বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৪৬

0
486

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৪৬.
ঘড়ির কাটা সাড়ে তিনটের ঘরে। টিকলি টায়রা আস্তে করে নিচে নেমে এলো। জামিলুর রেজা সোফায় বসে সকালের পত্রিকা এখন পড়ছিলেন। টিকলি টায়রাকে কনুই মেরে বলল,

‘দুপুরে খাওয়ার পর না বাবা ঘুমায়? আজ এখানে কেনো?’

টায়রা ব্যথা পেয়ে চোখ মুখ কুচকিয়ে বলল, ‘আমি জানি বাল। তোরে বাশঁ দেওয়ার জন্য মনে হয় বইসে আছে।’

টিকলি চোখ রাঙানি দিতেই টায়রা ঠেলা দিলো এগোনোর জন্য। পা টিপে টিপে ড্রইংরুম পার হতে না হতেই জামিলুর রেজার গমগমে আওয়াজ শোনা গেলো। টিকলি টায়রা তটস্থ হয়ে চোখ মুখ খিচে দাড়াঁলো। জামিলুর রেজা মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে জহুরি নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো। টায়রা তুতলিয়ে বলল,

‘কি কি হয়েছে বাবা?’

জামিলুর রেজা এক ভ্রু উঁচুতে তুলে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

টায়রা উত্তর খুঁজে পেলো না। টিকলিকে চিমটি কাটতেই টিকলি কটমট করে তাকালো। টায়রা কাধ দিয়ে হালকা ধাক্কা দিলো কিছু বলার জন্য। টিকলি বাবার দিকে ঘুরে বলল,

‘ওই তো…ওই তো..মানে…আর কি আমরা পার্লারে যাচ্ছিলাম বাবা। হ্যাঁ পার্লারেই তো যাচ্ছিলাম। সামনে আমার বিয়ে তো। একটু সাজুগুজু করতে হবে না? মুখটাকে ফ্রেশ না রাখলে তো সবাই বউ দেখে নাক ছিটকাবে।”

জামিলুর রেজা সোজা হয়ে দাড়ালেন। বিয়ে সম্পর্কে মেয়ের চিন্তা ভাবনার উন্নতি দেখে তার খুশি খুশি লাগলো। তবুও সচেতন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই দুপুরে পার্লার কে খোলা রাখে?’

টিকলি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে টায়রার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। টায়রা বলল,

‘আরে বাবা, এই পার্লার অনেক নামী দামী তো তাই সবসময় খোলা থাকে। কাস্টমার ডিমান্ড বুঝো না? সারাক্ষণ ভিড় থাকে।’

জামিলুর রেজা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘ওহ ভিড় হয়। তাহলে এখন যেতে হবে না। বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর। ঘরে যাও। বিকালে যেও।’

এই বলে জামিলুর রেজা চলে যেতে নিলেই টিকলি টায়রা সমস্বরে চিল্লিয়ে বলল, ‘না।’

জামিলুর রেজা থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বোকা বোকা গলায় বললেন, ‘কি হলো?’

টিকলি থেমে থেমে বলল, ‘আসলে বাবা..হয়েছে কি? আমাদের এ সময় এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে তো তাই।’

জামিলুর রেজা অবাক গলায় বললেন, ‘পার্লারে এপয়েন্টমেন্ট?’

টায়রা বিজ্ঞ সুরে আস্তে গলায় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা। সেটাই তো বলছি। এখন পার্লারের মালিকের সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে। এপয়েন্টমেন্ট এরপর না পার্লারে ঢুকে ফেসিয়াল আই মিন সাজুগুজু হেন-তেন হাবিজাবি করতে পারবো!’

জামিলুর রেজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আজকাল পার্লারেও এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে ঢুকতে হয়। দিনকাল কোথায় যাচ্ছে? দেশ আসলেই উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে।’

জামিলুর রেজা নিজের ঘরে যেতে যেতে বললেন, ‘গাড়ি নিয়ে যেও। আর এক ঘণ্টার ভেতর বাসায় আসা চাই।’

জামিলুর রেজা যেতেই টিকলি টায়রা চাপা সুরে হেসে উঠলো।

,

নামীদামী চাকচিক্যপূর্ণ আড়ম্বরি রেস্টুরেন্ট। মাঝখানে টেবিল। দু’পাশে সোফা। টায়রা মনোয়ারা খানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ছিলো। তার চোখে মুখেই ফুটে উঠেছে এখানে আসার বিরক্তি। টিকলি এক ঝলক মনোয়ারা খানের দিকে তাকিয়ে আবার এদিক ওদিক তাকালো। ভেতরটা অস্বস্তিতে বুঁদ হয়ে রয়েছে। মনোয়ারা খান সৌজন্যে হেসে বললেন,

‘কি খাবে বলো?’

টিকলি ভ্রু বাকিয়ে মনোয়ারা খানের দিকে তাকালো। এখানে নিশ্চয়ই আদর যত্ন করে খাওয়ানোর জন্য ডাকা হয়নি। এতো সময় না নিয়ে আসল কথায় আসলেই তো হয়। টিকলি মাথা দুলিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘নাহ কিছু খাবো না। আপনি এখানে কেনো ডেকেছেন তা যদি বলতেন-‘

মনোয়ারা খান স্মিত হাসলেন। টিকলি চোখ ছোট করে তাকালো। মহিলাটি নিতান্তই সুন্দর এবং আধুনিকা। পড়নে তার ঘিয়া রঙের জামদানী শাড়ির বেগুনি পার। মাথায় বেগুনি হিজাব। তার উঁচু নাক, চড়া কপাল, ভ্রুর নিচে একজোড়া নিঃসহায় চোখ, শ্যামলা মুখশ্রীর নিখুঁত গড়ন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে টিকলির মনে হলো, ‘আদর ওর মায়ের মতোন দেখতে।’

টায়রা সোফায় হেলান দিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কেনো ডাকা হয়েছে আন্টি?’

মনোয়ারা খান একটু নিভলেন টায়রার সরাসরি প্রশ্নে। একটু থেমে অপ্রতিভ গলায় বললেন,

‘তোমার সাথে কি আর্দ্রের কথা হয়?’

টিকল বিস্ফোরিত কন্ঠে বলল, ‘না না। ওর সাথে আর্দ্র ভাইয়ার কেনো কথা হবে?’

মনোয়ারা খান খানিকটা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালেন,’তুমি অনেক কিছুই জানো না টিকলি। উত্তরটা তোমার বোনকে দিতে বললে ভালো হতো।’

টায়রা অকপটে বলল, ‘নাহ কথা হয়না।’

মনোয়ারা খান ভ্রু কুটি করে তাকালেন। টায়রা একটু থেমে শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘কাল রাতে হয়েছিলো।’

টিকলি অবাক গলায় বলল, ‘কাল রাতে হয়েছিলো মানে?’

টায়রার জবাব দেওয়ার আগেই মনোয়ারা খান বললেন, ‘আর্দ্রের বিয়ে ঠিক হয়েছে নিভার সাথে। তা জানো?’

টায়রা উত্তর দিলো না। অন্যদিকে তাকালো। সে বুঝে গেছে তার এখানে আসার কারণ। সবার মাঝে টিকলি বলল,

‘জি শুনেছি।’

মনোয়ারা খান মাথা দুলালেন। টিকলি আবার বলল, ‘কিন্তু আর্দ্র ভাইয়া তো ছোট তার আগে তো।’

‘আদর বিয়ে করবে না। এদিকে ওর বাবাও মেনে নিবে না।’

টিকলি থামলো। সহায়হীন চোখে তাকালো মনোয়ারা খানের দিকে। মনোয়ারা খান উঠে এসে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে টায়রার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘আমি জানি না আর্দ্রের প্রতি আদেও তোমার কোনো অনুভূতি আছে কিনা। তবে আর্দ্র নিজের আত্মগোপনেই নিজের মনের অনেকটা অংশ জুড়ে তোমার প্রতি গাঢ় অনুভূতি তৈরি করে ফেলেছে।’

টিকলি হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। বিদীর্ণ চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলেই মনোয়ারা খান হাত জোর করে বললেন,

‘আমি তোমার পায়ে পরে বলছি টিকলি, দয়া করে আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যাও। আমার সংসার আগুনে জ্বলসে যাচ্ছে। বাবা-ছেলের মাঝে একমাত্র তোমার কারণেই বিবাদ ঘটছে। তোমার কারণে আদর বিয়ে করছে না। তোমার কারণে আদরের বাবা জেদ ধরে ছোট ছেলের আগে বিয়ে দিচ্ছেন। দয়া করো, আমি তো তোমার মায়ের মতোন। সরে যাও আমার ছেলের জীবন থেকে। পরিবারের দোয়া ছাড়া তোমরা কখনো সুখী হবে না। আর তোমাদের বাবারা মরে গেলেও কোনোদিন তোমাদের মানবে না। আমার সংসারটা চূর্ণবিচূর্ণ করো না।’

মনোয়ারা খানের শুষ্ক গাল বেয়ে পড়তে থাকলো নোনা জল। টিকলি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মনোয়ারা খানের দিকে তাকিয়ে থাকার কালেই চোখের কোণায় অশ্রুর কুণ্ডলী জমা হলো। আদরকে ভুলে যেতে হবে- এ কথা তো কল্পনাতেও আনা যায় না। আদরকে ভালোবাসার অধিকার তার থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। টিকলির এখন কি করা উচিত? এই জনবহুল রেস্টুরেন্টে প্রেমিকের মায়ের সামনেই হাউমাউ করে কাদা উচিত? তার পা ধরে বলা উচিত- ‘আমি আপনাদের দাসী হয়ে থাকবো তবুও এমন করবেন না।’ তাহলে কি বলা উচিত? কি বললে আদর-অধিকার শুধু তার হবে?

মনোয়ারা খানের মায়া হলো। তবে তার কিছু করার নেই। তিনি টায়রার দিকে তাকিয়ে কান্নারত অবস্থায় বললেন,

‘আমার আর্দ্রটাও ভালো নেই, মা। সরে যাও ওর জীবন থেকে। আর কক্ষনো কথা বলো না ওর সাথে। ওদের নতুন জীবনগুলো নিয়ে ওদের মতো করে থাকতে দাও। আমার সংসারটাকে বাঁচাও তোমরা। আমার ছেলেদের বাঁচতে দেও। সরে যাও তোমরা দুই বোন। দয়া করো, এই অসহায় মা টাকে।’

জগতের কোনোকিছুই যেনো টিকলির কর্ণগোচর হলো না। কানে তালা লেগে গেছে। পু’ করে বিকট ধ্বনির এক ধরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিকলির মনে হচ্ছে এ সবই অপার্থিব। এসব ঘটছে না। টিকলি কল্পনা করছে। শুধুই কল্পনা। এ সব তার হ্যালুসিনেশন। একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কয়েক মিনিট গড়িয়ে গেলো কিচ্ছু ঠিক হলো না। যেমন ছিলো তেমনি রইল সব। টিকলির কিছুই বলা হয়ে উঠলো না। হাউমাউ করে কাদা হলো না। পা ধরে অনুনয় সুরে অনুরোধ করা হলো না। স্থিত হয়ে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো সে। বাইরে নিজের ঠাট বজায় রাখতে গিয়ে এক ফোটা অশ্রু বিসর্জনও দেওয়া হলো না। দূর্বলতা প্রকাশ করার ইচ্ছে জাগলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। নিরব গলায় বলল,

‘টায়রা চল। বাসায় যেতে হবে তো! বাবা এক ঘন্টার মাঝে বাসায় যেতে বলেছে।’

টায়রা চমক দুটি চোখে টলটলে পায়ে টিকলির সাথে হেটে চলে গেলো। মনোয়ারা খান তখনও হাত জোর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েগুলো চলে যেতেই তিনি মুখে হাত দিয়ে কাদলেন। তিনি চাননি এই সুন্দর ফুটফুটে মেয়েগুলোর হৃদয়ের গভীরে আঘাত করতে৷ কিন্তু না চাওয়া জিনিস গুলোই চেয়েফেলা হয়। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে, ছেলেমেয়ের দিকে নজর দিয়ে, সুন্দর সংসারটা চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে সেই সংসারের হাল ধরতে নারীগণ অনেক সময় অলৌকিক শক্তি সঞ্চয় করে থাকেন। যেই হাতিয়ার শক্তিটির নাম ধৈর্য্য এবং চোখের অশ্রু।

আদর আর্দ্র যখন গাজীপুর থেকে বাড়ি ফিরে এলো। সকালে ছেলের ঘরে যেতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন ছেলে তার ফোনে টায়রার ছবি দেখছে। কালকে ছেলেকে ডাকার উদ্দেশ্যে ঘরে গিয়ে ফিরে আসার সময় কেদে কেদে ফোনে কথাও বলতে শুনেছেন। আদর বলেছিলো, বউ নিয়ে একাই সেটেল হবে। ঘরের বাইরে থেকে শুনেই মনোয়ারা খানের আত্মা ধক করে উঠেছে। এই এতো জুড় ঝামেলার মাঝে টিকলি টায়রাকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না তার। এখন অপেক্ষা এবং দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছু করার নেই। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক তবুও তার সংসার সুখের থাক। সংসারের জন্য তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বার্থপর হতেও রাজি আছেন। কিন্তু অবুঝ মহিলা এটা বুঝতে পারলেন না এতে তার সংসার আরো জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।

_________________________________

শেষ বিকালের আকাশে এক ঝাকঁ পাখি উড়ে গেলো উত্তর দিকে। উদাস চোখে সাথে বৈরাগী মনে জানালা গলিয়ে সবুজবীথি প্রকৃতি দেখছিলো টিকলি। পাশেই গভীর চিন্তায় টায়রা কপাল কুচকে বসেছিলো। খানিক বাদে এক পলক টিকলির দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরালো। অদ্ভুত! টিকলি কাদছে না। একটা কথাও বলছে না। আশ্চর্য বিষয়! টায়রা যতটা সম্ভব নিজের স্বভাব-সিদ্ধ গলায় বলল,

‘হাতে আছে আর মাত্র পাঁচদিন। কি করবি কিছু ভেবেছিস? ভাইয়াকে বলবি না?’

টিকলি উত্তর দিলো না। বিষন্ন মুখটায় যাতনা। চাপা অন্তর্বেদনার ক্লেশ। টায়রা বুঝতে পারছে এই এতো সুন্দর অরঞ্জিত নির্মল মুখটার পেছনের মর্মযন্ত্রণার মনস্তাপ। টায়রা ক্ষোভ ভাব নিয়ে মজা করার চেষ্টা করে এবার বলল,

‘সব দোষ ওই আকিদা ভাল্লুকিনীর। ঐ ব্যক্তি প্রথমে রাহুল ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য বাবা-মাকে উসকানি দিয়েছিলো। এই মহিলার মাথায় প্রচুর বুদ্ধি। কুটনি মহিলা। অসহ্য।’

টিকলি স্মিত হাসলো। কি আশ্চর্য ব্যপার! যে যত অন্যের ভুল ধরতে পারে, সমালোচনা করতে পারে, পট পট করে কথা বলতে পারে সমাজের ভাষায় সে তত বুদ্ধিমান। স্বল্পভাষী, অনধিকার চর্চা করে না, কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না এমন মানুষগুলোই সামাজিক ভাষায় বোকা। প্রকৃত অর্থে তাদের বুদ্ধি নেই। সহজ ভাষায় বুদ্ধিহীন জীব তারা!

শেষ বিকেল দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পক্ষীদের নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা দেখা গেলো। দূরের আকাশের ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা ভেসে উঠলো। প্রকৃতি নীল হতে হতে কালো আধারে ডুব দিলো তবুও টিকলি সেই স্থান থেকে নড়লো না। ঝিম মেরে একই স্থানে বসে রইলো।

রাত তখন আটটা। ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। এক ঝলক ফোনের দিকে তাকাতেই দেখা গেলো ‘বাদর ডাক্তার’ নাম ভেসে উঠেছে। টিকলি তাকিয়েই থাকলো। সেকেন্ড গড়ালো। মিনিট গড়ালো। পাঁচবার ফোন দেওয়া হয়ে গেলো। এরপর আর ফোন এলো না। মোবাইলের স্কিন কালো হয়ে গেলো। নিস্তব্ধ টিকলি তখনও তাকিয়ে থাকলো বোধবুদ্ধি নেই এমন ধারায়।

,

টিকলিকে ফোনে না পেয়ে আদর ভ্রু কুচকালো। এরকম তো কখনো হয়না। কপালে সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাঁজ ফেলে টায়রার নাম্বারে ফোন লাগালো।

টায়রা টিকলির পাশেই বসেছিলো। সবকিছু তার চক্ষুগোচর হয়েছে। আদর যে এবার তাকে ফোন করবে তাও ভেবে রেখেছিলো। মিনিট দুয়েক না গড়াতেই আদরের ফোন পেয়ে টায়রা বারান্দায় চলে গেলো।

‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি?’

‘ভালো আছি।’

‘টায়রা, টিকলি কোথায়? ফোন করলাম কিন্তু রিসিভ করলো না।’

‘আসলে…’

টায়রার তোতলানো দেখে আদর ভ্রু কুচকে বলল, ‘ইজ এভরিথিং অলরাইট?’

টায়রা ইতস্তত করে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি কি রিয়েক্ট করবেন বুঝতে পারছি না।’

আদরের কেমন যেনো লাগলো। ভীত গলায় বলল,

‘টায়রা হেয়ালি করো না। কি হয়েছে বলো?’

টায়রা চোখ মুখ কুচকে বলল, ‘টিকলির বিয়ে ঠিক হয়েছে ভাইয়া।’

আদর থমকে গেলো। থমকে দাড়ালো তার ঘোটা পৃথিবী। গোল গোল ঘুরতে লাগলো মাথা। মস্তিষ্কের নিউরন গুলোও অবাক হয়ে উঠে কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কেবল বলের মতো ঢপ খেতে লাগলো এই একটি বাক্য, ‘টিকলির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

আদর শূন্যে দৃষ্টি রেখে বিস্মিত গলায় বলল, ‘কি বলছো! বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? কবে? কার সাথে? উনি তো আমাকে কিছু বললেন না। টায়রা তুমি কি আমার সাথে মজা করছো? প্লিজ লক্ষী বোন এরকম মজা করো না।’

টায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘উত্তেজিত হবেন না ভাইয়া। পরিস্থিতি এখন আপনাকেই সামাল দিতে হবে। হাতে আর মাত্র পাঁচদিন সময়।’

আদর রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘পাঁচদিন মানে?’

‘পাঁচদিন পর টিকলির বিয়ে।’

আদর ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘আর তুমি আমাকে এখন বলছো? উনি কোথায়? আই ওয়ান্ট টু টক টু টিকলি।’

‘ভাইয়া আগে আমার পুরো কথাটা শুনুন। টিকলি আপনাকে বলতে চেয়েছিলো কিন্তু..’

আদর অধৈর্য্য গলায় বলল, ‘কিন্তু? কিন্তু কি? পাত্র কে? ডিটেইলস দেও।’

টায়রা চোখ বন্ধ করে মিনমিনে গলায় এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘পাত্র আমাদের মামাতো ভাই। নাম, রাহুল হক।’

আদর ভ্রু বাকালো, ‘রাহুল হক মানে? রাহুল হক মানে কি টায়রা?’

‘রাহুল হক মানে আমার মামাতো ভাইয়ের নাম।’

‘টায়রা আমার মেজাজ গরম। উল্টাপাল্টা কথা বলবা না। কোথায় থাকে এই ব্যক্তি?’

টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল, ‘আপনার বাসার উপরের তলার রাহুল ই আমাদের মামাতো ভাই। তার সাথেই বিয়ে।’

আদর স্থির কানে শুনলো। শুনা মাত্রই অচল হয়ে এলো হাত পা। যেনো অসাড় হতে লাগলো শরীর। প্রকৃতি হয়ে উঠলো শান্ত নিরব স্তব্ধ। স্থিতিশীল প্রকৃতিতে অদ্ভুত শব্দ করে উড়ে গেলো বাদুর। আকাশে জমাট বাধা কালো মেঘের দল আদরকে উপহাস করলো। কালো অশরীরীর ন্যায় গাছগুলো আদরকে ব্যঙ্গ করলো। ফাঁকা রাস্তাটা পর্যন্ত আদরের সাথে পরিহাস করলো। ঠাট্টা করলো। এ কোন রাহুল? এই রাহুলের বিয়েতেই কি আদর যেতে চেয়েছিলো? এটাই কি সেই রাহুল যাকে সে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতো? এটা কি সেই রাহুল যে আদরকে বড় ভাইয়ের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করতো! আদরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। বিরবির করে অনবরত বলতে থাকলো,

‘এসব কি শোনাচ্ছো তুমি টায়রা? এটা কীভাবে হতে পারে? রাহুল তোমাদের মামাতো ভাই? কীভাবে? আমাকে আগে কেনো জানাও নি? বিয়ে ঠিক হয়েছে তবুও আমাকে কেনো জানানো হয়নি?’

টায়রা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো বিকালের ঘটনা। মনোয়ারা খানের কাল কল করা। আজ দেখা করা। আদরের জীবন থেকে টিকলির সরে যেতে বলা সব বলল। সব শুনে আদর পাগলের ন্যায় ছুটে গেলো উপর তলায়। মায়ের সাথে বোঝাপড়াটা পরের জন্য তোলা রইল। এখন রাহুলের সাথে কথা বলা আবশ্যক। কিন্তু উপরে ব্যাচেলর বাসায় গিয়ে জানলো রাহুল বাসায় নেই। ফোন দিলে ফোন বন্ধ আসলো। একবার দুইবার দশবার তবুও একই কণ্ঠ একই কথা, ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।’

,

কলিংবেলের শব্দে শায়লা আক্তার সদর দরজা খুললেন। খুলে রাহুলকে দেখে চমকে উঠলেন। পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘বাবা তুই?’

রাহুলের মুখটা থমথমে। কালকের নিভার ঘটানো ঘটনা নিয়ে সে যথেষ্ট গম্ভীর। কোনোমতেই মাথা থেকে নামছে না ব্যাপারগুলো। তাই সেই বাসা ছেড়েই চলে এসেছে। মৃদু হেসে বলল,

‘ব্যাচেলর বাসা থেকে বিয়ে করবো নাকি? তাই এসে পড়লাম।’

‘ভালো করেছিস বাবা। কি খাবি বল?’

‘উমমম…. পোলাও, আলু ভাজি আর কালাভুনা খেতে ইচ্ছে করছে ফুপি।’

চলবে❤️

……..।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here