#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১৩)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
শান্ত চিঠিটা ফেলে ঘর থেকে বের হতে নিলেই তমা শান্তর হাত ধরে ফেলে এবং বললো,” রুপ ভাইয়াদের বাড়ি যাইতেছেন, লাভ নাই? ভাইয়া কাল রাতেই চইলা গেছে”?
শান্ত সেখানেই বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে বললো,” রুপ এরকম করতে পারে না। রুপ রাতকে খুব ভালোবাসতো”।
পলাশ কিছু বুঝতে না পেরে রাত্রীকে বিছানায় বসিয়ে রেখে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো,
” রাত আমারে ক্ষমা কইরা দিও। আমি তোমারে বিয়া করতে পারবো না।
তুমি ভাইবো না আমি তোমারে ভালোবাসি না, আমি সত্যি তোমারে ভালোবাসি৷ তয় তোমার লগে বিয়া করার ইচ্ছা বা সপন কোনটাই আমার ছিলো না। আমি তোমার প্রেমিক হইতে চাইছিলাম, সেইটা আমি হইছি। কিন্তু বিয়া! সেইটা আমার দ্বারা হইবো না। বয়ে চলা নদীর ঢেউ উপভোগ করার জন্য জীবনে একজন প্রেমিকার দরকার কিন্তু রাতের আকাশের তারাগুলো দেখার জন্য একজন বউ দরকার। আমি পুনরায় বলতেছি বউ দরকার, প্রেমিকা নয়! আমি রুপ জীবনডারে অন্যভাবে কল্পনা করি, সেই কল্পনায় প্রেমিকা প্রেমিকার স্থানে কিন্তু বউয়ের স্থানে প্রেমিকা নয়। যে প্রেমিকা হইতে পারে সে বউ হইতে পারে না। এইটা রুপের ভাষা। রুপ জীবনডারে এমনেই ভাবে।
শুধু এই কারনডার লাইগা তোমারে বিয়া করমু না তা নয়, আরো একটা কারন আছে। তা হইলো এত জলদি আমি বিয়া করতে চাই না। আমি শহরে যাইয়া ভালো কামকাজ খুইজা আগে নিজের একখান পরিচয় বানাইতে চাই। এত জলদি বিয়া কইরা বউরে খাওনের মতোন রোজগার আমার হইবো না। আমি উচ্চ শিক্ষিত নই তয় বোকাও নই। এহন বিয়া কইরা শেষে নুন ভাত খাইয়া মরার চাইয়া আগে টাকা উপার্জন কইরা বিয়ার কথা ভাবা ভালো। তোমার আব্বা, আম্মা আইজ আমাগো ভালোবাসার কথা ভাইবা যে বিয়া দিতে রাজি হইছে, একদিন তারাই আমার জন্য কষ্ট পাইবো। তহন তারা কইবো ভালোবাসা দিয়া পেট চলে না। তাই আমি উপার্জনের রাস্তায় পা বাড়ালাম।
আমি বেশি কিছু লিখতে পারলাম না। হঠাৎ করে ঠিক হওয়া এই বিয়ার বোঝা আমি নিতে পারতাম না। তাই চইলা গেলাম। যাওয়ার বেলায় বইলা যাইতে চাই, ভালোবাসি তা মিথ্যা নয়”।
হঠাৎ শান্ত বলে উঠলো,” আমার মনে হয় রুপ কোন বিপদে পড়েছে নয়তো ও রাতকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়”।
তমা বলে উঠলো,” এই হাতের লেখা রুপ ভাইয়ার। আমি রুপ ভাইয়ার হাতের লেখা চিনি”।
” হতেও তো পারে কেউ কপি করেছে”।
শান্ত কথাটি বলে রাত্রীর দিকে তাকালো। বেশ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,” রাত তুমি তো রুপের হাতের লেখা চেনো। তোমার কি মনে হয় এটা সত্যি রুপের হাতের লেখা নাকি……”।
শান্ত কথা শেষ করতে পারলো না তার পূর্বেই রাত্রী বললো,” এটা রুপের হাতের লেখা। এ লেখার মাঝে কোন কপি নেই। তাও আমি বিশ্বাস করি রুপ আমারে ঠকাতে পারে না। হয়তো রুপ মজা করছে। ঠিক সময় রুপ নিশ্চয় চলে আসবে”।
শান্ত রাত্রীর কথায় আসার আলো দেখতে পেলো।
” হ্যাঁ। আমারো মনে হয় রুপ মজা করছে। আমরা বরং ওর আসার অপেক্ষা করি”।
তমা বেশ বিষ্ময় নিয়ে বললো,” মজা? রুপ ভাইয়া এমন মজা করবো”?
একটু থেমে পুনরায় বললো,” হইতেও পারে। রুপ ভাইয়া রাতরে মেলা ভালোবাসতো৷ রুপ ভাইয়া কাজকামের দোহাই দিয়া চইলা যাইতে পারে না”।
রুপ মজা করছে ভেবে সবাই আসা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। সবাই মনেমনে চাইছিলো রুপ সত্যি জানো মজা করে! কিন্তু তাদের আসা সত্যি করে রুপ কি ফিরে এসেছিলো সেদিন! না রুপ ফিরে আসেনি। অপেক্ষার মাঝেও পলাশ এবং শান্ত রুপকে দুই তিন গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি।
সন্ধ্যা হতে চললো তাও রুপ ফিরে আসেনি। অতিথিরা নানা ধরনের কথা বলে চলেছে। কেউ কেউ রাত্রীর কপালের দোষ দিচ্ছে, কেউ বা চরিত্রের! অন্যদিকে রাত্রী নিরব হয়ে গেলো। সে খুব আসা করেছিলো সব মিথ্যে করে রুপ তার কাছে চলে আসুক। রুপ এসে বলুক এসব মজা ছিলো! কিন্তু না! রুপ আসেনি। হঠাৎ রহিমা বেগম রাত্রীর সামনে এসে হাত-জোড় করে বললেন,” গ্রামে আমাগো আর থাহা হইবো না। তোর বিয়া ভাইঙ্গা গেলে সমাজ আমাগো মুখে থুথু মারবো৷ এমনিতেই তুই বিষ খাইছোস এইটা জানার পর সবাই আমাগো লগে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে। এহন তো মুখ ফিরাইয়া নিবো”।
রাত্রী রহিমা বেগমের মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললো,” সত্যি সত্যি বিষ এনে দেও মরে যাই”?
” তুই তো মইরা যাইয়া শান্তি পাবি কিন্তু আমরা কি পামু? মইরা যে যায় সে তো বাঁইচাই যায়, মধ্যে থেইকা সারাজীবন কষ্ট বইয়া বেড়ায় আমার মতো রহিমারা”।
রহিমার কথার ইঙ্গিতে যে রাত্রীর মা রাইসা ছিলো তা বুঝতে কষ্ট হয়নি রাত্রীর। রাত্রী রহিমার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ভাবলো,” এই মানুষটি সারাজীবন অন্যের জন্য কষ্ট পেয়েছে, আজ আমার জন্য পাবে। না না তা হলে আমি বাঁচতে পারবো না”।
মুখ ফুটে রাত্রী বললো,” তুমি বইলা দেও আম্মা কি করলে তোমাগো জীবন সুন্দর হবে”?
রহিমা বেগম রাত্রীর মুখে এমন একটি কথাই আসা করছিলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন,” তোর বিয়া হইলে আমাগো সমাজ থুথু ফেলবো না”।
” বিয়ে হওয়ার জন্য বরকে তো আসতে হবে। সে তো পালিয়ে গেলো”।
” যে যাওনের সে গেছে। কিন্তু যে আছে তারে তো বিয়া করতেই পারো”?
” মানে…..”?
তারপর রহিমা বেগম যা বললেন তা শোনার জন্য রাত্রী প্রস্তুত ছিলো না। শেষে নিজের জন্য পরিবারের কষ্ট হোক তা চায় না বলেই রাজি হয়ে গেলো। বিশেষ করে রহিমা বেগমকে আর কষ্ট দিতে চায়নি।
_________
হতাশ হয়ে শান্ত এবং পলাশ বাড়ির উঠানে এসে বসলো। লোকজন কতেক চলে গেছে, কতেক বসে বসে কুটকাচালি করছে। এমন সময় রহিমা বেগম শান্তকে ভিতরে ডাকলেন। শান্ত ভিতরে যেতেই রহিমা বেগম অনুরোধের সুরে বললেন,” আমাগো এই বিপদ থেইকা বাঁচাও”।
শান্ত অবাক হয়ে বললো,” আমরা তো চেষ্টা করলাম আন্টি কিন্তু রুপ সে তো হারিয়ে গেছে”।
” তাই তো তোমার কাছে আইছি বাজান। আমাগো সম্মান, আমার মাইয়ার জীবনডা তুমি বাঁচাও”।
শান্ত বিষ্ময় নিয়ে বললো,” আমি এখন কি করবো আন্টি”?
রহিমা বেগম কিছুটা সময় নিয়ে বললো,” তুমি রাতরে বিয়া করো”।
শান্ত চমকে উঠলো। বিয়ে! রাত শান্তর বিয়ে!
” এটা অসম্ভব আন্টি। রাত রুপরে ভালোবাসে, রুপ রাতরে ভালোবাসে। সেখানে আমি তৃতীয় ব্যক্তি হতে পারবো না”।
শান্তর চোখের কোনা অশ্রুকোনা ধরা দিলো। রহিমা বেগম বেশ তেজ নিয়ে বললেন,” ভালোবাসা? কিসের ভালোবাসা? ঐ পোলা যদি রাতরে ভালোই বাসতো তয় বিয়া ছাইড়া পালাইছে ক্যান? আর তুমি তো রাতরে ভালোবাসো। ওরে চাও”?
শান্ত রহিমা বেগমকে বোঝানের সুরে বললো,” ভালোবাসা আর চাওয়া এক নয় আন্টি। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক আমি জানি রুপের ভালোবাসা মিথ্যে নয়। রুপ হয়তো কোন কারনে বিয়ে করতে আসেনি। কিন্তু রুপ রাতরেই ভালোবাসে। সেখানে আমি রাতের জীবনে বেরঙের ছায়া নিয়ে ডুকতে পারি না”।
দরজা এপাশ থেকে রাত্রী বলে উঠলো,” রঙ যখন হারিয়ে গেলো তখন বেরঙেই নাহয় জীবন সাজাই”।
শান্ত রাত্রীর দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। রাত্রী শান্তর বিষ্ময় বাড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বললো,” বন্ধু হিসাবে যার হাত ধরেছিলে, সম্মান বাঁচাতে আজ নতুন পরিচয় তার হাতটি ধরবা শান্ত”?
কথাটি বলে রাত্রী শান্তর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। দু’জনকে সময় দিতে রহিমা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। শান্ত রাত্রীর মুখশ্রীতে দৃষ্টি রেখে বললো,” রুপ তোমারে ধোঁকা দেয়নি। আমি বলছি ও হয়তো সমস্যায় পড়েছে। রুপ তোমার কাছে ফিরে আসবে”।
” সেই ফিরে আসা অব্দি আমার হাতটা ধরবে শান্ত”।
শান্ত এবার পূর্বের চেয়ে বেশি অবাক হলো। রাত্রী পুনরায় বললো,” আমি জানি আমার রুপ আমারে ঠকাতে পারে না। রুপ ফিরে আসবে। আজ নয়তো কাল। যেদিন রুপ ফিরে আসবে সেদিন ওর চলে যাওয়ার কারনটা যুক্তিগত হলে আমি রুপের জীবনে ফিরে আসবো। ততদিন অব্দি তুমি শুধু আমার সাথে থাকবে। একটা সম্পর্কের নামে৷ যে সম্পর্কের নাম স্বামী, স্ত্রী। আমি রুপের ফিরে আসা অব্দি বন্ধু হিসাবে তোমার হাতটি চাইছি শান্ত”।
শান্ত কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,” সমাজে স্বামী, স্ত্রী হলেও সম্পর্কটা চুক্তির গড়তে চাইছো তাই তো”?
রাত্রী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” তেমনি। তবে তুমি না চাইলে হবে না”।
শান্ত রাত্রীর হাতটি ধরলো। হাতের উপর হাত রেখে বললো,” আমি জানি রুপ একদিন ফিরে আসবে। তাই চুক্তি হিসাবেই হাতটি ধরলাম”।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত মনেমনে বললো,” ভালোবেসে না হোক চুক্তিতেই কিছুটা সময় তোমার জন্য ব্যায় করি”।
অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেলো। রুপ, রাতের বিয়ের স্থানে রাত, শান্তর বিয়ে হয়ে গেলো। পাড়া-প্রতিবেশীদের কুটকাচালিই থেমে গেলো। প্রকৃতপক্ষে পাত্র হিসাবে বিবেচনা করলে রুপের থেকে শান্ত বেশি যোগ্য। শহরে ভালো চাকরি আছে, ভালো ঘর আছে। সাধারণত পারিবারিক ভাবে ঠিক করা বিয়েতে সবাই প্রথমে পাত্রের চরিত্রের পূর্বে চাকরিটাই দেখে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের মুখ বন্ধ হওয়া অযুক্তিক নয়। ভালো চাকরির সাথে ভালো ছেলে এটা তো অনেক পাওয়া।
রাতটা সবার বিষাদেই কাটলো। সকালে শান্ত রাত্রীকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো। এত কষ্টের মধ্যে রফিক সাহেবের ছোট মেয়েকে তার গল্পটি বলে ওঠা হলো না।
শহরে যাওয়ার অন্য রাস্তা আছে, যেটা শান্ত প্রথমদিন না জানলেও পরে জেনেছি। তবুও শান্ত আজ সাঁকোর কাছে এলো নতুন বউ নিয়ে। সাঁকো ওপারে ওদের শহরে যাওয়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত ঠিকঠাক মতো সাঁকো পার হতে পারে না তবুও কেন এখানে নিয়ে আসলো সেটাই বুঝলো না রাত্রী। রাত্রীকে অবাক করে দিয়ে শান্ত রাত্রীকে কোলে তুলে নিলো। রাত্রীর বিষ্ময়ের মাত্রা দ্বিগুন করে শান্ত রাত্রীকে কোলে নিয়েই সাঁকো পার হতে লাগলো। রাত্রী সাঁকো পার হওয়ার পুরো সময় অবাক দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্ত সাঁকো ওপারে রাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে বললো,” রুপমের স্মৃতিগুলোকে সাথে নিয়ে চলো, যাতে তার সাথে দেখা হলে বলতো পারো তার স্মৃতিগুলো তুমি ভুলে যাওনি”।
রাত্রী পুনরায় বিষ্ময়ীত হলো। “এবার একটি কথা। পূর্বেই বলেছি এটা ইসলামিক গল্প নয়, আযান, নামাজ এসব দেখানো হয়নি। ইসলামিকভাবে স্বামী স্ত্রীর বন্ধন এতটাই সুন্দর যে বিয়ে হওয়ার পর তাদের মধ্যে ভালোবাসা এমনি জন্ম নেয়। সেক্ষেত্রে শান্ত, রাতের মধ্যে সম্পর্কে মানে ঐ আর কি ভালোবাসা হোক বা চাহিদা তা হবে কি হবে না জানি না৷ তবে কেউ ইসলামিক দৃষ্টিকোনে প্রশ্ন তুইলেন না”।
গ্রাম! গ্রামের ধুলো, মাটি, হাওয়া সাথে কিছু প্রিয় মানুষ সবকিছুকে পিছনে ফেলে রাত্রী এগিয়ে চললো তার নতুন জীবনে। যে জীবনটা তার কাছে বেরঙের। যেখানে দূর দূরান্তেও রঙের দেখা নাই৷ জীবন বোধহয় এমনি। যতটা সময় তুমি রঙীন থাকবে ঠিক ততটা সময় বেরঙগুলোও তোমাকে চাইবে। তাই হয়তো রুপমের দেখানো রঙীন জীবনকে ছেড়ে বেরঙের জীবনে পাড়ি জমাচ্ছে রাত্রী। এভাবেই জীবনটা হয়ে উঠলো
‘রঙ বেরঙের জীবন’
গাড়িতে উঠে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে রাত্রী। জানালার কাচ দিয়ে গ্রামের পথ, মাঠ দু’চোখ দিয়ে দেখে চলেছিলো রাত্রী। শান্ত রাত্রীর হাতটি ধরলো। রাত্রী চমকে শান্তর দিকে দৃষ্টি দিলো। শান্ত আস্তে করে বললো,” যতদিন না রুপ ফিরে আসছে ততদিন আমি তোমার বেরঙের জীবনকে রঙীন করার সম্পূর্ণ চেষ্টা করবো”।
একটু থেমে পুনরায় বললো,” তোমাকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা”।
চলবে,
[