হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩৩)

0
1548

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩৩)
#নাহার
·
·
·
মেঝেতে হাটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কান ধরে আছে তুহিন। তার সামনে কয়েকহাত দূরে একটা চোয়ারে তূর্য বসে আছে। তুহিন মুখ তুলে একবার তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করে ফেলছে। তূর্যের গাল ভর্তি দাড়ি চোখ দুটো গর্তে চলে গেছে। করুণ অবস্থা। তূর্যের সাফ মানা সে আর ওই বাড়িতে যাবে না। আর তুহিন তো নাছোড়বান্দা যেভাবেই হোক তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এতোক্ষণ অনেক রিকুয়েষ্ট করেছে কাজ হয়নি তাই এখন কান ধরেছে।

তূর্য মহা বিরক্ত হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে উঠে যাবে তার আগেই তুহিন হাটুতে ভর দিয়ে হেটে এসে তূর্যের পা জড়িয়ে ধরে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
— প্লিজ ভাই আমাকে ফেলে যাস না। প্লিজ ফিরে চল। মাফ চাইছি তো আমার সব ভুলের জন্য। ভাই মাফ করে দে প্লিজ।

তূর্য মূর্তির ন্যায় বসে আছে। সে ভাবতে পারেনি তুহিন এমন করবে। এখন কি করবে একদমই বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করেই বসে আছে। আর তুহিনের সেই আকুতি মিনতি ফিরে যাওয়ার জন্য। এবার সে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করেছে। তূর্য এবার হতভম্ব। হাসিও পাচ্ছে আবার রাগও লাগছে। তাই চুপ করে কিছুক্ষণ এসব দেখছে।

——————–
সকালবেলা আফিয়া রুম থেকে বের হয়ে নিচে এলো। বাড়ির বড়রা সবাই আছে। নিচে এসে বড়দেরকে সালাম করলো। কাশফি বললো,
— বহুত হয়েছে। এবার যাও যাও কাজ শুরু করো।

আফিয়া গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বা কি বানাবে কিছুই মাথায় আসছে না। তার শ্বাশুড়ি রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন বউ দাঁড়িয়ে আছে তাই কড়া গলায় বললেন,
— এখানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এসেছো তুমি? কি রাঁধবে শুরু করো।

— আসলে মা আমিতো এখানে নতুন তাই রান্নাঘরের কিছুই খুজে পাচ্ছি না। আপনি যদি একটু খু..

সম্পূর্ণ কথা বলার আগেই মিসেস তানজুম হুঙ্কার দিয়ে বললেন,
— সাহস দেখে আমি অবাক হই। এতো সাহস পাও কই হা? শ্বাশুড়িকে কাজের ফরমাইস করছো।

কথাটা বলেই হনহন করে চলে গেলেন। আফিয়ার চোখে পানি চলে এলো। মনে মনে ভাবলো বিয়ের আগ পর্যন্ত তো সবাই কত সুন্দর করে কথা বলতো আর এখন এমন কেন করছে? চোখের কোনের পানি মুছে নিজেই সব খুজে নাস্তা বানাতে লেগে যায়। নাস্তা বানানোর সময় মাথার কাপড় পড়ে যায়। তখন রান্নাঘরে মিসেস শায়েলা আসেন। আফিয়াকে একবার দেখে বলেন,
— রান্নাঘরে যে তোমার মেঝো শ্বাশুড়ি ঢুকেছে তার খেয়াল আছে তোমার?

আফিয়া মাথা তুলে তাকালো। আস্তে করে বললো,
— খেয়াল করি নি।

— এখন খেয়াল করেছো?

— হু।

— মাথার কাপড় কই তোমার? শুনো এ বাড়িতে থাকতে হলে আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হবে। মাথার ঘোমটা যেনো কারো সামনে না পরে।

মিসেস শায়েলাও চলে গেলেন। আফিয়া এবার কেঁদে দিলো। সবাই এভাবে কেন করছে তার মাথাতেই আসছে না। বিয়ের দিন পর্যন্ত সবাই কত ভালো ব্যবহার করেছে আর এখন। ভাবতেই তার ঢুকরে কান্না আসছে। নিজেকে সামলে কাজে মন দেয় আর একটু পর পর ঘোমটা ঠিক করছে। নাস্তা বানানো শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে ডাইনিং টেবিলের মধ্যে সাজিয়ে রাখে। সবাই খেতে বসেছে। কৌশিকও বসেছে সবার সাথে। নিরা আফিয়ার কানে আস্তে করে বললো,
— আজকে তোমার নাস্তা ভালো না হলে তুমি শেষ।

একটা আতংক ঢুকে গেলো আফিয়ার মনে। ভয়ে ভয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে বললো- “সবাই তো আমাকে বসতে বলছেই না আর এই হারামি জামাইটাও বলছে না। কেমন হারামি হয়ে গেলো। হাহ্।”

সবাই বসে একসাথে খাওয়া শুরু করলো। আফিয়া ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলছে। না জানি আজ কি হয়। সবাই খাবার মুখে দিয়ে চরম বিরক্ত হয়েছে এমন চেহারা করলো। মিসেস তানজুম রাগি চেহারা নিয়ে আফিয়ার দিকে তাকিয়েছে। আফিয়া ওখানেই গলে গেছে ভয়ে। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে এখন শুরু হবে কথা শুনানোর পালা। মিসেস তানজুম রেগে আফিয়ার দিকে তেড়ে আসতেই মেয়েটা ভয়ে দু তিন কদম পিছিয়ে যায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এমন সময় কানে এলো এক ঘর কাঁপানো হাসি। প্রথমে ভাবলো ভুল শুনেছে পরে মাথা তুলে দেখলো সত্যিই সবাই হাসছে। মেয়েটা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

কাশফি এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ওরে আমার ভাবি এটা প্র‍্যাঙ্ক ছিলো বুঝলা। আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে প্র‍্যাঙ্ক করছিলাম। সেখানে তোমার বর আর শ্বাশুড়িও সামিল ছিলো। হিহি।

মিসেস তানজুম আফিয়ার মুখটা ধরে বললেন,
— আমিও ফাইজলামি করছিলাম মা। নে চোখের পানি মুছে দিলাম আর কাঁদিস না। এমন প্র‍্যাঙ্ক আর হবে না। আচ্ছা তুই করে বলেছি রাগ করিস না ঠিকাছে। কাশফিকেও তুই করে বলি। তুই আর কাশফি তো একই তাই তোকেও তুই করে বলছি।

আফিয়া ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো। কি ভয়টাই না পেয়েছিলো সে। নিরা আর ফাতেমা এসে ধরে বললো,
— সরি গো। তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য।

মিসেস শায়েলা বললেন,
— আমাদের সামনে ঘোমটা না দিলেও হবে মা। দেখ নিরাকে ওড়না নিতেও মনে থাকে না। তুই আর নিরা তো একই আমাদের কাছে তাই না। সকালের ব্যাপারটার জন্য সরি বাবু।

কথাটা বলেই কপালে চুমু দেন। আফিয়াও জড়িয়ে ধরেন নিরার মাকে। সবাই মিলে মজা মাস্তি করে খাওয়া দাওয়া করে নিলো। আফিয়া একবার কৌশিকের দিকে কড়া চোখে তাকালো। ওমনি তার হাওয়া টাইট হয়ে গেছে। বেচারা আর বেশি খেতে পারলো না। সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রাফিন নিচে নেমে এসে দেখলো কৌশিক মনমরা। আস্তে করে বললো,
— কিরে ভাই বউয়ের কেলানি খেয়েছো মনে হয়।

কৌশিক কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
— তোর এই প্র‍্যাঙ্ক আইডিয়া সফল করতে গিয়ে আমার লাল বাত্তি জ্বলতেছে।

রাফিন হাসতে হাসতে হসপিটালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেলো। কৌশিকও অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেলো।

——————–
আফিয়া এসেছে এ বাড়িতে আজ দুইদিন হয়ে গেছে। সবাই কত খুশি। ভাবতেই নিরার মনটা আনন্দে নেচে উঠে। গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে রাফিনের রুমের সামনে যায়। দরজা খোলাই ছিলো। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো রাফিন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। একটু তীক্ষ্ণ চোখে নিরা রাফিনকে পরখ করতে শুরু করেছে। কালো গেঞ্জি আর কালো টাউজার পরেছে। গেঞ্জির হাতা হাফ হওয়ায় হাতের মাসেল গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গেঞ্জিটা গায়ের সাথে লেগে থাকায় রাফিনের সিক্স পেক বুঝা যাচ্ছে। নিরা ঠোঁট কামড়ে বললো,
— ইশ! আমার ডাক্তার সাহেব।

পরক্ষণেই গালে হাত দিয়ে মনে মনে বললো,
— নিরা তুইও তোর ডাক্তার সাহেবের মতো লুচু হয়ে গেছিস দেখছি। ছিইইইইইইই!

সব বাদ দিয়ে নিরা আস্তে আস্তে রাফিনের রুমে ঢুকে ধপ করেই রাফিনের পাশে বসে পড়ে। রাফিন বই থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে নিরা। আবার বইয়ের মধ্যেই মুখ গুজে দেয়। নিরা বিরক্ত হলে। রাফিনের একটু কাছে বসেই কাধে মাথা রাখে। রাফিন বললো,
— কিছু বলবে?

— না।

আর কিছু বললো না কেউই। রাফিনের মনোযোগ বইয়ের দিকে আর নিরা কাধে মাথা রেখেই দুই হাতের আঙুল গোল গোল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু ভাবছে। বললো,
— আচ্ছা আপনাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুর নেই?

বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বললো,
— আছে।

— পুকুরে ঘাট বাঁধানো আছে?

— হুম।

— চারপাশে গাছপালা নেই?

— আছে।

— পুকুর কি বাড়ি থেকে বেশি দূরে?

— না। কাছেই।

— অল্প দূরে?

— হুম।

— কয় মিনিটের রাস্তা?

— দুই

— মাত্র?

— হুম।

— আপনার জলপাই কালারের পাঞ্জাবি নেই?

— না।

— উম! বানিয়ে নিবেন। ঠিকাছে।

— ওকে।

— আমার জন্য জলপাই রঙের সূতির শাড়ি নিবেন।

— ওকে।

— বৃষ্টির সময় একসাথে ভিজবো। আমি জলপাই রঙের শাড়ি পরে পুকুর ঘাটে বসে থাকবো আপনি পাঞ্জানি পরে দুই মুঠো ভর্তি কাঠগোলাপ নিয়ে আমার সামনে এসে বসবেন। একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো। হুম?

— ওকে।

দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নিরা আবার বললো,
— শাপলা বিল গেছেন?

— না।

— একসাথে যাবো হুম?

— ঠিকাছে।

রাফিনের এমন হুম হাম জবাবে নিরা একটু বিরক্ত হলো। তাই কাধে একটা কামড় দিয়ে দৌড়ে পালালো রুম থেকে। কামড়ের জায়গায় হাত দিয়ে ঘষে হালকা হাসলো রাফিন। আস্তে করে বললো- “জংলি বিল্লি”।

——————————
দুইমাস পেরিয়ে গেছে তূর্যকে এবাড়িতে নিয়ে এসেছে তুহিন। সারাক্ষণ তূর্যের পিছনে পিছনে ঘুরে তুহিন। ছোটবেলায় যেমন ঘুরতো তেমন। তূর্যও তুহিনকে রেধে খাওয়ায়। তূর্য রান্নাঘরে রান্না করে আর তুহিন চেয়ারে বসে দুই গালে হাত রেখে আপনমনে কিছু ভাবে আর তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে।

আজ সকালে তূর্যকে চেপে ধরেছে তুহিন। কারণ সে নিরার কাছে মাফ চাইতে চায়। তূর্য যেনো সাথে যায়। তুহিন মাফ পাবে কিনা যানে না তবে মাফ চেয়ে মনটা হালকা করবে। তাই দুইভাই রেডি হয়ে ছাদে যাচ্ছে। সেদিকে থেকে ওদেরকে দেখলে মাফ চেয়ে নিবে। ছাদে এসে দেখলো রাফিন এবং নিরা চেয়ারে বসে আছে। নিরা হাতের আঙুলে চুল পেচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে আর রাফিন পত্রিকা পড়ছে।

তূর্য এবং তুহিন তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং হালকা কেশে মনোযোগ নেয় তাদের। রাফিন এবং নিরা তাদের দেখে বেশ চমকায়। তূর্য বললো,
— ঝগড়া করতে আসিনি ভাই। তুহিন কিছু বলতে এসেছে।

তুহিন মাথা নিচু করে নিরার দিকে ফিরে বললো,
— আমি যা করেছি তার জন্য হয়তো আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। তাও আমি ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে নিরা। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও।

রাফিন নিরার হাত শক্ত করে ধরে চোখের ইশারায় বললো মাফ করে দিতে। নিরা আস্তে করে বললো,
— হু মাফ করে দিয়েছি।

তুহিন হাসি হাসি মুখে বললো,
— ধন্যবাদ। আমি এতোদিন নিজেকে অপরাধী ভেবে নিজে নিজেই খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। এখন শান্তি লাগছে। ধন্যবাদ নিরা আমার অপরাধ ক্ষমা করার জন্য।

আরো কিছুক্ষণ হেসে হেসে কথা বললো তারা চারজন। কাশফি দৌড়ে উপরে এসে ছাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো,
— রাফিন ভাই মা ডাকে তোমাদের দুইজনকে।

কথা শেষ করে সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। গলা দিয়ে আর কথা বের হয়না কাশফির। চোখে পানি টলমল টলমল করছে। নিঃশ্বাস খুব দ্রুত উঠানামা করছে কাশফির। তূর্যেরও একই অবস্থা। দুইজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য নিজেকে সংযত করে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায়। নিরা একবার কাশফির দিকে তো একবার তূর্যের দিকে তাকাচ্ছে। তূর্য চলে যাওয়ায় কাশফির খুব কান্না আসে। দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে যায় চোখ মুছতে মুছতে। নিরাও কাশফির পেছনে ছুটে যায়। এদিকে রাফিন এবং তুহিন দুজনে হতভম্ব হয়ে গেছে।

কাশফি দ্রত নামতে নামতে নিচে চলে আসে। নিরাও আসে। মেইন ডোরের সামনে মানুষটিকে দেখে থমকে দাঁড়ায় দুই বোন। ড্রয়িং রুমে বড়দের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। দুইজনেই ভাবছে এটা কিভাবে সম্ভব। নিরা মনে মনে ভাবছে “এতো বড় চাল চালবে এটা তো আমি বুঝতেই পারিনি।”
·
·
·
চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here