ক্যামেলিয়ান ১০+১১

0
1305

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান (সুবাসিনী)
#পর্ব-১০+১১

(২৬)
বাবার কাধে সন্তানের লাশটা অনেক ভারী লাগে অথচ অসহায় তো হয় সেই সন্তান যে তার বাবার লাশটা বহনের জন্য হলেএ অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়।

মাশহুদের সম্মুখে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার মুখশ্রী পুরোপুরি ভাবে এক পলক দেখলো সে।
কালো ওড়না দিয়ে তার মাথার কিছু অংশ ঢাকা, পরনে কালো রঙের কোনো বাঙালি পোশাক হবে হয়তো যা দেখতে অনেকটা গাউনের মতো।অত্যাধিক রোদের কারণে মুখশ্রীতে লাল আভা ছড়াচ্ছে। কিছু চুল এলোমেলো ভাবে এসে হুটোপুটি খাচ্ছে মেয়েটার পুরো মুখে। অথচ তার দৃষ্টি ,ধ্যান অথবা মনোযোগ সব কিছুই সম্মুখে অদূরে রাখা কফিনের দিকে।

লাশের কাছে যেতে হলেও তাকে কিছু কাগজপত্রে সাইন করে নিতে হবে। একজন লোক তার দিকে কাগজ এগিয়ে দিতেই সে দ্রুত সাইন করে দিয়ে ছুটলো পিচ ঢালা রাস্তার দিকে। কফিনের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই তার বা পায়ের জুতোটা ছিড়ে গেল।দুই পায়ের জুতো জোড়া রেখেই সে দৌড়ে পৌঁছালো লাশের কাছে। কফিনটা রাখা ছিল রোদে, সেখানে দাঁড়িয়ে সে কফিনের উপরে নিজের ছায়া ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।মাথার দিকটা খেয়াল করে রোদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যতটা পারলো ছায়া দিতে চাচ্ছিলো সে।
অথচ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে তার নগ্ন দুই পা পিচ ঢালা রাস্তার গরম ভাব নিতে পারছে না।

স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাশহুদ। মেয়েটার এমন ব্যবহার এর কারণ বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো তার। যখন জাফরিন নামক মেয়েটা বার বার করে বলতে লাগলো,

“তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসুন। আব্বাকে এই ভাবে রোদে ফেলে রাখছে কেন?আব্বার গরম লাগতেছে যে। তাড়াতাড়ি করেন।”

মৃত্যুর এগারো দিন পর লাশ দেশে ফিরলো আজমল সাহেবের। ইউভান আগে থেকেই লাশ বাহী ফ্রিজিং গাড়ি নিয়ে এসেছিল।সকল কাগজ পত্র ঠিক দেখে গাড়িতে লাশ তোলার অনুমতি দিলে জাফরিন আর অপেক্ষা করেনি।এই সমাজের বড্ড এক রোখা নিয়ম। জাফরিন যেন এই নিয়মের বাইরে হাটতে চাইছে। মানুষ আসতে দেরি হচ্ছিলো বলে সে নিজেই হাত লাগালো কয়েক জনের সাথে। কফিনের এক পাশটা ধরে তুলে দিলো গাড়িতে।
নিয়মে নেই কন্যা সন্তানদের লাশ কাধে বহন করার কিংবা জানাজা পড়ার।কিন্তু জাফরিনের যে সইছিল না তার বাবাকে রোদে পুড়তে দেখা, তাই তো সে নিজেই হাত লাগালো কফিন উঠাতে এবং সাফ সাফ তার বোন জামাইদের বলে দিলো সেই যাবে লাশের গাড়ির সাথে অন্য কেউ না।জাফরিনের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল যার ফলে
তার চাচারা কিছু বলার সাহস করলো না।
কিছু সময় পূর্বেই তারা জানতে পেরেছে আজমল সাহেব তার সকল কিছুর দাবীদার হিসেবে রেখেছে জাফরিনের নাম।জাফরিন ব্যতীত অন্য কারোর কাছেই আজমল সাহেবের কিছুই হস্তান্তর করা হবে না। এটা তাদের স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ইউভান এসে দুলাভাইদের জানালো যে কোম্পানি থেকে আসা সাত জন লোক তাদের সাথেই যাবে। অবশ্য তারা নিজেদের যাতায়াতের ব্যবস্থা নিজেরাই করেছে।লাশ দাফনের পর তারা ফিরে যাবে নিজেদের দেশে।
এ বিষয়ে কারোর কিছু বলার ছিল না।সবাই শুধু চাচ্ছিলো জাফরিন একটু কাঁদুক।একটু নিজের কষ্টটাকে চোখের পানির দ্বারা প্রভাবিত করুক।

সুফিয়া বেগম কখনো তার স্বামীকে আনতে এয়ারপোর্টে যায়নি।সব সময় নিজেকে পরিপাটি করে অপেক্ষা করেছে, কখন সে আসবে। প্রতিবার জাফরিন গিয়েছে তার বাবাকে আনতে। প্রতিবার ফিরে এসে বাইরের সিড়িতে বসে বলতো,

“আম্মা, আব্বাকে নিয়ে আসছি। বাইরে আসেন।”

এবারো ব্যতিক্রম হলো না।তবে এবার বাড়ি ভর্তি মানুষ। পা ফেলার জায়গা নেই। নগ্ন পায়ে হেলে দুলে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে প্রবেশ করলো জাফরিন।সিড়িতে বসে স্বাভাবিক ভাবেই তার মা কে ডেকে বলল,

“আম্মা,আব্বাকে নিয়া আসছি।বাইরে আসেন।”

সুফিয়া বেগম মেয়ের ডাকে বাইরে এলেন।জাফরিন মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল প্রতিবারের মতোই তার মা নতুন কাপড় পরে আছে। পার্থক্য একটাই, প্রতিবার পরতো রঙ বেরঙের শাড়ি আর আজ পরেছে সাদা রঙের থান কাপড়।

(২৭)

আশার বাবা তার বড় ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে হাত ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন খবর কি?
তাদের চোখ মুখ দেখে যদিও সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে তবুও জিজ্ঞেস করতেই তার বড় ভাই উল্টো জিজ্ঞেস করলো ,

“ফয়সাল বাড়ি ফিরছে?”

“হুম। ওইখানে কি হইলো?”

“লাভ নাই। স্ত্রী সন্তান সব কিছুর মালিকানা পায়। যদি আম্মা-আব্বা জীবিত থাকতো তাহলে শক্তি করা যাইতো।”

“ওই লোকগুলা কারা? যারা লাশের গাড়ির আগে আগে আসলো?”

“ভালো কথা বলছিস,এরা কোম্পানির লোক।বিদেশ থেকে আসছে। তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর।”

আজাহার সাহেব চলে গেলেন বাহির বাড়ির দিকে।আজমল সাহেবের লাশ বাহী এম্বুলেন্স রাখা হয়েছে বাড়ির সামনে। সকালের রোদের প্রখরতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘ জমেছে, বইছে শীতল বাতাস। মনে হচ্ছে অদূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে।যে কারণে বইছে এমন শীতল বাতাস।
গ্রামের মানুষ অনেকেই বলাবলি করছে

“আজমল সাহেব ভালো মানুষ ছিলেন। তাই আজ বৃষ্টি নামাবে। সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে তার
উপর।”

কফিন নামানোর পর যদি বৃষ্টি নামে এই কারণে বাড়ির সামনে ছোটো একটা সামিয়ানার মতোন টানানো হয়েছে। অপর দিকে চলছে কবর খোড়ার প্রস্তুতি।

বড় আপা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।ছোটো আপা আজ নিজেকে শক্ত রেখেছেন।সে কাঁদছে না।মনে হচ্ছে এই সময়ের জন্য নিজেকে অনেক বুঝিয়ে চলেছেন তিনি।

ভিতর বাড়ি থেকে জাফরিন বেরিয়ে এলো।তার হাতে রয়েছে তার বাবার ফোন।কিছুক্ষণ পূর্বেই তার বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।সেগুলোকে সযত্নে নিজের ঘরে রেখে এসেছে সে।
লাশ বাহী ফ্রিজিং এম্বুলেন্স এর পাশে দাঁড়িয়ে জাফরিন বলল,

“এবার আপনারা কফিন নামানোর ব্যবস্থা করুন।”

মাশহুদ দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক হাত দূরেই।অদূর অতীতে এই মেয়েটা তার পাশে বসে ছিল। মাশহুদ তাকে দেখতে পেলেও জাফরিনদের পরিবারের কেউ বিদেশিদের চেহারা এখনো দেখতে পারেনি। তাদের মুখ কালো মাস্ক দ্বারা আবৃত ছিল।
কঠিন হৃদয়ের এই রমনীকে দ্বারা নিজের কাজ হাসিল করতে হলে অবশ্যই তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে এটাও সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো।

আজমল সাহেবের কফিন নামানোর পূর্বেই জাফরিন সেখান থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল।এবার আর তার কোনো শক্তি নেই কিছু করার। দুই দুলাভাই দাঁড়িয়ে রইলেন কফিনের সাথেই।
ধীরে ধীরে খোলা হলো কফিন।কফিনের গায়ে লেগে থাকা ইমিগ্রেশনের কোনো কাগজ ছিল।সেটা তার চাচারা নিয়ে রেখে দিয়ে বলল,

“এসব কাগজ দরকার।কোম্পানির থেকে টাকা এইগুলা ছাড়া দিবে না।”

লাশের মুখ অনাবৃত হতেই কান্নার দমক পড়ে গেল পুড়ো বাড়িতে। আজমল সাহেবের মুখের একটা পাশ বাঁকা হয়ে ফুলে গেছে। সফেদ রঙ ছিল আজমল সাহেবের গায়ের রঙ।দেখে মনে হচ্ছিলো তার দেহে কোনো রক্ত নেই।আবার কারোর মনে হচ্ছিলো লাশটা কালো হয়েছে অনেক।
একে একে সবাইকে এনে লাশ দেখানো হলো।জাফরিনের দুই বোন, মা সবাই লাশ দেখলেন।কিন্তু জাফরিন?

খানিকটা দূরে ছিল সবুজ মাঠ।যে মাঠের এক প্রান্তে রাখা হয়েছে লাস, তার ঠিক অপর প্রান্তে সবুজ ঘাসের উপর বসে পশ্চিম দিকে মুখ দিয়ে কেঁদে চলেছে জাফরিন।তার দুই চোখে এতদিন জমেছে সাত মহা সমুদ্রের নোনা জল।যা আজ গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সে। মাঠের একটা পাশে বসে আর্তনাদ করে কাঁদছিল জাফরিন।চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো পিঠে।
তার বাবা, বাবা বলে কান্নার ডাক শুনে আশেপাশের সবাই বলতে লাগলো,

“আজ এই মেয়েটা কাঁদুক,কেউ ওরে ধইরো না।আজ না কাঁদলে ও বাঁঁচবে না।ওর এত দিনের সব কষ্ট বাপেরে দেখে লুকাতে পারছে না।”

ইউভান এবং মায়ান দাঁড়িয়ে আছে জাফরিনের পাশে। জাফরিন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে চলেছে। কিন্তু এবার তাদেরকে যেতে হবে। দীর্ঘ সময় লাশ রাখাটা ঠিক হবে না। সকল প্রস্তুতি শেষ। এবার জাফরিন তার বাবাকে শেষ দেখাটা দেখলেই তারা এগিয়ে যাবে কবরস্থানের দিকে।
মায়ান এবং ইউভান দুজনে জাফরিনকে উঠিয়ে দাঁড় করালো।মেয়েটা ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিল।ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল বাবার লাশের দিকে। লাশের কাছাকাছি আসতেই হুজুর লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দেখালেন।জাফরিন বাবা, বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো খাটিয়ার একটা পাশ ধরে৷
কাঁদতে কাঁদতে তার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিলো।
যেখানে সবাই কিছুটা ঘেন্না পাচ্ছিলো লাশ নিয়ে।কারণ এত দিন হয়েছে তাছাড়া ফ্রিজিং করা ছিল এবার লাশটা কেমন নরম নরম দেখাচ্ছে সেখানে জাফরিন নিজের হাত দিয়ে বাবার মুখশ্রীতে স্পর্শ করে বলল,

“আব্বা ও আব্বা। আব্বা!”

হুট করেই বৃষ্টি শুরু হলো।বৃষ্টি ছাঁট এসে লাগছিল জাফরিনের গায়ে। সে বৃষ্টির ছাঁটের পথে অবরোধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাশহুদের বড্ড ইচ্ছে হলো এই মেয়েটার মাথায় হাত রাখতে। তাকে বলতে সে আছে। তার আশেপাশেই আছে।

চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১১

(২৮)

“আমি নিয়াজ চৌধুরী,মরহুম আজমল শিকদার এর বড় জামাতা। মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলছি,

যদি আপনারা কেউ আমার মরহুম শ্বশুরের কাছে কোনো প্রকার ঋণের দাবীদার থেকে থাকেন তবে আপনারা আমাদের জানাতে পারেন।আমরা তার ঋণ শোধ করবো।”

মাথায় কাপড় দিয়ে কাঁঠাল গাছে হেলান দিয়ে পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে আছে জাফরিন। সে জানে তার বাবার কাছে কেউ কোনো ঋণ নেই।শুধু সে নয় এই কথাটা সকলেই জানে।তবুও জিজ্ঞেস করাটা তাদের কর্তব্যের মাঝে পড়ে বলেই জিজ্ঞেস করা হলো। ইমাম সাহেব পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন সকলের উদ্দেশ্যে।
সবাই না করলেও এগিয়ে এলো আশার বাবা। সে এগিয়ে এসে ইমাম সাহেব কে বললেন,

“তার ঋণ নাই কিন্তু সে আমাদের সাথে যে বেঈমানী করছে এটাও কি ফয়সালা এখন করা যেতে পারে?”

তার কথায় ভিতরে চমকে উঠলো ইমাম সাহেব। এতদিন শুনেছে ওরা কি কি করেছে আজ কি লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার পায়তারা করছে তারা?
বয়স্ক ইমাম সাহেব বিজ্ঞ মানুষ। স্মিত হাসি ফুটে থাকে তার অধরে। দৃষ্টি অধিকাংশ সময় নিচের দিকেই রাখে। তিনি মানেন একজন নারীর যেমন পর্দা মেনে চলা উচিৎ, পুরুষের উচিৎ তার দৃষ্টিকে সংযত করে চলা।কিন্তু এবার সে আশার বাবার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,

” মরহুমের ঈমানী, বেঈমানী কাজের হিসেব আল্লাহ্ তালা অবশ্যই নিবেন। প্রতিটা কাজের জবাবদিহী সে করবে কিন্তু আমরা এখানে তার ঋণের কথা বলছি।আপনি কি তার কাছে ইহজাগতিক কিছু মানে টাকা পয়সার পাওনাদার।”

“ওভাবে না পাইলেও তো পাই।এই যে এত সহায় সম্পত্তি সব বৌ আর মেয়েগো দিছে। আমাদের ঠকায়নি?”

“জি না। সে তার নিজের সম্পত্তি তার কন্যাদের ভাগ করে দিয়েছেন।আপনাদের অংশ আপনাদের দিয়েছেন।”

“কিন্তু এখন যে কোম্পানি থেকে টাকা পাবো?ওগুলা?ওইগুলায় আমাদের হক নাই?”

“সে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তার সেই অন্যায়ের ভাগ নিবেন?তার যদি কোনো ঋণ থেকে থাকে তবে সেই ঋণ শোধের দায়িত্ব নিবেন?”

“তা নিবো কেন? ”

“অন্যায়ের ভাগ তার কন্যারা নিবে। তার কন্যারা সকল কিছুই মেনে নিবে।তার স্ত্রী তার ঋণ শোধের দায়িত্ব নিবে। যদি কেউ এসব দায়িত্ব না নিতে পারে তবে মরহুমের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব থাকবে না।”

আশার বাবা এ যাবত সময় ইমাম সাহেবের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন।খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে চলে এলেন সেখান থেকে।
ইমাম সাহেব এবার জাফরিন ও তার বোনদের বললেন,

“মা পৃথিবীতে কারোর বাবা মা চিরজীবী হয় না।আমরাও একদিন চলে যাবো।এবার আপনারা শক্ত হোন।আপনার বাবাকে খাস নিয়তে মাফ দিন।আমরা তাকে জানাযায় নিয়ে যাবো।”

বড় আপা শেষ বারের মতো বাবার চেহারা দেখতে চাইলেন।কিন্তু এবার সে কাঁদলেন না, জ্ঞান হারালেন না।স্বল্প সময় কিন্তু দীর্ঘ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন তার বাবাকে। তার ত্রিশ বছরের জীবনে সে তার বাবাকে সব থেকে বেশি ভালোবেসেছে। আব্বা ডাকটা শুধু নিজের বাবার জন্যই ছিল তার। মানুষ শখ, আহ্লাদ করে নিজের সন্তানকে আব্বা ডাকে কিন্তু সে কখনো ডাকেনি।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিরবির করে বলল,

“আব্বা, আমি শক্ত আছি।আপনি চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে আমার দুই বোন আর মায়ের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।আপনি না বলতেন আমরা আপনার কন্যা না, আপনার জান্নাত। আমি চাই আপনার সাথে আমার জান্নাতেই দেখা হোক।আজকে আপনার সামনে প্রতিজ্ঞা করতেছি আমি পূর্ণ পর্দা করবো। সব মেনে চলবো যাতে আমার জন্য আপনাকে কোনো হিসেব না দিতে হয়।”

লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় বড় আপা দুই হাতে দুই বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।দুই বোনের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

“আব্বার জন্য নামাজে দোয়া করবি তোরা। সন্তানের দোয়া যে বাবা মায়ের কাজে আসে।এছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।”

(২৯)

দেশের বাইরে অনেক লাশ দাফন দেখেছে মাশহুদ। অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টধর্মীয়। তাদের কফিন বন্দী করে দাফন করানো হয়। অথচ আজ প্রথমবার সে দেখছে মুসলিম কাউকে জানাজা পড়তে। আপন মানুষের মৃত্যুতে কেউ এতটা কাঁদে তার জানা ছিল না।
আজ অবধি তার কোনো আপনজন মারা যায়নি বলেই কী সে কষ্টটা অনুভব করতে পারছে না?
চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে সে তাকিয়ে আছে খাটিয়ার দিকে। শুভ্র সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা পরণে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে লাশের পাশে। মাথায় ছোট্ট টুপি।গোটা গোটা হাত দিয়ে সে লাশের উপরে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো।এরপর সে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নিলো।
এমিলি মাশহুদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“স্যার, এবার আমরা ফিরবো?এখানে আমাদের আর কোনো কাজ নেই। আমরা এখানে না এলেও চলতো।”

“কীসের প্রয়োজন আছে আর নেই এটা কি আমি বুঝি না মিস?”

“সরি স্যার।”

“খোঁজ নিন আমার দাদার বাড়ি কোথায় ছিল।”

“জি স্যার।আধ ঘন্টা সময় লাগতে পারে।”

“যত দ্রুত সম্ভব করুন।মনে রাখবেন দাদা যেন না জানে এবং আজমল সাহেবের পরিবারের সাথে কথা বলার ব্যাপারে ব্যবস্থা করুন।”

জাফরিনের সামনে তার মা বসে আছে। কেউ তাকে পুনরায় গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পরিয়েছে। তার দেহের সকল গয়না খুলে নিয়েছে। এই শোকের মাঝেও মায়ের চেহারা দেখে চৈতন্য ফিরে পেল।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলল,

“মায়ের গয়না কই?”

“তোমার বড় চাচীর কাছে।”

“খুলেছে ক্যান?”

“এটাই নিয়ম।”

“হাদিসে নেই।আমার মায়ের মানসিক অবস্থার সাথে এমন তামাশা না করলে চলছে না?”

জাফরিন নিজের গলা থেকে সরু চেইন, কানের দুল আর নাকফুল খুলে মাকে পরিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আম্মা আব্বা আছেন তো।এই যে আমরা, আমরা তিন বোন, আপনি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হোন আম্মা।আব্বা কিন্তু আমাদের দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়ে গেছেন।”

মেয়েকে চুপচাপ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন সুফিয়া বেগম।তার বুকে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে কখন জাফরিন ঘুমিয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি।

জাফরিনকে তার সময় দেওয়া হয়েছে। লাশ দাফন করে আসার পর মাশহুদ বসেছিল তাদের সাথে। ঘুম থেকে উঠার পর জাফরিন এসে বসলো তাদের সামনে।
মাশহুদ ইংরেজি ভাষায় বলছিল এবং অন্য একজন বাংলায় ট্রান্সলেশন করছিল।যদিও এটার প্রয়োজন ছিল না।তবুও কেউ বাধা দেয়নি।
মাশহুদ জানালো এমন ভাবে তাদের আশাটা যদিও কোম্পানির কোনো নিয়ম নেই তবুও আজমল সাহেব দীর্ঘ সময় তাদের সাথে কাজ করেছে বলেই তাদের আসা। তারা দুঃখিত যা হয়েছে এসবের জন্য।তাদের পাওনা অর্থ সময় মতো একাউন্টে পৌঁছে যাবে।

এরপর জাফরিনের দিকে তাকিয়ে সে বলল,

“আপনার কী কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল?”

জাফরিন সম্মতি জানালে মাশহুদ পুনরায় বলল,

“আপনার জন্য আমাদের বস একটা অফার পাঠিয়েছে। যদিও এটা কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।তবুও আজমল সাহেবকে সম্মান করেই এসব।
আপনার একাডেমিক সকল খরচ আমাদের কোম্পানি বহন করবে এবং আপনি রাজি থাকলে স্পেনের টপ যে কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর দায়িত্ব আমাদের। এছাড়াও কোম্পানিতে আপনার যোগ্যতা অনুসারে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।”

জাফরিন কিছুই বলল না।তারা জানালো ভেবে জানাবে। মাশহুদ এবং বাকীরা বিদায় নিয়ে চলে এলো। পিছনে ফেলে এলো জাফরিনের সন্দেহ। যার দু চোখ বার বার আটকে যাচ্ছিলো কথা বলা লোকটির কণ্ঠমনির উপর। সে কী লোকটাকে চিনে?

ধীরে ধীরে কেটে গেল দুটো দিন। আজ আজমল।সাহেবের জন্য মানুষ খাওয়ানো হচ্ছে। তাদের মুখে হাসি নেই অথচ বাকী সবাই কত খুশী!
জাফরিন নিজ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলো নতুন দুলাভাইয়ের সাথে রঙ খেলছে সবাই। তড়িৎ গতিতে সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।সরাসরি ঈশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“আমার বাবার থেকে দশ লাখ টাকা কেন নিয়েছিলে?”

ঈশান চমকালো কিন্তু নিজেকে সামলে বলল,

“সেই দশ লাখ টাকার সাথে আরও পাঁচ লাখ টাকা যুক্ত করে তোমার সম্মান কিনে নিয়েছে তোমার ইউভান।একবার তোমার বাবা দিয়েছে আবার ইউভান গতকাল। কী দামী তোমার সম্মান জাফরিন।এক সম্মান বাঁচাতে দুই জন কত কত টাকা দিয়ে দিলো।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here