ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ২৬ +২৭

0
1084

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৬

“আমি রাজি!

আহিয়ান মূহুর্তে’ই তার হাত সরিয়ে নেই। অতঃপর আমার হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে।‌ বাইরে এসে দেখি ফুলি একা একা দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে সে আমাদের কাছে আসে। আহিয়ান ফুলি কে বলে,

“তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আর শোন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে নিহা কোথায় বলবে আমার সাথে গেছে ঠিক আছে।

ফুলিও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। হয়তো এটা দেখে যে আমি কাঁদছি। আহিয়ান হেসে ওর মাথায় হাত রেখে। অতঃপর পকেট থেকে চকলেট বের করে ওর হাতে দেয়। ফুলি চকলেট নিয়ে আমাকে বলে,

“তুমি কাদতাছো ক্যান।

কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর হয়ে উঠে না। এর আগেই আহিয়ান আমাকে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। অতঃপর গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আমি নিঃশব্দে কেঁদে যাই কিন্তু সেই কান্না’র কোন প্রভাব আহিয়ানের উপর পড়ে না।

কিছুক্ষণ পর’ই আমরা এসে হাজির হই আহিয়ান দের বাসায়। আহিয়ান গাড়ি থেকে নেমে আবারো হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। বাড়ির সব কাজের লোকরা তখনও জেগে ছিল। দাড়োয়ান আমাকে দেখে অনেক অবাক হলো। হয়তো এর মধ্যেই সবার কানে কথা চলে এসেছে। এটা তো হবার’ই কথা কারন এটা গ্রাম। গ্রামে মুহুর্তে’র মধ্যেই সব কিছু ছড়িয়ে যায়।

ঘরের কাজের লোকদের ও একই চেহারা। সবাই আমাদের দেখে অবাক। আমাকে নিয়ে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে আহিয়ান কাউকে ফোন করল। আমি চোখের পানি মুছে সামনে তাকাতেই দেখি সবাই কেমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চাহনি দেখে নিজেকে আরো ছোট ছোট মনে হচ্ছে। আহিয়ান কথা বলা শেষ করে সবাই কে চলে যেতে বলে। সবাই চলে যায়।

খানিকক্ষণ’র মধ্যেই আকাশ ভাইয়া চলে আসে। তার পিছু পিছু আরেকটা লোক আসে। সে খুব পরিপাটি ভাবে এসেছে। হাতেও কিছু একটা আছে। আকাশ ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকায়। অতঃপর চোখ সরিয়ে আবারো আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“উকিল সাহেব এসে পড়েছে। সব কাগজ পত্র দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু তোদের সাইন লাগবে।

আহিয়ান বলে উঠে,
“নিহা’র সব কাগজ পত্র!

“হ্যাঁ সব এনেছি ওদের বাসা থেকে। চাচা বাসায় ছিল, মন খুব খারাপ তার।

“নাহান..

“ওদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। চাচাও এসে পড়বে!

“সব বলেছিস!

“হ্যাঁ বলেছি!

বলতে বলতে চাচাও চলে এলো। আমি তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে অভিমানের চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এমন ভাবে তাকে দেখে তার কাছে যাওয়ার সাহস হলো না আমার। আহিয়ান চাচা’র কাছে গিয়ে বলল,

“বিয়েতে মেয়ে পক্ষের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে লাগবে চাচা। তুমি কি থাকবে।

“হ থাকমু!

চাচা’র‌ কথায় আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কাঁদতে লাগলাম। আহিয়ান সেই লোককে বলল কাগজ পত্র বের করতে। এখন বুঝলাম লোকটা একজন উকিল। অতঃপর সে কিছু কাগজ পত্র বের করল। তাতে কিছু লেখালেখি করল। তার কাগজ টা আহিয়ান কে দিয়ে বলল,

“পাত্রী কে সাইন করতে বলুন।

আহিয়ান একটা কলম নিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
“সাইন করো।

আমি অশ্রু ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। একটা কথাই শুধু মনে মনে বলতে লাগলাম,

“কেন করছেন আমার সাথে এমনটা। আমাকে কষ্ট দিতে কি সবার এতো ভালো লাগে। শুধু’ই কি কষ্ট আমার এই জীবনে।

আহিয়ান শান্ত গলায় বলল,
“সাইন করো।

আমি কান্না বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে কলমটা ধরলাম। আহিয়ান বলল,

“এখানে সাইন করো।

আমার পুরো হাত কাঁপছিল। আহিয়ান আমার হাতটা ধরে কাগজে কলম ঠেকিয়ে বলল,
“সাইন করো ফার্স্ট!

উনার ধমকানিতে আমি লাফিয়ে উঠলাম। অতঃপর সাইন করলাম। আহিয়ানও কাগজটা নিয়ে সাইন করার পর উকিল কে কাগজ টা দিল। সে কাগজটা নিয়ে বলল,

“এখন থেকে আপনারা আইনগত স্বামী – স্ত্রী! যারা সাক্ষী তারাও সাইন করুন!

এসব শোনার পর’ই আমি ছুটে চলে আসলাম ঘর থেকে। বাইরের সিঁড়িতে বসে কাঁদতে লাগলাম। কেন ঠকাচ্ছে সবাই আমাকে। আহিয়ান কেন বিয়ে করল আমায়। ওর সাথে আমার ভবিষ্যৎ কি? কোন নিশ্চিত আছে কি। খালেদ জানলে কি হবে? ভাইয়া আর ভাবী কি ছেড়ে দিবে তাদের। সবকিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার।

খানিকবাদেই আহিয়ান আসল সেখানে। আমি হাঁটার শব্দ পেয়েই বুঝলাম সে এসেছে। উনি আমার পাশে বসল। অতঃপর বসে একটা সিগারেট ধরল। চুপচাপ সেটা খেতে লাগল। সিগারেট’র গন্ধ বরাবরই আমার কাছে বিরক্ত লাগে কিন্তু আজ সেই নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। হঠাৎ একটা পানির বোতল ধরল আহিয়ান আমার সামনে। বলল,

“নাও পানি খেয়ে নাও। কাঁদতে কাঁদতে শরীরের সব পানি চলে গেছে। পানি খেয়ে সেই খাটতি পূরন কর।

আমি মুখ ঘুমিয়ে নিলাম তার কাছ থেকে। আহিয়ান পানির বোতল টা পাশে রেখে বলল,

“ঠিক ২ ঘন্টা পর আমাদের ট্রেন আছে। এখন রাত ১ টা বাজে মানে ৩ টায় ট্রেন। তুমি এখানে থাকো আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর চলে আসবো। তোমারে চাচা এখানে থাকবে তোমার সাথে।

বলেই সে উঠে গেল। আমি স্থির হয়ে বসে রইলাম সেখানে। একে একে সবাই বের হলো শুধু চাচা রয়ে গেল। চাচা এসে আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখল। আমি তার দিকে ফিরে বলি,

“চাচা তুমি কি রাগ আমার উপর

“কি যে‌ কস না মা। তোর উপর রাখ করে থাকতে পারি আমি।

আমি আর কিছু না বলে চাচা’র ঘাড়ে মাথা রাখলাম। বসে রইলাম স্থির ভাবে। হঠাৎ করেই পানির পিপাসা পেল। আমি হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে বোতল টা নিতে গিয়ে নরম কিছু আমার হাতে এলো। আমি তাকিয়ে দেখি একটা রুমাল। আমি সেই রুমাল টার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ ও কি চোখ মোছার জন্য রুমাল রেখে গেলো সে? এটা কেমন কথা আমাকে কাদাবেও সে আবার সেই কান্না মুছতে রুমাল ও সে দেবে। আমি রুমাল টা হাতে মুঠ করে নিলাম। অতঃপর পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলাম।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে গাড়ির আওয়াজ আসলো। এর মানে আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া চলে এলো। আহিয়ান এসেই আমাকে উঠতে বলল। অতঃপর আমাকে নিয়ে এলো আমাদের বাসায়। মানে চাচা’র বাড়িতে। আমি বাড়ি ঢুকতেই দেখি মা দাওয়ায় বসে আছে। মা কে দেখে আমি তার কাছে ছুটে যাই। জরিয়ে ধরি তাকে। অতঃপর কাঁদতে থাকি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায়। আমি জিজ্ঞেস করি,

“বাবা কোথাও?

মা ঘরের দিকে ইশারা করলেন। আমি ঘরে এসে দেখি বাবা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। হয়তো তার ঘুম এখনো ভাঙে নি। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে নিয়ে এসেছে। আমি বাবা’র হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলাম। অতঃপর তার মাথায় একটা চুমু খেলাম। বাড়ির বাইরে থেকে তখন আহিয়ানের গলা পেলাম। সে বলছে,

” নিহা ট্রেনের সময় হয়ে গেছে আমাদের যেতে হবে।

অতঃপর আমি চোখের পানি মুছে আমার ব্যাগটা কাঁধে নিলাম। বের হয়ে গেলাম ঘর থেকে। শেষবারের মতো আবারো সবার সাথে দেখা করলাম কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। আহিয়ান আমার হাত ধরে গাড়িতে বসাল। আমাদের সাথে আকাশ ভাইয়া ও উঠল। আহিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিল।
.
স্টেশনে এসে পৌঁছাতে ভালোই সময় লাগলো। ভেবেছিলাম আমরা তিন জন’ই একসাথে ফিরব। কিন্তু না তা হলো না। আকাশ ভাইয়া গাড়ি নিয়ে চলে গেল। তাহলে কি সে পড়ে আসবে।

আমি আর আহিয়ান সিটে বসলাম। আর কিছুক্ষণ’র মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। আহিয়ান বাইরে গিয়ে একটা পানির বোতল আর কিছু খাবার আনলো। যদিও ক্ষিদে ছিল তবুও রাগে আমি কিছু খেলাম না। ট্রেন ছেড়ে দিলো।

ট্রেন চলতে দ্রুত গতিতে। আমার ঠিক সামনে বসে আছে আহিয়ান। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি আর সে আমার দিকে। হঠাৎ আহিয়ান আমাকে ডেকে বলল,

“নিহা!

আমি তার দিকে তাকালাম। আহিয়ান বলল,
“তুমি কি আর কিছুদিন দাদু’র বাড়িতে থাকবে।

তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তার দিকে তাকালাম। আহিয়ান আবারো বলল,

“আসলে বাড়ির কেউই জানে না আমি বিয়ে করেছে। ব্যাপারটা এতো সহজে কেউ মেনে নিবে না তা না। তবে পরিস্থিতি টা স্বাভাবিক করতে আমার আপু কে দরকার।‌কিন্তু সে এখন কিছু কাজে দেশের বাইরে গেছে। আপু না আসলে আমি আম্মু কে বোঝাতে পারবো না। আপু পারবে তাকে বোঝাতে।‌ শুধু ততোদিনের জন্য। পারবে না।

আমি কিছু না বলে আবারো বাইরে তাকালাম। আমার কিছুই যায় আসে না কি হয় আর কি না হয়। আহিয়ান আবারো ডেকে বলে,

“কথা বলছো না যে!

“কি বলবো?

“আমি যা বললাম তাতে তোমার মত দাও। যদি তুমি না চাও তাহলে আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।

“আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই না।

আমার কথায় আহিয়ান আমার দিকে একবার তাকাল। অতঃপর মাথা নিচু করে নিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়েই বলে উঠি,

“কেন বিয়ে করলেন এই মেয়েকে।

“মানে?

“আমি তো অবুঝের মতো কোন কথা বলি নি। একজন ধর্ষিতা আমি। তাই নয় কি?

“বার বার এই সব কথা বলা বন্ধ করো তো।

“বন্ধ করলেই কি সত্যি পাল্টে যাবে।

“যদি তুমি সত্যি বলতে তবে তো সত্যি পালটাতো। তুমি বলছো মিথ্যে এটা আবার পাল্টানোর কি আছে।

আমি উনার দিকে তাকালাম ‌উনি ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
“তুমি ধর্ষিতা নও এটা কি তুমি অস্বীকার করো।

“সমাজ কি তা অস্বীকার করবে। সবার কাছেই তো আমি একজন ধর্ষিতা। আপনি দেখেনি! দেখেছেন তো আমি কিভাবে ছিলাম!

“যদি তুমি ধর্ষিতা হতে তাহলে আমি যেভাবে দেখেছি সেভাবে থাকতে না তুমি। মানুষের দেখার মাঝে ভুল থাকে কিন্তু আমি যা দেখেছি তাতে কোন ভুল নেই। আমি দেখেছি তোমাকে লড়াই করতে, তুমি বার বার চেষ্টা করছিলে তার থেকে বাঁচতে। সে তোমাকে ছুঁয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তাই নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো।

আমি বাইরের দিকেই তাকিয়ে রইলাম। উনার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না আমার। কেন তা জানি না কিন্তু উনি আমার সাথে যা করেছে তা মোটেও ঠিক করে নি।

আমি বলে উঠি,
“আচ্ছা আপনার কি মনে হয় খালেদ আমাকে বিয়ে করলে সুখী হতাম না আমি।

“যে ছেলে পুরো গ্রামের সামনে তোমাকে অপমান করে, সেই ছেলে কি তোমায় সুখে রাখতো।

“আপনি জানেন সে এটা কেন করেছে?

“অনুমান করছি! বিয়ে ছেড়ে তুমি পালিয়ে যাওয়ায় অনেক অপমানিত হয়েছে সে। তাই তোমাকে গ্রামের সবার সামনে অপমান করে ছোট করলো। এছাড়াও ওর রেকর্ড কিছুই ভালো না। তুমি ভালো থাকতে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু একটা কথা কি জানো। যখন বিচার হচ্ছিল মনে হচ্ছিল এসব আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল সে। সবটাই তার বানানো। ইচ্ছে করেই এসব করা যাতে তুমি বাধ্য হও বিয়ে হতে এমনটা মনে হয় না তোমার

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,

“হয়! কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন খালেদ যা করেছিলো আপনি তা করেন নি।

উনি চমকে তাকালেন আমার দিকে আমি জানি সেটা। আমি হেসে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি,

“সবাই শুধু আমার সু্যোগ নিতে চায় আহিয়ান!

“তোমার মনে হয় সেই তালিকায় আমিও আছি।

“আজকের ঘটনার পর এটা মনে না করার কোন কারন কি আছে?

আহিয়ান কিছু বললো না চুপ হয়ে গেল। হয়তো রেগে গেছে। আমি আবারো বাইরে তাকালাম। মনে হলো উনি উঠে চলে গেছে। কোথায় গেছে? এইখানেই গেছে আমি জানি। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে শুরু করবে। আর কি? কিন্তু উনি আমার যা করেছে তা কি ঠিক। কি হবে কাল সকালে। খালেদ যখন আসবে একগাদা বরযাত্রী নিয়ে আর জানবে আমি নেই তখন!

রেগে উঠে চলে গেল। আমার কথাটা হজম করতে পারলেন না তিনি। তো! আমারও অভিমান আছে। কখনো মানবো না আমি এই বিয়েকে। পারি না মেনে নিতে। আমাকে জোড় করেছিলেন উনি। সেটা কি করে ভুলে যাবো আমি!
.
প্রায় অনেকক্ষণ পর আবার এলেন তিনি। এসেই বসে পড়লেন। যা ভেবেছিলাম তাই! সিগারেট খেয়েছেন উনি সেটার গন্ধ আসছে তার গা থেকে। বাতাসের সাথে তা মিশে আমার কাছে আসছে।

দেখতে দেখতে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন আমি জেগেই রইলাম। একবার তাকিয়ে দেখি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখলাম এই প্রথমবার। আগের বারও তাকে ঘুমোতে দেখে নি। দেখবো কিভাবে? আমি তো নিজেই ঘুমিয়ে ছিলাম। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে গেল। কিন্তু তিনি উঠলেন না। আমিও উঠালাম না।
.
ট্রেন থেমে গেল উনি এখনো ঘুমাচ্ছে। এতো ঘুম উনার চোখে! কিন্তু এখন যে আমাদের নামতে হবে। উনাকে ডাকতে যেয়েও ডাকলাম না। ক্ষোভ ছিল উনার প্রতি। না ডেকেই ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলাম। এবারকার গন্তব্য ছিল উনার মুখ আর না দেখার! উনার সাথে কোনমতে আর সম্পর্ক না রাখার!

#চলবে….

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৭

একটা রিক্সায় করে বাসায় চলে এলাম। ঘর তালাবদ্ধ! হয়তো মিতু আর মুন্নি আপু চলে গেছে। চাবি আমার ব্যাগে ছিল তা দিয়ে তালা খুললাম। অতঃপর ঘরে ঢুকে দু মিনিট শান্ত ভাবে বসে থেকে গোসল সেরে নেলাম। অতঃপর দাদা আর দাদি’র সাথে দেখা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। ঘরে কিছু নেই বলে খেতে পারি নি। তাই রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় একটা বিস্কিট কিনে সেটা খেতে খেতে হাঁটতে লাগলাম।
ভার্সিটিতে এসে দেখি ইতি একা একা বসে আছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে আমার কাছে এসে জরিয়ে ধরল।
আমাকে দেখে অনেক খুশি সে। ইতি আমাকে টেনে নিয়ে চলে গেলো ক্যাম্পাসে। সেখানেই দুজন বসে ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল দূরের এক কোনে। সেখানে নিতি ওরা বসে ছিল। মজার ব্যাপার ছিল নাহান আর আনাফ ভাইয়া ও ছিল। তারা আমাকে দেখে বেশ একটা চমক খেলেন। তারা হয়তো আমার আর আহিয়ানের বিয়ের সম্পর্কে জানে না। ভেবেছিল আজ আমার বিয়ে হবে আর দেখতে পারবে না। আফসোস! সেই আশা টা পূরন হতে দিলো না আহিয়ান! কেন জানি মনে হচ্ছে আমি না আসলে নিতি’ই সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। এর কারন টা আমার অজানা নয়।

আসার পর থেকেই ইতি কথা বলে যাচ্ছে, মেয়েটা কথাও বলতে পারে বেশ। তবে হ্যাঁ কথা বলার সময় ওর চোখ দুটো বেশ সুন্দর লাগে। তার নানা চোখের ভঙ্গি অন্যের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম।
এতোক্ষণ বাদে মনে পড়ল আহিয়ানের কথা। আচ্ছা কোথায় উনি? এখনো কি ঘুমিয়ে আছেন নাকি উঠে গেছেন। উঠলেও কি বাসায় চলে গেছে নাকি আমাকে খুঁজছে! খুঁজলে কি এতোক্ষণে এসে পড়তেন না তিনি। যাই হোক উনার সম্পর্কে এতো ভেবে আমার কাজ নেই।

মূহুর্তে’ই খেয়ার করলাম নিতি ওরা আমাকে নিয়ে কানাকানি করছে। হয়তো গ্রামে যা ঘটেছে সেটা নিয়েই কথা চলছে। একপর্যায়ে নিতি ওরা সবাই উঠে গেল। আমি নিশ্চিত এখন তারা আমার কাছেই আসবে। আর তাই হলো আমার দিকেই এগিয়ে আসছে তারা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করছি। অনেক কড়া কড়া কথা শুনতে হবে।

হঠাৎ মনে হলো ঝড়ের বেগে কেউ এলো। চোখ তুলে তাকিয়ে একটা চিরচেনা মুখ দেখলাম। তার মুখে একগাদা রাগের‌ রেশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার এলোমেলো চুল গুলোর হাল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি,

“আপনি!

সে আমার কথার কোন উওর না দিয়ে হুট করেই আমার হাত ধরে ফেলল। আমি সবার আগে তাকালাম নিতির দিকে। বেচারার আমার থেকেও বেশি শক খেয়েছে লাগছে। আহিয়ান আমার হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেল। ভার্সিটির সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বাইরে আনার পর’ই আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিল। অতঃপর ওপাশ দিয়ে এসে ড্রাইভিং সিট বসল। আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। খুব জোরে ধরেছে হাত টা। ব্যাথা করছে খুব।

সিটে বসে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তার চাহনির সাথে আমি পেরে উঠছিলাম না বলে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখি এখানে নিতি ওরা সবাই উপস্থিত! গাড়ির কাচ উঠানো তাই ভেতরের কিছুই তাঁদের কাছে স্পষ্ট না। তবে আমি এখান থেকে তাঁদের দেখতে পারছি।

আহিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“তুমি এমনটা কিভাবে করতে পারো!

চট করে উওর দিলাম,
“কি করেছি আমি!

“আমাকে ট্রেনে একা রেখে চলে এলে কেন?

“তো! কোন মেয়ে না তো আপনি যে পাচার করে দেবে।

“তাই বলে এভাবে রেখে চলে আসবে!

“হ্যাঁ আসবো! কিন্তু এসে লাভ কি হলো চলেই তো এলেন।

“মানে! তুমি চাইতে আমি আর না ফিরি।

“না এই কথা কখন বললাম!

“এই যে বললে!

“এই কথার অর্থ ছিল আমার জীবন থেকে সরে যাবেন।

“ভেবেছিলে রেগে গিয়ে তোমার সাথে আর দেখা করবো না।

আমি উনার দিকে তাকালাম। আসলেই আমি এটা ভেবেছিলাম। আহিয়ান সিটে আরাম করে বসে বলল,

“আহিয়ান নিজের মন মতো চলে! কখনো কেউ তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না তুমিও না।

আমি উনার থেকে মুখ সরিয়ে বলি,
“এভাবে আমাকে তুলে আনার মানে কি?

“অন্য কোন মেয়ে কে তো আর আনি নি।

“জোর করে বিয়ে করেছেন আমায়।

“বিয়ে তো হয়েই গেছে এখন আর এসব বলে লাভ নেই।

“দেখছেন ওরা কিভাবে তাকিয়ে আছে।

“ওদের চোখ ওরা তাকিয়েছে তোমার সমস্যা কি?

“আমাকে দেখছে এটাই সমস্যা!

“কে বললো তোমায় দেখছে? দেখছে আমার গাড়ি কে?
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেন জানি উনাকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। আমি বলে উঠি,

“গাড়িটা কোথা থেকে এলো।

“গাড়িটা স্টেশনে এসেছে। যদিও অনেক দেরি করে, জ্যামে ছিল বলে। ( অতঃপর আমার দিকে মুখ করে ) আজকের দিন টাই আমার খারাপ যাবে শুধু তোমার জন্য বুঝলে।

“আমি আবার কি করলাম?

“চলে যাচ্ছিল ভালো কথা একটা চিঠি তো লেখেই যেতে পারতা তাই না। ঘুম থেকে উঠে শুনি ট্রেন আবার ছেড়ে দেবে। এটা শুনেই বের হতে যাবো তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

“তাহলে আপনি কিভাবে নামলেন? লাফ দিয়ে?

“ভুতে কামরায় নাকি আমায়? নাকি আমাকে তোমার মতো ভাবো যে পাগলামি করবো!

আমি একটা ভেংচি কেটে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি বললেন,
“ট্রেনের চেন টেনে তারপর থামিয়েছি। অতঃপর আমি নেমে রাস্তায় এসে দেখি গাড়ি এখনো আসে নি। ফোন বের করে দেখি চার্জ নেই। এতো রাগ হচ্ছিল বলার মতো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি এলো। রাগের কারনে ড্রাইভার কে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে টাকা দিয়ে বললাম সিএনজি দিয়ে বাসাম চলে যাও।
গেলাম তোমার বাসায়, গিয়ে দেখি রুম তালা বন্ধ! দাদু’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন ভার্সিটি চলে গেছো।

“আর আপনি এখানে চলে এলেন!

“না! বাসায় গেলাম। ফোন চার্জে রেখে মা’র সাথে দেখা করলাম। তারপর এলাম ভার্সিটিতে!

“ফোন চার্জ দিতে বাসায় গেছেন আপনি।

“হ্যাঁ কেনো কি হয়েছে? তবে আরেকটা কারন ছিল, মা নিশ্চিত অনেক ফোন করেছিলো আমায়। কিন্তু ফোন তো বন্ধ ছিল তাই চিন্তা করছিলো তাই বাসায় গেলাম। কারন জানতাম ভার্সিটি থেকে তুমি তো আর পালিয়ে যাবে না।

“ভালো। আমি বের হলাম!

“কোথাও যাবে না তুমি।

“আপনি বলার কে? আমি তো যাবোই!
বলেই গাড়ির দরজা খুলতে গেলাম। কিন্তু তা খুলছেই না। বিরক্ত হয়ে বলি,

“আপনার গাড়ি কি খারাপ হয়ে গেল ।

“ভূতনি একটা! দরজা লক করা এটা এখনো বুঝতে পারো নি।
বলেই তিনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি কিছুই করতে পারলাম না। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলল,

“সিট বেল্ট বেঁধে নাও।

“আমার ক্লাস আছে।

“করা লাগবে না, এখন বাসায় যাবে আর ঘুমাবে

“এখন কি ঘুমানোর সময় নাকি।

“জানি ঘুমানোর সময় না কিন্তু তুমি কাল সারারাত ঘুমাও নি, তাই এখন বাসায় গিয়ে ঘুমাবা।

“আপনাকে কে বললো আমি ঘুমায় নি।

“তুমি ঘুমালে আমাকে রেখে যেতে পারতে না। তোমার যেই ঘুম!

“কি বললেন আপনি।

“সত্যি বলেছি!
বলতে বলতে একটা রেস্টুরেন্টে’র সামনে গাড়ি থামাল। কিন্তু আমার সিটবেল্ট না বাধায় গাড়ি ব্রেক করার সাথে সাথে আমি সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম।‌ আহিয়ান আমার বাহু ধরে টেনে বসাল। অতঃপর বলল,

“দেখলে তো বড়দের কথা না শুনলে কি হয়!

“ছাড়ুন আমাকে।

“নাও ছেড়ে দিলাম!

“এখানে কেন গাড়ি থামালেন।

“ক্ষুধা লেগেছে খাবো তাই!

“ভালো!

“নামো।

“আপনার ক্ষুধা লেখেছে আপনি খেয়ে আসুন আমাকে কেন নামতে বলছেন

“বসে বসে দেখবে আমি কি খাবো। নামো জলদি!

উনার ধমক খেয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। অতঃপর দুজনেই রেস্টুরেন্টে গেলাম। উনি সত্যি সত্যি একজনের জন্য’ই খাবার অর্ডার করেছে। তাহলে কি সত্যি’ই উনি একা একা খাবেন আর আমি বসে বসে দেখবে। আজব লোক তো!

আমি হালকা কেশে বললাম,
“আপনি আমাকে এভাবে নিয়ে এলেন আপনার বন্ধুরা সব দেখেছে।

“চোখ কি তোমার একাই আছে নাকি। দেখেছি আমি।

“ওরা যখন জিজ্ঞেস করল আপনি এমন কেন করলেন তখন কি বলবেন।

“তুমি কি চাও!

“আপনার স্ত্রী হয়ে কখনো পরিচয় দিতে চাই না।

উনি হেসে বললেন,
“ঠিক আছে তাই হবে।

“আপনি হাসছেন। নিতি কি আপনাকে ছেড়ে দিবে ভাবছেন।

“আহিয়ান কাউকে কৈফিয়ত দেয় না। তাই নিতি ভুলেও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। যদি ধরে এসে তোমাকেই ধরবে। তুমি বরং ভেবে নেও তখন কি বলবে!

আমি উনার কথায় ভ্যাবলার মত উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু বলতে যাবো এমন সময় ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। আহিয়ান তাকে বলল খাবার গুলো আমার কাছে রাখতে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,

“কি করছেন এসব?

আমার কথার পাত্তা না দিয়ে আহিয়ান ওয়েটার কে বলল,
“এক কাপ চা দিতে!

ওয়েটার চলে গেল। আমি বসে আছি। আহিয়ান বলে উঠে,
“খেয়ে নাও।

“না আমি খেয়েছি।

“খেয়ে থাকলেও খেয়ে নাও। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা পড়ে যাবে

“আপনার মনে হলে আমি কি করতে পারি।

“কিছু না শুধু খেতে বলেছি খাও।

“না।

“তাহলে বসে থাকো।

“কেন?

“আমার ইচ্ছা।

“আজব তো সবকিছু কি আপনার ইচ্ছায় চলবে নাকি।

“হুম চলবে। নাও খেতে শুরু করো।

“আমি চলে যাবে।

“উঠে তো দেখো।

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আহিয়ান বলে উঠে,
“দেখো ভূতনি অনেক রাগানোর চেষ্টা করেছো আমায়। কিন্তু আমি যথেষ্ট ধৈর্য্য রাখছি। চুপচাপ খাওয়া নেও। শেষবারের মতো বলছি। এরপর আর বলবো না।

বলেই নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে রইলেন। উনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে রাগ ধরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে। উনার এমন চেহারার ভঙ্গি দেখে কেন জানি ভয় পেতে শুরু করলাম। তাই আর কথা বাড়ালাম না। তবে খাওয়া শুরু করলাম না। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“আপনি খাবেন না!

“না এখন আর খাবো না। বাসায় গিয়ে ‌ফ্রেশ হয়ে খাবো তারপর ঘুমাবো।

“আবার ঘুমাবেন।

“আমি তোমার মতো ভূতনি না যে রাতেও জেগে থাকবো আবার সারাদিনও

“ভূতনি হবেন কেন? পেঁচা আপনি।

“কিন্তু পেঁচা তো রাতে জেগে থাকে।

“আপনি হলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি পেঁচা,‌‌ যে রাতেও জেগে থাকে আর সকালেও!

“তুমি তো একটা পাগল, তোমার সাথে বকবক করে আমিও পাগল হবো। চুপচাপ খাও তুমি। এককথা একশবার বলা লাগে তোমায়!

“কিন্তু আপনি তো…

বলার আগেই আহিয়ান হাত দিয়ে নিজের মুখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে চুপ করতে বলে আর খেয়ে নিতে বলে। আমি খাওয়া শুরু করেছি তখন’ই ওয়েটার এসে চা দিয়ে গেল।

অতঃপর দুজনেই বের হলাম। আহিয়ান শুধু চা’ই খেল আর কিছু খেল না।
.
আহিয়ান আমাকে বাড়ির নামিয়ে দিল। অতঃপর সে চলে গেল। ঘরে এসে‌ বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর’ই ঘুমিয়ে গেলাম। কখন ঘুমোলাম টের ও পেলাম না।

কারো ‌দরজা কড়া নাওয়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙল আমার। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি দুপুর দুটো বাজে। এসময় আবার কে এলো। এখনো দরজা কড়া নাড়ছে।‌ অতঃপর চোখ ঢলতে ঢলতে আগালাম দরজার দিকে…

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here