গোধূলিলগ্ন ১৭

0
440

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৭

তৌসিফ সাহেব খবর পেয়ে ছেলেকে নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেন। কাব্যকে চিকিৎসাধীনে রেখে ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে এখানে সেখানে গিয়ে রক্ত,ইঞ্জেকশন, স্যালাইন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জোগাড় করছেন৷ রেখা বানু কেঁদে খুন ছেলের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে। ছেলের রক্তে শাড়ির এক পাশ ভিজে একাকার হয়ে আছে। রক্তে মাখা জায়গায় চোখ গেলে রেখা জোরে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠেন কিছুক্ষণ পর পর। বুকের মানিকের রক্ত দেখতে খুব বেশি কষ্ট হয় রেখার। সহ্য করতে পারছেন না উনি। রাতটা খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিল তৌফিক সাহেব ও রেখা বানুর জন্য। কম ধকল গেলনা তাদের উপর দিয়ে। সারারাত তারা দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি ছেলের শোকে। মাঝরাতে কাব্যর জ্ঞান ফিরলে সে তার দুর্বল শরীর নিয়েই মিতুকে দেখার জন্য,মিতুর কাছে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। তৌফিক সাহেব ছেলেকে বৃথা আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন,
‘সকাল হোক, আমি নিয়ে যাব মিতুদের বাড়ি।’ সেই মিথ্যে আশ্বাসের বলে কাব্য ধাতস্থ হলো বটে। ঠিক সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে ডাক্তার কৌশলে কাব্যকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেয়।
***
পরদিন কিছু মেয়েরা মিলে মিতুকে বউ সাজে সাজিয়ে তুলল। লাল রঙের বেনারসি,কপাল ভর্তি লাল-সাদা কুমকুম সাথে মুখ ভর্তি অন্যান্য সাজ। শরীরে স্বর্ণের গহনা ঝিলিক দিয়ে মিতুর সাজে অনন্যসাধারণ কিছু ছিটিয়ে দিচ্ছে। বউ সেজে নিশ্চুপ বসে আছে মিতু। ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে আশপাশটা পরখ করছে কিছুক্ষণ যাবৎ। তার চারিদিকে অসংখ্য মেয়েদের ভীড়। তারা যে যার মতো মিতুকে সুন্দরী, পরী,অপ্সরা আরও কতো কি বলে সম্মোধন করছে। মিতুর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে গভীর চিন্তায় মগ্ন তার কাব্য ভাইকে নিয়ে। বারবার চোখ বেয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে। বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে বুকের চিনচিন ব্যথা, হাহাকার প্রকাশ করতে পারছে না। বুক হাঁপড়ের ন্যায় ওঠা-নামা করে অসহ্যকর অবস্থা বানাচ্ছে। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় লাগছে মিতুর কাছে। মনে হচ্ছে কত কি যেন বোঝে সে। একদিনের ব্যবধানে অনেক কিছু বদলে গেল। মিতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই কত কিছু ঘটে গেল তার সাথে। বিশাল এক টর্নেডো বয়ে গেল যেন। যা মিতুর সব কিছু ওলট পালট করে দিল মুহুর্তেই। জীবনের মোড়টাই ঘুরে অন্যদিকে রূপ নিল। মিতু উপলব্ধি করছে, তার প্রতিটি কাছের মানুষ এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে তার থেকে। পুরনো মানুষদের অভ্যাস ত্যাগ করে নতুন মানুষের খোঁজে যাচ্ছে সে। সবই বুঝতে পারছে মিতু। তবে কিছুই করতে পারছে না। আবুল কালাম যে মিতুর চার হাতপা বেঁধে রেখেছে। আজ মিতুর সামনে পেছনের সকল দরজাই সর্বদার জন্য বন্ধ। বেরোবার সদর দরজায় প্রলেপ ছড়ানো পাকাপোক্ত ভাবে। যে প্রলেপ ভেদ করা মিতুর কাম্য নয়। অদৃশ্য চার দেয়ালের মধ্যে আটকে সে নিরুপায়। একবার তার কাব্য ভাইয়ের দেখা পেলে উঁকি দেওয়া চাতক পাখিরা শান্ত হতো। তবে এও হবার নয়। ভাবলেও মন কাঁদে মিতুর। শেষে তার কাব্য ভাই এমন খারাপ চরিত্রের বের হলো! চিন্তাটি মাথায় এলে প্রচুর ঘৃণা জন্ম নেয় মিতুর নির্মল মনে। ভাবতে ইচ্ছে করেনা কাব্যকে নিয়ে।

কিছুক্ষণ পর পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। সকলের মুখে একই ধ্বনি। আর সেটা হলো ‘বর এসেছে, বর এসেছে।’ মিতুর ছোট হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতে৷ সাথে সাথে আরো একটি শব্দ মিতুর কানে এলো। পুলিশ! বাড়িসুদ্ধ লোক বরকে দেখে যতটা না খুশি হয়েছে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি আতংক ছেয়ে গিয়েছে পুলিশ দেখে। তৌসিফ সাহেব তার ছেলেকে মারা এবং বাল্যবিবাহ দেওয়ার কঠিনতম অপরাধের জন্য আবুল কালামের নামে থানায় ডাইরি করেছেন। পুলিশ সর্বপ্রথম আবুল কালামকে ধরে৷ বাল্যবিবাহ দেওয়ার অপরাধে আবুল কালামসহ নুরুলকে যখন থানায় নিয়ে যাওয়ার উদযোগ বানান, ঠিক তখনই নুরুল পুলিশের সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য অনুরোধ সাধেন। পুলিশ এক অনুরোধে রাজিও হয়ে যায়৷ কথা শেষে পুলিশ নুরুল এবং আবুল কালামকে ছেড়ে দিল। পুলিশদের সাথে তৌসিফ সাহেবও এসেছেন। তিনি দারোগা সাহেবের মতিগতি বুঝে না উঠে জিজ্ঞেস করেন,
‘স্যার আপনি অপরাধীদের না নিয়েই চলে যাচ্ছেন কেন?’

মেইন অফিসার মুখশ্রী বিকৃত করে বললেন, ‘আপনি না জেনে শুধু শুধু মিথ্যে অভিযোগ কেন করলেন তাদের নামে?’

তৌসিফ সাহেব আশ্চর্যান্বিত হয়। তীর্থের কাকের ন্যায় চেয়ে থেকে বলেন,
‘স্যার কি বলছেন আপনি? আমি মিথ্যে অভিযোগ কিভাবে করলাম?’

‘আপনি কি নিজের চোখে দেখেছেন আপনার ছেলেকে আবুল কালামই মেরেছে? মানলাম মেরেছে। তবে মারলেও কেন মেরেছে? কারণটা না জেনে আবুল কালামের অ্যাগেইনস্টে অভিযোগ কিভাবে তুলে দিলেন শিক্ষিত লোক হয়ে?’

‘স্যার পুরো গ্রামের লোক জানে সে আমার ছেলেকে মেরেছে। আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন সকলকে।’

‘গ্রামের লোকের খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই। তারা আমকে জাম বানাতে দু মিনিটও লাগায় না। বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা না পাকিয়ে চলুন এখান থেকে। আপনি সম্মানিত একজন ব্যক্তি। আপনাকে এসব মানায় না। আপনার ছেলে তার দোষের জন্যই মার খেয়েছে। অন্যের মেয়েকে উত্যক্ত করলে মার খাবে না তো কি রাজভোজ খাবে আপনার ছেলে? অনেকদিন ধরে আপনার ছেলে ওই মেয়েটির পেছনে পড়ে ছিল। মেয়ের বাবা অতিষ্ঠ হয়ে বিয়ে দিচ্ছিলো অমনি আপনার ছেলে জোরপূর্বক মেয়েকে নিয়ে পালাতে চায়। মেয়েটি তো রাজিও ছিল না। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা পর্যন্ত করছিল। এসব দেখে আবুল কালাম এগিয়ে যান মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য। বাবা হিসেবে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকা তো সম্ভব নয়। তাই উনি ওনার জায়গায় সঠিক। আমার মতে কেস আপনার ছেলের নামে ঠুকে দেওয়া দরকার। তবে আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি বলে আপনার ছেলেকে আরেকটা সুযোগ দিলাম। নইলে আপনার ওই কুলাঙ্গার সন্তানকে রিমান্ডে ফেলে এই জঘন্য কাজের শাস্তি দিতাম। কি ছেলে জন্ম দিয়েছেন আপনি? শিক্ষিত বাপের সন্তান এমন হওয়ার কারণ কি? ছেলের খেয়াল রাখতে পারেন না আপনি? আপনাদের মতো শিক্ষকদের হাতে নাকি আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তবে মজার বিষয় হলো, আপনি নিজের ঘরের সন্তানকেই সঠিক শিক্ষা দিতে জানেন না। এতে করে বুঝলাম, আপনার শিক্ষক হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো যোগ্যতা নেই। এবার চলুন এখান থেকে!’ পুলিশ কর্মকর্তার ব্যঙ্গাত্মক কথা সরাসরি তৌসিফ সাহেবের সম্মানে আঘাত হানে। এই প্রথম তার দিকে শিক্ষা, যোগ্যতা নিয়ে কেউ আঙুল তোলার সাহস পেল। অপমানে তৌসিফ সাহেবের মাথা হেঁট। আপাদমস্তক কেঁপে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হ্রাস পাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে সে অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে পালিয়ে যাবার পাত্র নয়। এই ভেবে অপমান ভুলে বলেই বসে,
‘স্যার আপনি অন্যদের কথায় কান না দিয়ে আমার সাথে হাসপাতালে চলুন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার ছেলে অন্তত মিথ্যে কথা বলবে না। আপনি প্রমাণ না খুঁজে এভাবে চলে যেতে পারেন না। আমার ছেলে ভুল কিছু করেছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। আপনি তার কথাগুলো দয়া করে শুনুন তারপর নাহয় আরোপ দিয়েন। তাছাড়া এখানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এটা নিয়ে কোনো স্টেপ না নিয়েই বা আপনি কিভাবে চলে যাচ্ছেন বুঝলাম না আমি!’
পরমুহূর্তে পুলিশ কর্মকর্তার ঝাঁজালো কন্ঠস্বর তৌসিফ সাহেবের দিকে তাক হলো।
‘একদম চুপ করুন আপনি। এখানে কোনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে না। মেয়ের পরিণত বয়সেই বিয়ে হচ্ছে। আমাকে মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট দেখিয়েছে মেয়ের বাবা। সেখানে মেয়ের বয়স ১৯ দেখাচ্ছে। আপনি অযথা আমাদের সময় নষ্ট করলেন। আমাদের ফালতু সময় নেই। আর ঝামেলা না পাকিয়ে চলুন এখান থেকে। নইলে আপনাকেই সাথে করে নেব অযথা কারো বিয়েতে ঝামেলা করার অভিযোগে।’

বেশ ধমকের সুরে বললেন পুলিশ কর্মকর্তা। তৌসিফ সাহেব প্রথমে না বুঝলেও পরবর্তীতে ঠিক ধরতে পারেন যে এখানে অন্য কোনো কারসাজি রয়েছে। দারোগা সাহেব যে আলাদা কথা বলতে গিয়ে ঘুষের স্বীকার হয়েছেন, সেটা তৌসিফ সাহেবের একটুও বুঝতে সমস্যা হলো না। তাই তিনি আর বাড়তি কোনো কথা না বলে মাথা নুইয়ে সেই জায়গা ত্যাগ করলেন। সেখানে থেকে যে তার কোনো লাভ হবে না, সেটা তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন। সেই সাথে ধিক্কার জানালেন এসব মুখোশধারী দালাল পুলিশ নামক অফিসারদের। ঘৃণা ছুড়লেন নুরুল ও আবুল কালামের মতো মানুষ নামের কিছু অমানুষদের দিকে।
***
বিয়ে সম্পন্ন হলে নুরুল বউ নিয়ে রওনা দিল নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। এদিকে সেতু বালিশে মুখ চেপে কেঁদে চলেছে অনবরত। সেতু ইচ্ছে করেই বিয়েতে যায়নি। কারণ এই বিয়েতে তার বিন্দু পরিমাণ মত নেই। সেতু অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে মিতু ও নুরুলের বিয়ে ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। তাই রাগ করে বিয়েতেও যায়নি। এক প্রকার জেদ দেখিয়ে শ্বাশুড়ি, স্বামী, বাবা-মার সঙ্গে যুদ্ধ করেই যায়নি সে। এর জন্যেও নানান কথার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। এছাড়াও বিয়েতে না যাওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ হচ্ছে ঘৃণা। ইতোমধ্যে সেতুর মনে তার পিতা-মাতাকে নিয়ে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। সেতু আর জীবনেও এমন লোভী বাবা-মাকে, বাবা-মায়ের স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। সে চায়না আবুল কালাম ও রুপালির মুখোমুখি হতে। মরার আগ পর্যন্ত সে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে। এই আশায় মনকে শান্তনা দিচ্ছে অনবরত। আজ তার প্রতিটি চোখের পানি সে সযত্নে তুলে রাখলো সুবর্ণ কোনো দিনের অপেক্ষায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here