গোধূলিলগ্ন 11

0
1198

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১১

মিতুর মন ভালো না। তার কাব্য ভাইয়ের আজ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। মাস খানেক কাব্য ভাইকে আগের মতো সে আর পাবে না। আগের মতো কাব্য ভাই তার সাথে নদীর ঘাটে বসে গল্প করবে না, চানামুঠ নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে না, নাক টেনে বলবে না “তুই আর বড়ো হলি নারে মিতুবুড়ি।” মিতু কাব্যর সাথে কাটানো সময় গুলো মনে মনে উপলব্ধি করছে। মাঝে মাঝে কাব্যর সাথে কাটানো খুশির মুহুর্ত কল্পনা করে হাসির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। তবে সেই হাসি যেন কয়েক সেকেন্ডেই সীমাবদ্ধ রইল। কারণ খানিক পর পর মিতুর মন ঝাকি দিয়ে ওঠে। মিতুর মনে পড়ে তার কাব্য ভাই বেশ কদিন তাকে ভুলে থাকবে। আপন করবে শুধুই বইকে। তার মিতুবুড়িকে ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে করবে না। আজ সারাদিন এই ভাবনাটাই মিতুকে দু মিনিটের জন্যও শান্তি দিচ্ছে না। মিতুর সর্বত্র জুড়ে এই ভাবনাটাই তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। যেই তোলপাড় দমন করার সাধ্যি মিতুর নেই। তা কেবল তার কাব্য ভাই-ই পারবে। আজ মিতুকে বিষন্নতার বায়ু গ্রাস করে ফেলেছে। যে বায়ুর কবল থেকে একমাত্র তার কাব্য ভাই-ই তাকে বাঁচাতে পারবে।

মিতুর মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। ভালো লাগা, মন্দ লাগার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দিনকে দিন। অনেকটা গোছালো হয়ে গেছে। নিয়ম করে চুলে তেল পানি মাখে। ওড়নার সঠিক ব্যবহার শিখে গিয়েছে। মিতু এখন আর কারো থেকে বকা শোনে না ওড়নার ব্যবহার নিয়ে। তার সেই বেখালি ভাবটা আর নেই। সব কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও, মিতুর বাচ্চা স্বভাবের কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি এখনো পর্যন্ত। সে কলাপাতা ছিড়ে এনে পুতুলের ঘর বানাচ্ছে। পুরো উঠোন ভর্তি কলাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা। মিতুর মা রুপালি গোসল করে এসে উঠোনের অবস্থা দেখে মহা আকারে ক্ষেপে উঠলেন। তিনি নাক মুখ দিয়ে গরম হাওয়া ছেড়ে বললেন, ‘মিতুনি! কি করলি তুই এইডা? উডান কি তুই ঝাড় দেছ, নাকি তোর বাপে দেয়?’

‘এইভাবে চিল্লাইতাছো ক্যান মা? সব সময় আমার বাপ, জাত, গুষ্টি তুইল্যা কথা কও ক্যান? মনখান আমার ভালো না। তাই মন ভালো করোনের লাইগ্যা পুতুলের বিয়া দিতাছিলাম। আমার পুতুলের বিয়া হইতাছে আইজ। পারলে দুইডা খাইয়া যাও তা না কইরা চিল্লাইয়া ফাল্লাইয়া বাড়ি কাঁপাইতাছো। তুমি এইডা ছাড়া আর কি কিছু পারোনা মা?’

‘দামড়ি মাইয়া! এহনো পুতুল দিয়া খেলতে লজ্জা করেনা? বিয়া দিলে পোলাপাইনের মা হইয়া যাবি। আর তুই কিনা পুতুল খেলোস?’

মিতুর মুখটা ছোট হয়ে আসলো। সে গম্ভীরমুখে বলল,
‘তুমি এইগুলা কি কইতাছো মা? আমি তো ছোডো মাইয়া। আমার পোলাপান কেমনে হইবো? বুবু তো আমার থেইক্যাও কত বড়ো। তারই তো এহনো পোলাপান হয় নাই, তাইলে আমি ছোডো হইয়া আমার কেমনে হইবো?’

মিতুর কথায় রুপালি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মিতুর ছোট মন না বুঝেও অনেক বড়ো একটা কথা বলে ফেলেছে। সেতুর কথা মনে আসতেই রুপালির চোখ ছলছল করে ওঠে। মেয়ের জন্য কতই না দোয়া মোনাজাত করেছে নামাজের পাটিতে। সেতুর যেন একটা সন্তান হয় তার জন্য নিয়ম করে নফল রোজাও রাখেন রুপালি। সর্বদা মেয়ের শান্তি কামনা করেন। এসব চিন্তার মাঝে কেউ একজন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রুপালিকে। রুপালি ঈষৎ কেঁপে ঘুরে তাকালেন। আচমকা সেতুকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রুপালি খুশি হবে নাকি আশ্চর্য হবে সেটা বুঝতে পারছেন না। তারপরও নিজেকে সামলে মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন, ‘কেমন আছিস রে মা? এইভাবে কিছু না কইয়া আইলি? জামাইও কি আইছে?’

সেতু উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। সেতুর কান্নার শব্দে মিতু খেলা থামিয়ে সেতুর দিকে তাকালো। সেতুকে দেখেমাত্রই সে এক ছুটে সেতুর কাছে চলে গিয়ে বলল,
‘বুবু তুই আইছোস? আমার লাইগ্যা কি আনছোস বুবু?’

তৎক্ষণাৎ রুপালি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠেন,
‘মাইয়া আমার কানতাছে আর তুই কি আনছে না আনছে হেইডা জিগাস?’

বেশ ধমকের সুরে বলায় মিতু চুপ হয়ে গেল। রুপালি সেতুকে আবার জিজ্ঞেস করল,
‘কিরে মা, কিছু কইতাছোস না ক্যান? আমি তো কিছু বুঝতাছি না। কি হইছে সব খুইল্যা ক আমারে। এমনে কাইন্দা লাভ নাই।’

সেতু কন্ঠে কান্নার রেশ বজায় রেখে বলল, ‘মা আমারে মিথ্যা অপবাদ দিয়া শ্বশুরবাড়ি থেইক্যা বাইর কইরা দিছে। তোমাগো জামাই আর আমার লগে সংসার করতে চায়না কইয়া দিছে।’

‘সংসার করতে চায়না! বাইর কইরা দিছে মানে? কিহের লাইগ্যা বাইর কইরা দিছে? কিহের অপবাদ?’ রুপালির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কূল কিনারা হারিয়ে ফেলে। তিনি দিশেহারা হয়ে মেয়েকে একের পর এক প্রশ্ন করেই গেলেন।

সেতু এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে রুপালি মাথায় হাত দিয়ে উঠোনে বসে পড়েন।
তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘গেরামের মাইনষে জানতে পারলে আমাগো এক ঘরে কইরা রাখবো। আমরা কোণঠাসা হইয়া থাকমু। বাইরে যাওয়ার উপায় থাকবো না। পুরা গেরামের মাইনষে কইয়া বেড়াইবো, আবুলের মাইয়া পরকীয়া করতে গিয়া ধরা খাইছে। তার লাইগ্যা শ্বশুরবাড়ি থেইক্যা তারে গলা ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিছে। আল্লাহ্ গো, তুমি আমারে তার আগেই মাইরা ফেলাও।’

রুজন কিছুই বুঝতে পারছে না। তার ওইটুকু মস্তিষ্কে এতো জটিল বিষয় ঢোকার কাম্য নয়৷ তবে মিতু সবটা না বুঝলেও এটা খুব ভালো করে বুঝেছে যে ওর বুবুকে ওর দুলাভাই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে অপবাদ দিয়ে।

মিতু বলল, ‘বুবু তুই চিন্তা করিস না। ভাইজান আবার তোরে এইহান থেইক্যা নিয়া যাইবো দেহিস। তুই আর কান্দিস না।’

সেতু কিছু বলল না। চুপচাপ গিয়ে এক কোণে বসে থাকলো। রাতে আবুল কালাম বাসায় এসে মেয়ের কথা শুনে ভয়ে আতংকে জ্ঞান হারানোর উপক্রম। তিনি কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মুখ খুললেন,
‘কোন মুখ নিয়া এইহানে আইলি তুই? গলায় কলসি বাইন্দা গাঙে ডুব দিয়া মরতে পারলি না? এই বয়সে আইয়া এহন হামারে মাইনষের কতা হুনোন লাগবো তোর লাইগ্যা!’

রুপালি আবুল কালামকে থামিয়ে বললেন, ‘আস্তে কতা কও কইতাছি। আমি সবাইরে কইছি মাইয়া কয়দিনের লাইগ্যা বেড়াইবার আইছে। এহন তুমি চিল্লাইয়া সাত গেরাম ছড়াইয়ো না দয়া কইরা।’

‘আইজ নাইলে কাইল সত্য সামনে আইবোই রুপালি। আমি বুক ফুলাইয়া কইতাম, হামার সেতু মার লাগান মাইয়া এই পুরা গাঁয়ে একটাও নাই। গেরামের পতিডা লোকে সেতুরে ভালো কয়। এইগুলা যদি হোনে তাইলে কি অবস্থাখান হইবো ভাবছো তুমি?’

রুপালি কিছু বললেন না। সেতু বলল,
‘বাজান তুমি আমারে বিশ্বাস করো। আমি এই খারাপ কাজখান করি নাই। আমার ননাশরে আমি হাতেনাতে ধরছিলাম হেই আকিজ ভাইয়ের লগে। হেয় নিজে বাঁচতে গিয়া আমারে ফাঁসায় দিছে। দয়া কইরা আমার কথাখান বিশ্বাস করো বাজান।’ সেতু বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে তবুও আবুল কালামের মন মানছে না।

‘এইডা তো গাঁয়ের মাইনষে বুঝবো না। তোর শ্বশুরবাড়ির মাইনষেগো মতো হেরাও তোর দোষখানই দেখবো। আমার পোড়া কপালে সুখ নামের শব্দখান নাই-ই নাই। হায় কপাল!’ আবুল কালাম নিজের কপাল থাপড়াচ্ছেন কিছুক্ষণ পর পর।

তখনই সেতু আবুল কালামের দিকে অগ্নি চক্ষু তাক করে বলল,
‘আমার বিয়া দিছিলা ক্যান? সখ কইরা মাইয়ারে বড়ো ঘরের বউ বানাইয়া পাডাইছো। তোমরা কি জানো না বড়ো গাছে লাউ বান্ধোন যায়না? তাইলে সেই লাউ শক্ত হইয়া ঝুইল্যা থাকতে পারে না। তোমরা তো ভাবো আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমরা তো আর জানো না, আমারে পতি দিন তোমাগো জামাই মারে তো মারে, সাথে শ্বাশুড়ি আর ননাশও কম নির্যাতন করে না। শরীরে এত কাটা ছেঁড়ার দাগ দেইখ্যাও বোঝো না আমি কত সুখে আছি? তিনবেলা খাইতে পারি ঠিকই, কিন্তু গরুর লাগান খাটার পর। ভালো শাড়ি পরি ঠিকই কিন্তু মাইনষেরে দ্যাহানোর লাইগ্যা। আমার শ্বাশুড়ি মাইনষেরে দ্যাহাইতে চায় বাড়ির বউরে দামি শাড়ি পরায় রাহে। হেরা তো জমিদারের বংশ। শিক্ষিত বংশ। আমার খাওয়া, পড়া নিয়া যে কি পরিমাণে উঠতে বইতে খোটা দেয়, তা কেবল আমিই জানি। আমার শ্বাশুড়ি কয়, ফকিরের মাইয়া হইয়া ভালো কাপড় পরতাছোস, ভালো খাইতাছোস এইডাই অনেক। ননাশে কয়, মুর্খ মাইয়া মানুষ হইয়া এই বাড়ির বউ হইছি, এইডা নাকি আমার ভাগ্য। আর তোমাগো জামায়ের কথা আর কি কমু? আমারে বিয়া করার পরও আরও দুই তিনখান বিয়া করছে হেয়। ভাবছিল তাগো যদি ছেলেমেয়ে হয়। কিন্তু তাগোও কোন ছেলেমেয়ে হয় নাই। আমার মতো তারা মাইর গুতা খাইতে পারে নাই দেইখ্যা বছর ২ পার হইতে না হইতেই পালাইয়া গেছে। লজ্জার কথা আর কি কমু? তোমাগো জামাই পতি রাইতে মাইয়া মানুষ লইয়া পইরা থাকে। আমারে দুই চোক্ষেও দেখতে পারে না। কয় আমার দোষ আছে বইলা পোলাপান হয়না। আইচ্ছা, আমার যদি দোষ থাহে, তাইলে বাকী যেগুলারে বিয়া করছিল তাগো পোলাপান ক্যান হয় নাই? কয় দিন পর পর আমার শ্বাশুড়ি এই কবিরাজ, সেই কবিরাজ আইন্যা ঝাড়ায় আমারে। কই কোনো দিন তো তার পোলারে ঝাড়াইলো না? তারা ভাবে দোষ বাড়ির বউগো। সমস্যা খালি বাড়ির বউগোই থাহে। আর পোলারা তো স্বর্ণের আংটি। তাগো তো সমস্যা থাহার কথা না। খালি এই পোলাপান হয়না বইলা কম কথা শুনলান না। কম মাইর খাইলাম না। তোমাগো কি? মাইয়ারে ভালো, বড়ো পরিবারে বিয়া দিয়া তোমরা বাঁইচ্চা গেছো। মাইয়া মইরা গেলেও তোমাগো কিছু আইবো যাইবো না। কারণ তোমরা তো দায়িত্বমুক্ত। আইজ বাজান কইলো গলায় কলসি বাইন্দা মইরা যাইতে! এই চিন্তা আমার মাথায়ও অনেকবার আইছিল। কিন্তু যতবার আত্মহত্যার দুঃসাহস দেহাইছি, ততবার তোমাগো কথা মনে আইছে খালি। আমি যদি মইরা যাইতাম তাইলে তোমরা নিজেগো কোনদিনও ক্ষমা করতে পারতা না। আর জাহান্নামের ভয় তো আছেই। তার লাইগ্যা আমি ভাইব্যা নিছিলাম আত্মহত্যা করুম না ঠিকই কিন্তু মাইর খাইয়া মরুম। উঠতে বইতে যেই মাইর গুতা খাই, তাতে একদিন না একদিন মরতে হইবোই আমারে। এই আশায় মুখ বইজ্যা সব সইতাম।’

‘তুই এই কতা গুলা আগে জানাস নাই ক্যান মা?’ কাতর গলায় বললেন আবুল কালাম।

সেতু বলল,’এইসব কথা আমি তোমাগো আগে কই নাই কারণ তোমরা কিছুই করতে পারতা না জানলেও। উল্টা আমারে বুঝাইয়া সুঝাইয়া স্বামীর ঘরেই পাডাইতা। আর তোমারা অনেক কষ্ট পাইতা আমার লাইগ্যা। না পারতা সইতে আর না পারতা আমারে ফেরত নিয়া আইতে। তার লাইগ্যাই কিছু কই নাই বাজান। বাজানগো, আমারে তুমি কারো থেইক্যা ধানের সার আইন্যা দেও। তারপর নিজের হাতে পানির লগে গুলাইয়া আমারে খাওয়াইয়া মাইরা ফেলাও। মাইরা ফেলাও আমারে বাজান! আইজ যদি আমি পড়ালেখা শেষ করতে পারতাম তাইলে কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা ঠিকই হইতো। শ্বশুরবাড়ি নাইলে বাপের বাড়ির উপর বোজা হইয়া থাকতে হইতো না আমারে। দেড়ি না কইরা মুক্তি দেও আমারে। মুক্তি দেও বাজান!’

সেতুর কথাগুলো আবুল কালাম ও রুপালির কলিজায় গিয়ে বারি মারছে যেন। মেয়ের কথা শুনে আজ তারা খুবই অনুতপ্ত। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সেতুকে বুকে টেনে নিলেন। সেই সাথে এও বুঝলেন, ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দিলেই মেয়ে স্বামীর সুখ পায়না। পায়না বুক ভরা শান্তি। নিতে পারেনা স্বস্তির নিঃশ্বাস।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here