গোধূলিলগ্ন ১৬।

0
405

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৬

খানিক বাদে বাদে তৌফিক সাহেব হিসহিসিয়ে কি যেন বলছেন নিজেকে নিজেই। মেজাজ তার মাথায় চড়া। শরীর ভালো না বিধায় বিদ্যালয়ে আজ যাওয়া হলো না তার। মস্ত পাকা দালানের নিজ ঘরের বারান্দায় বসে খবরের কাগজের একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছেন খড়মড় শব্দ তুলে৷ রেখা বার কয়েক উঁকি মেরে দেখে যাচ্ছেন স্বামীর অস্থির কার্যকলাপ। মাথায় প্রশ্নের পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু চিন্তাভাবনার জের ধরে। ইতস্ততভাবে কদম এগিয়েও পেছান রেখা। তা কেন? ভয়ে নাকি সংকোচে, রেখা ভেবে পান না। হঠাৎ উষ্ঠা খেতে বিকট শব্দ উৎপন্ন হলো। ফলে তৌফিক সাহেবের হতচকিত চোখ জোড়া বারান্দার দরজায় গিয়ে থামলো। তিনি মস্তিষ্কে তৈরিকৃত প্রশ্নটি রেখার দিকে ছুড়ে দেন তৎক্ষনাৎ। ‘এভাবে চলাফেরার মানে কি রেখা? তোমার কি এই বয়সে লাফালাফি করার সময়?’

রেখা আমতা-আমতা করে জবাব দিলেন,
‘মাফ করবেন। আসলে আপনাকে চিন্তিত দেখে চিন্তা হলো আমারও। জিজ্ঞেস করবো করবো করেও পেরে উঠছিলাম না।’

‘এখনো আমাকে এত বেশি ভয় পাও কেন তুমি? নির্দ্বিধায় বলে ফেললে সমস্যা কোথায়?’

রেখার সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি, ‘শ্রদ্ধা করি আপনাকে। তাছাড়া চাইনা আপনার কাজে আমার দ্বারা ব্যাঘাত ঘটুক। বলুন দেখি আপনার মাথায় কিসের এত চিন্তা খেলে বেড়াচ্ছে?’

তৌসিফ মুখ বেজার করলেন। কন্ঠ ছোট করে বললেন, ‘গ্রামের লোজেদের কাজকর্ম আর ভালো লাগছে না। দিনকে দিন অনাচার বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে হৃদয়হীন কিছু ক্রিমিনাল। বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, যৌতুক, নিজের খেয়ে নিজের পড়ে অন্যের পেছনে লাগা- এসব দেখে শুনে আসতে আসতে দম আটকে এসেছে আমার। আমি আর পারছি না এসব দেখতে। সেদিন নয়না নামক মেয়েটির বিভৎস মৃত্যুটা আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে। যদি মেয়েটা আমার সন্তান হতো, তাহলে আমি কিভাবে শান্ত হতাম? আদৌ নিজেকে সামলাতে পারতাম কি না সন্দেহ স্পষ্ট।’

‘তা-যা বলেছো কাব্যর বাবা। কিন্তু আমরা যে সাধারণ মানুষ। আমাদের বিচার নেই। আমরা সৎ তাই পারিনা আইনের নিয়মমাফিক তাদের চাহিদা পূরণ করতে। অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়েও দিতে হচ্ছে আমাদের। কারণ আমরা যে ঘুষের নাম অবধি মুখে আনতে লজ্জা পাই। আর গরীব মানুষের কথা নাই বললাম৷ কারণ তাদের তো সামর্থ্যই নেই ঘুষ প্রদানের।’

‘একদম উচিত কথা বললে রেখা। সঠিক সুশাসন প্রয়োজন যা শিক্ষার মান ব্যতীত অসম্ভব। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেকাংশ কাজে করেও দেখিয়েছি। এখন সঠিক সময়ের পালা শুধু।’

‘কি সেটা?’ প্রশ্ন ছুড়ে রেখা।

‘এখানকার বিদ্যালয়ের চাকরি ত্যাগ করে শহরে বদলির আবেদন দিয়ে দিয়েছি। খুব শীঘ্রই এই গ্রাম ছাড়বো আমরা। নইলে গ্রামের পরিস্থিতি! বুঝলাম এ গ্রামে থাকলে, ছেলে আমার ছুটবে বিষাদময় মরীচিকার পেছনে।’

‘সে কি? কাব্য জানলে বাড়ি মাথায় তুলবে৷ যেতে চাইবে না সে কোনভাবেই।’

‘জন্ম আমি দিয়েছি। তাই তার প্রতিটি ধাপের দিক-নির্দেশনাও আমি দেব। সে কেউ না তাকে নিয়ে ভাবার। সে এখবো বুঝদার নয়। বুঝলে রেখা?’

‘কিন্তু কাব্যর বাবা….?’

‘কোনো কিন্তু নয়, আমি যা বলবো তাই হবে। আমি এখনো জীবিত তাই আমার কথাই শেষ কথা।’

তৌসিফের জোড়ালো ধমকের বলে রেখা বানু চুপ হতে বাধ্য হলেন।
***
খুব তোড়জোড়ে মিতু আর নুরুলের বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। ওইদিকে কাব্য মিতুর বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকে দিশেহারা প্রায়। কোনভাবেই সে মিতু অবধি পৌঁছে উঠতে পারছে না। মিতুও তার কাব্য ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য, তার সাথে জমা কথাগুলো ভাগ করার জন্য আকুল হয়ে আছে। আগামীকাল বিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী আজ মিতুর গায়ে হলুদ হওয়ার কথা। ওইদিকে নুরুলদের বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে মিতুদের এখানে তেমন কোনো আয়োজন নেই। কারণ মিতুরা অজপাড়া গাঁয়ের লোক। এখানে বিয়ের দিন কনেকে গোসল করানোর আগে গায়ে হলুদ দিয়ে একেবারে গোসল করিয়ে বিয়ের সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। যুগে যুগে এটাই হয়ে এসেছে।

বিয়ের আয়োজনে লেগে আছে অনেকেই। আবুল কালাম বাঁশ গেড়ে বসে মিতুকে পাহারা দেন। মিতু নুরুলদের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে এক পাও বাড়ির বাহিরে রাখতে পারেনি। কারণটা অবশ্য আবুল কালাম। তিনি মিতুকে দেখে রাখবে বলে কাজে যায়না কয়েকদিন। একেবারে মিতুকে বিদায় করেই কাজে যাবে সে। তিনি বেশ ভয় দেখিয়ে বাড়িতে আটকে রেখেছেন মিতুকে। তার কড়া নজরদারির প্রকোপে মিতু সামান্যটুকু ফাঁক পাচ্ছে না বাড়ির বাহিরে পা ফেলার। মিতু সাধারণত সালোয়ার কামিজ পরে। কিন্তু আজ তাকে শাড়ি পরানো হয়েছে। লাল রঙের ছাপা টাঙ্গাইলের শাড়ি। শাড়িটা পরানোর কারণ অভ্যাস করানো। আগামীকাল যাতে বেনারসি পরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারে, এই উদ্দেশ্যে রুপালি তার একটা শাড়ি পরিয়ে দিলেন মেয়েকে। মিতু এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। তাই তার একটু বেশিই অসুবিধা হচ্ছে। বার দুই হোঁচট খেয়ে পড়েও গিয়েছিল। শাড়ি পরাতে বেশ লম্বা লাগছে মিতুকে। মিতুর হাইট ভালোই। তবে বাচ্চাসুলভ চেহারার গড়ন হওয়ায় তেমন বোঝা যায়না উচ্চতা। ঘরের ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিয়ে দেখছে মিতু। মিতুর উদ্দেশ্য যে কোনো ভাবে আবুল কালামের চোখে ধুলো দিয়ে বাহিরে বের হবে। শেষবারের জন্য হলেও তার কাব্য ভাইয়ের সাথে কথা বলবে। কিন্তু কিছুতেই সুযোগ হয়ে উঠছে না তার। যদি কখনো আবুল কালাম এদিক সেদিক যায়ও, তবু্ও কেউ না কেউ মিতুর আশে পাশে থাকবেই থাকবে৷ খানিক পর মিতু সুযোগ পেয়ে সকলের অগোচরে বাহিরে আসতে সফল হলো।

দুপুর বেলা। এখন কাব্য নদীর ঘাটে নাও থাকতে পারে। তাছাড়া এখন ঘাটে মানুষের অভাব নেই। এই ভেবে মিতু আর নদীর ঘাটে গেল না।

‘ওই মিরাজ! হুইন্যা যা একটু।’

মিতু একটা হাফ প্যান্ট পরিহিত ছেলেকে দেখে ডাক দিল। ছেলেটির বয়স হবে আট কি নয় বছর।
মিরাজ নামের ছেলেটি তার বন্ধুদের সাথে লাটিম দিয়ে খেলছিল। মিতুর ডাকে খেলা থামিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর সামনে ও নিচের দুই পাটির দাঁত বের করে বলল, ‘মিতু বুবু তোমার না কাইল বিয়া?’

‘হ রে, আমার কাইল বিয়া। তুই যাইস আমার বিয়া খাইতে। এহন একটা কাজ কর ভাই।’

‘আমি খেলতাছি। আমি এহন কাজ করতে পারুম না।’

‘আইচ্ছা তাইলে বিয়া খাইতেও পারবি না। কাইল দূর দূর কইরা তাড়ায় দিমু তোরে।’

মিরাজ হাত দুটি নাচিয়ে বলল, ‘না, না আমি করুম তোমার কাজ। কও কি করা লাগবো।’

‘তুই আমাগো ইশকুলের হেড মাস্টারের পোলারে চিনোস না?’

মিরাজ মাথা ঝাকালো। বলল, ‘হ চিনি কাবু ভাইরে।’

‘ভেড়ার পশম ওইডা কাবু ভাই না, কাব্য ভাই। বল কাব্য ভাই।’

‘হ, হ কাবু ভাই জানি তো।’

‘ধুর তোর যা ইচ্ছা তাই কইস। এহন তুই গিয়া হেরে কবি গাঙের পাশের কলা বাগানে আইতে। মিতু বুবু আইতে কইছে।’

‘হেয় তো তুমাগো বাইত্তের রাস্তাডায় আছিলো দেখছিলাম।’

‘কহন দেখছিলি?’

‘মেলাক্ষণ আগে।’

‘কই আমিতো দেহি নাই। মনে হয় গেছেগা। তুই যা ভাই একটু গিয়া খবরখান পৌঁছা তার ধারে।’

‘যাইতাছি কিন্তু আমারে কাইল পেট ভইরা খাওয়াইতে হইবো?’

‘আইচ্ছা তুই খাইস কাইল। এইবার যা। আমিও যাই কলা বাগানে।’

মিরাজকে পাঠিয়ে মিতুও স্থান ত্যাগ করল। আগের মতো ঝড়ের বেগে দৌঁড়াতে পারছে না শাড়ির জন্য। বারবার বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও কোনমতে গিয়ে পৌঁছালো। মিনিট দশেক পর কাব্যও চলে এলো কলা বাগানে। একদম পাগলের মতো ছুটে। খুব অস্থির আর বিচলিত সে। চোখ মুখ ফোলা সাথে ফ্যাকাসে। মিতু কাব্যকে দেখেই বলে ওঠে,
‘তোমার কি হাল হইছে কাব্য ভাই? কয়দিনে চেহারার কেমন হাল বানাইছো তুমি?’

কাব্য কিছু না বলে মিতুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। মিতু কাব্যর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কাইন্দো না কাব্য ভাই। কাইল আমার বিয়া। তুমি আমারে হাসি মুহে বিদায় দেও। নাইলে আমি যে ভালো থাকতে পারুম না শ্বশুরবাড়ি যাইয়া।’

কাব্য কথাটা শুনে মিতুকে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে আসলো। ভাঙা গলায় বলল,
‘তুই আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারলি মিতুবুড়ি? তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কিভাবে ভাবতে পারলি? কিভাবে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিতে পারলি? কিভাবে স্বার্থপরের মতো আমাকে মরণ যন্ত্রনা দিয়ে নিজে সুখ খুঁজে নিলি? বল কিভাবে?’ কাব্য এমন অনেক প্রশ্ন ছুড়ে দিল মিতুর দিকে।

‘কাব্য ভাই তুমি এইগুলা কি কইতাছো? আমি কি করছি তোমার লগে? আমি শ্বশুড়বাড়ি চইল্যা যামু দেইখ্যা তুমি রাগ করতাছো? বিয়া হইলে তো সব মাইয়াই শ্বশুরবাড়ি চইল্যা যায়। বাপের বাড়ি পইড়া থাকে না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি কয়দিন পর পর আমু এইহানে। তহন সবার আগে তোমার কাছেই ছুইট্টা যামু।’

কাব্য এক প্রকার ধমকের সুরে বলল,
‘চুপ! অনেক বলেছিস তুই। আর না। এসব নাটক বাদ দে। তোর বিয়ের বয়স হয়নি এখনো। তুই তোর বাজানকে গিয়ে বল তুই এখন বিয়ে করবি না।’

‘না আমি বিয়া করমু। তুমি জানো না কাব্য ভাই, আমি বুবুর শ্বশুরবাড়িতে কত ভালো ভালো খাওন খাইছি। কত সুন্দর বাইত্তে ঘুমাইছি। আমার যার লগে বিয়া হইতাছে, হেয় অনেক বড়লোক। আমার লাইগ্যা অনেক কিছু কিন্যা পাডাইছে।’

‘তুই এগুলো কি বলছিস মিতু? এসবের জন্য তুই বিয়ে করছিস? তুই বুঝতে পারছিস না তুই কত বড়ো একটা বিপদের মুখে পড়তে চলেছিস। এখনো সময় আছে বিয়ের জন্য না বলে দে।’

মিতু বলল, ‘না কইছিলাম আগে। কিন্তু বাজান কইছে আমি বিয়া না করলে আমারে মাইরা ফেলাইবো। বাসায় রাখবো না।’

‘আমি আব্বুর সাথে কথা বলেছি। আব্বু তোর বাজানকে বোঝাবে আজ। তোর এখন পড়াশোনা করার বয়স। বিয়ে করার না। ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দিতে নেই। কোনো অভিভাবক যদি ১৮ বছরের আগে তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেই অভিভাবকদের শাস্তি দেবে পুলিশ। কারণ সরকার বিয়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা দিয়ে রেখেছে। সরকারের বানানো এই নিয়ম অমান্য করা আইনত অপরাধ।’

‘আমি জানি না হেইডা। যাই হইয়া যাক না ক্যান, আমি বিয়া করুম কাব্য ভাই। তুমি তো জানো আমার বাজানের ঘাড়ে কিস্তির চাপ। আমার যার লগে বিয়া, হেয় কইছে ২লাখ টাকা দিব আমার বাজানরে। তুমি কও ২লাখ কি কম টাকা?’

‘কিহ! টাকার লোভ দেখিয়ে বিয়ে করছে লোকটি?’

‘লোভ না কাব্য ভাই। বাজান কইছে হেই টাকা দিয়া কিস্তি থেইক্যা মুক্তি পাইবো৷ আমি তার লাইগ্যাই রাজি হইছি। আর ওইহানে আমার বুবুও আছে। মায় কইছে দুই বোন মিল্লা সুখে সংসার করমু। বুবু আছে বইল্যা আমার একা একা লাগবো না সেইহানে। তুমি খুশি হও নাই কাব্য ভাই?’

কাব্য এবার চিৎকার করে বলল, ‘না আমি খুশি হইনি। আমি কিভাবে বোঝাবো তোকে? কি করলে তোকে আটকে রাখতে পারবো নিজের কাছে? বল আমায়? আমি তাই করি।’

‘তুমি এমন কইরা কইতাছো ক্যান? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। কাইল আমি বউ সাজুম। তুমি তো আমারে বউ সাজে দেখতে চাইছিলা। দেখছো তোমার ইচ্ছাডা কতো জলদি পূরণ হইতাছে! কাইল তাইলে আমারে দেখতে আইবা। বাজান কিছু কইবো না কাইল চিন্তা কইরো না।’

‘বউ! তুই বউ সাজবি? কার জন্য সাজবি তুই? আমার জন্য তো সাজবি না। তুইতো অন্য কারো জন্য বউ সাজবি। আমি যে তা চাইনা মিতুবুড়ি। তুই শুধু আমার। শুধুই আমার মিতুবুড়ি। তোকে শুধু আমার ছোঁয়ার অধিকার আছে। আর কারো না। আমি তোকে অনেক বেশি ভালবাসি মিতুবুড়ি।’

কাব্য কাঁদছে তো কাঁদছেই। তার চোখ যেন বাঁধ মানছে না। কলিজা যেন ছিড়ে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে বারংবার।

‘তুমি আর কাইন্দো না কাব্য ভাই। আমিও তোমারে অনেক ভালবাসি। তোমার কথা অনেক মনে পড়বো আমার। তুমি ভাইবো না আমারে নিয়া। আমার বুবু আছে তো ওইহানে।’

‘তুই কেন বুঝতে পারছিস না আমার কথা? তুই যেই ভালবাসার কথা বলছিস, আমি সেই ভালবাসার কথা বলছি না। আমি তোকে মন থেকে ভালবাসি। মানে তোকে আমার বউ বানাতে চাই। আমার ঘরের বউ হবি তুই। আর কারো না।’

শুনে মিতুর শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। কান পঁচা মুখ করে বলে,
‘ছি কাব্য ভাই! তুমি এইগুলা কেমনে কইতে পারলা? তোমারে তো ভাই কই আমি। বাজান ঠিকই কয়। তুমি একটা খারাপ পোলা। এতদিন আমি বুঝতে পারি নাই সেইডা। কিন্তু আইজ বুঝলাম। তোমার পেটে পেটে তাইলে এইগুলা আছিল?’

‘তুই আমাকে যা ভাবার ভাবতে পারিস। আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাও বিয়ে করিস না। আমি বাঁচতে পারবো না তোকে ছাড়া। তুই আমাকে কটা বছর সময় দে শুধু। দেখবি আমিও একদিন অনেক টাকা রোজগার করবো৷ তোকে অনেক ভালো রাখবো। কিন্তু আমার যে তার জন্য সময় লাগবে।’

‘আমি তোমার সাথে আর একটা কথাও কইতে চাইনা কাব্য ভাই। আইজ থেইক্যা আমি ভুইল্যা যামু তোমারে। আমি ভুইল্যা যামু কাব্য নামের কাউরে আমি ভাই কইতাম। আমি আর তোমার মুখ দেখতে চাইনা।’ বলে মিতু চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু দু কদম যেতেই কাব্য মিতুর হাত ধরে ফেলল শক্ত করে। মিতুর প্রচুর রাগে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়।
‘আমার হাত ছাড়ো কাব্য ভাই। আমারে যাইতে দেও কইতাছি।’

‘আমি তোকে যেতে দেবনা মিতুবুড়ি। আমি তোকে কিছুতেই যেতে দেব না। তোকে অন্য কারো হতেও দেব না। কিছুতেই না। আমার দেহে প্রাণ থাকতে তো না-ই।’

কাব্য কিছুতেই ছাড়ছে না মিতুকে। মিতু ভয়ে শেষে কেঁদেই দিল। এদিকে আবুল কালাম তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো মিতুকে। পুরো গাঁয়ে মিতুকে খুঁজে না পাওয়ার কথাটা ছড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। আবুল কালাম মিরাজের থেকে জানতে পারলো মিতু কাব্যর সাথে কলা বাগানে আছে। এটা শুনে আবুল কালামের চোখে রক্ত জমে যায়। তিনি গাঁয়ের কয়েকজন লোক নিয়ে ছুটে এলো কলা বাগানে। এসে দেখলো মিতুর হাত ধরে কাব্য টানাটানি করছে। আবুল কালাম হুংকার দিয়ে বজ্রকণ্ঠের ন্যায় আওয়াজ তুলে বলে ওঠেন,
‘মিতু! তোর কইলজা আইজ কাইট্টা এই গাঙে ভাসায় দিমু আমি।’

মিতু আবুল কালামকে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগে। কাব্য আবুল কালামকে দেখা মাত্র সাথে সাথে মিতুর হাত উন্মুক্ত করে দিল। আবুল কালাম গিয়ে মিতুর খোলা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে টান দিল সজোরে। মিতু আঁতকে উঠে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, ‘আমারে মাফ কইরা দেও বাজান। আমি বাইত্তেই যাইতাছিলাম, কিন্তু,,,।’

‘চুপ কর খারাপ মাইয়া। তোরে জন্ম দিয়াই আমার ভুল হইছে। আইজ তোর লাইগ্যা আমার মান সম্মান সব মাটিতে মিশ্যা গেছে । দাগ লাইগ্যা গেছে তুইসহ আমার গায়ে।’

কাব্য তখন হাত জোড় করে বলল, ‘কাকু মিতুকে ছেড়ে দেন। ওর কোনো দোষ নেই। ওকে আমিই আসতে বলেছি এখানে। দয়া করে ওকে মারবেন না কাকু।’

আবুল কালাম মিতুর চুল ছেড়ে দিয়ে কাব্যর গেঞ্জির কলার চেপে ধরল। তারপর অকথ্য ভাষায় বলল, ‘কুত্তার বংশ, মাস্টারের পোলা তোরে আমি আইজ জ্যান্ত কবর দিয়া দিমু। তার লাইগ্যা আমার জেল হইলেও হোক। সব নষ্টের মূল হইতাছোস তুই। আমার সহজ-সরল মাইয়ার মাথাডা গিলছস তুই।’

আবুল কালাম কথাটা বলেই কাব্যকে চড়,ঘুষি মারতে শুরু করে। একে একে ৪-৫টা মানুষ মিলে কাব্যর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ওইদিকে মিতু এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না। চিৎকার করে কাঁদছে আর কাব্যকে ছেড়ে দিতে বলছে। কিন্তু কেউ মিতুর কথায় কর্ণপাত করছে না। মিতু কাউকে শরীরের জোরে আটকাতেও পারছে না। হিংস্র জানোয়ার ন্যায় কাব্যকে মারছে সবাই মিলে। সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছে কাব্য ছোট একটা ছেলে। কারো মনে সামান্য পরিমাণ মায়া হলোনা কাব্যর জন্য। একেবারে মারতে মারতে রক্ত বের করে ফেলল কাব্যর নাক মুখ দিয়ে। রক্তবমি হলো কাব্যর। ওইদিকে মিতু শুধু কান্না করে যাচ্ছে। কত করে বলল কাব্যকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু কেউ শুনলো না মিতুর আওয়াজ। সবাই কাব্যকে ছেড়ে দিল ঠিকই, কিন্তু নিজেদের তেজ মিটিয়ে। মার খেতে খেতে যখন আর নিতে পারছিল না, তখন গিয়ে কাব্য চোখ দুটো বন্ধ করে শরীর ছেড়ে দিল মাটিতে। তারপর গিয়ে সবাই শান্ত হলো। কাব্যর শরীরটা পরিত্যক্ত বস্ত্রের ন্যায় পড়ে রইল। অন্যদিকে আবুল কালাম প্রায় টেনে হেঁচড়ে মিতুকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here