হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩২)

0
1694

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩২)
#নাহার
·
·
·
সবাই আফিয়াদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আফিয়াদের আত্মীয় স্বজনরা সবাই বরযাত্রীকে বরণ করে নিতে ব্যস্ত। পাশাপাশি দুটো বর বউয়ের চেয়ারে কৌশিক এবং আফিয়া বসে আছে। কৌশিক একটু পর পর আফিয়ার সাথে কানে কানে কথা বলছে আর আফিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। কৌশিক ফিসফিস করে বললো,
— এভাবে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কবে যে কাজি এসে বিয়ে পড়াবে আর আমি তোমাকে নিয়ে জলদি জলদি চলে যাবো। এতো দেরি ভাল্লাগছে না।

আফিয়া মাথা নিচু করে আস্তে করে বললো,
— তোমার লজ্জা সরম নেই নাকি। এভাবে সবার সামনে এসব বলতে লজ্জা লাগছে না?

— না। একদমই না। আমার বউ আমি নিয়ে যাবো কথা বলবো তাতে কার কি?

— বউ এখনো হইনি।

কথাটা বলে চোখ গরম করলো আফিয়া। কৌশিক মুখ গোমরা করে অন্যদিকে ফিরে গেলো। তার আর ভালো লাগছে না এসব অনুষ্ঠান। কি দরকার এসবের? কাজি নিয়ে আসবে কবুল বলেই বউ নিয়ে যাবো সেটা না যত্তসব। এমন সময় রাফিন এসেছে কৌশিকের কাছে। কৌশিকের পাশে হালকা বসে আস্তে করে বললো,
— এতো অধৈর্য্য হলে কেমনে হবে মিয়া? আরেকটু সময় তারপরই তো আফিয়া তোর।

— তোর সময় যখন আসবে তখন বুঝবি ধৈর্য কি। হাহ্।

— আচ্ছা তাই।

রাফিন আনমনে কথাটা বলে পুরো মজলিসে নিরাকে খুজতে শুরু করে। এক কোণে পেয়েও যায় নিরাকে। বান্ধুবিদের সাথে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর তো হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে তাদের গায়ে। নিরা একটা সাদা সিলকের গাউন পরেছে। ফুল হাতা। কাপড়ে গোল্ডেন স্টোনের কাজ। গোল্ডেন কালারের হিজাব বেধেছে। মেকাপ এতো বেশি নেই। হালকা সাজ। এতেই চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছে। যখনই হাসছে মনে হচ্ছে একটা সাদা পরি প্রাণ খুলে হাসছে। তার হাসির আওয়াজে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। রাফিন একনজরে নিরার দিকে তাকিয়েই কৌশিককে বললো,
— আমিতো উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার বউকে।

কৌশিক হালকা পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
— আমাকেও বউ নিয়ে পালিয়ে যেতে হেল্প কর ভাই।

রাফিন একগাল হেসে অন্যদিকে চলে গেলো। এরমধ্যেই কাজি চলে এলেন। নিরা স্টেজ থেকে একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেছে। কৌশিককে কবুল বলতে বলায় এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে কবুল বলে দেয়। আফিয়া আরো বেশ লজ্জা পাচ্ছে। সবাই একসাথে হাসছে। নিরাও হাসছে। এমন সময় পেছন থেকে কাধে হালকা ভাবে কেউ ধাক্কা দেয়। নিরা একটু চমকে যায়। পাশে তাকিয়ে দেখলো রাফিন দাঁড়িয়ে আছে। বুকে হাত ভাজ করে সামনে তাকিয়ে হাসছে।

আজকের বিয়েতে রাফিন একদম নরমাল ভাবে এসেছে। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছে। হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। বুকের দুইটা বোতাম খোলা। এতে করে বুকের লোম অল্প দেখা যাচ্ছে। মাথার সিল্কি চুলগুলো থেকে একয়েকটা কপালে ছড়িয়ে আছে আর ঠোঁটে সেই মন ভুলানো হাসি। এমন লুকে নিরার বুকে তোলপাড় শুরু হয়। পলকহীনভাবে রাফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিন ঠোঁট উল্টে কানে ফিসফিস করে বললো,
— জানিতো আমাকে সুন্দর লাগছে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ওদের বিয়ে দেখো।

নিরার সামনের দিকে মুখ ঘুরায়। রাফিন হালকা হাসে। নিরার বুকে এখনো তোলপাড় চলছে। দুইহাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। এই মুহুর্তে তার সেই পুরানো একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে৷ তুহিনের সাথে যেদিন নিরার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সেদিন তুহিন ঠিক এভাবেই এসেছিলো। একদম রাফিনের মতো করেই আসে৷ তারপর রাতে তাকে খুব অপমান করে এবং পরের দিন তাকে পুরো এলাকায় চরিত্রহীন বানিয়ে দেয়। নিরা চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। কেনো যেনো এই দৃশ্য বারবার চোখে ভাসছে আজ। মনে মনে ভাবছে “তবে সেদিনের মতো করেই কি আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে?” একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিরার। হাতে কারো ছোয়া টের পেয়ে চোখ খুলে তাকায়। দেখলো রাফিন তার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। নিরার মলিন হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে রাফিনের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। মনে মনে ভাবলো “তবে কি এতোদিনেও মেয়েটার মন থেকে তার সেই বাজে অতীত মুছতে পারিনি?” রাফিন আরো শক্ত করেই নিরার হাত ধরে।

দুইজন সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিন আস্তেকরে বললো,
— ওইসব ভেবো না নিরুপাখি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সবাই এক না। তোমাকে আমি কোনোদিন ছেড়ে যাবো না। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করে দেবো। যদি কোনোদিন বাধ্য হয়ে তোমায় ছাড়তে হয় তবে অপেক্ষা করো আমি তোমার কাছে ঠিক ফিরে আসবো। এই নিরুপাখিকে রাফিন নামক খাচায় বন্দী করতে।

নিরা কিছু বললো না। সেও শক্ত করে ধরে রাফিনের হাত। বিয়ে পড়ানো শেষ। সবাই কথা বলছে। রাফিন ফিসফিস করে আবার বললো,
— উমম! আমারো বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। চলো আমরাও বসে যাই কাজি আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিক। কি বলো?

নিরা চোখ গরম করে রাফিনের দিকে তাকালো। রাফিন দাত কেলিয়ে হাসছে। এই হাসি দেখে নিরা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে রাফিনের দিকে। “যাক এই একটা মানুষ বলেছে তাকে ছেড়ে যাবে না।” নিরাও একটা হাসি দেয়।

বিদায়ের পালা শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো ফেরার উদ্দেশ্যে।

————————————————–
তুহিনকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। এখনো হুইলচেয়ারে বসে আছে সে। একয়েকদিন তূর্যকে না দেখে কেমন যেনো বিষন্নতায় ভরে উঠছে তার মন। অনেক খোজ খবর নিয়েও তূর্যের কোনো হদিস পেলো না তুহিন। এবার বেশ ভয় কাজ করছে মনে। হঠাৎ করে কোথায় গায়েব হয়ে গেলো তূর্য এটা ভেবে টেনশনে মাথা ঝিমঝিম করছে তুহিনের।

——————————

রাতে সবাই কৌশিককে ধরেছে দরজার সামনে। টাকা না দিলে নাকি ঢুকতে দিবে না ভেতরে। ফাহিম, নাঈম আর ফায়াজও ছিলো মেয়েদের সাথে। কৌশিক অবাক হয়ে বললো,
— কয়দিন পর তোরাও বিয়ে করবি আর এখন আমাকে রুমে ঢুকতে দিচ্ছিস না। এ কেমিন বিচার?

ফাহিম বললো,
— পরেরটা পরে এখনেরটা এখন হবে। টাকা দাও নাহলে ঢুকতে দিবো না।

— ভাই আমার শোন, তোর আফিয়া ভাবি কান্না করবে আমাকে ঢুকতে না দিলে।

নাঈম হেসে বললো,
— আফিয়া ভাবি বেশ মজা নিচ্ছে। বিনোদন পাচ্ছে। এখন কথা না বাড়িয়ে টাকা বের করো ভাই। নাইলে সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

কৌশিক অসহায়ের চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। নিরা আর কাশফি দুইজন দুইদিক থেকে দুইহাত চেপে ধরে বললো,
— ওলে আমার ভাইটা কানদে না। পানি খাবে বাবু? কিন্তু আজকে পানি খেতে হলেও যে টাকা দিতে হবে।

— আমার বাড়িতে আমি টাকা দিয়ে পানি খাবো নাকি?

— ওলে ওলে। হ্যাঁ বাবু৷

কাশফি কৌশিকের গাল ধরে টানছে। কৌশিক রেগে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো। রাগে ফোসফাস করতে করতে পকেট থেকে তার ক্রেডিট কার্ডটা বের করে দেয়। ফাতেমা ছো মেরে নিয়ে নেয়। সাথে সাথেই দরজার থেকে সবাই সরে পরে। কৌশিক রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে লাগাতে বললো,
— তোদের বিয়ের দিনও আমি দেখে নিবো। হুহ।

বলেই দরজাটা খপ করে লাগিয়ে দেয়। সবাই একসাথে হেসে লুটুপুটি হচ্ছে।

—————————————-
রাতের দেড়টা বাজে। খুব দ্রুত ড্রাইভ করছে তুহিন। মনে হাজার উত্তেজনা তার। চোখে পানি বাধ মানছে না। একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থামায়। গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় তুহিন। সামনে খাদ এবং এরপরে জঙ্গল। চারিদিকে হালকা বাতাস বইছে। তুহিন হাটু গেড়ে বসে খুব জোরে চিৎকার করে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্রমশ চিৎকার করেই কাঁদছে।

আজ একমাস পেরিয়ে গেলো তুহিন এখনো খোঁ জ পায়নি তূর্যের। পুরো শহর খুজেছে। এমনকি হাসপাতাল, পুলিস স্টেশন সব জায়গায় খুজেছে। কিন্তু কোথাও পেলো না তূর্যকে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে । কি করে পারলো তার বাবার মতো আগলে রাখা বড় ভাইকে এভাবে অপমান করতে। সেদিনের কথাগুলো ভাবলেই আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে তুহিনের। তার ভাইকে সে কোথাও খুজে পাচ্ছে না। ছোট থেকেই এই তূর্যই তাকে আগলে রেখেছে। কখনো নিজেকে অসহায় মনে হলে তূর্যই তাকে শিখিয়েছে কিভাবে সে আবার স্বাভাবিক হবে। আর আজ এতো অসহায়ের সময় তূর্য নেই তার পাশে। তার ভাই নেই তার পাশে। তুহিন আবার চিৎকার করে বলে,
— প্লিজ ভাই ফিরে আয় প্লিজ। মাফ করে দে আমাকে। দরকার হয় মেরে হাত পা ভেঙে দে তাও দূরে থাকিস না ভাই প্লিজ।

এখানে তুহিনের চিৎকার শুনার কেউ নেই। আশেপাশে সব নির্জন এলাকা। ঘরবসতি নেই বললেই চলে।

কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় ফিরে। আজকাল তার মাকে কেমন যেনো অসহ্য লাগে। এই মহিলাটার জন্যই তূর্য চলে গেছে। তাই ঠিকমত কথাই বলে না তুহিন তার মায়ের সাথে। এখন সে খুব বুঝতে পারছে তার মায়ের আসকারায় সে কতটা নিচে নেমে গেছে।

ঘরে ঢুকতেই মিসেস তনিমাকে দেখে তুহিনের রাগ হয়। কোনো কথা না বলেই দপদপ করে সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত রেখে ভাবছে কোথায় যেতে পারে তূর্য। চোখটা লেগে আসবে আসবে এমন সময় মাথায় এলো তূর্যের ঘরটা একবার সার্চ করে দেখলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। ঝটপট করে উঠে তূর্যের রুমে ঢুকে পড়ে। কত সুন্দর করে গোছানো রুমটা। তুহিন বরাবরই খুব অগোছালো। তাকে সবসময় তূর্যই ঘুছিয়ে রাখতো। তার রুমটা পর্যন্ত তূর্য গুছিয়ে রাখতো।

তূর্যের রুমে ঢুকে লাইট জালালো। রুমের মাঝ বরাবর বেড। একপাশে কাবার্ড, ড্রেসিং টেবিল। অন্যপাশে বুক সেলফ, পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলের প্রতিটা জিনিস খুব গোছালো। বুক সেল্ফের প্রতিটা বই খুব গোছানো। মাথার পাশের দেয়ালে সাদা রঙ এবং সেখানে কালো রঙে গাছ আর পাখি আঁকা। তূর্যের এইভাবে ঘর সাজাতে খুব ভালো লাগতো। সব দেয়ালে এমন নকশা। তূর্য খুব সুন্দর আর্ট করতে পারে। কারণ তূর্য আর্কিটেকচার। বেড সাইডের টেবিলে তূর্য আর তুহিনের একসাথে তোলা ফ্রেমে বাধানো ছবি। সেটা দেখে বেডে বসে ছবিটা দেখতে শুরু করে। অপরপাশের টেবিলে চোখ যেতেই উঠে এসে এপাশে বসে। এখানে তূর্যের কাধে তুহিন এইরকম একটা ছোটবেলার ছবি ফ্রেমে বাধানো। সামনে তাকিয়ে দেখলো পড়ার টেবিলের বা পাশের খালি জায়গায় চক দিয়ে আঁকা দুইটা মানুষের ছবি। তুহিনের সেটার সামনে বসে আনমনেই হেসে উঠে।

তুহিনের তখন দুইবছর বয়স ছিলো আর তূর্যের নয় বছর। দুইভাই একসাথে খেলতে খেলতে দেখলো তুহিন দেয়ালে আঁকিবুঁকি করছে। তূর্য এসে তুহিনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ভাই ভাই এভাবে দেয়ালে আঁকিস না। দেয়ালে আঁকলে রাতে ভূতনি আসবে।

— না না আমি আকঁবো।

তূর্য তুহিনকে টেনে একপাশে নিয়ে আসলে তুহিন উ উ করে কান্না শুরু করে। তখন দুই ভাই মিলেই এই দেয়ালে আকঁতে শুরু করে। আনমনে হেসে আবার চুপসে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের দিকে চোখ যেতেই দেখে একটা রঙিন মলাটের ডায়েরি রাখা। ডায়েরি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ উলোটপালোট করে দেখলো। তারপর কয়েকপাতা উলটে দেখলো দুইজন বন্ধুর নাম্বার লেখা। তুহিন যেনো একটা আশার আলো খুজে পেলো। ডায়েরি হাতে দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে মোবাইলে নাম্বার তুলে ফোন দেয়। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়। অপরপাশ থেকে সালাম দেয়। সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আমি তুহিন। তূর্য ভাইয়ার ভাই। তূর্য ভাইয়া কি আপনার সাথে আছে?
·
·
·
চলবে………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here