সন্ধ্যায় সন্ধি পর্ব ১৫

0
991

#সন্ধ্যায়_সন্ধি
#মম_সাহা

পর্বঃ১৫

–“বলেন না তেজ ভাইয়া কে খুন করেছে?এত ঘুরাচ্ছেন কেনো?আপনি কি বুঝতে পারছেন না সবাই ভেঙ্গে পড়েছে?প্লিজ বলেন।” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল চাঁদ।

তেজ চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়া তাকে দাড় করিয়ে খুনির সামনে গিয়ে তার হাত ধরে টেনে সবার সামনে এনে বলে,
–“এই যে ও খুন করেছে।শুধু ও না ওর সাথে আরও একজন মিলে খুন করেছে।”

সবাই জেনো আকাশ থেকে পরেছে।এই মানুষটা খুন করেছে কেউ মানতে পারছে না। চাঁদের বাবা মহসিন সাহেব তো বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তেজের মা জাহানারা বেগম দৌড়ে এসে তেজের হাতের হাতের মুঠে থাকা খুনির হাতটা ছাড়িয়ে তেজকে একটা সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো আর চিৎকার দিয়ে বলল,,

–“তুই কি বলছিস বুঝে বলছিস?প্রহেলিকা? আমাদের প্রহেলিকা খুন করেছে? অসম্ভব। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে দেখা।কি প্রমাণ আছে?”

তেজ একটা বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে অশ্রুশিক্ত নয়নে মাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত হতে বলছে।তারপর তার মাকে বসিয়ে বলা শুরু করলো,,

–“তোমাদের মতন আমিও মানতে পরিনি প্রহু এমন করেছে, ইনফ্যাক্ট এখনো মানতে পারছি না।কিন্তু মানতে হবেই কারল সব প্রমাণ প্রহুর বিরুদ্ধে। রাহাকে যে বালিশ চাপা দিয়ে মারা হয়েছে সে বালিশে প্রহুর হাতের ছাপ আছে।আর যে দড়িটাই রাহা ঝুলে ছিলো সেটাতেও প্রহুর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।সুইসাইড নোট টাও প্রহুর লেখা।”

মহসিন সাহেব মানে প্রহেলিকার বাবা বুকে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পরেন।নীলিমা বেগম মানে প্রহেলিকার মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে হৃদির মা।চাঁদ অনবরত কাঁপছে তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে মনে হয়। সে লুটিয়ে পরবে মাটিতে।কিন্তু আহান ধরে রাখায় এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে।

তেজ প্রহেলিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নামাখা কন্ঠে বলল,

–“কেনো এমন করলি প্রহু?তোকে তো ভালোবাসতো সবাই তুই এই কাজটা করতে পারলি?কেনো করলি এমনটা বল?”

প্রহেলিকা এবার অশ্রু মুছে বেশ হিংস্র স্বরেই বলে উঠলো,

–“হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই করেছি এমন।আমি করেছি।আর বেশ করেছি।কেনো করেছি তোমরা জানো তোমাকে পাওয়ার জন্য তেজ ভাইয়া তোমাকে পাওয়ার জন্য। আমি ভালোবাসি তোমাকে পাগলের মতন ভালোবাসি কিন্তু তোমরা কেউ বুঝলে না কেউ।”

কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রহেলিকা।চাঁদের পায়ের নিচের মাটি এবার সত্যিই সরে গেছে।অনেক কষ্টে সে প্রহেলিকার দিকে এগিয়ে প্রহেলিকার বাহু ধরে অবিশ্বাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলল-“আপু?”

প্রহেলিকা ঝাড়া মেরে চাঁদকে ফেলে দিলো।চাঁদ পরে গিয়ে মাথা লাগলো সেন্টার টেবিলে।মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে।আহান এবার পাগল প্রায়। তার দুবোন কলিজা ছিলো। এখন সে বোন একজন আরেকজনের শত্রু হয়ে উঠবে ভাবতেও পারে নি।আহান দৌড়ে গিয়ে প্রহেলিকার দু গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় লাগিয়ে দিলো।আর তেজ চাঁদের কাছে গেলো চাঁদকে ধরার জন্য কিন্তু চাঁদ হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো।এর মাঝেই প্রহেলিকা কান্না করতে করতে বসে পরলো ফ্লোরে আর বলল,,

–“তুই চাঁদ তুই সব শেষ করে দিলি আমার।তুই যদি আমার আর তেজ ভাইয়ার মাঝে না আসতি তাহলে তেজ ভাইয়া আমার হতো কিন্তু তুই সব শেষ করে দিলি।আমি পাগলের মতন ভালোবাসতাম তেজ ভাইয়াকে।সেটা বাবা মাও জানতো। তাদের আমি নিজে বলেছিলাম কিন্তু তারা একটা রাস্তার মেয়ের জন্য আমার ভালোবাসার দাম দিলো না।তোকে রান্তার মেয়ে কেনো বলেছি জানিস? কারণ তুই আমাদের কেউ না কিচ্ছু না।এই যে তোর জন্য আমার ভাই আমাকে মারলো ওর ও তুই কিছুই লাগিস না।কারণ তোর সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই।আমার একটা ছোট বোন হয়ে যখন মারা যায় তখন মা ভেঙে পড়েছিলো।বাবাই তখন অনাথ আশ্রম থেকে সাতদিনের চাঁদকে তুলে এনেছিলো কিন্তু দেখ এই তুই রাস্তার মেয়ের জন্য বাবা মা আমাকে কম ভালোবাসতো।আমার ভাই তোর হয়ে কথা বলতো।যখন সবাই তোকে এত ভালোবাসত তখন আমার খারাপ লাগতো তবুও নিজের বোন হিসেবেই তোকে মেনে নিয়ে ছিলাম কিন্তু তুই আমার ভালোবাসা তেজ ভাইয়ার দিকেও শেষমেষ নজর দিলি।এত লোভ তোর?”

চাঁদের মাথায় এবার আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।এ কোন সত্যি জানলো সে।এ দিনও বুঝি দেখার ছিলো।আপন মানুষ এভাবে বদলে যাবে,এতদিন যাদের নিজের বাবা মা ভেবেছিল তারা কেউ না সেটাও মানতে হবে তার।অপরদিকে মহসিন আর নীলিমা এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। এটাই হলো।চাঁদকে সামলাবে কীভাবে সেই চিন্তায় দুজনের মাথা ঘুরে গেলো। তেজও ভয় পাচ্ছে চাঁদকে নিয়ে। এতদিন সবাই জানতো কেবল তুহা,হৃদি আর চাঁদ বাদে।আজ সবাই জেনে গেছে।

চাঁদের দম বন্ধ হয়ে আসছে।তবুও অনেক কষ্টে বলল,
–“আপু আমি রাস্তার মেয়ে,তোমার সব কিছুতেই ভাগ বসিয়েছি আমি তাহলে মৃত্যু টা আমার না হয়ে রাহার কেনো হলো?আমার জায়গায় খুনটা রাহাকে কেনো করলে?আজ কথার আঘাতে না মেরে রাহার মতন জানে মেরে দিতে।রাহা আপুকে কেনো খুন করলে আপু?”

প্রহেলিকা এবার জ্বলে উঠে বলল,
–“খুন তো আমি তোকেই করতাম কিন্তু রাহা সব জেনে গিয়েছিল আর তোকে সব জানিয়ে দিবে বলেছিল তাই ভেবেছিলাম ওকে মেরে তোকে ফাঁসিয়ে দিবো তাহলে এক কাজে দুকাজ হবে কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ তোকে পারলাম না তেজের জীবন থেকে সরাতে।”

তেজ এবার বাহিরে দাঁড়ানো পুলিশকে ডাক দিলো পুলিশ ভিতরে আসার পর তেজ বলল,
–“অফিসার সব তো শুনলেন এবার ওকে নিয়ে যান আর শুধু প্রহেলিকা না সাথে দাদী কেও নিয়ে যান কারণ প্রহেলিকার সাথে মিলে সেও প্রহেলিকাকে বুদ্ধি দিয়েছে।”

উপস্থিত সবাই আরও ভেঙ্গে পরেছে।কেউ প্রস্তুত ছিলো না এটার জন্য। মনোরমা বেগম মানে তেজের দাদী এতক্ষণ সোফায় চুপ করে বসেছিলো কিন্তু যখন তার নাম বলা হলো সে চমকে গেলো।তখন প্রহেলিকা অবাক স্বরে বলল,
–“তুমি কীভাবে জানলে দাদী আমার সাথে ছিলো?”

–“কারণ তুই একা এত প্ল্যান করতে পারবি না।আর ক’দিন যাবত দেখছিলাম দাদীর সাথে তুই কেমন চিপকে থাকতি। আর রাহার পা দাদী চেপে ধরেছিলো মারার সময় তখন ওনার আংটির ছাপ পড়েছে পায়ে। “তেজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠল।

রাহার মাও ভেঙে পড়েছে।শেষমেশ ওনার মেয়ের মৃত্যুর জন্য ওনার মা দ্বায়ী সেটা মানতে পারছে না।প্রহেলিকাও এবার কেঁদে বলল,

–” আমি কাউকেই মারতে চাওয়ার মতন জঘন্য চিন্তা আনিনি।কিন্তু দাদী আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল এসব। সে বলেছিল চাঁদ মরলে আমি তেজ ভাইয়ার বউ হবো।যখন রাহা শুনে ফেলে তখন দাদীই বলেছিলেন রাহাকে না মারলে আমরা ফেঁসে যাবো তাই দাদীর কথায় ভয় পেয়ে আমি মেরে দিয়েছিলাম রাহাকে”।

উপস্থিত সবাই নির্বাক।প্রতিটা মানুষ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে।এসব কিছু সব থেকে খারাপ প্রভাব ফেলে চাঁদের উপরে।তাই দাদি আর প্রহেলিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে খুব কষ্ট করে উঠে প্রহেলিকাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।তার চিৎকারে রুমের প্রত্যেক টা সদস্য কেঁদে উঠে।চাঁদ কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

–“আপু তুমি আমাকে মারতে সক্ষম হয়েছো।সব মৃত্যু ছুড়ির আঘাতে হয় না।মনের আঘাতেও হয়।আমি মরে গেছি তখনই যখন শুনেছি আমার আঠারো বসন্তের সই আমার প্রাণপ্রিয় বোন আমাকে খুন করতে চেয়েছে। আমি তখনই মরে গিয়েছি যখন শুনেছি আমার এত এত কাছের মানুষ গুলো আমার না।আমি অন্য কারো জায়গায় ভাগ বসিয়েছি।আমি মরে গেছি আপু তখনই যখন আমার আপু আমাকে দোষারোপ করেছে সব কিছুর জন্য। আমি জানতাম না তুমি তেজ ভাইয়াকে এত ভালোবাসো জানলেও কি করতাম আমি জানিনা।যতই হোক ভালোবাসার ভাগ কি আর কাউকে দেওয়া যায়? দেওয়া যায় না তো তবুও হয়তো আমার আপুকে খুশি করার জন্য হয়তো সেই ভাগটাও ছেড়ে দিতাম।একটা বার বলতে আপু আমি তোমার সুখের কাটা আমি নিজেই সড়ে যেতাম।এভাবে ছিন্নভিন্ন করে না মারলেও তো পারতে আপু।এ মৃত্যু যে বড় যন্ত্রণা দায়ক।আমি যে সইতে পরছি না।আপু ও আপু রে আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আপু।বেঁচে থাকাটা বুঝি এত অসহ্য হয় আপু?”

প্রহেলিকা কাঁদছে।চাঁদের আর্তনাদ তার ভিতরটাকেও আজ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।রুমের প্রতিটা সদস্য কাঁদছে।তেজও কাঁদছে।আর চাঁদ দৌড়ে রুমে ঢুকে গেছে।আর দরজা আটকিয়ে চিৎকার করে বলছে,,

–“হে আল্লাহ বেঁচে থাকার স্বাধ যে আমাকে মেরে ফেলেছে আমি যে আর বাঁচতে চাই না।”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here