সন্ধ্যায় সন্ধি শেষ পর্ব

0
1737

#সন্ধ্যায়_সন্ধি
#মম_সাহা

অন্তিম পর্বঃ

তীব্র ফিনাইলের গন্ধে ভিতরটা বার বার কেঁপে উঠছে আর বার বার বোধহয় জানান দিচ্ছে খারাপ কিছু হবে।তেজের মাথা ধরে আসছে।হৃদপিণ্ডটা বোধহয় স্বাভাবিকের চেয়েও জোড়ে লাফাচ্ছে।আজ হসপিটাল টাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা মনে হচ্ছে তার।কারণ তার ভালোবাসার মানুষটা শুয়ে আছে নির্লিপ্ত ভাবে এখানে।তাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে।হ্যাঁ চাঁদ শুয়ে আছে হসপিটালের বেডে।কোনো জ্ঞান নেই।ডাক্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ওর শরীর থেকে বিষ বের করার।বাঁচবে কিনা জানা নেই কারণ নিজেকে শেষ করার সবটুকু উপায় সে ব্যবহার করেছে।চাঁদ সুইসাইড করেছে।
___________
” ফ্লাশব্যাক ”

চাঁদ দরজা লাগিয়েছে বেশ খানিকটা সময় পার হয়েছে।এতক্ষণ কান্নার আওয়াজ আসলেও এখন সব নিষ্চুপ।চাঁদের কান্নার আওয়াজ এতক্ষণ সবাইকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেও তার নিরবতা আরো বেশি কাঁপিয়ে দিচ্ছে হৃদয়টা।হঠাৎ কিছু পরার শব্দ হলো।সবাই চাঁদের ঘরের দিকে কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। তেজ কিছু একটা ভেবে ছুটে যায় চাঁদের ঘরের দিকে। তেজকে ছুটে আসতে দেখে সবাই তার পিছে পিছে আসে।তেজ দরজার সামনে এসেই পাগলের মতন অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে আর হাজার আকুতি মিনতি করছে চাঁদকে দরজা খোলার জন্য। অপরপাশ থেকে আশানুরূপ ফল আসছে না বরং গোঙানির আওয়াজ আসছে।আওয়াজটা উপস্থিত সবার মনে ভয় ঢুকে গেছে।আহান আর তেজ দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করছে।চাঁদের বাবা-মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।চাঁদের বাবা নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“মারে ও মা দরজা খোল,যা শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো কিন্তু বড় কোনো শাস্তি তুই নিজেকে দিস না মা।আমার তো আম্মা নাই তুই আমার আম্মা তুই তোর ছেলেকে কষ্ট দিস না। খোল মা দরজাটা।”

ততক্ষণে তেজ আর আহান দরজা ভাঙতে সক্ষম। দরজা খোলার সাথে সাথে মনে হয় তাদের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো চাঁদের নিথর শরীর টা ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকতে দেখে। চাঁদের মা সাথে সাথে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।তেজ কতক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো।যখন তুহা হৃদির চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসলো তখনই ছুট লাগায় নিথর দেহটারে দিকে।তাড়াতাড়ি দু’জন মিলে চাঁদকে খাটে শুয়িয়ে দেয়। হৃদির বাবা অ্যাম্বুলেন্স কল দেয়।চাঁদের মায়ের চোখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরায়।আর চাঁদের বাবা চাঁদকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করছে উপরওয়ালার দরবারে জেনো তার কলিজার টুকরাকে কেড়ে না নেয়।

হৃদির চাঁদের হাতে মুঠ করে রাখা চিঠিটা নেয়।চিঠিটা খুলে জোড়ে জোড়ে পড়া শুরু করল,

প্রিয় সবাই,,
তোমরা সবাই কি জানো তোমরা আমার কতটা প্রিয়? আমার সাথে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক না থেকেও এতটা আপন হয়ে ছিলাম শুধু আত্মার সম্পর্কের জন্য তাই না?তোমরা আমার কেউ না, বিশ্বাস করো এটা আমি মানতে পারবো না কখনো।এই রঙিন দুনিয়ায় আমার আর কেইবা আছে বলো তোমরা ছাড়া? আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে জানো,আমি ভাবতেও পারি নি আমি আমার আপুর কষ্টের কারণ হবো।যেহেতু হয়ে গেছি এই অপরাধ আমি মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবো না।আব্বু আম্মু তোমাদের আমি অনেক ভালোবাসি।পরের জন্মে জেনো আমাদের রক্তের সম্পর্ক হয়।বারবার রাস্তার মেয়ে আমি সেটা শুনতে চাই না।ভাইয়া ও ভাইয়া একটা রাস্তার মেয়েকে বুঝি এত ভালোবাসা যায়? তুই কেনো এত ভালোবাসলি?এখন যে তোকে ছেড়ে যেতে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।তেজ ভাইয়া,, আমাকে মাফ করে দিয়েন।এজন্মে আমার আর আপনার সাথে ঘড় করা হলো না।আমাদের একটা সাজানো সংসার হলো না।আমি বেইমানী করেছি।ক্ষমা করবেন তো আমায়?আজ একটা কথা না বলে পারছি না।তেজ ভাইয়া ভালোবাসি আপনাকে অনেক।খালামনি তুহা,হৃদি,ছোট মা,খালু,ছোট বাবা সবাইকে আমি বড্ড মিস করবো গো।আমার বুকের বা’পাশে বড্ড জ্বালা করছে।তোমাদের ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা মৃত্যু যন্ত্রণা থেকেও কঠিন।

ইতি
অভাগীনি।

পুরো ঘর নিস্তব্ধ। কান্নার আওয়াজ আসছে না।সবাই চিঠিতে ডুবে গিয়েছিল। বাহিরে আ্যম্বুলেন্সের শব্দে সবার হুঁশ ফিরে।তাড়াতাড়ি চাঁদকে হসপিটালে আনা হয়।বর্তমানে সবাই আইসিইউ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

চাঁদের বাবা মা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। শুধু কাঁদছে না তেজ।সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।আইসিইউর লাইট বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সবার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।দমবন্ধকর পরিস্থিতি। ডক্টর বের হয়ে এসেই বলল,

–“সরি।ওনাকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি।সে নিজেকে বাঁচানোর কোনো রাস্তা রাখে নি।প্রথমেই হাতের রগ কেটেছে,তারপর বিষ খেয়েছে আমার ফ্যানের সাথে ঝুলেছে।কোনো ওয়ে ছিলো না তাও সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছি আমরা।তবে ওনার একবার জ্ঞান ফিরেছিল আর বলে গেছে “পরজন্মে আমি বাবা মায়ের রক্তের সম্পর্কের সন্তান হবো,আত্মার সম্পর্কের মূল্য কেউ দেয় না।আর তেজ ভাইয়ার সাথে সংসার করার স্বাধ পরজন্মে পূরণ করবো”।

চাঁদের বাবা আম্মুরে বলে একটা বিরাট চিৎকার দিলো।সবাই কান্নায় ভেঙে পড়লো শুধু একজন বাদে সে হলো চাঁদের হতভাগা প্রেমিক, যে তার প্রেমিকাকে পাবে পাবে বলেও শেষ মেশ পেলো না।তেজের বাবা আর চাচা দৌড়ে তেজের কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।কীভাবে সামলাবে এ ছেলেটাকে? তেজের বাবা তেজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

-“আব্বা একটু কান্না করো, তোমার চাঁদ চলে গেছে বাবা”।

তেজ নির্লিপ্ত ভাবে তার আব্বুর দিকে চেয়ে বলল,

-” আব্বু কার জন্য কান্না করবো? ও বড় বেইমান আব্বু।বড্ড স্বার্থপর আব্বু।ওরে ছাড়া যে আমি থাকতে পারবো না ও জানে তবুও এমন করলো।বড্ড বেইমান চাঁদ আব্বু বড্ড বেইমান।চাঁদরা বুঝি এমনই হয় সবার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকে তাই না? বড্ড ভালোবেসে ছিলাম তাই বেইমানী করলো।আব্বু গো এই বেইমানকে ছাড়া বাঁচবো কেমনে আমি? ভালোবাসি যে এই স্বার্থপর মেয়েটাকে।ও আব্বু আমি বড্ড ভালোবাসি।ও তো বাসলো না একটুও ভালো। ”

তেজ লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে।ডাক্তার দৌড়ে আসলো। তেজকে চ্যাক করলো। এবারও বাঁচাতে পারলো না তারা তেজকে।তেজ স্ট্রোক করেছে আর মাটিতে পড়ার কারণে সাথে সাথে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।

পুরো হসপিটালময় আর্তচিৎকার।মানুষ দেখতে আসছে সেই প্রেমিক প্রেমিকা যুগলকে যারা ভালোবেসেছে এক অপরকে আকাশসম।

__________________
সন্ধ্যার আজান দিয়েছে চারদিকে।চাঁদ আর তেজের জানাজা হলো একটু আগে।এমন ভর সন্ধ্যা বেলা চাঁদের সাথে তেজের সন্ধি হয়েছিলো আবার এই ভরসন্ধ্যা বেলায় দুজনের সন্ধি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলো।তবে স্মৃতি? সেটা থেকে যাবে আজীবন। সন্ধ্যায় সন্ধি হওয়া মানব মানবীকে সবাই স্মরণ করবে।পরেরজন্মে নাহয় আবার সন্ধি হবে তাদের।ভালোবাসা বেঁচে থাকুক দৃষ্টান্ত হয়ে।মানুষ গুলো নাহয় না-ই রইল.

#সমাপ্ত

?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here