গোধূলিলগ্ন 9

0
637

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৯

আরও ছয়টা দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। মিতু এই ছয় দিন ইচ্ছে করেই নদীর খাটে আসেনি। কাব্য খুব অস্থির হয়ে আছে তার মিতুবুড়িকে এতদিন দেখতে না পেয়ে। মনে তার বিষন্নতার উথাল পাথাল ঢেউ। সে না পারছে ছুটে তার মিতুবুড়ির কাছে যেতে, আর না পারছে স্কুল ছুটির সময় রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে তার মিতুবুড়ির জন্য অপেক্ষা করতে। দুটো কাজেই বিশাল এক দেয়াল তার এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্য জানে প্রথম উপায়টি বেছে নিয়ে তার মিতুবুড়ির বাড়িতে গেলে আবুল কালাম নির্ঘাত তুলকালাম এক কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। এতে তার মিতুবুড়িরই কষ্ট হবে। আর কাব্য তা চায়না। সে চায়না তার জন্য তার মিতুবুড়ির কোনো ক্ষতি হোক। পক্ষান্তরে, সে যদি দ্বিতীয় উপায়টি নির্বাচন করে তাহলে পাড়ায় এটা নিয়ে মস্ত এক গুজব ছড়িয়ে পড়বে। কাব্য খুব সচেতন একটা ছেলে। তার বাবা তৌসিফ সাহেব খুব সম্মানীয় একজন ব্যক্তি। পাড়ায় প্রায় প্রতিটি লোক তৌসিফ সাহেবকে খুব মেনে চলে। শ্রদ্ধা করে। কাব্য চায়না তৌসিফ সাহেবের এত বছরের অর্জিত সম্মান ওর জন্য ধূলিসাৎ হয়ে যাক। গ্রামীণ অজপাড়া গাঁয়ের লোকজনের মন মানসিকতা অতি নিকৃষ্ট। তারা প্রতিনিয়ত অন্যের ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগে থাকে। একটা সামান্য ঘটনাকে টেনে হেঁচড়ে বিশাল অট্টালিকায় রূপ দিতে তাদের কষ্ট করে বছরের পর বছর পরিশ্রম করতে হয়না। তার জন্য মাত্র অল্প কিছু সময়ই যথেষ্ট। কার মেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অমুকের ছেলে অমুকের মেয়ের সাথে প্রেম করে, তমুকের ছেলেমেয়ে পালিয়ে গেছে। এসব যেন গ্রামীণ অজপাড়া গাঁয়ের এক অনন্য স্লোগান। যা চোখের পলকে ঝড়ের গতিতে পুরো গাঁ কাঁপিয়ে তুলতে সক্ষম। কাব্য জানে এদের জীবনেও শিক্ষা হবে না। আজ যাকে নিয়ে পুরো গাঁয়ে সমালোচনার ঢোল বাজবে, একদিন সে-ই অন্যের কুকীর্তি নিয়ে রঙ তামাশা করবে৷ দাঁত কেলিয়ে অন্যকে কিভাবে নিঁচু করা যায়, তা কেবল অজপাড়া গাঁয়ের কুখ্যাত সব নিম্ন মন মানসিকতার লোকেরাই জানে। অন্যকে নিয়ে সমালোচনা করাটা যেন তাদের স্বভাব না, এটা তাদের অর্জিত মহৎ গুন। কাব্য এসব ভেবেই নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে। গ্রামের আলো বাতাসে বড়ো সে। তাই সে খুব সহজেই গ্রামের সকল দিক প্রতিকূলতা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। কাব্য মিতুকে নিয়ে মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন পুষে রেখেছি ঠিকই, কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ শুধু তার মা অবধিই সীমাবদ্ধ। কখনো মনের ভুলেও কাব্য তার কাছের বন্ধুদের সাথেও মিতুকে নিয়ে তেমন গুরুতর পর্যায়ের আলোচনা করেনি। কারণ সে জানে, বন্ধুরাও এই পাড়ারই বাসিন্দা। সময় আসলে তারাও নিজেদের নিকৃষ্ট স্বভাব পেশ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করবে না। তাইতো মন খুলে বন্ধুদের নিকট নিজের মনের অতল গভীরতা প্রকাশ করেনা কাব্য। সেই প্রকাশ সীমা শুধুই পড়াশোনা অবধি বরাদ্দ। দিন শেষে কাব্যর সকল ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয় তার মা। কাব্য জীবনে কখনো ভেঙে পড়েনি। কারণ কখনো সেই সুযোগটাই সে পায়নি। তার পাশে সবসময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে রেখা বানু। তিনি সর্বদাই কাব্যকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। ভালবাসা, মায়া, মমতা দিয়ে কাব্যকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি সব বিষয়ে কাব্যকে স্বাধীনতা দিয়ে এসেছেন। রেখার চরিত্রে মায়ের ভালবাসার থেকেও বন্ধুদের ভালবাসা বেশি প্রকাশ পেয়েছে। অন্য দিকে তৌসিফ সাহেবের চরিত্রে আদর্শ, কঠোরতা ও বিচক্ষণতার প্রকাশ পেয়েছে। রেখা বানু ছেলের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদার হলেও তৌসিফ সাহেব খুব কড়া। তিনি সবসময় কাব্যকে কড়া শাসনে রাখেন। যদিও বেশিরভাগ সময় বিদ্যালয়ের কাজেই মগ্ন থাকেন তিনি। তবুও অতি ব্যস্ততার ভীড়েও ছেলের খবরাখবর নিতে একটুও ভুল করেন না। ছেলেকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তার বিশ্বাস একদিন কাব্য তার নাম উজ্জ্বল করবেই করবে। কাব্যর মনেও একই স্বপ্ন। সে অনেক বড়ো হতে চায়। সমাজের চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটাতে চায়। সাথে তার মিতুবুড়িকে আপন করে পেতে চায়। কাব্য এখনো আঠারোতে পা ফেলেনি। কিশোর ছেলে। তবুও যেন খুব বোঝে সে। তার চিন্তাধারা কোন ম্যাচিউর লোকের চেয়ে কম নয়। পড়াশোনায় কখনো কোনো প্রকার গাফিলতি দেখায়নি সে। সবকিছু ঠিক রেখে একটু অবসর নিতে চায়, একটু বিনোদন চায়, হৃদয় ফুরফুরে করতে চায়। আর এটা সম্ভব করতে পারে কেবল তার মিতুবুড়ি। কিন্তু গত কদিন যাবৎ কাব্য তার মিতুবুড়িকে দেখেনি। তাই মনের মধ্যে অনেক কথা জমাট বেঁধেছে তার। যা কাব্য কেবল তার মিতুবুড়িকেই শোনাতে চায়। বসে থাকতে থাকতে গত পাঁচ দিনের মতো আজও কাব্যর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এক প্রকার হাঁপিয়ে উঠেছে বলা যায়।

‘এভাবে আর কতদিন বসে থাকবো একা একা? আগের বার পরাপর তিনটা দিন অপেক্ষার পর তোর দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার ছয়দিন পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তোর আসার নাম গন্ধই নেই। আর ভালো লাগছে না আমার। কি চাস তুই মিতুবুড়ি? যতদিন যাচ্ছে, তুই আমার থেকে তত যেন দূরে সরে যাচ্ছিস। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রথম প্রথম তুই রোজ দেখা করতি আমার সাথে। কিন্তু এখন একদিন দেখা হলে আবার কবে হবে সেই চিন্তায় বসে থাকতে হয় আমাকে। তোকে কতদিন আমার নয়ন দুটো মন ভরে দেখেনি। আমার সবকিছুই যে এলোমেলো হয়ে গেছে। তুই আয় না! এসে আমার ভগ্নহৃদয় টা জোড়া লাগিয়ে দে না। সবকিছু গুছিয়ে দে আগের মতো। দুদিন পর আমার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তখন আর আমি কদিন নদীর ঘাটে আসতে পারবো না। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোর সাথে দেখা করবো না। ভেবেছিলাম সব মনোযোগ পরীক্ষার উপর রাখবো। কিন্তু তার আগেই তুই আমাকে একা করে দিলি? আজ তোর সাথে মন ভরে কথা বলবো- এই শেষ আশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। কিন্তু আজও আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভেরত যাব মনে হচ্ছে। তুই কেন বুঝিস না আমাকে? তোর সাথে অনেক,,,,গলা আটকে আসলো কাব্যর। সে বার দুই কাশি দিয়ে আবার বলল, তোকে অনেক কিছু বলার আছে। তুই যদি আমাকে শুভ কামনা না দিস, তাহলে আমি শান্তি মতো পরীক্ষা দিতে পারবো নারে। আজ এক মিনিটের জন্য হলেও আমার সাথে দেখা করে যা প্লিজ। শুধু এক মিনিটের জন্য।’

কাব্যর চোখ গড়িয়ে নোনা পানি পরতে লাগলো। মিতুকে এক ঝলক দেখার জন্য তার শরীরের প্রতিটি শিরা ধমনী পর্যন্ত আকুল হয়ে উঠেছে। আজ কাব্যর চোখ যেন বাঁধ মানতে চাইছে না। বুকের চিনচিন ব্যাথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে ফেলেছে। কাব্যর কলিজা ঠান্ডা হলো দূর থেকে দৌঁড়ে আসা মেয়েটিকে দেখে। কাব্য ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল। শুষ্ক অধর নেড়ে বলল,
‘ওইতো আমার মিতুবুড়ি।’

মিতু নয়নার সাথে দৌঁড়ে আসছে কাব্যর দিকে। মিতুর দৌঁড়ের গতি কমে যায় কাব্যর কাছে এসে। মিতু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘আমি বাজানের লাইগ্যা এই কয়দিন আইতে পারি নাই। আইজ নয়নার স্যারে প্রাইভেট পড়াইতে আহে নাই। ওর উছিলায় বাইত থেইক্যা বাইর হইছি। নাইলে মায় বাইরাইতে দিতো না। বাজান কইয়া দিছে আমি যেন ইশকুলে যাওয়া ছাড়া বাইত থেইক্যা না বাইরাই। তুমি রাগ কইরো না কাব্য ভাই। আমি ইচ্ছা কইরা কিছুই করি নাই।’ মিতু কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ফেলল।

‘আমি জানি রে মিতুবুড়ি, তুই ইচ্ছে করে কিছুই করিসনি। ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। তোকে শেষ বারের মতো দেখার সুযোগ পেয়ে আমি খুব খুশি হলাম।’

‘শেষ বার মানে! তোমার কি হইছে কাব্য ভাই? চোখ মুখ ফোলা ক্যান? তুমি কি কান্তাছিলা?’

কাব্য ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার কিছুই হয়নি। তুই বল কেমন আছিস?’

‘তোমার কি হইছে কাব্য ভাই? আমারে খুইল্যা কও। তুমি কি কিছু লুকাইতাছো আমার থেইক্যা?’

মিতুর ব্যাকুলতা কাব্যর সব অভিমান ধূলিসাৎ করে দেয়।
‘কিছু না। তোকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলাম। কালকের দিন পর আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। কাল থেকে আমি আর নদীর ঘাটে আসবো না। আজই শেষ। তাই বললাম শেষ বারের মতো তোকে দেখে খুশি হলাম।’

‘এইডা কেমন কথা কইলা কাব্য ভাই? পরীক্ষার পরতো আবার দেখমু তোমারে। আবার আমরা দুইজনে এইহানে বইয়া মন খুইল্যা গল্প করুম। তুমি চিন্তা কইরো না। মন দিয়া পড়ো। আমি জানি তুমি ভালো নাম্বারে পাশ করবা। আমার কাব্য ভাই অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।’

‘কিন্ত তোর সাথে যে বেশ কয়দিন দেখা হবে না আমার!’ মলিন মুখে বলল কাব্য।

‘চিন্তা কইরো না কাব্য ভাই। দিন দেখতে দেখতে চইল্যা যাইবো। আমি কিন্তু অপেক্ষা করুম তোমার লাইগ্যা।’

তখন নয়না বলল, ‘হ কাব্য ভাই। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি আছি। আমি তোমার মিতুবুড়িরে ছায়ার মতো আগলাইয়া রাখুম।’

নয়নার কথায় কাব্য স্বস্তি পায়। কাব্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে বলে,
‘আমি এই বিষয়টা নিয়ে একদম নিশ্চিন্ত। নয়না থাকতে মিতুবুড়িকে কেউ কিছুই বলতে পারবে না। নয়না তোকে অনেক ধন্যবাদ। তোর জন্য আমি আমার মিতুবুড়িকে দেখার সুযোগ পেলাম। আমার ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেল।’

‘ধন্যবাদ দিতে হইবো না কাব্য ভাই। মিতু খালি তোমার না আমারও অনেক ভালো বন্ধু। মিতুর খুশির জন্য আমি সব করতে পারুম। এইবার মন ভইরা কথা কইয়া নেও তোমার মিতুবুড়ির লগে।’

সেদিন কাব্য আর মিতু বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি। সন্ধ্যা নেমে এসেছিল বলে ওদের বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here