জোনাকিরা ভীড় করেছে last part

0
867

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#শেষ পর্ব

৪৮.
কাবিন হয়ে যাওয়ার পর আমরিন আনাফের মধ্যে দেখা বা কথা হয়নি। দুজনে দুজনার বাড়িতে বসে থাকে মান অভিমান নিয়ে। আনাফ অবশ্য প্রতিদিন নিময় করে একবার ফোন করে আমরিনকে।কিন্তু আমরিন ফোন রিসিভ করে না কখনোই।কাবিন হওয়ার দুসপ্তাহ হতে চললো। আমরিনের অভিমানের পাহাড় গলছে না কিছুতেই। আনাফ বুঝতে পারছে না তার আসলে কি করা উচিত? সে জেরিনের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক চুকে বুকে দিয়েছে।সামান্য একটা মেয়ে এতদিন ধরে তাকে এতবড় মিথ্যায় জড়িয়ে রেখেছে ভাবলেই তার রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।ইচ্ছে করছিলো জেরিনর দুগালে পরপর চারটা চড় দিতে।কিন্তু সেটা সে কখনোই পারবে না।একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলার শিক্ষা পায় নি সে। আমরিনকে মারা ছিলো অন্য ব্যাপার।আমরিনের ওপর নিজের যে অধিকার বোধ মনে মনে তৈরি করেছিলো তা থেকেই সেদিন চড় টা দিয়ে বসেছিলো।কারণ আমরিন নামের মেয়েটা জন্মের দিন থেকেই তার অধিকার হয়ে গেছে। সবে তখন ক্লাস সিক্স এ উঠেছে সে।স্কুল থেকে ফিরে শুনতে পায় তার মামির কোল আলো করে মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়েছে।আনাফ মায়ের সাথে হাসপাতালে যায়।গিয়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।অবিকল যেন পুতুল শুয়ে আছে মামির কোলে।গোল গোল চোখ গুলো দিয়ে পিটপিট করে চারপাশে তাকাচ্ছে। লাল টুকটুকে ঠোঁটা গুলো জোড়াতে কি সুন্দর ভেজা ভেজা ভাব।সদ্য জন্মানো বাচ্চা পুতুলটি আনাফের ভালো লেগে যায়।এরপরে সে প্রায় বায়না করতো আমরিনকে দেখার।জোর করে।সারাদিন কোলে নিয়ে থাকতো।দেখতে দেখতে আমরিন বড় হয়।সাথে পরিবর্তন হয় আনাফের মন।তিব্র ভালোলাগাটা যেন ধীরে ধীরে ভালোবাসা রূপে দৃঢ় হয়।আনাফ নিজেও টের পায় না।সে ছোট বাচ্চা পছন্দ করতো বিধায় আমরিনকেও খুব পছন্দ ছিলো।তবে সেটা যে এই পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে তা কখনো কল্পনাও করেনি।নিজের অনুভূতিকেই ভয় পেতে শুরু করে সে।তাই তো আমরিন বড় হওয়ার পর থেকে সবসময় অন্য রকম আচরণ করতো।আমরিনকে রাগীয়ে দিতো।যাতে আমরিন তার থেকে দূরে দূরে থাকে।অবশ্য এতে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হয়েছে।উল্টো আমরিনের রাগে লাল হয়ে যাওয়ার মুখশ্রী তাকে বারবার ফাঁদে ফেলতো।একটা সময়ের পর আমরিনের রাগী মুখখানা দেখতে পাওয়াটা নেশার মতো হয়ে গেছে।সেজন্যই তো খুকি বলে রাগাতো।খুকি ডাকটা শুনলেই আমরিনের রাগ পারদের মতো তরতর করে বেড়ে যায়।ধীরে ধীরে ভালোবাসাটা গাঢ়ো হয়ে যায়। তবুও যেন নিজেকে নিজের সীমার মধ্যে বেঁধে রেখেছিল সে।কিন্তু সেদিন যখন উপলব্ধি করতে পারলো আমরিনও তাকে ভালোবাসে তখন সবকিছু তার এলোমেলো হয়ে গেছে।কোনোকিছু চিন্তা না করেই মাকে বলে বসেছে বিয়ে করবে সে।কিন্তু আমরিন কে বিয়ে করতে চায় তা বলতে পারেনি।বেরিয়ে গেছিলো জেরিনের মুখোমুখি হতে।আদিব সবটা এত তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলবে তা জানতো না।আমরিন যে এতটা অভিমান করা সত্বেও বিয়েতে চুপচাপ রাজি হয়েছে এটাই তো অনেক।আসলেই সে আমরিনকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।এখন কি করে তার পাটরানির মান ভাঙানো যায়?আচ্ছা, মেঘলা ভাবীর কাছে কি পরামর্শ চাইবে তার ননদিনীর মান ভাঙানোর জন্য?

৪৯.
আনোয়ার সাহেব অফিস যাওয়ার আগে এখন প্রতিদিন মেঘলার হাতে চা খেয়ে বেরোন।মেঘলার বানানো চা খুব পছন্দ করেন। আজ মেঘলা চা নিয়ে আসছে না দেখে তৈরী হয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোলেন।দেখলেন দিলারা একা রান্না ঘরে। মেঘলাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

মেঘলা উঠেনি এখনো?আমার চা টা দিলো না যে আজ?

উঠেছিল। ওর নাকি শরীরটা ভালো নেই তাই আমাকে বলে আবার শুতে গেছে।গতরাতে নাকি হালকা জ্বর এসেছিলো মেয়েটার।

তাই নাকি!আমাদের আগে বলেনি কেন?তুমি ওষুধ দিয়েছ?

আমার দেয়ার সময়টুকু কি তোমার ছেলে রেখেছে?নিজেই তো বউয়ের সবায় নিয়োজিত হয়েছে।

দেখতে হবে না ছেলেটা কার!আনোয়ার সাহেন বেশ আমুদে ভঙ্গিতে বললেন।

হ্যাঁ বেশ বুঝতে পারছি আমার মতো মেঘলার জীবনটাও ত্যানাত্যানা হবে।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি খুব জ্বালিয়েছি তোমায়?

তা আর বলতে!এখন চা টা নিয়ে টেবিলে যাও।আমি নাস্তা দিচ্ছি।

আনোয়ার সাহেব একবার আশে পাশে তাকালেন।কাউকে দেখতে না পেয়ে দিলারা বেগমের কাছে একটু চেপ এসে ফিসফিসিয়ে বললে, অনেকদিন হলো হানিমুনে যাই না,চলো না কোথাও ঘুরে আসি!

দিলাম বেগম কপাল চাপড়ালেন।বিরক্ত মুখে বললেন,

তোমার ভীমরতি কখনো ছুটে না তাইনা?বুড়ো হয়েছ অথচ হানিমুনের শখ তোমার মেটে না।নিজের ছেলের যে বিয়ে হয়েছে ওদের যে এখনো হানিমুনটা হলো না সে বিষয়ে কোনো খেয়াল আছে?

ওহ তাইতো।আচ্ছা আমরা কোথাও ঘুরে আসার পর নাহয় ওদের পাঠাবো।

দিলারা রেগে যেতে ধরেও হেসে ফেললেন।সারাটা জীবন এ লোকটার পাগলামি চলতেই থাকবে।জীবনে আর কি চাওয়ার আছে?সবটাই কানায় কানায় পরিপূর্ণ যেন!

আমরিন নাস্তা খেতে এসে দূর থেকে বাবা মায়ের এমন সুন্দর মুহূর্ত দেখে মিষ্টি হাসি হাসলো।হঠাৎ আনাফের মুখটা ভেসে উঠলো।তারও তো এমন একটা মানুষ আছে!যার সাথে একটা সুন্দর সকালের সূচনা হতে পারে!আমরিনের অভিমানটা হঠাৎ ফিকে হয়ে এলো।ঘরে ফিরে ভাবলো কিছুক্ষণ আনাফের কথা।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো এখনো নয়টা বাজতে দেরি আছে এখনো।প্রতিদিন নয়টার পর আনাফের একটা ফোনকল আসে।আজ আমরিন চাতক পাখির মতো চেয়ে রইলো ফোনটার দিকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন ফোনটা আসলো তখন আমরিন কিছুটা কেঁপে উঠলো। কাঁপা হাতে ফোনটা কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসা ভারী নিশ্বাসের শব্দে অন্তরে কাঁপন ধরলো।সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইলো।আড়ষ্টাতা এসে যেন খুব করে চেপে ধরলো তাকে।আশ্চর্য! আনাফ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে তো কখনো এমন অনুভূতি হয়নি?তবে আজ কেন হচ্ছে? সম্পর্কের ধরণ পাল্টে গেছে বলে?পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে বলে?

আনাফ ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে একটু হালকা গলায় বললো,

আমি একবার তোর কাছে আসতে পারি, আমরিন?বিশ্বাস কর প্রতিনিয়ত পুড়ছি আমি,তোর নামের শীতলতা যে বড্ড প্রয়োজন আমার!

আমরিনের বুকটা মুচড়ে উঠলো এমন আবেগঘন কথায়।সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কান্না দিয়েই জবাব দিলো সে ভালোবাসার মানুষটাকে।

৫০.
মেঘলাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে আদিব।মেঘলার দুচোখে তন্দ্রা ভাব।গতরাত থেকে শরীরটা খুব একটা ভালো নেই তার।আদিব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাই একটু ঘুম ভাব এসেছে আদিবের বুকের উষ্ণতায়।গতরাতে তো ঘুম নামেনি দুচোখে।ওর কারনে আদিবেরও ঘুম হয়নি।মেঘলা বারবার ঘুমোতে বলেও লাভ হয়নি।আদিব বউয়ের সেবায় নিজেকে অর্পন করেছে।মাথা টিপে দিয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত।মেঘলা মাঝে মাঝে ভাবে আদিব কি কখনো ভালোবাসতে ক্লান্ত হয়না?এই ছেলের আগাগোড়াই ভালোবাসায় ভরপুর।বরং এত ভালোবাসা পেয়ে সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে যায়।

মেঘলা নিভু নিভু চোখে আদিবের দিকে তাকালো মাথা তুলে।দেখলো আদিব তার দিকেই চেয়ে আছে।

কি দেখছো?ঘুমোনোর চেষ্টা করো একটু।

আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?

হুম তা হচ্ছে। তোমাকে এমন অসুস্থ অবস্থায় দেখে আমার কষ্ট না হয়ে কি সুখ হবে?

মেঘলা শুকনো হাসে।আবার মাথা রাখে আদিবের কোলের কাছটায়।ফ্যাকাশে গলায় বলে,

আপনি এত ভালো কেন?

তোমার জন্য। একি প্রশ্ন করো সবসময় তাই একি উত্তর পাও।এসব না ভেবে ঘুমাও আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।তোমার জন্য একটা দারুণ সারপ্রাইজ আছে!

কি সারপ্রাইজ?

পাগলি,সারপ্রাইজ কেউ বলে দেয়?তবে জানতে হলে তোমায় সুস্থ হতে হবে।

ঠিক আছে একটু পরই দেখবেন আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি।তখন কিন্তু বলতে হবে?

আচ্ছা।আদিব ঝুঁকে মেঘলার কপালে চুমু দিলো।বললো,

আমাদের ভালোবাসা গুলো সবসময় দলবেঁধে ভীড় করুক হৃদয়ে।

মেঘলা হাসে আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।

আনাফ বিকেলে এসে হাজির হয়েছে আনোয়ারা বেগম সহ।দিলারা খুব খুশি আজ আমরিন আর আনাফকে একটু স্বাভাবিক দেখে।

মেঘলার একটু ভালো লাগায় সেও এসে বসেছে সবার সাথে।আমরিনকে একটু ফিসফিস করে বললো,

ব্যাপার কি ননদিনী, মুখখানা এতো রঙিন লাগছে কেন আপনার?জামাই তাহলে মান ভাঙাতে পারলো অবশেষে!

তুমি কি করে জানলে?

জানতে হয় গো, জানতে হয়।যার ভালোবাসার কারখানার মতো একজন স্বামী আর গোডাউনের মতো এক ননদিনী আছে তাকে অনেক কিছুই জানতে হয়,বুঝতে হয়!

আমরিন খিলখিল করে হেসে উঠলো।সবাই অবাক হয়ে তাকালো মেঘলা আমরিনের দিকে।

৫১.

পুরো পরিবার ঘুরতে এসেছে পাহাড়ে।সকলের চোখে মুখে উল্লাস।আদিব মালিহা বেগমকেও জোর করে এনেছে।কারণ হাওয়া বদল মালিহা বেগমের শরীর স্বাস্থ্যের জন্য অনেক প্রয়োজন। তবে খুব বেশি বাইরে বের হচ্ছেন না তিনি।রিসোর্টের আশেপাশেই থাকেন তিনি।একটা চেয়ারে বসে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করেন।সাথে আনোয়ারা বেগম তো আছেই গল্প করার জন্য। আনোয়ারা বেগমের হাঁটু ব্যাথার জন্য বেশি হাটতে পারেন না তাই তিনি মালিহা বেগমের সাথেই থাকেন।

আনোয়ার সাহেব দিলারা বেগমের হাত ধরে ধীরে ধীরে হেটে বেড়াচ্ছেন।মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গাইছেন।দুজনের মুখেই শান্তির আভা।দূরে থাকা ছেলে মেয়ে গুলোকে দেখে বড্ড ভালো লাগে দুজনের।দুজনেই মনে মনে প্রার্থনা করেন,

হে সৃষ্টিকর্তা তুমি ওদের সবসময় ভালো রেখ, সুখে রেখ,শান্তিতে রেখে!

মেঘলা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সবুজ রঙে আঁকা নিখুত কারিগরের সৃষ্টি দেখছে।আর তার পাশে থাকা আদিবেরও চোখে মুখে অদ্ভুত মুগ্ধতা। প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে হাজার বছর বেচে থাকার আশ জাগে তার মনে।সে মেঘলার মাথাটা নিজের কাঁধে এলিয়ে নেয়।মেঘলা আদিবের একটা বাহু আঁকড়ে ধরে।চোখ বন্ধ করে বলে, আমি আপনার সাথে জীবনের শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চাই আদিব।

আমরা এক সাথে বাঁচবো হৃদয়েশ্বরী!

একটু দূরে আনাফের বুকে লেপ্টে থাকা আমরিন ফিসফিসিয়ে বলে,

তোমার খুকি কি বড় হয়ে গেছে আনাফ ভাই?

আনাফ ঠোঁট কামড়ে হাসে।আমরিনের কপালে অধর স্পর্শ করে বলে,

আমার খুকি কখনো বড় হবে না
সে আমার হৃদয়ে চিরকাল খুকি হয়েই থাকবে।

আমরিনের আজ মোটেও রাগ হলো না। বরং একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেল।উঁচু পাহাড়ের ওপর প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে মনে হয় সমস্ত ভালোবাসা গুলো আজ যেন ভীড় করেছে ওদের নিড়ে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here