসলেই আদিব একটা পাজির পা ঝাড়া!

মেঘলাকে দেখে হাসলো আদিব।সে শুধু কয়েকমাস অপেক্ষা করবে।মেঘলার ভর্তিটা হয়ে যাক তখন সে প্রাকটিকাল শাস্তি শুরু করবে।মেঘলা তখন বুঝতে জ্বালা কত প্রকার, হু!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here