” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৯।
অন্তিম।
হৃদয় সারা ঘরময় পায়চারি করছে। অস্থিরতায় ধুপধাপ করছে তার ভেতরে। বিছানায় বসে নিহান ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে। বিগত এক ঘন্টা যাবত হৃদয় ছটফট করছে। কিন্তু মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। নিহানের বাড়ি ফেরার পর থেকেই তার এই অস্থিরতা। নিহানকে জোর করে বসিয়ে রেখেছে তার সামনে। বিরক্তিতে উঠে যেতে চাইলে আবারো বসিয়ে দিচ্ছে। খানিক বাদে সে নিজে এসেই ফ্লোরে নিহানের সম্মুখে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।
” তুমি আবারো আমায় ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছো? এমন করো না। দেখো না, আমি কিন্তু তোমায় কিছু বলিনি। রাগও করিনি। তোমার যেখানে যেতে মন চাইবে, যার সাথে যেতে ভালো লাগবে, যাবে। আমি কিছু বলব না। জিজ্ঞেসও করব না কোথায় গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে? শুধু আমায় ছেড়ে যেও না। আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। তুমি এখানে এসেছিলে বলে, আমি তোমার গিটার ভেঙে ফেলেছিলাম তাই তুমি রাগ করে আছো? আমি একই রকম গিটার আনিয়ে রেখেছি তোমার জন্য। আর কখনো তোমায় কষ্ট দেব না। তুমি যা চাইবে তাই হবে। তবু আমায় ছেড়ে যেও না। আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারি না বিশ্বাস কর। ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয় কলিজায় প্রতিনিয়ত কেউ জ্বলন্ত সিগারেট চেপে রাখে। হৃদপিন্ড দেহের ভেতর থেকে ছিঁড়ে নেয়। এভাবে বাঁচা যায় বলো? মৃত্যুর জন্য হাশফাস লাগে না? কিন্তু আমিতো বাঁচতে চাই। আমার একটু শান্তি চাই জান। গত পাঁচটা বছরের একটা দিনও আমি শান্তিমত ঘুমোতে পারিনি, নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। বিষাক্ত লাগে। আত্ম নিঃশ্বাস বিষাক্ত লাগার চেয়ে বড় নরকীয় যন্ত্রণা এই পৃথিবীতে হয় বলো? এভাবে আমায় নির্মম খুন করো না প্লিজ। তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমায় ছেড়ে যেও না। যা শাস্তি দেওয়ার আমার সঙ্গে থেকে দেওয়া যায় না?
হুট করে হৃদয় ওঠে দাঁড়ায়। জানকে টেনে বুকে নিয়ে নেয়। প্রচন্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেন বুকের পাজর ভেঙে ভেতরে লুকিয়ে রাখবে।
আমি তোমায় যেতে দেব না। আমি বাঁচতে চাই, জান। আমি বাঁচতে চাই। আর আমার বাঁচার জন্য তোমাকে চাই। তাই তোমায় থাকতে হবে। আমার হয়ে থাকবে হবে। ”
হৃদয় পাগলের মত নিহানের সারা মুখে চুমো আঁকছে। নিহান ছলছল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে। সে স্পষ্ট হৃদয়ের চোখে পাগলামি দেখতে পাচ্ছে। তীব্র ভালোবাসার পাগলামি।
——————————-
বধূবেশে জুঁই বসে আছে পিতৃলোকের নিজস্ব ঘরটায়। কত বছর পর সে এলো এখানে? বিয়ের পর তার আর এ বাসায় আসা হয়নি। এমনকি ডিভোর্সের পরেও না।
নির্মলতা পাশে বসেই টুকুর টুকুর চোখে একবার মায়ের দিকে, আরেকবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে। সেও আজ মায়ের মত সেজেছে। লাল পরী লাগছে তাকে। কাজী কিছু সময় পূর্বেই বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন করেছেন। আপাতত তাদের মা, মেয়েকে একা রেখে সবাই বেরিয়ে গেছে। খানিকবাদেই নিহান নোবাইদকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। নোবাইদের তৃষ্ণার্ত নয়ন জোড়া জুঁইকে দেখতেই শীতল হয়ে এলো। তার এত বছরের অপেক্ষা আজ পূর্ণতা পেয়েছে। তার প্রিয়তমা আজ তার বৈধ স্ত্রী।
নিহান নোবাইদকে জুঁইয়ের পাশে বসাতেই নির্মলতা নোবাইদের কোলে বসল। নোবাইদ একগাল হেসে মেয়ে দু’গাল চুমোতে ভরিয়ে দিলো। নিহান তিনজনের দিকে গভীর নয়নে তাকায়। তিনজনকেই আজ পরিপূর্ণ লাগছে। তৃপ্তির শ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। তিনজনের ব্যক্তিগত পরিবারের সময় প্রয়োজন যে।
নিহান একটু সামনে এগোতেই সাব্বির আর রিমান্তিকে দেখতে পায়। সাব্বিরের বুকের মাঝে থেকেই তাকে নিয়ে অভিযোগ করছে সে। সাব্বির হাসিমুখে তার মিষ্টি যন্ত্রণা সহ্য করছে। নিহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অবশেষে তার মিষ্টি বোনটাও ভালো আছে।
নিহান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ধীর পায়ে ছাদে প্রবেশ করল। তার কিছু কাজ এখনো যে অসম্পূর্ণ রয়েছে। ছাদের রেলিং ধরে উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে নোমান। নিহান পাশে দাঁড়াতেই মুচকি হাসল। কিন্তু ভাবমূর্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। নিহান চরম উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল,
” বড় ভাইয়াতো বিয়ে করে ফেলল। তুমি জুমাকে কবে আমার ভাবি বানাচ্ছো? ”
” জুমা কখনো তোর ভাবি হবে না। তবে তোর একান্তই ভাবির প্রয়োজন হলে মন মতো কাউকে পছন্দ করতে পারিস। তোর ভাইয়ের তোর পছন্দের উপর ভরসা আছে। ”
” আমারতো জুমাকেই পছন্দ। আমার পিচ্ছি ভাবি। ”
” তা কখনো সম্ভব না। ”
” কেন? ”
” তুই ভুলে গেছিস ও কী করেছিলো? ”
” ভুলিনি। ওর জায়গায় তুমি হলে কি করতে না? জুমা জানতো এটা করার পর তুমি তাকে কখনো আর আপন করবে না। তাও করেছে। ভাইকে কতোটা ভালোবাসলে নিজের ভালোবাসার বিসর্জন দেওয়া যায়? ”
” ওর এই ভাইয়ের ভালোবাসায় ভবিষ্যতে ও আবারো আমায় ছেড়ে যাবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? ”
” আমার ভালোবাসায় ভবিষ্যতে তুমি তাকে আবারো ফিরিয়ে দেবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? তুমি তাকে ছেড়ে যাবে জেনেও কিন্তু সে তোমায় ভালোবেসেছে। ভালোবাসায় গ্যারান্টি নামক কোন শব্দ থাকে না ভাইয়া। ভালোবাসা ভালোবাসাতে পরিপূর্ণ। ”
নোমান হতাশ নয়নে বোনের দিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে বোনকে বুকে টেনে নেয়। কপালে আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দেয়।
” এতোটা ভালো হতে নেই। ”
” হয়ে গেছি। এখনতো আর কিছু করার নেই। ”
নোমান নিঃশব্দে হাসল। বোনকে বুকের মাঝে রেখেই প্রশ্ন করল,
” তুই কি হৃদয়ের কাছে ফিরতে চাইছিস? ”
” ক্ষুদ্র হায়াতে কিছু অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তিতে পরিণত করাই যায়। আমার ক্ষুদ্র হায়াতের সঙ্গে যদি কারো আজীবনের সুখের কারণ জড়িয়ে থাকে, তবে আমি তাকে সেই সুখ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। ”
হৃদয় নিচে বসে আছে। চারপাশ থেকে তার ফ্যানরা তাকে ঘিরে রেখেছে। বিশেষ করে মেয়েরা। ক্রিকেটের সুপরিচিত মুখ হওয়ার সুবাধে বহু মেয়েই তার উপর ফিদা। কিন্তু সে ভয়ে আছে। নিহান এসব নিয়ে আবার কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে। হৃদয় ওদের সাথে কথা বলছিলো, তখনি সেখানে হাজির হয় নিহান। সবার দিকে সরোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, হৃদয়কে টেনে সেখান থেকে নিয়ে আসে। ঘরে এনেই দরজা বন্ধ করে দেয়।
” ওখানে কী করছিলেন? ”
” বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে যাইনি। ফেঁসে গিয়েছিলাম। তুমি প্লিজ ভুল বুঝো না। ”
হুট করেই নিহান তাকে জড়িয়ে ধরে। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকিছু তার কল্পনা অতীত।
” শুনুন, আমার সব আবদার পূরণ করতে হবে। অনেক ভালোবাসতে হবে। কখনো বকতে পারবেন না। আমায় ছেড়েতো কখনোই যেতে পারবেন না। ”
হৃদয়ের চোখ মুখে খুশি চিক চিক করছে। চোখের কোণেও জমে যাচ্ছে সে খুশি। খুশিতে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে তার পাখিটা পোষ মেনেছে। নিহান পুনরায় বলে উঠল,
” আমি আপনাকে কারো সাথে ভাগ করতে পারব না। আপনি আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। একান্তই আমার। ”
হৃদয় নিঃশব্দে হাসল। নিহানকে দুহাতে শক্ত করে আগলে নিয়ে বলে,
” ডাঃ নিহান তাহলে জেলাস? ”
” হ্যাঁ, হিংসা হয় আমার। আপনার কপাল বেয়ে পড়া ঘামের উপরেও আমার হিংসা হয়। কারণ তারা সারাক্ষণ আপনাতে লেপ্টে থাকতে পারে। আমি পারি না। ”
নিহান আরো শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। হৃদয়ের বেশ শান্তি লাগছে। সে বুঝতে পারছে, তার শূন্যতা আর নেই। নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।
” আমায় ক্ষমা করেছো? ভুলে গেছোতো সব? ”
” মানুষ বিপরীত প্রাণী। উপকারের চেয়ে অপকার বেশি মনে রাখে। সুখের চেয়ে বেশি দুঃখ আগলে রাখতে পছন্দ করে। ভুলে গেছি বললে মিথ্যা বলা হবে। সবটা মানিয়ে নিয়ে সুখী হওয়া যায় না।
সবটা উপেক্ষা করেও যায় না।
ভালো থাকতে হলে কখনো কখনো মানিয়ে নিতে হয়। ”
ডায়েরির বাকি অংশ খালি। আর কিছু লিখা নেই। ডায়েরি বন্ধ করে বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় নিবেদিতা। আজ থেকে সেও অষ্টাদশী নারী। প্রাপ্ত বয়ষ্ক। এই ডায়েরিটা ছিলো তার অষ্টাদশে পদার্পণের প্রথম পুরষ্কার। এই আঠারো বছরে তাকে তার মায়ের হাজার গল্প শোনানো হলেও এই ডায়েরি সম্পর্কে বলা হয়নি। অদ্ভুতভাবে আজ পর্যন্ত মায়ের কোনো ছবিও দেখেনি সে।
রাত তিনটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বাবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিবেদিতা। এতরাতে বাবাকে ডাকা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। তার ভাবনার মাঝেই ভেতর থেকে ভরাট গলায় কেউ ডেকে ওঠে।
” ভেতরে আয়, মা। ”
নিবেদিতা বিস্ময় নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
” তুমি ঘুমোওনি বাবা? ”
সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে ‘বেলা ফুরাবার আগে ‘ বই নিয়ে ইজি চেয়ারে বসেছিলো হৃদয়। মেয়ের আওয়াজে হাতের বইটা বন্ধ করে পাশের রাখে। চোখের চশমাটা বামহাতে ঠেলে ঠিক করে নেয়। চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে মেয়েকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে।
” তোরই অপেক্ষায় ছিলাম। আমি জানতাম তুই আসবি। বল কী জানতে চাস? ”
নিবেদিতার দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। ধরা গলায় বলে,
” আমি মাকে একবার দেখতে চাই বাবা। ”
হৃদয় নিবেদিতার হাত টেনে তাকে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে। হৃদয় আয়নার দিকে ইশারা করে বলে,
” এটাই আমার জান। তোর মা। ”
নিবেদিতা অবাক হয়ে দেখছে নিজেকে। ধীরে ধীরে নিজের আদলে হাত বুলায়। সবকিছু তার কাছে জলের মত স্বচ্ছ। সে হুবহু তার মায়ের মত দেখতে হয়েছে। এজন্যই তার নানু বাড়ির সবাই, মামারা তাকে এত আগলে রাখে। সবার চেয়ে বেশি চোখে হারায়। নির্মলতা বাবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে। মায়ের সিক্রেট চিঠিটা হাতে নেয়। এখনো এটা পড়া হয়নি তার। সে ব্যতীত এই চিঠি কারো ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই। এমনকি হৃদয়েরও না। নিবেদিতা চিঠির ভাঁজ ছাড়িয়ে পড়তে শুরু করে,
” আজ আমার অংশটার আঠারো বছর পূর্ণ হয়ে গেছে তাই না? আচ্ছা তুই ছেলে না মেয়ে হয়েছিস? ইশ! তোকে যদি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। তোকে চিনতে পারছি না বলে রাগ করিস না আবার। আমি জানি আমি তোকে দেখতে পাব না। না দেখেতো বলা যায় না তাই না?যাই হোস। তুইতো আমারি অংশ। আমার অসম্পূর্ণ জীবনের পূর্ণতা। তবে আমার বিশ্বাস তুই মেয়ে হবি। বাবার আদরের রাজকন্যা। বাবাকে ঠিক আমার মত করে সামলে নিবি। আজ তোর সাথে কিছু সিক্রেট শেয়ার করি। আমার আর তোর বাবার অভিমানের কথাতো তুই জানিস। এতদূরে থেকেও আমি তাকে ভুলতে পারিনি। প্রতিবছর ঠিকই তার জন্মদিনে চ্ট্টগ্রামে চলে আসতাম। লেকের ধারে লুকিয়ে তোর বাবাকে দেখতাম। কষ্ট হতো ভীষণ। কিন্তু তাকে মাফ করতে পারতাম না। নিজের মায়ের অপমান, এত সহজে কী ভুলা যায় বল? তারপর আমার অর্নাস শেষ হল। পরীক্ষা চলাকালীন আমার শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। পিরিয়ড হচ্ছিল না ঠিকঠাক। ডাক্তারের কাছে গেলাম। টেস্ট করালাম। তারপর সাদা কাগজের কিছু কালো কালি, আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে রেখে দিলো। ঠিক সাদা কাফনের মত। জরায়ুতে সমস্যা ছিলো আমার। অপারেশন করালে বাঁচার চান্স পাঁচ পার্সেন্ট। না করালে বড়জোর কয়েক মাস পৃথিবীর বায়ু আমার অক্সিজেন সরবরাহ করবে। তবে ভুলক্রমে কোনো সন্তান আমি গর্ভে ধারণ করতে পারব না। তাহলে তার জন্মের সাথে সাথে আমার মৃত্যু ঘটবে। নিজেকে তখন কতোটা অসহায় লাগছিলো জানিস। একজন নারীর কাছে মাতৃত্বেহীনটার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার কিছু নেই। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরব। আমার জন্য অনেকগুলো জীবন যে এলোমেলো হয়ে ছিলো। শেষ সময় গুছিয়ে না গেলে যে আমার পৃথিবীতে আসাই বৃথা। আর শেষ সময়টা নিজের মাতৃভূমির সংস্পর্শে কে না চায় বল? আমি তোর বাবার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ আমি তোর বাবার জীবনে না ফিরলে, তোর ফুফিদের ভালোবাসা যে পূর্ণতা পেতো না। কিন্তু তোর বাবার সাথে থাকতে থাকতে, তার পাগলামি আবারো তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলো। আরো সহস্র কোটি বছর তার সাথে বাঁচার ইচ্ছে করত। কিন্তু প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই অসহায়।
ডাক্তারের দেওয়া কয়েক মাসের সময়কে মিথ্যা করে গোটা দুইটা বছর পৃথিবীতে ছিলাম আমি। একমাত্র সবার ভালোবাসার জোরেই। তবে নিজেকে মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ থেকে আটকাতে পারিনি। কোন নারী পূর্ণতা চায় না বল? কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোকেই ছুঁয়ে দেখতে পারলাম না। আমার কাছে কেউ আমার প্রিয় রঙ সম্পর্কে জানতে চাইলেই আমি বলতাম, ‘ কাফনের রঙ। ‘ সেই ভালোবাসাই হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পূর্ণতা পেতে চেয়েছিলো।
এই, তুই কাদিস না কিন্তু। তোকেতো কাঁদলে চলবে না। আমার ভাগের ভালোবাসাগুলো সবাইকে দিতে হবে। আমার ভাইদের কলিজা তোর মাঝে, তোর বাবার জান তোর মাঝে। সবাইকে সামলাতে হবে যে তোকে। দেখ, মা কী স্বার্থপর। এইটুকু বয়সেই তোর উপর কতগুলো দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছি।
খবরদার কাউকে বলবি না এসব। অনেক কষ্টেতো সব ঠিক হয়েছে। এসব জানতে পারলে, ভাইয়ারা আবার তোর বাবাকে ভুল বুঝবে। তুইতো আমায় থেকেও বেশি স্ট্রং। একদম কাঁদবি না। সবসময় ভালো থাকবি। মা তোকে অনেক ভালোবাসে রে, সোনা। ‘
নিবেদিতা শব্দ করে কেঁদে ওঠে। এত মানুষের ভালোবাসাকে হারিয়ে তার মা চলে গেছে। তার মায়ের তোর জানাই হয়নি প্রকৃতি ঠিকই প্রতারণা করেছে। তার ভাইয়ারা ঠিকই তার স্বামীকে ভুলে বুঝেছে। নোমানতো নিবেদিতাকে প্রথম প্রথম সহ্যই করতে পারতো না। তার মামারা কখনো জানতে পারেনি, কী অসহ্য যন্ত্রণা, সীমাহীন কষ্ট নিয়ে মারা গিয়েছিলো তাদের বোন।
এত ভালোবাসায় পেয়েও তার মা পৃথিবীতে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছে। প্রতি মুহুর্ত মৃত্যুর প্রহর গুণা সহজ নয়।
হৃদয় বাড়ির পেছন দিকের কবরস্থানে বসে আছে। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর কবরটা জ্বলজ্বল করছে। বকুল ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারিপাশ। কবরের মাথার বকুল গাছের ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবরের চারিপাশে।এখানেই তার জানটা নিরবে শায়িত। সে আজও তাকে ছাড়া এক রাত ঘুমোয় না। যেতে যেতে তাকে বাঁচার কারণ দিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষটার স্মৃতি মুছেনি। হারিয়ে গিয়েও হারায়নি তার প্রাপ্তি। আজও তার জীবনের প্রতিটা প্রহর জানময়।
‘ তুমিই শূন্য, তুমিই পূর্ণ
তুমি আমার এক আকাশ, ভালোবাসার অরণ্য। ‘
তুমি আমার জমা সঞ্চয় বুক পকেটের
তুমি আমার আত্মার আত্মীয় খুব নিকটের।
তোমার আমার মাঝে আজও পার্থিব দূরত্ব
নির্ভুল যন্ত্রণার জাদু, ভালোবাসার গুরুত্ব
তুমি আমার কাছে বরাবরই অমূল্য দামি
তোমার মাঝেই আছি, তুমিময় আমি। ‘
সমাপ্ত