গোধূলিলগ্ন 10.

0
783

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১০

চুলায় রান্না বসিয়ে উঠোনে ফেলা ধান পা দিয়ে নেড়ে হাঁস মুরগীর খাবার দিতে গেল সেতু। বাড়ির পেছনের ক্ষেতে গিয়ে ‘চইচই’ বলে হাঁস মুরগিকে ডাকছে। সহসাই সেতুর নজর কাড়ল দূরের এক বিশাল খেজুর গাছ। সেতু দেখলো তার ননদ রাবেয়া কার সাথে যেন কথা বলছে খেজুর গাছের আবডালে দাঁড়িয়ে। সে মাথা ঈষৎ উঁচিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখছে ওখানে কি চলছে।

‘ওইহানে আপা না? ওইডা আপাই তো। কিন্তু ওইহানে আপায় কি করে? কারো সাথে মনে হয় কথা কইতাছে? যাইয়া দেখমু কি?’

সেতু কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। তারপর বলে, ‘না বাবা। আমি আর আগাইতাম না। আপা যদি আমারে দেইখ্যা রাগ করে! কিন্তু আমি না যাইলে ব্যাপারডা তো বুঝতেও পারুম না। আপায় তো দেহি হাইস্যা হাইস্যা কথা কইতাছে। এই ভর দুপুরে আপারে জ্বিনে টিনে ধরে নাই তো! তাই যদি হয় আমারে আগে আম্মারে জানাইতে হইবো। কিন্তু আম্মায় তো বাইত্তে নাই। এহন আমি কি করি? তাইলে আমি একাই যাই আড়াল থেইক্যা দেখমু কি চলতাছে ওইহানে।’

সেতু আস্তে আস্তে পা ফেলে রাবেয়ার থেকে প্রায় কয়েক হাত দূরে থাকা খড়ের গাদার এক পাশে লুকিয়ে গেল। সেতু ভালোভাবে চোখ ঘোরাতেই চরম পর্যায়ের বৈদ্যুতিক শক খেল। সে মনে মনে এতক্ষণ যেটা ভাবছিল সেরকম কিছুই হয়নি। রাবেয়া দাঁড়িয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছে। লোকটি আর কেউ নয় ধান কাটার কাজে নিয়োজিত আকিজ মিয়া। কালো কুচকুচে তার গায়ের রঙ। বয়স ভালোই হয়েছে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের কম না। পান খেয়ে ঠোঁট,দাঁত লাল করে রেখেছে একদম রাবেয়ার মতোই। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে ময়লা একটা শার্ট আর লুঙ্গি। আকিজ কথা বলছে আর তার মুখ থেকে পানের চিপটি ছিটকে বেরিয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। সেতু কিছুটা কাছে গিয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করল।

রাবেয়া বলছে, ‘আপনি আর কতো দিন ঘোরাবেন শুনি? বয়স আমার বেড়েই চলেছে দিন দিন। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার মাকে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেন।’

আকিজ লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন, ‘তুমার কি মাতা ঠিক আছে রাবেয়া? আমি এহনো কামের টাহা পাইনাই। আর আমার লগে তোমার আম্মায় তোমার বিয়া দিবো না। এর থেইক্যা আমরা পালাইয়া বিয়া করি চলো।’

‘পালিয়ে গেলে কিছুই ভাগে পাবো না। তাছাড়া মা এমনিতেই রাজি হবে কারণ আমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। তালাকের পর এখানেই থাকি। বাপের বাড়ি। মা চায় আমি আরেকটা বিয়ে করে জীবন গুছিয়ে নেই। এত বছরেও মনের মতো আর কাউকে পাইনি। তোমার যেহেতু আমার মতো তালাক হয়ে গেছে, সেহেতু তুমি আর আমি একই জলের মাছ। তুমি আর আমি বিয়ের পর এখানেই থাকবো ভেবে নিয়েছি। সব কিছুই ঠিকঠাক হবে। ভয় পেওনা। তুমি নির্দ্বিধায় মাকে বলে ফেল আমাদের বিয়ের বিষয়টা।’

‘কি যে কও রাবেয়া? আমার ডর করতাছে। আমারে যদি তোমার ভাই মারে? এই বয়সে মাইর খাইতে চাইনা আমি।’

‘কিছুই হবে না আকিজ। আমি সব সামলে নেব।’

সেতু রাবেয়া আর আকিজের কথা শুনে অবাকের শেষ চূড়ায় পৌঁছে গেল। সে আর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারলো না৷ চট করে বেরিয়ে একদম রাবেয়ার নিকট চলে গেল। গিয়ে বলল,

‘ছি ছি ছি আপা! আপনি কত বড়ো খারাপ একজন মহিলা। আমারে অশিক্ষিত, মূর্খ বইল্যা দিনরাত এক কইরা দেন। আর এহন অশিক্ষিত ব্যাডার লগেই প্রেমের সম্পর্কে জড়ায় গেলেন?’

রাবেয়া আর আকিজ অকস্মাৎ সেতুকে প্রকট হতে দেখে চরম আকারে ভয় পেয়ে যায়। আকিজ কোন কিছু না ভেবে সোজা রাস্তা ধরে দিল এক দৌঁড়।

‘সে,, সে,,সেতু তু,,তু,, তুই!’ রাবেয়া ভয়ে তোতলে গেল।

‘আমারে আশা করেন নাই তাইনা আপা? আপনি বিয়া করতে চান ভালো কথা কিন্তু এই বয়সে? আগে ক্যান কন নাই বয়স থাকতে? অকারণে স্বামীর ঘর ছাইড়া আইছিলেন অহংকার, জমিদারি দেখাইয়া৷ ভাবছিলেন রাজপুত্র আপনারে নেওয়ার লাইগ্যা বইয়া থাকবো। এই ভাইব্যা নিজের এত ভালো জামাইরে বারবার ফিরায় দিছেন। কিন্তু আইজ কি কান্ড করলেন আপনি? মানুষ ঠিকই কয়, কাউরে নিন্দাইতে নাই। দেহা যায় যারে নিন্দাইবেন, হের থেইক্যাও খারাপ জীবনসঙ্গী কপালে জুডে।’

‘চুপ কর মূর্খ মেয়ে। আমাকে জ্ঞান দিস তুই? আমাকে?’ চোখ গরম দিয়ে বলল রাবেয়া।

‘চোখ নামাইয়া কথা কন আপা। আপনের মতো কুৎসিত স্বভাবের মাইয়া মানুষ গো এত গলা থাকা ভালো না। আপনারা সমাজের কলঙ্ক।’

‘সেতু!’ বলে চিৎকার দিয়ে রাবেয়া সপাটে এক চড় লাগায় সেতুর গালে।

সেতু গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘কম মারেন নাই আমারে আপনারা সবাই। শরীর আমার পঁইচ্যা গেছে মাইর খাইতে খাইতে। আইজ যাই হইয়া যাক আমি আপনার এই কুকীর্তির কথা সবাইরে জানামু। আপনি যে শিক্ষার বড়াই করেন, তা ঘুচামু। আমি অষ্টম শ্রেণী পাশ কইরাও নিজের সম্মান বাঁচাইয়া চলতে পারি। আর আপনি উচ্চশিক্ষিতা হইয়াও কুরুচিপূর্ণ স্বভাব আপনার! এই শিক্ষায় লাভ কি? আপনার মা আইজকে জানুক, তার মাইয়ার স্বভাবখান কেমন।’

‘তুই আমার নামে বিচার দিবি তাইনা? দেখি তুই কিভাবে বিচার দিস।’ এই বলে সেতুকে টানতে শুরু করলো রাবেয়া।

‘আপনি আমারে এইভাবে টানতাছেন ক্যান? ছাড়েন আমার হাত। ছাড়েন কইতাছি।’

রাবেয়া সেতুর কোনো কথায় কর্ণপাত করেনি। সে বাড়ির উঠোনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে সেতুকে ফেলে দিয়ে মা, মা বলে ডাক ছাড়তে থাকে৷ রাবেয়ার চিৎকারে আশেপাশের প্রতিবেশীরা চলে আসে। সবাই রাবেয়াকে প্রশ্ন করে কি হয়েছে? রাবেয়া কারো কোনো কথারই উত্তর দেয় না। সে শুধু তার মাকে ডেকে যাচ্ছে এক সুরে। খানিক বাদে মছিদা বেগম আসলে হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন রাবেয়ার দিকে।
‘লোক জমিয়ে গলা ছেড়ে মা,মা বলে ডাকছিস কেন? কি হয়েছে? এখানে এত ভীড় কেন?’

এমন অনেক প্রশ্ন করে বসলেন মছিদা বেগম।
সেতু গিয়ে মছিদা বেগমকে বলল, ‘আম্মা আইজ আপনার মাইয়া…..।’ আর বলতে পারলো না। তার আগেই রাবেয়া বলে ওঠে,

‘থাম বলছি। তোর ওই নোংরা মুখে আর একটাও কথা বলবি না। কোন সাহসে কথা বলছিস তুই? লজ্জাশরম কি একটুও নাই তোর মধ্যে?’

সেতুর তখন কি বলা উচিত সে ভেবে পায়নি। যেখানে রাবেয়ার লজ্জা নিয়ে ভাবা দরকার, সেখানে রাবেয়া নিজেই অন্যকে লজ্জাশরম নিয়ে কথা শোনাচ্ছে।

‘নোংরা মুখ আমার নাকি আপনার আপা?’ সেতু পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল রাবেয়ার দিকে।

‘একদম চুপ। চোরের মায়ের বড়ো গলা। নোংরা কাজ করে বেড়াবি, আর গলা তুলে কথা বলে
অন্যের দিকে আঙুল তুলবি! বাবা মা এই শিক্ষা দিয়েছে নাকি?’ বেশ জোর গলাতেই বলল রাবেয়া।

সেতু আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘আপনার মাথা ঠিক আছে আপা? আপনি কারে কি কইতাছেন? লজ্জা করে না এহনো মুখ দিয়া কথা বাইর করতাছেন? আবার আমার বাপ মার শিক্ষা নিয়া গলাবাজি করতাছেন!’

‘এই মেয়ে! তোর দিন দিন সাহস বাড়ছে দেখছি। আমার মেয়ের সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস কোথায় পাস শুনি?’ সেতুর দিকে গরম চোখ তাক করে বলে উঠলেন মছিদা বেগম।

‘আম্মা আপনার মাইয়া খুব খারাপ একজন মহিলা। হের কাছে জিগান হের কীর্তি কালাপের কথা। আমার কইতেও লজ্জা লাগতাছে হেইগুলা।’

মছিদা বেগম কড়া গলায় বললেন, ‘কি করেছিস তুই রাবেয়া? এই ফকিরের মেয়েটা বলে কি?’

‘আমি কিছুই করিনি মা। আমি হাতে নাতে ধরেছি শুধু। তোমার ছেলের বউ আড়ালে আবডালে গিয়ে ওইযে আকিজ ভাই আছে না, যে আমাদের ধান কেটে বাড়ি দিয়ে যায়। তার সাথে প্রেমালাপ চালাচ্ছিলো। আকিজ ভাইকে বলছিল, নাহিদের সাথে আর সংসার করতে ভালো লাগে না নাকি ওর। আমি গিয়ে হাতে নাতে ধরেছি বলে পুরো দোষটা আমার উপর দিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে এখন। তুমি ওর কথা কানে নিও না মা।’

রাবেয়ার গোছানো বানোয়াট কথায় সেতুর পায়ের তলা থেকে জমিন সরে গেল মুহুর্তেই। রাবেয়া যে পুরো ঘটনাটা ওর উপরে চাপিয়ে দেবে, তা সেতু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

‘আপনি এগুলা কি কইতাছেন আপা? নিজের কুকর্ম আমার উপর চাপায় দিতে আপনার একটুও লজ্জা করলো না? বিবেকে বাঁধলো না? আমি, নাকি আপনি আকিজ ভাইয়ের লগে খেজুর গাছের নিচে দাঁড়াইয়া বিয়ার কথা কইতাছিলেন।’

‘মা দেখেছো! নিজের দোষ ঢাকতে আমাকে কিরকম করে মানুষের সামনে ছোট বানাচ্ছে। আমি যদি এমন কিছু করতাম তাহলে অনেক আগেই করতাম। এভাবে শেষ বয়সে এসে, ছি ছি আর বলতে পারলাম না। তুমি এর বিচার করো মা।’

মছিদা গিয়ে টানা কয়েকটা চড় মারল সেতুর গালে। তারপর বলল, ‘এই দুশ্চরিত্রা মেয়েকে আমি আর এই বাড়িতে রাখতে চাইনা। রাবেয়া তুই নাহিদের ফোনে কল লাগা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে আসতে বল নাহিদকে।’

‘ঠিক আছে মা।’ বলে ভয়ংকর একটা চাঁপা হাসি দিল রাবেয়া৷

নাহিদ এসে সেতুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দিতে শুরু করে দেয়। সেতু বারবার বলেছে সে এমন জঘন্য কাজ করেনি। কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করলো না। বিনা দোষে অনেকের নানান কথা শুনতে হয়েছে সেতুকে। সে নির্দোষ হয়েও শুধুমাত্র প্রমাণ না থাকায় তার খালি মুখের উক্তি গুলো কেউ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি। আর নাহিদ তো সাফ সাফ বলে দিয়েছে সে আর সেতুর মতো দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে সংসার করতে পারবে না। তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নাহিদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। হাজার আকুতি মিনতি করেও সেতু নিজের সংসারটা আর ধরে রাখতে পারলো না। শেষে আর কোন উপায় না পেয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আল্লাহর কাছে অঢেল অভিযোগ তুলে বিচার দিল। তারপর একরাশ ঘৃণা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে বেরিয়ে পরে অজানা এক গন্তব্যে।
***
চেয়ারে বসে একের পর এক কাগজপত্র ঘেটে যাচ্ছে তৌসিফ সাহেব। বিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগে। সামনে বাচ্চাদের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা। খুব কাজের চাপ সাথে চিন্তাও। আজ থেকে তার ছেলে কাব্যর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কাজে মনোযোগ দিলেও মনে মনে ছেলের জন্য অশেষ দোয়া প্রার্থনা করে যাচ্ছেন তোসিফ সাহেব। ছেলে তার একমাত্র সম্বল। বেঁচে থাকার আশা,ভরসা। প্রতিদিন বিদ্যালয়ের কাজ শেষ করে বাড়ি যেতে তার ৪টা পার হয়ে যায়। আজ আরও সময় লাগবে। জমে থাকা কিছু কাজ সাথে বাচ্চাদের বোর্ড পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে কিছু ঝামেলা শেষ করতে হবে তাকে। তার কাজে বিচ্ছেদ ঘটে কারো ডাকে।

‘আসতে পারি স্যার?’

তৌসিফ সাহেব চশমাটা ঠিক করে মাথা সামান্য উঁচিয়ে বললেন, ‘শফিক স্যার যে। ভেতরে আসুন। আপনাকে যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটা শেষ তাহলে?’

শফিক সাহেব একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর হাতে রাখা কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে বললেন, ‘জ্বি স্যার। তবে আমি খুব হতাশার সাথে বলছি যে এবারে আমাদের এসএসসির মতো জেএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আগের বারের তুলনায়ও খুবই কম।’

তৌসিফ সাহেব ভ্রু কুঁচকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? এ বছরের শুরুতে তো ভালোই ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছিল।’

‘হ্যাঁ স্যার। তবে…..।’ কথার মাঝে থেমে যান শফিক সাহেব।

‘থেমে গেলেন কেন? বলুন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার অধঃপতনের কারণ কি?’

‘স্যার ছাত্র সংখ্যা মোটামুটি আগের জায়গাতেই আছে তবে ছাত্রী সংখ্যা ৬০℅ কমে গিয়েছে। বিশেষ করে জেএসসি পরীক্ষার্থীর। গত মাস থেকে প্রায় অনেক ছাত্রীই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত।’

‘তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন কি?’

‘জ্বি। যেসব ছাত্রীরা স্কুলে আসেনা, তার মধ্যে অধিকাংশ ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’

শুনে তৌসিফ সাহেবের কপালে বলিরেখার ভাজ পরল। তিনি ভাড় মুখে বললেন ‘প্রতিবছর এই একই কাজ হয়ে আসছে দেখছি। কিন্তু এবার যেন বেশিই!’

‘হুম ঠিক স্যার।’

‘একটা ৮ম শ্রেণীর মেয়ের কতই বা বয়স? হবে ওই ১৪-১৫। এই বয়সের একটা অবুঝ মেয়ের বিয়ে হওয়া মানে জানেন শফিক সাহেব? শিক্ষার হার কমে যাওয়া, জন্মহার বৃদ্ধি পাওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা ও শিশুর প্রাণহানি ঘটা। এসব প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এসব কি মানুষের চোখে পড়ে না!’

শফিক সাহেব যোগ করলেন, ‘এছাড়াও বিয়ের কয়েক বছর পর বিবাহবিচ্ছেদের মতো মারাত্মক পথ বেঁছে নেওয়া। ফলে ছেলেমেয়ে উভয়ের জীবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যাওয়া। এসকল অনাচারের মূলই হচ্ছে এই বাল্যবিবাহ।’

‘ঠিক বলেছেন শফিক স্যার। এক কথায় একটা ফুটন্ত ফুল পুরোপুরি ফোঁটার আগেই ঝড়ে পড়ে যাওয়া। নিষ্প্রাণ হয়ে মুচড়ে যাওয়া। সজীবতা হারিয়ে নিরস প্রাণহীন জন্তুতে রূপ নেওয়া।’

‘ঠিক স্যার। জানেন স্যার, এখন শুধু মেয়েরা নয় ছেলেদেরও অকালে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন তাদের নির্বোধ অভিভাবকরা।’

তৌসিফ সাহেব আরও কয়েক দফা চমকে উঠে বলেন, ‘কি বলেন শফিক স্যার!’

‘হ্যাঁ স্যার, আপনার ছেলে কাব্যর সাথে পড়তো নুহাশ নামের ছেলেটা। মনে পরে কি তার কথা?’

তৌসিফ সাহেব মনে করার চেষ্টা করে বললেন,
‘কোন নুহাশ? খেয়াল নেই আমার।’

‘আমাদের বিদ্যালয় থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেছিল। মোটামোটি ভালো ছাত্র ছিল সে। মনে করে দেখুন। আপনার ছেলে কাব্যর ব্যাচমেট নুহাশ। যার বোন বাক-প্রতিবন্দী।’

‘হুম মনে পড়েছে। এসএসসি তে ভালো গ্রেডও পেয়েছিল ছেলেটা। কত পরিশ্রম করেছিলাম ছেলেটার পেছনে। বিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর আর আসলো না দেখা করতে। টিচারদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করলে এদের কি যে ক্ষতি হয়ে যায় বুঝিনা। বছরে একবার দেখা করতে আসলেও তো মনটা ভরে ওঠে আমাদের। তারা যে আমাদের গর্ব। আমার বেশ কিছু স্টুডেন্ট অনার্সে পড়ছে। তারা একদিন এই বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী ছিল। তাদের সাথে দেখা হলে কি যে সম্মান দেয়, তা বলে বোঝাতে পারবো না আপনাকে। ওই সময়টা মনে হয় জীবনে সত্যি একটা মহৎ কাজ করেছিলাম শিক্ষাকতার পেশাটি বেছে নিয়ে।’

‘জ্বি একদম ঠিক বলেছেন স্যার। আমরা কত কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ বানিয়ে কলেজের দুয়ারে পাঠাই। কত আশা করি তাদের নিয়ে। ভাবি একদিন তারা অনেক বড়ো পেশায় নিয়োজিত হয়ে দিন শেষে আমাদের মতো শিক্ষকদের স্মরণ করবে। তাদের সাফল্যের পেছনে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে শ্রদ্ধা জানাবে। কিন্তু দেখা যায় স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার পর কেউ কেউ হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী। আবার কেউ সংসারের হাল ধরতে কাজে নেমে পরে। কেউবা শিক্ষাকে ধরে রেখে হয়ে ওঠে আমাদের মতো শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আরও কত কি।’

‘একটা ছাত্র’র ভালো মন্দ বিচারের ৫০ শতাংশ যায় তার নিজের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশের ২৫ শতাংশ যায় অভিভাবকদের উপর। আর বাদ বাকী ২৫ শতাংশ যায় আমাদের মতো শিক্ষকদের উপর। তবে দিনকাল ভালো না। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ছেলেমেয়েরা নিত্যনতুন সঙ্গ পেয়ে কেউ যায় বিগড়ে, কেউবা যায় শুধরে। তবে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যাই হোক, আপনি নুহাশকে নিয়ে কি যেন বলতে চাইলেন, শফিক সাহেব?’

‘ও হ্যাঁ, ওই নুহাশ ছেলেটি কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে শুনলাম।’

তৌসিফ সাহেব হতচকিত ভঙ্গিতে বললেন,
‘কি বলেন! ওতো আমার কাব্যর বয়সী হবে। বিয়ের বয়সই তো হয়নি তার।’

‘আমিও তাই ভাবছি। নুহাশের ছোট ভাই সবুজ তো আমাদের স্কুলেই পড়ে। আমি ওর থেকেই জানলাম কথাটা। শুনেই অবাক হলাম। এখনো মানতে পারছি না।’

‘কিন্ত এত কম বয়সে বিয়ে কিভাবে হয়? অভিভাবক কেমন গার্ড দেয়? কাজী সাহেবরা তাদের চোখ কি গাছে তুলে বিয়ে পড়ান নাকি?’

‘নুহাশ নাকি দীর্ঘ দুবছর রিলেশন করার পর তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগে। সেদিনের ছেলে নুহাশ। চোখের সামনে কতই না হই-হুল্লোড়, পড়াশোনা, খেলাধুলা করতো। আমার চোখে এখনো ভাসছে ছেলেটার চেহারা।’ কথা শেষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শফিক সাহেব।

‘আমারও তো বিশ্বাস হচ্ছে না। যার পড়াশোনা করার বয়স সে কিনা বিয়ে করে ফেলেছে। তাও আবার বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই!’
তৌসিফ সাহেব কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চিন্তায় মজে রইলেন।

‘স্যার আমাদের কিছু একটা করা দরকার। নইলে এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের এই অজপাড়া গাঁয়ে একজনও শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যাবে না।’

‘ঠিক বলেছেন শফিক স্যার। ছাত্রছাত্রীদের উপর এবার থেকে কড়া নজর রাখতে হবে। পরবর্তীতে যদি শোনেন বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তাদের অভিভাবক, তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি তখন পুলিশের শরণাপন্ন হবো। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা নয়। দুটো প্রাণের ব্যাপার।’

‘এটাই ভালো অপশন স্যার। তবে আমাদের গ্রামে ছেলের বিষয়ে আপনি শীর্ষ স্থানে। আসলে কথাটা না বললেই নয়, আমাদের কাব্য খুবই ভালো একটা ছেলে। পড়াশোনা হোক কিংবা ভদ্রতা। সব দিক থেকে এগিয়ে সে। আমার খুবই প্রিয় সে। কাব্যকে আমি কখনোই কোনো শিক্ষক অথবা স্টুডেন্টসদের সাথে খারাপ ব্যবহার বা ঝগড়া-বিবাদ করতে দেখিনি। পুরো আপনার মতোই হয়েছে কাব্য। আপনার আদর্শের ছায়ায় বড়ো হয়েছে বলেই আজ সবার কাছে প্রশংসার পাত্র সে। দোয়া করি কাব্য জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাক। আজ থেকে তার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কাব্য যেন ভালো নাম্বার পায় এই দোয়াই করি।’

তৌসিফ প্রশান্তিকর হাসির সঙ্গে বলে উঠলেন,
‘আমিন। অসংখ্য ধন্যবাদ শফিক স্যার। আপনাদের দোয়াই কাজে লাগবে। আশা করি আপনাদের মতো মানুষের দোয়ার জন্যই আমার কাব্য একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। যেমনটা আমি চাই।’

‘কাব্যর উপর আমারও পুরো বিশ্বাস আছে। কিন্তু ভালো ছেলে মেয়ে খারাপ হতে বেশি সময় লাগে না স্যার। উদাহরণস্বরুপ, আমার নিয়ত যতই ভালো হোকনা কেন, খারাপ মেলামেশা করলে আজ নাহয় কাল আমি খারাপ হতে বাধ্য থাকিবো। এটাই বাস্তব। আমাদের ঝিকাতুলি গ্রামের মানুষ কতটা নিকৃষ্ট জানেনই তো। অন্যের ভালো কেউ দেখতে পারেনা এখানে। কেউ একটু উপরের দিকে উঠতে চাইলেই লোকেরা ওতপেতে বসে থাকে তাকে মাটিতে নামানোর জন্য। আশা করি আপনি বুঝেছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি।’

‘হুম কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন শফিক স্যার।’

‘তাহলে আমি আজ বাড়ি গেলাম স্যার।’

‘জ্বি, যেতে পারেন।’

শফিক সাহেব চলে যান। কিন্তু যেতে যেতে এক পাহাড় দুঃচিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে যান তৌসিফ সাহেবের মাথায়। তৌসিফ সাহেব গভীর মনোযোগসহ শফিক সাহেবের শেষের কথাগুলো বারবার তার মস্তিষ্কে আওড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ ভাবার পর তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন,
‘শফিক সাহেবের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। আমি যদি কাব্যর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি, তাহলে আমাকে যেভাবেই হোক এ পাড়া অতি শীঘ্রই ছাড়তে হবে। নইলে আমার ছেলের কপালে খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে। যা আমি কখনোই হতে দিতে পারি না। সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তাই যতদ্রুত সম্ভব কিছু একটা করতে হবে আমাকে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here