” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ৩।
সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যার হাতছানিতে এগিয়ে আসছে রাত, রাত থেকে গভীর রাত।
কুমিল্লা শাসনগাছার উত্তরা আবাসিক এলার চারতলা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল হৃদয়ের গাড়ি। বাবা- মা পৌছে গেছে সেই দুপুরে। তারপর থেকেই তাকে বেশ কয়েকবার কল করেছে নূরজাহান আহমেদ। হৃদয় তুলেনি। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কুমিল্লায় রওনা করলেও নানু বাড়ি সে আসেনি। গাড়ি নিয়ে চষে বেরিয়েছে চট্রগ্রামের অলি-গলি। বাঁধাধরা জীবন তার পছন্দ নয়। ট্রিপ ক্যান্সেল হওয়ায় তার মেজাজ খারাপ ছিলো। কিন্তু মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। কিছুটা সময় নিজের সাথে কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্যই একা বেরিয়ে এসেছিলো। এতগুলো বছর পর তিক্ততা নিয়ে সে এখানে আসতে চায়নি। এখন নিজেকে পাখির পালকের মতোই হালকা লাগছে।
বাড়িটা খুঁজে পেতে হৃদয়ের অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে। তিন বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে। শহরটা কেমন অচেনা। কিন্তু বাড়িটা সেই আগের মতোই আছে। হৃদয় কলিং বেল দিতেই দরজা খুলে দিলো একটা মেয়ে। তাকে দেখেই হাসিমুখে জড়িয়ে ধরল। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
” ভাইয়া, কেমন আছো? ”
” ভালো, পুঁচি। তুই কেমন আছিস? ”
” আমিও ভালো। ”
” মা, দেখো হৃদয় ভাইয়া এসে গেছে। ”
হৃদয় হাসিমুখে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল।
তখনি একজন মহিলা এগিয়ে এলো।
” কেমন আছিস? কত বড় হয়ে গেছিস। ”
হৃদয় লাজুক হেসে জবাব দিলো,
” ভালো। ”
” রাইসা, ভাইয়াকে ভেতরে নিয়ে বসা। ”
মেয়েটির উদ্দেশ্য বলল। উনি হৃদয়ের ছোট মামি। তখনি রান্না থেকে আরো এজন মহিলা বেড়িয়ে এলো। উনি হৃদয়ের বড় মামি।
” এতক্ষণ লাগে তোর আসতে? ”
” আর বলোনা বড় মামি, রাস্তায় এত জ্যাম! ”
মুহুর্তেই হুলস্থুল বেঁধে গেল। একে একে অনেকে এসে উপস্থিত হলো বসার ঘরে। হৃদয়ের নানার যৌথ পরিবার। দুই ছেলে, পুত্রবধূ, নানি নাতনিদের নিয়ে একসাথে থাকতেন। দুটি কন্যা সন্তান ও রয়েছে। যাদের যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। তারা এখন নিজ নিজ স্বামি সন্তানদের নিয়ে খুশি। হৃদয়ের বড় মামা আলমগীর হোসেন তার নানার ব্যবসা দেখাশুনা করেন। বড় মামার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে নোবাইদ ডাক্তারি পড়ছে। ছোট ছেলে অনার্স থার্ইড ইয়ারে পড়াশোনা করছে। একমাত্র মেয়ে নিহাতুল। ছোট মামা ইব্রাহিম, পেশায় রাজনীতিবিদ। এখানকার মেয়র তিনি। উনার দুই মেয়ে। রিমান্তি, রাইসা৷ রিমান্তি দশম শ্রেণিতে পড়ে, রাইসা চতুর্থ। হৃদয়ের খালামুনির আমেনার একমাত্র ছেলে আরমান। বর্তমানে দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে৷ নূরজাহান আহমেদ পরিবারের সকলের ছোট ছিলেন। হৃদয়ের নানা মারা গেছেন তিন বছর আগে। তার মারা যাবার বাইশ দিন পর তার নানুও মারা যায়। সেদিনই শেষবার হৃদয় এই বাড়ি এসেছিলো।
সবার সাথে কথা শেষ করে হৃদয় একেবারে খেয়ে উপরে চলে গেল। মাঝখানে নূরজাহান আহমেদ অবশ্য একটু বকাঝকার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু হৃদয়ের মামিদের জন্য তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। হৃদয় বিছানার উপর বসে ফোন ঘাটছিলো। তখনি তার পাশে ধুম করে বসে পড়ে রিমান্তি।
” কী করছ চকলেট বয়? ”
হৃদয় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
” এভাবে তাকানোর কিছু নেই, আমি জানি আমি সুন্দর। ”
” ঠিকঠাকভাবে কথা বল, তোর বড় ভাই আমি। ”
মাথায় মেরে।
” সবাই ভাই হলে প্রেমিক হবে কে? তোমাকে আমি ভুলের মাঝেও ভুল করে ভাই বলব না। ”
” এইটুকু মেয়ের কীসব কথাবার্তা! বড়দের সাথে এইভাবে কথা বলে? ”
” এমনভাবে বলছো, মনে হচ্ছে তুমি আমার নানার আব্বার বয়সী। মাত্র তিন বছরেরইতো বড়। ”
” তিন বছরের বড় কি বড় নয়? ”
” এত বড় বড় করো নাতো। নাহয় বাবাকে বলে বর বানিয়ে নেবো। তারপর সারাজীবন বুঝাব কত বড় তুমি। ”
হৃদয় বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। রিমান্তি সেদিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটেই বিছানার মাঝে হাত মেলে শুয়ে পড়ল। হৃদয় টেনে বসিয়ে দিলো।
” তুই, এখুনি আমার ঘর থেকে বেরুবি। রাইট নাউ। ”
” মোটেও না। ”
রিমান্তি আয়েশি ভঙ্গিতে পুনরায় শুয়ে পড়ল।
হৃদয় টেনে রিমান্তিকে দাঁড় করাল।
” সাধারণ জ্ঞান নেই তোর তা আগে থেকেই জানা। এখন কি লাজ- লজ্জাও সব বার্থরুমের কমোডে রেখে এসেছিস? ”
” লাজ- লজ্জা নেই তোমায় কে বলল? লজ্জার সময় ঠিকই লজ্জা আসে। তুমি কি আমায় আদর করেছ নাকি, যে লজ্জা পাব? ”
হৃদয় চোখ বন্ধ করে চোখে শ্বাস নিলো।
” বেহায়া মেয়ে, বের হয়। ”
রিমান্তির অপেক্ষা না করে হৃদয় নিজেই ঠেলে তাকে বাইরে বের করে দরজা ভেতর থেকে আটকে দিলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো জয়ী শ্বাস। এই মেয়ে মানেই তার কাছে আতঙ্ক। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। পরে মান- সম্মান নিয়ে টানাটানি লেগে যায়। সারাক্ষণ হৃদয়ের পেছনে পড়ে থাকে। এসব ভাবনার মাঝেই হৃদয় ঘুমে তলিয়ে গেল।
উচ্চশব্দে হৃদয়ের ঘুম ছুটে এলো। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসল। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই অবাক হলো। অনেকটা হইচই বেঁধে আছে। তার মামীরা রান্না ঘরে ব্যস্ত। সঙ্গে যোগ দিয়েছে তার মা, খালামুনি। বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। জুঁই থেকে শুরু করে জুমা অবধি সকলে ব্যস্ত। কেউ বেলুন ফুলাচ্ছে তো কারো ফানুসের আয়োজন চলছে। এতসবের মাঝে সেই একমাত্র ব্যক্তি যার কোনো কাজ নেই। এত আনুষ্ঠানিকতার আসল কারণ তার জানা নেই। আর না সে জানার আগ্রহ প্রকাশ করল। চুপচাপ সোফায় বসে সকলের কর্মকান্ড দেখছে। এমন সময় খাবার প্লেট হাতে সামনে এসে দাঁড়াল রিমান্তি। হাসি হাসি মুখ করে বলল,
” খেয়ে নেও। ”
হৃদয় ভ্রু কুচকে খানিকটা বিদ্রুপের স্বরে বলল,
” আমার জন্য? তা রাণীসাহেবা, হঠাৎ এত দয়ার কারণ? ”
” আমি এত ভালোবেসে তোমার জন্য খাবার বানিয়ে আনলাম, আর তুমি দয়া বলছ? ”
” তুমি বানিয়েছ? খাওয়া যাবেতো? ”
রিমান্তির মুখটা কালো আঁধারে ঢেকে গেল। মুহূর্তেই চঞ্চল মেয়েটার চোখে কোণে জমা হলো নীলজল।
হৃদয়ের খারাপ লাগল। হাত বাড়িয়ে বলল,
” দাও খাচ্ছি। খাওয়ার পরে ডায়রিয়া না হলেই হয়। ”
রিমান্তি হালকা হেসে প্লেটটা হৃদয়ের হাতে দিয়ে দিলো। হালকা ঝুকে ফিসফিস করে বলল,
” এখন থেকেই অভ্যাস করে নেও বরসাহেব। কয়দিন পর রোজ ডায়রিয়া হবে যে! ”
হঠাৎ উদয় হওয়া রিমান্তি হঠাৎই হারিয়ে গেল। হৃদয় হালকা হেসে খাওয়ায় মন দিলো। শ্যামবর্ণের ছিপছিপে গড়নের এই মেয়েটাকে মন্দ লাগে না। বড় বড় চোখ আর বোচা নাকের মঐি মেয়েটা তার আশেপাশেই মানায়। খাওয়া মাঝেই এসেই উপস্থিত হলেন ছোটমামি। আক্ষেপের সুরে বললেন,
” তুই উঠে গেছিস, আমি খেয়ালই করিনি। আসলে সকাল থেকেই অনেক ব্যস্ত। ”
” সমস্যা নেই, ছোট মামি। ”
” ঠিক মত খাওয়া শেষ কর। ”
এমন সময় রান্না ঘর থেকে বড় মামির ডাক।
” বনু, এদিকে আয় তাড়াতাড়ি। ”
ছোট মামিও বাধ্য মানুষের মত দ্রুত পা চালিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। এদের দেখলে কেউ বলবে না, এরা দুই জা। তার নানুমনি পরিবারটাকে একদম শক্ত হাতে গড়েছেন। তাইতো তাদের চলে যাওয়ার পরেও সবকিছু আগের মত রয়ে৷ গেছে। বরং এদের সম্পর্কে গভীর দৃঢ়তা এসেছে।
হৃদয় খাওয়া শেষ করে ছাদে চলে গেল। বিশাল ছাদের একপাশ কালোগোলাপের দখলে। কালো ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের কোনো ফুল নেই। তাকালেই কেমন চোখ ধাধিয়ে যায়। হৃদয় শেষ বার যখন এসেছিলো, তখন এ বাগান ছিলো না। শহরের সাথে সাথে বাড়িটাও তাহলে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ছাদ থেকে স্পষ্ট বাড়ির প্রবেশ পথ, প্রধান দরজা দেখা যায়। বাড়ির প্রধান দরজার সামনে জুমা আর রিমান্তিকে দেখা যাচ্ছে। দুজনেই বেশ উৎফুল্ল মনে গেইটের সামনে কিছু করছে। হৃদয় ছাদ থেকে নেমে তাদের সামনে গেল।
” কীরে, এখানে কী তোদের? ”
” তোমার আজ বিয়েতো, তাই গেইট সাজাচ্ছি। ”
রিমান্তির সহজ গলা। হৃদয় থমথম খেয়ে গেল। পাশ থেকেই জুমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হৃদয় বির বির করে বলল,
” তোর সাথে কথা বলা আর ঠান্ডার রাতে স্বইচ্ছায় পুকুরে গোসল করা, দুইটাই এক। ”
” এত কষ্ট করতে হবে না। বিয়ের পর আমি জল গরম করে দেবো। ”
রিমান্তি, জুমা দুজনেই সশব্দে হেসে উঠল। হৃদয় ওদের চোখ রাঙিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসল। ক্যান্টিন থেকে একটু দূরেই বিশাল বাগান। এই বাগানের পরিসীমা বাড়ির সামনের একপাশ থেকে পেছনের বিশাল জায়গা অবধি বিস্তৃর্ণ। এখানে বসলেই কেমন শান্তি লাগে। এই জায়গায় বসে তার নানাজান বিভিন্ন শালিস, বিচার করতেন। এখন অবশ্য ছোটমামা কাজে আসে। বেশিরভাগ সময়ই তার দলকর্মীদের নিয়ে এখানে তাকে আলোচনা বসে থাকতে দেখা যায়। হৃদয় কিছুক্ষণ এখানে বসে নিজের ঘরে চলে গেল। সূর্যমামা তেজি থেকে তেজি হলো। একসময় হেলে পড়ল। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল ধরা দিল। সারাটা সময় হৃদয়ের অলস ভঙ্গিতেই কেটে গেল।
চলবে,