“কীভাবে ব্যাথা পেলি চাঁদ আমাকে বলবি নাকি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে হবে আমায়”– এমন শীতল কন্ঠের হুমকি ক্ষানিকটা ঘাবড়ে গেলো চাঁদ।কারণ তার সামনে স্বয়ং যমদূতের মতন ভয়ানক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আর সেটা আর কেউ না তার খালাতো ভাই তেজ।আজ সকালে ছাদে কবুতরের পিছে ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাতে আর পায়ে বেশ খানিকটা ব্যাথা পেয়েছে সে।কিন্তু সামনের মানুষটাকে কোনো ভাবে জানানো যাবে না।এতে তার ছাদে উঠা বন্ধ করে দিবে তেজ।
তেজ আর চাঁদরা একই বাড়িতে থাকে তবে পাশাপাশি ফ্লাটে।তেজ খুব গম্ভীর আর রাগী একজন মানুষ।কিন্তু সে একজনের সামনে এই রাগটা প্রকাশ করে খুব কম সে হলো চাঁদ।এই মেয়েটার কাছেই তার যত দুর্বলতা।তেজ পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে আর চাঁদ শ্যামলা গায়ের বর্ণা আর এবার অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।তেজ তার নামের মতনই অনেক তেজী।তেজের আসল নাম তেজস্ব আবরার সবাই ছোট করে তেজ ডাকে।আর চাঁদের পুরো নাম কুহেলিকা চাঁদ। সবাই তাকে চাঁদ বলেই ডাকে।সে চাঁদের মতনই ঠান্ডা একটা মেয়ে।একটু দুষ্টু কিন্তু রাগ টাগ কিছু নাই তার।সে তেজের একদম উল্টো।মেয়েটা অকারণেই তেজকে ভয় পায়।
” চাঁদ তোমাকে কিছু বলছি আমি,ব্যাথা কীভাবে পেলে?- তেজের এমন শীতল
প্রশ্ন,, আবার তুই থেকে তুমি তে চলে যাওয়া চাঁদের শরীরকে ভয়ে অসার করে দিলো।অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো,চাঁদ জ্ঞান হারালো।তেজ তো বোকা হয়ে তাকিয়েই রইল। তার মাথায় এটাই আসছে না যে সে কি এমন বললো যে অজ্ঞান ই হয়ে যেতে হবে।
সে চাঁদকে সুন্দর করে বালিশের উপর শুয়িয়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।এত কাজের চাপের মাঝে এই গরমে হুট করে এতক্ষাণি পথ আসাটাও অনেক কষ্টকর।একটু আগে যখন মায়ের সাথে কথা বলার সময় চাঁদের ব্যাথায় কান্না করার শব্দ শুনেছে তখনই ছুটে এসেছে। আর কেউ জানুক না জানুক সে জানে মেয়েটা কি তার কাছে।
এক সন্ধ্যা বেলায় এই চাঁদ পৃথিবীর আলো দেখে সেদিন ছোট তেজের জীবনেও খুশির আলো আসে।ছোট চাঁদকে দেখে তেজের কি যে খুশি।কোলে নেওয়ার জন্য কি বায়না।তখন তার মা ছেলের হাতে সন্ধ্যায় জন্ম নেওয়া ছোট্ট চাঁদকে তুলে দেয়।সেই হতেই তাদের সন্ধি।সন্ধ্যায় সন্ধি হয় তেজ আর চাঁদের।
সেই ছোট বেলা থেকে চাঁদের প্রতি তেজের আলাদা টান।মেয়েটা একটু গোলগাল।কেমন মায়া মায়া মুখ৷ দেখলেই আদর করতে মন চায়।আজও তেজের মনে আছে ছোট বেলায় তার বয়স আট বছর হবে আর চাঁদ এক বছরের পুচকি।সে চাঁদকে কোলে নিয়ে বসে আছে।এর মাঝেই টিভিতে একটা বিয়ে হচ্ছে।তখন সে পাশে বসে থাকা তার মাকে জিঙ্গেস করলো — মা ওরা কী করছে?
তেজের মা মুচকি হাসি দিয়ে উত্তর দিলো — বাবা, ওদের বিয়ে হচ্ছে।ছোট তেজের মনে প্রশ্ন জাগলো। সে আবার তার মাকে জিজ্ঞেস করলোঃ মা বিয়ে কোনো করে?
তার মা গম্ভীর ছেলের এমর প্রশ্ন শুনে তো অবাক।কারণ তেজ খুব কম কথা বলে আজ হঠাৎ বিয়ে নিয়ে তার এত আগ্রহ দেখে তার মা অবাকই হলো।এর মাঝেই ছোট তেজ আবার বলে উঠেঃ বলো না মা বিয়ে কেন হয়।
তার মা ছোট ছেলেকে কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না।তার মাঝেই তেজের বাবা আমজাদ সাহেব হেসে বললোঃ বাবা যখন আমাদের কাউকে ভালো লাগে তখন তাকে নিজের কাছে রাখতেই বিয়ে করা হয়। ছোট তেজ তখনই মনে মনে ভাবলো সে তো এই পুচকিটাকে অনেক পছন্দ করে অনেক ভালো লাগে পুচকিটাকে।তাহলে সেও পুচকিটাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রেখে দিবে।সেদিন তেজ আট বছরের ছিলো আজ সাতাশ বছরের যুবক কিন্তু আজও মনের ইচ্ছাটার কোনো নরবরে হয় নি।
চাঁদকে সে আগলে আগলে রাখে।মেয়েটার কিছু হলেই তার বুকের ব্যাথা হয়।পাগল পাগল লাগে নিজেকে।কিন্তু মেয়েটার চাল চলনের জন্য রোজ একটু না একটু ব্যাথা পাবেই।বাকি সব ক্ষেত্রে তেজ রাগী কিন্তু চাঁদের বেলায় সে বড্ড শান্ত।কিন্তু তবুও মেয়েটা তাকে ভয় পায়।এসবই ভেবে আনমনে হেসে উঠলে তেজ।
______________________________
বিকাল নেমেছে চারপাশে।চাঁদের ঘুম ভেঙ্গেছে আরো আগে।তার মা যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিয়েছে। খালামনি এসে দেখে গেছে।খালা যাওয়ার পরই তুহা আপুই আর হৃদি এসেছে।তুহা আপুই হলো তেজ ভাইয়ার ছোট বোন আমার অবশ্য দুই বছরের বড়।সে এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর হৃদি হলো তেজ ভাইয়ার চাচাতো বোন আর আমার প্রানপ্রিয় বান্ধবী।আমাদের সারাদিন কেটে যায় আমার আপু প্রহেলিকা, তুহা আপু,হৃদি আর আমার আড্ডা দিয়ে।সবাই আমাকে খুব আদর করে।আর ভুলেই তো গেছি বলতে,আমাদের বড় ভাইয়া ও আছে আমার আর আপুর দুজনেরই বড় তবে তেজ ভাইয়ার ছোট।সেও এবার পড়াশুনা শেষের দিকে আর বাবার ব্যবসা ও সামলাচ্ছে।সবাই আমাকে খুব আদর করে।এমনকি হৃদির মা মানে তেজের চাচী সেও আমাকে খুব আদর করে। তাকে আমি ছোট মা বলি তুহা আপু আর তেজ ভাইয়ার দেখাদেখি।যাক এখন আড্ডা টাইম।সবাই তো আমাকে জিঙ্গেস করেছে কীভাবে ব্যাথা পেয়েছি কিন্তু কেউই জানতোনা আমি ছাদ থেকে ব্যাথা পেয়ে এসেছি শুধু মা আর খালা বাদে।কারণ তেজ ভাইয়ার কানে একবার এই কথা গেলে আমি শেষ।
হঠাৎ আমার আপু বলে উঠলো – কিরে সেদিন যে একটা ছেলে তোর পিছু নিয়েছে তার খোঁজ কিছু জানিস? আমারও হঠাৎ মনে হলো তাই তো,সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে এক ছেলে পিছে পিছে আমার সামনে পর্যন্ত এসেছিলো।আমি আর হৃদি রিক্সায় ছিলাম ছেলেটা বাইক করে এসেছিলো।আমি তো ভয়ে জমে শেষ একবার যদি তেজ ভাইয়া জানতে পারে তাহলে সর্বনাশ।কিন্তু তেজ ভাইয়া সেদিন কিছু জানতে পারে নি।তবে ছেলেটাকে আর দেখি নি।আপুকে বললাম- না আপু,সেদিনের পর থেকে আর দেখি নি ওই ছেলেরে,ভাগ্য ভালো তূর্য ভাইয়া জানেনা যদি জানতো আমি শেষ।আমার কথা শেষ হতেই তুহা আপু হেসে উঠলো আর বললোঃ এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা জানিনা,আর তুই অকারণে আমার ভাইকে দোষ দিবি না আমার ভাই একমাত্র তোর সাথে ই ঠান্ডা মাথায় কথা বলে তাও তুই যা ভয় পাস।সবাই এবার সমস্বরে হেসে উঠলো।ও ভালো কথা এতক্ষণে তেজ ভাইয়ার কথা মনে পড়লো।
সেই কোন দুপুরে দেখেছি এখনও একবার এলো না কেনো?
এসব ভাবনার মাঝেই দরজায় টোকা পরে।সে পিছে ফিরে দেখে দরজায় তেজ দাড়াঁনো।আর তেজের হাতে থাকা জিনিস টা দেখে তার বুক কামড় দিয়ে উঠলো।তাহলে কি তেজ জেনে গেলো,
তেজকে দেখেই তুহা,প্রহেলিকা, হৃদি চাঁদের রুম থেকে চলে গেলো।আর চাঁদ তো ভয়েই বসে রইল পাথর হয়।তেজ তার হাতের খাঁচা টা নিয়ে চাঁদের হাতে দিলো। শার্টের উপরের দুইটা বাোতাম খুলে সোফায় গিয়ে বসে আমাকে বললো-চাঁদ এক গ্লাস পানি দে তো,বাহিরে বডড গরম। আমিও একমুহূর্ত দেড়ি না করে তেজ ভাইয়াকে পানি দিলাম।ভাইয়া পানি খেয়ে বলে-কিরে এই কবুতর দেখার জন্যই তো ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলি তাই না।
তেজ ভাইয়ার কথা শুনে তো শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে গেলো।মনে মনে ভাবছি ভাইয়া কেমনে জানলো।এর মাঝেই তেজ ভাইয়া বলে উঠলো-আমি কীভাবে জানলাম সেটা না জানলেও চলবে তোর,এরপর থেকে দিনেদুপুরে ছাদে যাবি না, এই যে কবুতরের জন্য এত প্রেম এই কবুতর এনে দিলাম।আর একবার যদি শুনি ব্যাথা পেয়েছিস কোনো কারণো তাহলে সেদিন তোর শেষ দিন।
তেজ ভাইয়ার কথা শুনে তো কলিজায় পানি শুকিয়ে গেছে।তবে একটা ভালো লাগাও কাজ করছে।এ মানুষটা আমার জন্য কত ভাবে।না চাইতেও সব হাতের কাছে নিয়ে আসে।
“কিরে এমন ভ্যাবলার মতন তাকিয়ে আছিস কেনো?” তেজ ভাইয়ার এমন কথায় ধ্যান ফিরলো আমার, লজ্জাও পেয়েছি।কেমন ভাবে লজ্জা দিলো মানুষটা।সবসময় এমন করা লাগে ওনার।
অন্যদিকে চাঁদেরর এমন লজ্জা পাওয়া দেখে মিটিমিটি হাসছে তেজ।মেয়েটার লজ্জায় গাল গুলো কেমন লাল হয়ে গেছে।এতে লজ্জা পায় তার ছোট্ট চাঁদটা।এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে চাঁদের বড় ভাই আহান ঘরে ঢুকে।আহান তেজকে ঘরে দেখে বেশ বিব্রত বোধ করলো।তেজ আহানকে স্বাভাবিক করতেই বলে উঠলো-আহান কি খবর তোমার,ওখানে দাড়িয়ে আছো কেনো এখানে আসো,বসো সোফায়। আহানও স্বস্তি পেলো তেজের অনুমতি পেয়ে।
আহান এসেই চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে-কীভাবে চলাফেরা করিস বোন?একটু সাবধান থাকবি তো।আর যেনো কখনো এমন ভাবে চালচলন না দেখি।বাবা আসলে মাকে খুব বাবে জানিন তো এর এমন উল্টাপাল্টা চালচলনের জন্য।আমরাও বাদ যাবো না বকা খাওয়া থেকে তাও তুই সাবধান হোস না।
চাঁদ ঠোঁট ফুলিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ এছাড়া ভাইয়াকে চুপ করানো যাবে না।চাঁদের এমন ঠোঁট ফুলানো দেখে আহানও চুপ হলো।কত আদরের বোন তার।ছোট বেলা থেকেই বোনটা একটু দুর্বল। দেখতে গোলগাল হলেও শরীরে হাজার রোগের বাসা।তাই তো সবার এত চিন্তা।সে বোনের মাথাঢ হাত বুলিয়ে বললো – আচ্ছা থাক বোনটা আর রাগ করে না ভাইয়া তার জন্য যে আইসক্রিম এনেছে সেটা কি জানে আমার চাঁদমনি।
চাঁদের আর কি চাই।সে খুশি মনে জড়িয়ে ধরলো ভাইয়াকে।
ভাই বোনের এমন মিষ্টি শাসন দেখে সোফা থেকে শান্তির শ্বাস ফেললো তেজ।সে চায় ৎার চাঁদ সবসময় এমন হাসি খুশি থাকুক, ভালো থাকুক।এর মাঝেই তেজের ফোন বেজে উঠলো।চাঁদ তেজের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখে তেজ ফোন হাতে নিয়ে ঘরের বাহিরে চলে যাচ্ছে।চাঁদের মনে খটকা লাগে। কে এমন কল করেছে যে তেজ ভাইয়া আমাদের সামনে কথা বলতে পারবে না।তাহলে কি তেজ ভাইয়ার ও ব্যাক্তিগত কেউ আছে?
চলবে,,,,,
[আপনাদের সাড়া পেলে আগামীকাল পরের পর্ব পোষ্ট করা হবে❤️❤️।।অবশ্যই পাশে থাকবেন পাঠকমহল।।আমি নতুন লিখালিখি করি।।তাই ভুল গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]
#গল্পঃসন্ধ্যায়_সন্ধি
#মম_সাহা