#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৫১.(শেষ মন্দ যার সব মন্দ তার)
শেষ পর্ব.
বাইরে তখন গুনগুন করে বাতাস বইছিলো। আষাঢ়ে ঝুড়ির আলাপন শেষে শরৎ এর প্রবেশবার্তা। তবুও বৃষ্টির সাথে পেলবতা প্রেমালিঙ্গণ প্রকৃতির। রাত হচ্ছিলো। শেষ সন্ধ্যার এক মুঠো লাল রঙা স্ফটিক রং মিলিয়ে গেলো হাওয়ায় ভেসে… রাতের আধারে… বৃষ্টির কাছে।
টিকলি বসে ছিলো ঘরে একা। লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে। মাথায় রাজকীয় সোনালি উড়না দিয়ে। তার চুলের মাঝ বরাবর সিথির খাঁজে একটা বড় টিকলি। পুরো কপালের দখলদার। হাতের লাল চুড়ির ভাঁজে ভাঁজে আদরের দেওয়া সোনালি চুড়িগুলো। আলতা রাঙা পা দুটোতে মোটা নুপুর। টিকলি আলতো হাতে ছুঁলো টিকলি। ছোয়ার মাত্রই তার শরীর টা কেমন ঝনঝনানি দিয়ে উঠলো। জখম হলো। রক্তাক্ত হলো। পরিশেষে কষ্ট হলো! আদরের দেওয়া প্রথম উপহার। ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন এই টিকলি! কেনো হলো কে জানে কিন্তু টিকলি যখন তার কুচকুচে কালো চুলগুলোর মাঝে পড়িয়ে দেওয়া টিকলিটায় ছুঁলো তার কাজল রাঙা চোখদুটো তখন বর্ষার অঝোর বৃষ্টিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়া দীঘির মতো টলটলে হয়ে উঠলো। তার মনে হলো আদর তার কাছে। খুব কাছে! আদর তার কানের কাছে দুষ্টুমি করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলছে,
‘মিস. টিকটিকি, আপনাকে তো টিকলিতে অপ্সরী লাগছে। শুনুন, বিয়ের পর আপনি রোজ রাতে টিকলি পড়বেন। আমি দেখবো! দু’চোখ ভরে দেখবো। আপনার ওই টিকলি মাখানো কপালটায় অজস্র চুমু খাবো! আদর করবো! ভালোবাসবো! মনে থাকবে?’
টিকলি তখন আদরের গলায় ঝুলে পরে বলবে, ‘জি বাদর সাহেব মনে থাকবে। আদরের আদর পাওয়ার অসংখ্য প্রেমইচ্ছায় ডুবে মরতে চাই আমি।’
ঘোর লাগানো চোখে টিকলি সামনে থাকা আয়না ভেদ করে নিজেকে দেখছিলো। পাশে কল্পনায় দেখছিলো আদরকে। তাদের দুষ্টুমি ভরতি কথাগুলোকে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। তার ঘোর যখন ভাঙলো তখন দরজায় কড়ার শব্দ। টিকলি পিলকে চমকে উঠলো। কেউ একজন বলেছিলো, ‘বিয়ে আগে না ভাঙতে পারলে পরে ভাঙা দুষ্কর।’ সময়গুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই খুব তাড়াতাড়ি অতিবাহিত হয়ে গেলোনা?
,
খয়েরী শেরওয়ানি পরে মাথায় সোনালি পাগড়ি পরে আর্দ্র সবার গোপনে ছুটলো নিভার বাড়ি। নিভার বারান্দা ঘেঁষে উঠে গেছে একটা মস্ত বড় জলপাই গাছ। আর্দ্র আশেপাশে সচেতন চোখে দেখে নিয়েই পায়জামা উপরে উঠালো। গাছ বেয়ে উঠতেই সে ফাররর… করে একটা শব্দ শুনতে পেলো। চমকে তাকিয়ে দেখলো তার পাজামা ছিড়ে গেছে। আর্দ্রর এ মুহুর্তে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিষ্কর্মা, অকর্মক, অকালকুষ্মাণ্ড এবং অসহায় লাগলো। মনে হলো এই গাছ থেকে এক লাফ দিয়ে নিচে পরে মরে যাই। শালার ছিড়ছে তো ছিড়ছে তাও এমন জায়গায়!
আর্দ্র চোখ মুখ বন্ধ করে বিসমিল্লাহ বলে আবার গাছ বেয়ে উঠে নিভার বারান্দায় নামলো। বারান্দা থেকে নিভাকে ফোন করে বলল ঘর ফাঁকা করতে। দশ মিনিটের মাথায় নিভার ঘর ফাঁকা হলো। আর্দ্র ঘরে ঢুকে বলল,
‘একটা প্যান্ট দে তো। কুইক।’
নিভা আর্দ্রের দিকে তাকালো। শেরওয়ানি লম্বা হওয়ার দেখা যাচ্ছে না ছিড়া জায়গাটা। নিভা অবাক হয়ে বলল, ‘প্যান্ট? আমি প্যান্ট কোথায় পাবো? আমার প্যান্টও তো তোমার পায়ে লাগবে না।’
আর্দ্র বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কিছু একটা দে। তা নাহলে এটা আরো বেশি ছিড়ে যাবে।’
নিভা একটু শুকনো কেশে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি? পায়জামা ছিড়ছে?’
‘হুম।’
‘সেফটিপিন দেই কয়েকটা। লাগাও।’
আর্দ্র আঁৎকে উঠলো, ‘কি বলিস? লেগে যাবে তো ভাই। সিরিয়াস কেস। এসব দিস না বোন। একটু এদিক থেকে ওদিক হলে সর্বনাশ।’
নিভা নাক ছিটকে বলল, ‘ছি! আমি তোমার ছোট বোন। একটু তো লজ্জা সরম করো। বেহায়া একটা। সেফটিপিন দিচ্ছি। আস্তে করে বাথরুমে গিয়ে লাগাও।’
আর্দ্র আতংকিত ফেসে বাথরুমে গিয়ে অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে সেফটিপিন লাগালো। এরপর এসে যুদ্ধে জয়লাভ করার মতো গর্বিত হয়ে বলল, ‘শেষ!’
নিভা মুখ টানা মেরে বলল, ‘ভালো হইছে। এবার আমরা কি করবো সেটা বলো?’
‘এবার আমরা দুজন পালাবো।’
নিভা চমকিত কণ্ঠে বলল, ‘পালাবো মানে?’
‘পালাবো মানে। এখান থেকে আমরা যাবো টিকলির বিয়ের আসরে। ওদের বাড়ির যেকোনো জায়গায় লুকিয়ে থেকে টায়রাকে ফোন করবো।’
‘আর আদর ভাইয়া? টিকলি? রাহুল? ওদের কি হবে?’
‘ভাইয়া যে কোথায় সেটা তো আমি জানি না। দুদিন থেকে ভাইয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে আমরা টিকলিদের ওইখানে যাই। টায়রাকে ডেকে আনি। তারপর একটা কিছু প্ল্যান করে টিকলির বিয়েও ভাঙা যাবে।’
‘আর যদি টায়রা আমাদের বিয়ে খেতে চলে আসে? তখন কি হবে?’
আর্দ্র অবাক গলায় চাপা স্বরে বলল, ‘কি বলিস! উনি আমার বিয়ে খেতে আসবেন? পারবেন উনি? এতো সাহস?’
,
দরজার কড়াঘাত জোরালো হলো। টিকলির অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সময় কি এসে পড়েছে কবুল বলার? রাহুলকে স্বামী হিসেবে মেনে দেহ ধাক্কিয়ে সংসার নামের বেড়াজালে নিজেকে রোবটের মতো করে আটকানোর সময় এসে পড়েছে? এখন কি ওকে নিতে এসেছে?
দরজায় এবার আরো জোরে ধাক্কানো হলো। টিকলি কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাড়ালো। হালকা পায়ে দরজা খুলতেই ঘরে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো টায়রা। দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে ঠেকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জোরে শ্বাস নিয়ে হাপাঁলো। টিকলি সরু দৃষ্টিতে ওকে দেখলো। এরপর কোনো কথা না বলে নির্মিত্ত পায়ে গিয়ে আয়না বরাবর বিছানায় বসলো। টায়রা হাঁপ ধরানো গলায় খেক করে উঠলো,
‘কি হয়েছে তোর? মুখটাকে এভাবে বাংলার পাঁচ করে বসে আছিস কেনো? বালের প্রেম পিরিতি করো? বিয়ের আগে দুইজনের যতশত ভাব ধইরে এখন ঢং করতাছো? আমি বড় হলে থাপড়ায়ে তোর কান লাল করে দিতাম।’
‘তুই না বলেছিলি আজ আর্দ্র ভাইয়ার বিয়েতে যাবি?’
টায়রা আগুন গরম চোখে তাকিয়ে আগের থেকেও দ্বিগুণ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আমি তোরে কি বলি আর তুই কি বলস?’
‘কখন যাবি? যেতেও তো সময় লাগবে। যা। তা নাহলে তো ভাইয়ার মুখ থেকে কবুল শোনার দুঃসাহসিক আশাটা তোর পূর্ণ হবেনা।’ টিকলি একটু থেমে আবারো বলল তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে, ‘আমাদের দু’বোনের কপাল একরকম তাই না বল?’
টায়রা একটু থামলো। দুর্বলচিত্তে বলতে গিয়েও বাইরে নিজের ঠাট বজায় রেখে বলল, ‘কিসের দুই বোন? আমার ভাগ্য ভালো! অনেক ভালো! সোনা না না না হিরা দিয়ে মুড়ানো আমার ভাগ্য।’
টায়রা আর টিকলির কথার মাঝেই দরজায় শব্দ হলো আবারো। টিকলি স্থিরচিত্রে বলল, ‘আমাকে নিতে আসার সময় হয়েছে?’
‘এখনি তো হওয়ার কথা না।’
বলতে বলতে টায়রা গিয়ে দরজা খুলল। দেখলো দরজার বাইরে ছোটো খাটো পুতুলের মতো ঝগড়ুটে মহিলার ভঙ্গিতে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমকি। গাল দুটো ফোলা। রেগে আছে বোধহয়। পাশেই আকিদা হক। টায়রা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘ওহ, আপনারা এসে পড়লেন নাকি?’
টায়রার প্রতি আকিদা হকের জমানো অনেক দিনের ক্ষোভ। তিনি ত্যাড়া ভাবে বললেন, ‘কেনো? আমাদের আসার কথা ছিলো না?’
‘না না ছিলো তো। আমি কি তাই বলেছি?’ টায়রা জোরপূর্বক হেসে বলল।
‘দেখি সরো ভেতরে যেতে দাও।’
টায়রা দরজার পুরো জায়গা জুড়ে দাড়ালো। বলল,’এখন তো যাওয়া যাবে না। কনে শাড়ি পড়ছে।’
আকিদা হক আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এতোক্ষনে শাড়ি পড়ছে? আর শাড়ি পড়ছে তো কি হয়েছে? আমি গেলে আরো হেল্প হবে।’
টায়রা এক চোখ টিপে বলল, ‘আরে বুঝেন না। কনের যে ফিগার আর আপনার যে চোখ! দুটো বিপরীত আকর্ষণ করে কনের নজর লাগবে। তারপর দেখা গেলো বিয়ের আসরে যাওয়ার আগেই কনে কাৎ আর বিয়ে বাদ।’
আকিদা হক কটমট করে তাকালেন। অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘অভদ্র মেয়েছেলে একটা।’
টায়রা অবাক হয়ে ঠোঁট ভেটকিয়ে বলল, ‘ছেলে? ছেলে কই এখানে?’
আকিদা হক আর একটা কথাও না বাড়িয়ে ফুসতে ফুসতে চলে গেলেন। তার কিছুক্ষণ পর টিকলির দিকে এক পলক তাকিয়ে টায়রাও চলে গেলো। টিকলি রয়ে গেলো একা। চোখ পড়লো ওয়াড্রপের উপর রাখা চকচকে ব্লেডটার দিকে। টিকলি যেনো মন্ত্রবিষ্টের ন্যায় উঠে দাড়ালো। এগিয়ে গেলো ওয়াড্রপের দিকে। ব্লেডটার দিকে তাকিয়ে। ঘরের দরজা তখন খোলা। টায়রা চলে যাওয়ার পর আর লাগানো হয়নি৷
টিকলি ব্লেড টা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে যেই হাতে ফ্যাস দিতে যাবে ওমনি তড়িঘড়ি করে এসে রাহুল চেপে ধরলো। টিকলি চমকে উঠলো। রাহুলকে দেখে শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। এক অশরীরী শক্তি ভর করলো। জোরজবরদস্তি শুরু করলো। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে রাহুলের আঙ্গুল কেটে গেলো। তবুও ছাড়াতে পারলো না। এক পার্যায়ে রাহুল টিকলিকে সপাটে চড় মেরে দিলো। সারাদিন না খাওয়া দুর্বল টিকলি ছিটকে পড়লো। চোখে অন্ধকার দেখলো। রাহুল টিকলির চুল ধরে টেনে উঠিয়ে দাঁতে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,
‘আমি তোকে বিয়ে করবো না। এটা বলার জন্যই এসেছিলাম। এই বিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে দিতে এসেছিলাম। আর তুই কি করতাছিস?’
টিকলি বিস্ময় নিয়ে তাকালো। রাহুল টিকলির চুল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোকে ভালোবাসি তোর ভালোবাসার দাম আমার কাছে নেই কিন্তু সম্মান আছে। প্রতিটা ভালোবাসাই মূল্যবান৷ আমি নিজে বুঝি ভালোবাসা না পেলে ঠিক কি হয়? বুকের ভেতর কি জ্বালাপোড়া হয়! মন কেমন দগ্ধ হয়! জীবন্ত শরীর কেমন মৃত হয়ে যায়! কাল রাতে অনেক ভেবেছি। সারারাত চিন্তা করেও আমি তোকে একটাবার নিজের করতে পারিনি।’
টিকলির চোখের তাঁরা উজ্জ্বল হয়ে এলো। প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় কলি থেকে ধীরে ধীরে ফুলের বাগান ভরে গেলো। চোখের ভাঁজে উৎফুল্লতা। রাহুলের কষ্ট হলো। এই উৎফুল্লতা কেনো রাহুলের জন্য নয়? এটা মানতে রাহুলের খুব পুড়ছে। খুব!
কিছুক্ষণ মুহুর্ত কাটলো টিকলির শূন্যে হাসির আনন্দে ..রাহুলের বেদনায়.. নিশ্চুপ খুশি এবং চাপা কষ্টে। এরপর রাহুল অনেক কষ্ট করে বলতে পারলো,
‘আয়। সে অপেক্ষা করছে।’
,
খুব সাবধানে দায়িত্ব নিয়ে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে রাহুল টিকলিকে বাইরে নিয়ে এলো। সারাবাড়ি লাগানো হরেক রকম আলো দিয়ে। ভেতর থেকে বাজছে বিয়ের বাজনা। চারিদিকে বিয়ের আমেজ। দিগ্বিদিক জমেছে বিয়ের আসর। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে মস্ত বড় পুকুর। পুকুরের একপাশে বাধাই করা। আরেকপাশে বিশাল বড় শিমুল গাছ। শিমুল গাছের ফাকঁ-ফোকঁর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে পেলব ম্লান চাঁদের আলো। মাখিয়ে দিচ্ছে তার নরম আদর। আদর দাঁড়িয়ে ছিলো জীর্ণশীর্ণ হয়ে। অগোছালো কাপড়ে। টলমলে অসাড় শরীরে। কিন্তু দূরে ওই দাঁড়িয়ে থাকা লাল টুকটুকে বউ টিকলিকে দেখে যেনো আদরের অসাড় শরীর চাঙ্গা হলো। বুকে বল এলো। ক্রমাগত শরীর ভালোবাসার কম্পনে কম্পিত হলো।
রাহুল টিকলির হাত ধরে ছিলো ঠিক ছোটোবেলার দিনগুলোর মতোন। যখন এদিক ওদিক টিকলিকে নিয়ে ছুটতো সবার আড়ালে… টিকলির আবদার পূরণ করতে। ঠিক তেমনভাবে। টিকলি রাহুলের দিকে হেসে একবার তাকালো। আস্তে আস্তে হাত ছেড়ে দিলো দৌড়ে গেলো আদরের দিকে। আছড়ে পড়লো তার বলিষ্ঠ বুকে। রাহুল তাকিয়ে থাকলো নিজের হাতের দিকে। বুকের কোথাও একটা… কোথাও একটা মনে হচ্ছে কিছু নেই। হারিয়ে গেলো কিংবা হারিয়ে ফেললাম বা পেয়েও হারালাম। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড টা শরীরে নেই। কেউ দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলো এই জলাশয়ে। আদর তখন টিকলির কপালে চুমু দিলো। টিকলির কপাল জুড়ে থাকা টিকলিটার আড়ালে চুমু দিয়ে আবারো ঝাপটে ধরলো টিকলিকে। বলল,
‘আজ চুমু সম্পূর্ণ হলো মনতাঁরা! শুনুন, আমাদের বাচ্চার নাম রাখবো শুকতারা।’
টিকলি হাসলো। আদর হাসলো। ওরা দুজনে হাসলো। এদিকে রাহুলের মন পুড়লো। গন্ধ ছেয়ে গেলো চারিদিকে। সারা প্রকৃতি ওর জন্য দুঃখবিলাস করলো কিন্তু শুধু যার করার কথা ছিলো সে করলো না। রাহুল আর থাকতে পারলো না। পুকুরের এদিকটায় এসে পড়লো। ইট বিছানো জায়গায় বসলো। একটুপর নিজের পাশে বসতে দেখতে পেলো নয়নকে। নয়নের চোখ মুখ শুকনো। চোখের তেজের ছাট নিয়ে সে বলল,
‘নিজের জিনিস বিলি করে দিলি?’
রাহুল সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ওটা আমার জিনিস কখনো ছিলো না, দোস্ত। আমি ছিলাম নামমাত্র তার পাহারাদার।’ খানিক বাদে রাহুল আবার বলল, ‘তোর মনে আছে? আমি যেইদিন প্রথম জানলাম টিকলির সাথে আমার বিয়ে ঠিক সেইদিন রিক্সা দিয়ে আমার বাবার বাড়ি যেতে যেতে বলেছিলাম, জীবনে এই প্রথম আমি যা চেয়েছি তা পাচ্ছি। মনে আছে?’
নয়ন মাথা নাড়ালো। রাহুল তাচ্ছিল্য হেসে ইটে থাপ্পড় দিয়ে বলল, ‘শালার আমার ভাগ্যটাই খারাপ! যা চেয়েছি তা কোনোদিন পাইনি।’
‘কিন্তু যা চাসনি তা তো পেয়েছিস। নিভা তো তোকে খুব ভালোবাসতো।’
সিগারেট মুখে লাগিয়ে রাহুল ঠোঁট বাকিয়ে বলল, ‘আরে বাদ দে। ওর আজ বিয়ে। বিয়ে করে সুখে সংসার করুক।’
বলতে না বলতেই খয়েরী বেনারসি পড়ে ছুটে আসতে দেখা গেলো নিভাকে। রাহুল অবহেলায় তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার তাকালো। ভালোমতোন দেখলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিভা রাহুলের খুব কাছে এসে দাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি।’
রাহুল বিমূর্তমান বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কেনো?’
নিভা দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘ফাইযলামি করেন? এমন কেনো করছেন? আপনি তো টিকলিকেও বিয়ে করছেন না। তবে..? তবে সমস্যা কি?’
রাহুল আকণ্ঠ হয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন? আমার সাথে থাকবেন? পারবেন?’
নিভা আবিষ্টমনে একনাগাড়ে উদ্ধৃত মোলায়েম স্বরে বলল, ‘লোকে বলে, তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে জীবনসঙ্গিনী করার আগে যে তোমাকে ভালোবাসে তার দিকে নজর দেও।’
‘কথাটা আমার ক্ষেত্রে সত্যি হতে পারে কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে..’
রাহুলকে আটকিয়ে নিভা বলল, ‘হয়ে যাবে। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
নিভা বলল আচম্বিতে রাহুলের বুকের বাম পাশের উপর হাত রেখে। রাহুল নিভার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
‘ভালো করে ভাবুন নিভা। আমি আপনাকে আদর করতে পারবো তবে ভালোবাসতে পারবো না। মন দিতে পারবো হয়তো হৃদয় দিতে পারবো না। এই বুক দিতে পারবো কিন্তু ধুকপুক শোনার অনুমতি দিতে পারবো না।’
নিভা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। এতোটা কষ্ট..! কি করে বোঝাবে নিভা? তবুও নিভা বলল, ‘আমি তাতেই রাজি? যাবেন আমার সাথে? পথ পাড়ি দিতে? অজানার পথে? যেখানে আর কখনো আপনাকে কষ্ট ছুবে না হয়তো দুঃখ ছুবে। কান্না ছুবে কিন্তু মন খারাপ ছুবে না।’
নিভা হাত বাড়িয়ে দিলো। রাহুল একবার নয়নের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে সেই হাত ধরলো। নিভা দেখছিলো রাহুলের চোখের কোণায় টিকলির জন্য পানি। বুকটা ছিন্নভিন্ন হলো। রাহুল নিভার ওই আলতো ফর্সা রাঙা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। তাকাতেই চোখের সামনে টিকলির মুখ ধরা দিলো। রাহুল চকিতেই চোখ সরিয়ে নিলো। সে কি কখনো পারবে টিকলিকে ভুলতে? নিভাকে আপন করতে? না পারুক চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? ক্ষতি তো নেই! তবে খুঁজে নেওয়া যাক চিরকালের দুঃখের পর একটু সুখের আশ্রয়! ছোঁয়া! আশা!
,
বাড়ির পেছনের দিকে আসতেই আর্দ্র টায়রাকে ফোন করলো। টায়রা বেরিয়েছিলো আর্দ্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর্দ্রের ফোন পেয়ে টায়রা তড়িঘড়ি করে বাড়ির পেছনের দিকে গেলো। বুক দুরুদুরু করলো। কাঁপলো। চিন্তা হলো। মানুষটা এখানে কেনো? কিন্তু মন বলল, যেই কারণেই আসুক। যখন এসেছে। আমি যেতে দিতে পারবো না। কিছুতেই না। লোকটা নিজে যেচে ধরা দিচ্ছে। এর থেকে তার নিস্তার নেই।
আর্দ্রের সামনে গিয়ে টায়রা অস্থির কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাস মেলে দিয়ে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবেন?’
আর্দ্র থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টায়রা তাড়া দিলো, ‘কি হলো? করবেন না?’
আর্দ্র মাথা দুলাতে পারলো শুধু। টায়রা আর্দ্রের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আসুন তবে।’
আর্দ্র যন্ত্রমানবের ন্যায় যেতে লাগলো। টায়রার পিছু পিছু। সে যেনো এক বন্ধ ঘোরপূর্ণ ঘরের মাঝে আবদ্ধ। তার চোখ চেয়ে দেখছে টায়রাকে। হাত ধরে আছে টায়রা নামের আজব ব্যক্তিকে। কান শুনছে টায়রা নামক অপ্রাকৃত চিন্তাশীল অস্থির মানবীকে।
,
ওরা ছয়জন এখন শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ছয়টি মস্তিষ্কে তুমুল চিন্তা চলছে, কি করবে এখন? একটুপর দেখা গেলো হারে রে রে করে ডাকাতের মতো দল ভুক্ত হয়ে ছুটে আসছে এক দল ব্যক্তিবর্গ। টিকলি টায়রার বাবা মা, আকিদা হক। রুহুল হক আস্তে ধীরে আসছেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড পেছনে আদর আর্দ্রের বাবা মাকে দেখা যাচ্ছে। নিভার বাবা মাও আছে দেখা যায়। ওরা কখন এলো? টিকলি নখ কামড়িয়ে কাদো কাদো কণ্ঠে বলল, ‘কি করবো এখন আমরা?’
দূর থেকে ভেসে আসছিলো গান। সম্ভবত টিকলিদের বাড়ি থেকেই। বিয়ে বাড়ি বলে কথা!
“আজ ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পালায়ে যাই…”
ডাকাতের দল ক্রমশ এগিয়ে এসে পড়েছে। টিকলি ছুট লাগালো। ওর ছুট লাগানো দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সবাই। ছুট লাগিয়ে চিতকার করে টিকলি বলল, ‘সবাই পালাও…..’
টায়রা আর্দ্র রাহুল নিভাও ছুট দিলো। আদর পড়িমরি করে দৌড়ে গিয়ে বলল, ‘এই আমাকে নিয়ে যান।’
,
ওরা দৌড়াচ্ছিলো রাস্তা মাড়িয়ে… ধূলো উড়িয়ে…বাতাস কেটে কেটে। আদর টিকলিকে বলল, ‘মিস পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলা? আজ পনেরো তারিখ জানেন?’
টিকলি কটমট চোখে তাকালো। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে। পথ ঘাট ভেজা। ভেজা গাছের ফুল পাতা। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রেম সাথে ছন্দের ফুলঝুরি। আদর টিকলির হাত ধরে আরেকটু জোরে দৌড়ে টিকলির কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“বাতাসে পাতায় আবেগী বর্ষার গন্ধ,
রোদ আকাশের জানালা করেছে বন্ধ,
মেঘলা আকাশের দ্বার খুলেছে মৃদুমন্দ,
আপনি এলে হয়ে যাবে বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ।”
……পরিপূর্ণ সমাপ্ত….
চমকে উঠেছেন কে কে? উপরের টাইটেল টা দেখে? আজ কিন্তু আমার সব শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেখতে চাই। পুরো উপন্যাস কেমন লাগলো গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন সবাই।