বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_৭
আমি ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে গিয়ে দেখলাম একজন মহিলা খুব জড়সড় হয়ে বসে আছেন তার সাথে বুবু খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন, আমি একটু অবাক হলাম কারণ আপা বাড়ি আসা কোনো মেহমানের সাথে কেমন আছেন ভালো আছেন ছাড়া কথা চালায় না,ইনি হয়তো বুবুর কলেজের কেউ, আমায় দেখে বুবু ডেকে বললেন
—হাত মুখ ধুয়ে এসো সাহিত্য,তুমি নাস্তা করলে আমি চা বানাবো এই আন্টির সাথে একসাথে বসে চা খাবে, উনি অনেক্ষণ হলো এসেছেন তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো ওনার ফ্লাইট আছে সন্ধ্যায় লেট হয়ে যাচ্ছে।
আমি বাধ্য ছেলের মতো আমার ঘরের দিকে গেলাম দেখি আম্মা আমার ঘরে আমার কাপড় গোছাচ্ছেন আমি সোজা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বললাম,
—হেমন্ত ভাই কি চলে গেছেন?
—হ্যা হেমন্ত চলে গেছে, এবার তো তাকে বাড়িও ফিরতে হবে নাকি? তোমার বুবু যে খেল দেখাচ্ছে তাকে নিয়ে,বেচারার তো পরিবার আছে নাকি?
—আচ্ছা আচ্ছা তাদের ব্যাপার তারা বুঝুক আপনি আমায় খেতে দিন,
—পুষ্প অথবা বৃতিকে বলো বাবু আমি কাপড় গুছিয়ে আসছি সময় লাগবে,
আমি বেরিয়ে আসার আগে দেখলাম আম্মার মুখ শুকনো,
—আব্বা কি আবার আপনাকে কিছু বলেছে আম্মা?
—এ কি নতুন কিছু?
—তিনি কোথায়?
—ঘর আটকে বসে আছেন
—এজন্য বুঝি আপনি আমার গোছানো কাপড় আবার গোছাচ্ছেন
—বিরক্ত করো না তো বাবু যাও
আমি হেসে বেরিয়ে এলাম আব্বা আম্মা প্রায় অযথা ব্যাপার নিয়ে কথা বলা মুখ দেখা বন্ধ করে দেন, তবে আমি দেখেছি আব্বা কখনো আম্মাকে ছাড়া খেতে বসেন না, সব সময় সব কাজে আম্মাকে প্রাধান্য দেন যেন তিনি আম্মার কাছে কত কৃতজ্ঞ!
আমি নাস্তা করে বসার ঘরে বসলাম ভদ্রমহিলা দেখছি আমাদের সব ভাই বোনের জন্যে কিছু না কিছু উপহার এনেছেন, তিনি আমায় কাছে ডেকে কিছুক্ষণ আদর করে কপালে একটা চুমু খেলেন আমি একটু লজ্জাই পেলাম, দাদাই এর কথাও জিজ্ঞেস করলেন,আমাকে একটা মাউথ অর্গান দিয়ে বলল,
—আমি গান গাইতাম বলে,আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ আমায় এটা উপহার দিয়েছিলো তবে আমি কখনো বাজাই নি,পুষ্পের কাছে শুনলাম এ বাড়িতে নাকি তুমিই গান করো তাই তোমাকে দিলাম
—আপনি গান করেন?
—হ্যা
—আপনি কি কোনো কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন?
—নাহ আমার আপা জাপানে থাকে, আমিও সেখানে থাকি এখানে একটা কাজে এসেছিলাম পুষ্প আমার খুব স্নেহের, দেশে আবার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই তাই ওর জোরাজুরিতেই এলাম, এখন কি উপহার টা নেবে?
আমি ইতস্তত করে বুবুর দিকে তাকাতেই বুবু ইশারায় সম্মতি জানালো,তিনি আরো কিছুক্ষণ বসলেন যাওয়ার আগে বুবুকে জড়িয়ে কেদে ফেললেন, আমি আর বৃতি একটু বিরক্তই হলাম,বৃতি আমার সাথে উঠে এসে বলল,
—মহিলাটা কেমন অদ্ভুত নারে ছোট ভাইয়া?
—আমি ভাবছি বুবুর সাথে তার কিসের এত ভাব
—সে যাইহোক গিফট গুলো কিন্তু দারুণ হয়েছে,
আমি মাউথ অর্গান টা নেড়েচেড়ে বললাম
—হু
বাড়ির সব কিছু আবার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে লাগলো,এর মধ্যে হেমন্ত ভাই আর এলো না শুনলাম তার নতুন অফিসে জয়েন কাগজ পত্র সব কিছু নিয়ে খুব ব্যাস্ত বুবুও নিজের মত চলতে লাগলেন এর মধ্যে একদিন সারাদিন বৃতির খোজ পাওয়া গেলো না আমি আর দাদাই খুব খুজলাম কলেজ, বান্ধবীর বাড়ি, কোচিং কোথাও না পেয়ে রাতে যখন পুলিশে খবর দেব ভাবছি মা একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন,আব্বা মুখ কালো করে বসে আছেন আমি আর দাদাই বের হবো তখন রাত এগারোটার দিকে বেল বেজে উঠলো,হেমন্ত ভাই এসেছেন তাকে খবর দেওয়ার কথা মনেই ছিলো না পেছন পেছন দেখলাম বৃতিও আছে সাথে একটা সুদর্শন মতো একটা ছেলে,আবার তুলনও!আব্বা প্রথমেই সবার সামনে কষে বৃতির দুই গালে দুটো থাপ্পড় লাগালেন এর আগে আব্বা আমাদের কারো গায়ে হাত তুলেছেন বলে মনে পড়ে না দাদাই ও খুব রেগে গেলেন,আমি নিরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে রইলাম যদিও আমারও তখন খুব রাগ হচ্ছিলো, হেমন্ত ভাই সবাইকে শান্ত করে বসলেন,তারপর বললেন,
—সন্ধ্যায় আমি অফিস থেকে ফিরছিলাম দেখি বাসার নিচে তুলন দাড়িয়ে,বৃতি আগে তুলন কে জানিয়েছে তারপর তুলন আমায় বলল আসতে ও নিজেও বাচ্চা একটা মেয়ে আর বৃতি সম্ভবত বিয়ে করে নিয়েছে।
দাদাই আবার উঠে বৃতিকে চড় মারতে যাবেন তার আগেই হেমন্ত ভাই বললেন
—স্বাধীন প্লিজ তুই অন্তত মাথা গরম করে কিছু করিস না। ছেলেটা সম্ভবত সাহিত্যের ব্যাচমেট।
দাদাই রাগ করে বললেন
—আমি কিছুতেই বুঝলাম না ও এত্ত সাহস পেলো কোথা থেকে আর ওর সাথের যে ছেলেটা ওরই বা কি আক্কেল ও করে টা কি বিয়ে যে করলো কোন যোগ্যতায়?একটা মেয়েকে বাড়ি থেকে নিয়ে পালানো মানে বোঝে?পালালেই হয়ে গেলো?
আর তুলন তুমি, তুমি সব জানতে তাই তো?
তুলন দাদাই এর চেয়েও বেশি তেজ নিয়ে বলল,
—আমি কিছুই জানতাম না, তবে জানলে অবশ্যই সাহায্য করতাম।
—চুপ বেয়াদব মেয়ে একটা
—আমার সাথে একদম ধমক দিয়ে কথা বলবে না
—আর একটা কথা বললে কিন্ত চড় খাবে তুলন খুব মুখে মুখে কথা বলো তুমি
হেমন্ত ভাই এবার রাগ দেখিয়ে বলল
—স্বাধীন তুই কি থামবি?
আম্মা সমানে কেদে যাচ্ছে, বুবু তখনো চুপ।কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর যখন সবাই সিদ্ধান্ত নিলো বিয়েটা মানা হবে না যেহেতু কেউ জানে না বৃতি মরা কান্না জুড়ে দিলো অথচ তখনো আমরা কেউ ছেলেটার নামও জানি না বুবু হঠাৎ বললেন
—সবাই শান্ত হও আমি কিছু বলব।
মুহুর্তেই সব শান্ত হয়ে গেলো বুবু ছেলেটাকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো তার নাম আহনাফ, বুবু খুব শান্ত কণ্ঠে সবার সামনেই বলে উঠলো,
—তুই কনসিভ করেছিস কতদিন হলো বৃতি?
এবার আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম বৃতি কান্না ভুলে মাথা নিচু করে ফেললো,তুলনও দেখলাম মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো তবে কি তুলন জানতো?
আম্মা এবার চিৎকার দিয়ে উঠলেন
—এসব কি বলছিস পুষ্প
বুবু সহজ ভাবে বলল,
—দয়া করে মা চিল্লাবে না,বৃতি তুমি জানো আমি এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করি না,
বৃতি ভয়ে কাপতে লাগলো, আমি দেখলাম বুবুর চোখ লাল হয়ে আসছে হেমন্ত ভাই বুবুর পাশে এসে বলল,
—তোমার শরীর খারাপ লাগছে পুষ্প?
—নাহ, দাদাই তুমি ওদের কারো গায়ে প্লিজ আর হাত তুলো না,ছেলেটার বাসায় খবর পাঠাও ছোট করে একটা কাবিনের ব্যাবস্থা করো।
বুবু আব্বার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখলো আব্বা একদম মূর্তির মতো শক্ত হয়ে আছেন,আমরা সবাই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি,আব্বা উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন সেদিন রাত্রে কারো ঘুম হলো না শুধু বুবু ঘুমাতে চলে গেলো।
মোটামুটি সকালে আহনাফের বাড়িতে খোজ পাঠাতেই ওর আপা আর দুলাভাই এলেন আর কেউ এলো না,আলোচনার আর কিছু বাকি ছিলো না লোক দেখানোর জন্যে কাজী ডেকে ওদের কাবিন হয়ে গেলো ঘরোয়া ভাবে, আব্বা সারাদিন ঘর থেকে বের হলেন না।বুবু ঠিকই কলেজ করলো, হেমন্ত ভাই বুবুর সাথে গেলেন অফিসে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে আবার চলে আসলেন।সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো বৃতি আমাদের বাড়িতেই থাকবে দুজনেই পড়াশোনা করবে, এতকিছুর মধ্যে সব কথা দাদাই বললেন আম্মা রইলেন নির্বাক আর আব্বা তো এলেনই না, হেমন্ত ভাই,আমি, দাদাই আর তুলনই সব আয়োজন করলাম।
আব্বাকে ঘর থেকে বের হতে না দেখে বুবুই নিজে গেলেন আব্বাকে ডাকতে, তবে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেলো আব্বা হয়তো এতবড় একটা ধাক্কা নিতে পারেন নি।আমি কিছুই বুঝে উঠলাম না এতগুলো ঘটনা পরপর হলো যে আব্বার দাফন পর্যন্ত সব ঘোরের মধ্যে কাটতে লাগলো।সবচেয়ে বেশি কাদলেন আম্মা আর বৃতি, আমি বেশিরভাগ সময় আম্মার কাছেই থাকলাম।
চলবে…
সামিয়া খান মায়া