#রক্তের বন্ধন
Part_17
আমার মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবেন? জন্ম নেওয়ার আগেই যাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। জন্ম নেওয়ার পর যাকে রক্তাক্ত করেছিলেন। পতিতার মেয়ে নামে যার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। আর কি চান? প্লিজ আপনি চলে যান।
– কথা রুম থেকে বের হয়ে গেল! সাথি আমার হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরল!
– কথা দরজায় দাঁড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো। কথার ছলছল দৃষ্টির চাহনী হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বইয়ে দিল!
– হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটা ভেসে ওঠল! ফোনের ওয়েলপেপারে ‘মা’ লিখা টা ভেসে উঠতেই ফোনটা রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে কে যেন বলল’ রাজ ভাইয়া আপনার মা অসুস্থ। আপনি একটু মুন ক্লিনিকে আসেন?
– আচ্ছা
.
ফোনটা রেখেই সাথিকে রাইসার কাছে রেখে চলে গেলাম মায়ের কাছে। মা’এর মাথার কাছে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি রুমে ঢুকতেই মেয়েটা দূরে গিয়ে বসল।
.
মা কি হয়েছে তোমার? আমায় আগে কেন বলনি!
– নারে বাবা, বয়স হয়েছে তো। তাই শরীরের এ অবস্থা!
– মা এর মাথায় হাত দিয়ে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
.
বাবা কাদছিস কেন? জানিস বাবা আজ তুকে কিছু বলতে চাই। জানি না তুই কি মনে করবি? আমি তো চলেই যাবো, তাই যাবার আগে সত্যটা বলে দিতে চাই তোকে। রাজ বাবা আমি তুর মা নই। তুই এই পতিতার গর্ভে জন্ম নিসনি
– মা কি বলছ এসব? আমি কি শুনতে চেয়েছি? তোমার পরিচয় শুধুই মা। তুমি আমার জান্নাত তুমিই আমার সব। আমার মা তুমি। কেন মিথ্যা বলছো?
– বাবা মরার আগে কেউ মিথ্যা বলে না।
– মা প্লিজ তুমি থামবে? আমার মা তুমি অন্য কেউ নয়।
– রাজ বাবা মরার আগে কেউ মিথ্যা বলে না। কোন পতিতার ঘরে তুর মতো ছেলের জন্য হয় না বাবা। তুই এই শহরের সবচেয়ে সম্ভান্ত বংশের ছেলে। তোর বাবার নাম ‘ রাজ্জাক চৌধুরি!
– কি বলছ এসব মা?
-হ্যাঁ বাবা সত্যি বলছি। তোর বাবা এ শহরের নামকরা ধনীদের মাঝে একজন। তুই ছিলি তোর মা- বাবার একমাএ আদরের দুলাল। তোর বাবা একদিন রোডএকসিডেন্টে মারা যায়। তোর মা বিধবা হয়ে যায়। তোর মা তোর মামাকে নিয়ে আসে তোদের বাড়ি। পরে তোর মা জানতে পারে, তোর মামাই তোর বাবার রোড একসিডেন্ট করিয়েছে। তোর মামাই তোর মাকে বিধবা বানিয়েছে।
আজ থেকে ২৬ বছর আগের কথা। আমি তখন যৌবতী ছিলাম। তোর মামা আমাকে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে নিয়ে যায়। ভোগ করার জন্য। তোর মা তোদের বাংলোতে আসলে তোর মামার কুর্কীতি জেনে যায়। তাই তোর মাকে পুড়িয়ে মারে। আমি তোর মাকে বাঁচাতে পারিনি বাবা। তোর মাকে বাসা থেকে বের করায় আগেই মারা যায়। তাই তকে তোর মৃত মায়ের বুক থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। তোর মায়াভরা মুখটা, একটা পতিতাকেও মায়ের স্বাদ জাগিয়েছে। তোকে পেয়ে মাতৃত্বের অনুভূতিটা বুঝেছি। বাবা কাঁদছিস কেন?
– মা এসব বলো না আমি সহ্য করতে পারি না!
.
রাজ বাবা আমায় ক্ষমা করে দিস। আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে! বাবা আমার একটু কাছে আস। তোর মাথায় শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে দেয়।
– মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি মায়ের কাছে মাথাটা দিয়ে চোখ বুজে আছি। সকল কষ্টের মাঝেও হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল’জানিস বাবা তোর বাবা মায়ের খুনি কথার বাবা। কথা তোর মামাতো বোন। ‘ তবে কথা মেয়েটাকে তুই কোনদিন কষ্ট দিস না।
– মা আর কথা বলছে না। মা কথা বল, কথা বল তুমি!
-ডাক্তার প্লিজ দেখেন আমার মায়ের কি হলো?
– ডাক্তার এসে হাতের নাড়ি চেক করে বলল’ আপনার মা আর নেই। সরি মিস্টার রাজ।
.
ডাক্তার আপনি মিথ্যা বলছেন। মা দেখ ডাক্তার মিথ্যা বলছে। তুমি কথা বল মা। ও মা কথা বল না কেন?
– মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আমার যে শেষ আশ্রয়স্হল পায়ের পদতলটাও হারালাম! পরের দিন মাকে দাফন করে। হসপিটালে এসেই দেখি ক রাইসা কাঁদছে আর বলছে’ আমার বাবাই কোথায় আমার বাবাই এর কাছে যাবো! মামনি তোমার বাবা আসবে। তুমি কান্না করো না। তোমায় অনেকগুলো খেলনা কিনে দিব। আমার কোন খেলনা চাই না। তুমি পঁচা তুমি আবার আমার বাবাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে সেজন্য হয়তো বাবা আসতে পারছে না। মামনি আমার বুকে আস। তোমার বাবা আসবে তো বললাম।
– আসবে না তো ছাই! আমার মম কই? তুমি চলে যাও। কথার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ফ্লরে ঢিল মারল!
– কথা রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল’ মামনি এটাও ঢিল মারো তবুও আমাকে মা বলে ডাকো।
– না, তুমি আমার বাবাকে মেরেছো। যতদিন না আমার বাবাই এর কাছে sorry না বলবে তোমার সাথে কথা বলবো না। আর আমার মম আছে। হঠাৎ সাথি কোথায় থেকে এসে রুমে ঢুকল।
আমি জানালার গ্রিল ধরে মা -মেয়ের খুনসুঁটি দেখছি।
– আপনি এখানে কেন?
-মামনি দেখ, এই আন্টি এসে আমাকে বুকে নিতে চাচ্ছে। মম বলে ডাকতে বলছে। বলো মামনি তুমি আমার মম।
– কি হলো আপনি কি চান? কেন আমাদের বিরক্ত করেন। আপনি আর আমাদের মাঝে আসবেন না।
– আপু, আমি শুধু আমার মেয়েটাকে দেখতে এসেছি। একটু বুকে নিয়েই চলে যাব। মাথাটা নিচু করে বলল!
– আপু আজ আপনাকে বলতে চায়। শুনেন রাজকে আপনি অনেক কষ্ট দিয়েছেন। এমন একটা রাত নাই সে আপনার ছবিটা বুকে নিয়ে কাঁদেনি। আপনি যেদিন অফিসে সবার সামনে চরিএহীন বলে ধিক্কার দিলেন। আপনার স্বামী, আকাশ সাহেব সবার সামনে রাজকে চড় মেরেছে। আপনি তা দেখে মজা নিয়েছেন। ছিঃ আপনি এতটা নীচ। একটা ভালোমানুষকে চরিএহীন বানাতে আপনার বিবেকে একটুও বাঁধল না? আর রাইসা আপনার মেয়ে নয়। রাইসা আমার মেয়ে। শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। যে মা, সন্তানকে ভূমিষ্ট হওয়ার পরই মেরে ফেলতে চায়। যে বাবা তার মেয়েকে বাঁচাতে, তারই মায়ের কাছে দিয়ে আসতে চায়। শুধু মেয়েটাকে বাঁচাবে বলে, কিন্তু পতিতার মেয়ে নামে আখ্যায়িত পায় সে! নিজের মেয়েকে যখন তার মা পতিতার মেয়ে বলে। রাজ তখন বাবা হয়ে নিজের কিডনী বিক্রি করে , তার মেয়ের জীবন বাঁচায়! কি হলো কাঁদছেন কেন? বুকের ভেতর হাহা করে ওঠল? নাকি রাইসা বেঁচে আছে এজন্য? ছিঃ আপনি মা জাতির কলংঙ্ক! শুনেন আপনাকে আজ বলি, রাজকে আমি ভালোবাসি বলতে গেলে নিজের থেকেও বেশি । আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না। আর রাইসা আমার মেয়ে। আপনার কাছে আজ আমি রাইসাকে ভিক্ষা চাইছি, কারণ আমি কোনদিন মা হতে পারব না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রাইসাকে বুকে নিয়েই কাটাবো। আরেকটা কথা, আপনি চান না রাজ সুখে থাকুক। চান না রাজ শান্তিতে থাকুক। আপনার মেয়েটা একটু প্রাণখুলে হাসুক। যদি চান আর কখনো আসবেন না! আর শুনে নেন এতদিন আমি রাজকে ভালবাসতাম। যেদিন আপনি আর আপনার স্বামী আকাশ মিলে রাজকে মেরে অফিস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। সেদিন থেকে রাজও আমায় ভালবাসে। আপনি প্লিজ চলে যান।
– আপু, আমি শুধূ একটিবার শুনবো ‘ আমার কলিজার টুকরা রাজ, তোমায় সত্যি ভালবাসে কিনা। আমার মন বলছে আমার প্রতি যত রাগ অভিমান থাকুক না কেন। আমি যতই খারাপ হয় না কেন, আমার রাজ শুধু আমায় ভালবাসে!
– এমন সময় আমি চোখের পানি মুছে রুমে ঢুকলাম। রাইসা আমাকে দেখেই বাবাই করে কান্না করে দিল!
– বাবাই তুমি আসছো বাবাই? এই আন্টি কি আবার তোমাকে বকা দিয়েছে? আবার কি তোমাকে মেরেছে। জানো বাবাই আমি এত্তোগুলা বকা দিয়েছি! বাবাই তুমি কাল কোথায় ছিলে? জানো কাল রাতে আমি একটুও ঘুমায়নি, মমকে জিজ্ঞেস করো?
ও বাবাই কাঁদছো কেন তুমি? বাবাই তুমি খাওনি? তোমাকে ওমন দেখাচ্ছে কেন?
– মনে হচ্ছে মা হারিয়ে আমি মা পেয়েছি। মা মরাতে বুকের ভেতর যে আগুনটা জ্বলতে ছিল রাইসাকে বুকে নিয়ে, শীতল স্পর্শে সে আগুনে জল ঢেলে দিলাম।
– হঠাৎ পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম চেয়েই দেখি কথা!
– মা টান দিতেই,
– প্লিজ পা টান দিয়ো না। রাইসা মামনি, মা আমার দেখো আমি তোমার বাবাই এর মা ধরেছি। তুমার বাবাইকে সরি বলেছি। তুমি আমায় একবার মম বলে ডাকো। তোমার বাবাইকে বলো, তোমার এ হতভাগিনী মম টা তোমার বাবাইকে ছাড়া বাঁচবে না। সত্যি মরে যাবে।
– রাইসা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল। বাবাই ক্ষমা করে দাও। তুমি না বলেছো ক্ষমা করলে আল্লাহ খুশি হন। আচ্ছা মম ওঠো, বাবাই ক্ষমা করে দিয়েছে। দেখছো না বাবাই কাঁদছে।
– কথা আমার পা ছেড়ে দিয়ে রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে গালে মুখে চুমু দিয়ে বলল।
– মামনি, আবার ডাক না। আমার ভালবাসার সাগরে যে ভাটা পড়েছে। ডাক না মা।
– এমন সময় রাইসাকে সাথি টান দিয়ে নিয়ে বলে। বাচ্চা মানুষ অসুস্থ ওর সাথে এমন না করলে হয় না। আপনি চলে যাচ্ছেন না কেন?. আপনি ভুলে যাবেন না। রাজ আমার হবু স্বামী আর রাইসা আমার মেয়ে।
– আমি সাথির মুখে এমন কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠলাম!
– হঠাৎ মনে পড়ল। বিনা অপরাধে চরিএহীন সাজানোর কথা। কথার সামনে তারই হাসবেন্ড আমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার কথা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠলো। কারণ আমাকে যদি ভালবাসতো তাহলে এভাবে কষ্ট দিতে পারত না। মায়ের কথাটা মনে পড়তেই কথার মুখটা দেখতে মন চাচ্ছে না। কারণ এর বাবার জন্যই আমি এতিম হয়ে বড় হয়েছি। জীবনে বাবা বলে ডাকতে পারিনি । পায়নি গর্ভধারিনী মাকে দেখতে। পুড়িয়ে অসহ্য কষ্ট দিয়েছে মেরেছে কথার বাবা। কোন খুনির মেয়েকে স্ত্রী করে আমি বাবা – মায়ের অাত্মাকে কষ্ট দিতে পারবো না।
– রাজ সাথি যা বলল তা কি সত্যি?
– কথার কথা শুনে কল্পনা থেকে বাস্তবে আসলাস!
– মুখে হাসির রেখা, রেখে বললাম হ্যাঁ দিনের আলোর মতো সত্যি!
-তুমি কি সত্যিই সাথিকে ভালবাসো?
– হ্যাঁ ভালবাসি। আপনি যদি, সাতমাসের বাচ্চা রেখে বিয়ে করতে পারেন?তাহলে আমি কেন ভালবাসতে পারবো না?
– রাজ চুপ আর বলো না। তোমার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা কেউ ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিজ হাতে খুন করো, তবুও ছেড়ে যেয়ো না।
-ছিঃ স্বামী রেখে এসব বলতে লজ্জা করে না?
– কে আমার স্বামী? আমার স্বামী তুমি। প্লিজ আমায় একটু বুকে নাও। আমার ধমঃবন্ধ হয়ে আসছে! এই কথা বলে কথা যখনি আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসল।
– ঠাস-ঠাস করে দু’গালে চারটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম! সুন্দর গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে!
– চোখের কাজলগুলো লেপ্টে গেছে! টপটপ করে পানি পড়ছে। তুমি আমায় আরো মারো। মারতে মারতে মেরে ফেল। তবুও আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না। আর হ্যাঁ আকাশ আমার স্বামী না। তোমাকে মিথ্যা বলেছি।
চলবে????
বিঃদ্রঃ ভুলক্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।