#ঈংরেজ সাহেবের বাঙালী বধূ
#লেখিকা : সামিয়া ইমাম নূর
#পর্ব : ১৭+১৮
আরিয়ানের কথা শুনে মাধূর্য ফিক করে হেসে দিল কিন্তু সানার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মাধূর্য আরিয়ানকে বলল,
মাধূর্য – Please Mr. Ariyan, stop. কিসব বলছেন আপনি তখন থেকে বলুন তো? তখন থেকেই কিসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে যাচ্ছেন।
আরিয়ান – আচ্ছা ঠিখ আছে, আর বলব না খিন্তু থুমি তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে আমার সাথে ছলো। রাহা থোমার জন্য অপেক্ষা খরছে। আর সানা, থুমিও মাধূর্যখে খি বলবে বলে রাহার খাছে যাও।
মাধূর্যও বলল,
মাধূর্য – হ্যাঁ সানা, বলো তুমি কি বলবে?
সানা দ্রুত বলে ওঠল,
সানা – আব… না মানে, আচ্ছা আমি বরং পরে তোমার সাথে কথা বলি হ্যাঁ? তুমি বরং গিয়ে পানি খেয়ে আসো, আমি উপরে যাচ্ছি। bye.
বলেই সানা সেখান থেকে একরকম দৌড়ে চলে যেতে লাগল আর আরিয়ান মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। ঐদিকে মাধূর্য সানাকে ঐভাবে চলে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
সানা উপরে তার মায়ের কাছে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে ধুপ করে চেয়ারে বসতেই সেলিমা বলে ওঠল,
সেলিমা – কি হয়েছে আমার বাচ্চাটার? তোমার মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
সানা – Mamma, ঐ আরিয়ান!
সেলিমা দ্রুত মুখের কাছে আঙ্গুল নিয়ে ইশারায় সানাকে চুপ হতে বলে বলল,
সেলিমা – আস্তে বলো কি হয়েছে। আরিয়ানের সাথে ঝগড়া হয়েছে? কিন্তু সে তো ঝগড়া করার ছেলে না?
সানা গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
সানা – Mamma তোমার ভাইয়ের ছেলে আমাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। আমার তো মনে হচ্ছে ও আমাকে সহ্যই করতে পারে না। অথচ ঐ মাধূর্য না ফাদূর্য ঐ মেয়ের সাথে দেখো সারাক্ষণ আঠার মতো চিপকে আছে। ঐ বাঙ্গালী unsmart মেয়েটার মধ্যে কি আছে যা আমার মধ্যে নেই? তাছাড়া তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউও তো ঐ মেয়েটাকে নিয়ে সারাক্ষণ আদিখ্যেতা করে বেড়াচ্ছে।
সেলিমা – শান্ত হও মামণি, রাহার বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। এরপর আমি আরিয়ানের সাথে তোমার বিয়ের ব্যবস্থাটা এবার করেই ছাড়ব দেখো। যেভাবেই হোক ওদের রাজী করিয়েই ছাড়ব এবার। আর যদি সোজা আঙ্গুলে ঘি না ওঠে তাহলে আঙ্গুল কিভাবে বাঁকাতে
হয় তাও জানা আছে তোমার মায়ের। আর আরিয়ানকে কোনোরকমে একবার বাগে আনতে পারলে ঐ পুচকি মেয়ে মাধূর্য না কি, ঐটা তো কিছুই না। বুঝলে?
সানা অস্থির হয়ে বলল,
সানা – কি করবে তুমি Mamma?
সেলিমা – সময় হলে দেখতে পারবে, এখন আনন্দ করো। Just chill, ok?
সানা মেকি হেসে বলল,
সানা – Ok my sweet mamma.
বিয়ের দিন চরম ব্যস্ততায় কাটে সবার দিন। কেউ নিজে সাজতে ব্যস্ত তো কেউ অন্যকে সাজাতে। আর বাড়ির বড়রা তো নানা কাজে ব্যস্ত আছেই। এর মধ্যে রাহাকে এসে সাজিয়ে গেছে পার্লারের কয়েকজন মেয়ে। বিয়ের দিন মাধূর্য সারাক্ষণ রাহার কাছেই ছিল শুধু নদী থেকে পানি আনার সময়টা বাদে। সকালে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে নদী থেকে পানি আনতে যায় শুধু রাহা আর বাড়ির কিছু মহিলারা বাদে। মাধূর্য আর আরিয়ানও যায় নদীর পাড়ে সাবার সাথে। আর সেখানে গিয়েই ঘটে যায় আরেক ঘটনা। মাধূর্য যেহেতু সাঁতার জানে না আর পানিতেও তার ভয় আছে তাই সে সবার থেকে কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে একটু উঁচু স্থানে গিয়ে দাঁড়ায় যাতে কেউ তাকে ভিজিয়ে দিতে না পারে বা পানিতে ফেলতে না পারে। কিন্তু এতে সে আরও বড় বিপদের সম্মুখীন হয়। কারণ সবাই যখন পানি ওঠানো নিয়ে আর মজা মাস্তিতে ব্যস্ত তখনই সুযোগ বুঝে সানা মাধূর্যকে পানিতে ফেলে দেয়ার জন্য বুদ্ধি আটে। মাধূর্য যেহেতু সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর সবাইও হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত তাই এখান থেকে মাধূর্যকে ফেলে দিলে হয়ত কেউ টেরও পাবে না। তাছাড়া মাধূর্য যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানটা কিছুটা উঁচু বলে সেখান থেকে নদীটাও অনেকটা গভীর বলে মনে হয়েছিল সানার। তাই ভাবনা মাফিক একটা শয়তানি হাসি দিয়ে সে ধীরপায়ে মাধূর্যর দিকে এগিয়ে যায় পিছন দিক দিয়ে। আর এই দৃশ্য আরিয়ানের চোখ এড়ায়নি। আরিয়ান মাধূর্যর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে মাধূর্যর দিকে খেয়াল রাখছিল যেহেতু দুষ্টু সানাও এখানে এসেছে। কিন্তু সানা এটা টের পায়নি যে আরিয়ান সবটা দেখছে। তাই সানা ধীরে ধীরে মাধূর্যর পিছনে গিয়ে যেই মাধূর্যকে ধাক্কা দিতে যাবে ঠিক তখনই আরিয়ান এসে ছু মেরে মাধূর্যকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে সানা নিজেই গিয়ে নদীতে পড়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আর মাধূর্য দ্রুত মাথা তুলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আবার সানার চিৎকার অনুসরণ করে পিছনে তাকিয়ে দেখে সানা পানিতে পড়ে হাত ঝাপ্টাচ্ছে। সানার চিৎকার শুনে দ্রুত সবাই সেদিকে যেতে লাগল আর যারা পানিতে ছিল তারা সাঁতরে সানার কাছে যেতে লাগল সানাকে বাঁচাতে। ঐদিকে সানার মা সেলিমা দ্রুত আরিয়ানের কাছে ছুঁটে এসে নাকে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল,
সেলিমা – একি আরিয়ান? তুমি এখানে এই মেয়েটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছ? তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমার মেয়েটা পানিতে পড়ে গেছে? তুমি সানাকে পানি থেকে উঠানোর চেষ্টা না করে এই মেয়েটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আর তুমি তো এখানেই ছিলে এতক্ষণ তাহলে সানা কি করে পানিতে পড়ল বলো তো?
আরিয়ান মাধূর্যর হাত ছেড়ে দিয়ে সেলিমার উদ্দেশ্যে বলল,
আরিয়ান – আপনার মেয়ে থো সাঁথার জানে, থাহলে আপনি এথো tention খেন খরছেন? তাছাড়া আপনার মেয়ে নিজের দোষেই পানিথে পড়ে গেছে। সে মেরিনখে পানিথে ফেলথে গিয়ে নিজেই পানিথে পড়ে গেছে। So, এইসব drama বন্দ খরুন।
সেলিমা আগেই বুঝেছিল এখানে দোষটা সানারই কোনো না কোনোভাবে কিন্তু সে ভেবেছিল আরিয়ানকে কোনোভাবে emotionally blackmail করবে কিংবা মাধূর্যের উপর কোনোভাবে দোষ চাপাবে কিন্তু সে জানত না তার মেয়ে যে আরিয়ানের চোখেই ধরা খেয়ে গেছে। যার কারণে এখন আরিয়ানের সামনে থেকে কোনোভাবে কেটে পড়লেই বাঁচে সে। তাই দ্রুত আবার কান্নামাখা মুখ করে আরিয়ানের সামনে নাটক শুরু করে দেয় সে।
সেলিমা – Sorry বাবা আরিয়ান, আসলে আমি জানতাম না সানা এমন একটা কাজ করেছে। Please তুমি সানার উপর রাগ কর না। আর মাধূর্য! প্লিজ মামণি তুমিও সানার উপর রাগ পোষে রেখ না। আসলে ও এখনো অনেকটাই বাচ্চা স্বভাবের তো? তাই হয়ত তোমার সাথে দুষ্টুমি করতে চেয়েছিল। Please, রাগ কর না হ্যাঁ? আর please কাউকে এই কথাটা বলো না যে সানা তোমাকে পানিতে ফেলতে চাইছিল।
মাধূর্য বলল,
মাধূর্য – না না aunty, it’s ok. আমি কাউকে বলব না। আসলে এরকম দুষ্টুমি তো বিয়েশাদীতে হয়-ই। আপনি সানার কাছে যান। দেখুন গিয়ে ওর কোনো problem হচ্ছে কিনা। দেখুন সানাকে পাড়ে তোলা হয়েছে। আরিয়ান! চলুন আমরা সানার কাছে যাই।
আরিয়ান মাথা নাড়ল। তারপর সেলিমা সানার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে আরিয়ান আর মাধূর্যও সেদিকে পা বাড়ায়।
মাধূর্যর বাবা-মা এসেছে বিয়েতে। মাধূর্যর বাবা আফসান চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী এবং মা মারিহা একজন গৃহিণী। যাই হোক, তারা আসার পর রাহা, রাশেদা আর আমানের সাথে দেখা-সাক্ষাত করে আর সেই সময় আমান আর রাশেদা মাধূর্যর বাবা-মা’কে রায়হান খান আর মোনালিসা এবং আরিয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমান আর রাশেদা মেয়ের বিয়ের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আগুন্তুক অতিথিদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব নেয় রায়হান আর কিসমত। তাই রায়হানও খুব একটা সময় পাচ্ছেনা মাধূর্যর বাবা-মায়ের সাথে মাধূর্য আর আরিয়ানের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। তবে মোনালিসা মাধূর্যর মায়ের সাথে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর মোনালিসার মেইন টপিকই মাধূর্য। মাধূর্যর প্রশংসায় যেন সে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেছে। মাধূর্যর মাও এক বিদেশীনির কাছ থেকে নিজের মেয়ের প্রশংসা শুনে খুশিতে চোখমুখে যেন তার আলো ঝলমল করছে। এদিকে তিনিও এই কয়দিন তার মেয়ের কাছে আরিয়ান আর তার মা-বাবার অনেক গল্প শুনেছেন phone এ। যার কারণে তাদেরকে কাছ থেকে দেখার একটা ইচ্ছা এই কয়দিন মনের ভিতর আকুম-বাকুম করছিল আর আজ সেই ইচ্ছেটা তার পূরণ হল। তিনি এতদিন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে একজন বিলেতী মহিলা এতটা সরল হয় আর এত সহজে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু আজ সরাসরি দেখে তিনি তা উপলব্ধি করতে পারছেন। তাছাড়া আরিয়ানের আচার-আচরণও খুবুই নম্র-ভদ্র মনে হচ্ছে তার। একটা ইংরেজ ছেলেও যে বড়দের এতটা সম্মান দেখাতে পারে তা মাধূর্যর মা-বাবার জানা ছিল না।
যথারীতি বিয়ের কাজ সম্পন্ন হল। এবার রাহার বিদায়ের পালা। বিদায় বেলা রাহা আর বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের হাউমাউ করে কান্না করতে দেখে আরিয়ান পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। সে দেখল একপর্যায়ে মাধূর্যও রাহাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। আরিয়ান তো পুরোই থ হয়ে গেছে এই দৃশ্য দেখে। কারণ সে কখনোই এমন কোনো বিয়ে দেখেনি লন্ডনে যেখানে বিয়ের পর বউকে নিয়ে যাওয়ার সময় বউ এবং তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্নীয়স্বজনরা এভাবে কাঁদে। তার উপর এখানে শুধু মহিলারাই না বরং রাহার বাবা আর সেই সাথে রায়হানকে আর কিসমতকেও চোখের পানি ফেলতে দেখা যাচ্ছে। আরিয়ান এইসব দেখে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রাহা কান্নাকাটি করতে করতে আরিয়ান আর তার মায়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। মা-ছেলে দুইজন একসাথেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। রাহা তাদের কাছে এসেই ও জেঠিমনি গো বলেই মোনালিসার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। মোনালিসা পড়ে যেতে নিয়েও কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রাহাকে শান্তনা দিতে লাগল। এদিকে আরিয়ান মনে মনে ভাবছে এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি মরা বাড়ি যে সবাই এমন আচরণ করছে আর এত হাউমাউ করছে? যাই হোক, রাহা তার জেঠির থেকে বিদায় নিয়ে এবার আরিয়ানের সামনে গিয়ে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলতে লাগল,
রাহা – bro…, আমি চলে যাচ্ছি। আবার পরশু বা তরশু আসব বউভাতের পর। তাই তুমি কিন্তু একদম এরমধ্যে লন্ডন চলে যাওয়ার নামও নিবে না। আর অবশ্যই আমার বউভাতে তোমাকে থাকতে হবে নইলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাব হুম। আর শুনো! তোমার কত ছোট হয়েও দেখ আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই এবার নিজেও বিয়ের জন্য তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যাও। তোমার বিয়ে খাওয়ার জন্য আর তোমার বিয়েতে আনন্দ করার জন্য আমার মন এখনই কেমন আকুম-বাকুম করছে।
আরিয়ান কি রাহার কথায় হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়ে একদিক দিয়ে কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে আর আরেকদিক দিয়ে নাকি তার আরিয়ানের বিয়েতে আনন্দ করার জন্য মন আকুম-বাকুম করছে! এদিকে রাহার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠল।আরিয়ানও মুচকি হেসে বলল,
আরিয়ান – আচ্ছা বুজলাম খিন্তু, থুমি এইঠা বলো যে থুমি cry খেন খরছ এইভাবে? আমার বিয়ে খাওয়ার জন্য?
রাহা ফিক করে হেসে দিয়ে খানিক নিচু স্বরে বলল,
রাহা – আরে না bro…। আসলে এটা আমাদের বাঙালীদের culture. বিয়ের সময় আর বিদায়ের সময় বউদের কাঁদতে হয়। নইলে মানুষ মন্দ বলে। তাই একটু কাঁদছি আরকি। এটা just একটা formality। বুঝলে?
আরিয়ান অবাক হয়ে কয়েক মুহুর্তে ভাবতে লাগল এটা আবার কেমন নিয়ম? এর মধ্যেই রাহা আবার বলে ওঠল,
রাহা – আচ্ছা bro…, আমি আসি হ্যাঁ? সবাই ঐদিকে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। জেঠিমনি আমি আসি হ্যাঁ? তোমরা কিন্তু চলে যেওনা আবার আর অবশ্যই আমার বউভাতে যাবে কিন্তু। দেখবে অনেক মজা হবে, আসি তাহলে।
বলেই রাহা সবার থেকে আবার বিদায় নিয়ে চলে গেল তার বরের গাড়ির কাছে।
১৮.
রাহার বিদায়ের পড় কথা ছিল মাধূর্যর বাবা-মা তাদের বাড়ি ফিরে যাবে কিন্তু রায়হান আর আমান খান জরুরী কোনো বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলবে বলে আটকে দেয় তাদের। ঐদিকে সানা আর তার মায়ের পেটে মুচড় মাধূর্যর বাবা-মায়ের সাথে রায়হান খান কোন জরুরী কথা বলবে তা ভেবে ভেবে। যাই হোক, রায়হান খান মাধূর্যর বাবা-মায়ের সাথে আরিয়ান আর মাধূর্যর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে বলে পরিবারের সবাইকে ডেকে একত্র করে বসার ঘরে। মাধূর্য আর আরিয়ানও এখনো কিছু জানে আর বুঝতেও পারছে না এখানে কি হতে চলেছে।
আফসান চৌধুরী- তা আমান সাহেব, আপনারা কি এমন জরুরী বিষয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছেন বলুন তো?
আমান – হ্যাঁ, কথা আসলে আমি নই আমার বড়ভাই বলবে। ভাই তুমি শুরু কর এবার। আমরা সবাই তো এসেই গেছি। আর কি?
রায়হান খান বলল,
রায়হান – হ্যাঁ বলছি।
তারপর রায়হান খান আরিয়ানের সাথে মাধূর্যর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে মাধূর্যর বাবা-মায়ের সামনে। মাধূর্যর বাবা-মাও খুব খুশি এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে। আরিয়ানের মতো এমন একটা শিক্ষিত সুদর্শন ছেলে পেলে কেই বা হাত ছাড়া করতে চাইবে? তবে যেহেতু আরিয়ান জন্মগতভাবে একজন ব্রিটিশ আর তার শিক্ষাদিক্ষা, সংস্কৃতি সবই বিদেশী। তাই তারা কিছুটা চিন্তিতবোধ করছে তাদের মেয়ে এমন একটা বিদেশী সংস্কৃতির ছেলের সাথে নিজেকে adjust করতে পারবে কিনা তা নিয়ে । তাছাড়া আরিয়ান যেহেতু একটা বিদেশী ছেলে, সেই ক্ষেত্রে তার চরিত্র কেমন হবে? বিয়ে- শাদীর মর্ম আর মর্যাদা তার কাছে কতটুকু বা আদৌ বিয়ে নামক সম্পর্কটা তার কাছে matter করে কিনা নাকি আরিয়ানও অন্যান্য বিদেশীদের মতোই উশৃংখল, সেই নিয়েও তারা ভাবছে। তাই তারা এই ব্যাপারে ভাবার জন্য কয়েকদিন সময় চেয়েছে। রায়হান আহমেদও তাদের ভেবে দেখার জন্য সময় দিয়েছে। ঐদিকে সানা আর তার মা সাপের মতো ফুঁসছে আরিয়ান আর মাধূর্যর বিয়ের কথাবার্তা চলছে দেখে। সানা বারবার তার মা’কে ইশারায় বলছিল যেন মাধূর্যর সাথে বিয়ের কথা ঠিক হওয়ার আগেই তার মা তার মামাকে তার সাথে আরিয়ানের বিয়ের প্রস্তাব দেয় আবার কিন্তু সেলিমা সানাকে চোখের পলক ঝাপটে আস্বস্ত করে যে সে সব করবে কিন্তু এখন এত মানুষের সামনে এই সব নিয়ে কথা বলতে গেলে সমস্যা হতে পারে আর এতে সবাই ওদেরকেই কথা শুনাবে কারণ এর আগেও আরিয়ান সানার সাথে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে আর সেটা আমানরাও বেশ ভালো করেই জানে।
মাধূর্যর মা-বাবা যেহেতু আজ রাতটা এখানেই থাকবে তাই তারা খেয়ে-দেয়ে চলে যায় নিজেদের থাকার রুমে। এদিকে বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে মাধূর্য তো লজ্জায় আরিয়ানের সামনেই যেতে পারছে না আর না পারছে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে তার সাথে। আজ আবার রাহাও নেই তার সাথে তাই খেয়েই গিয়ে নিজের রুমে মানে রাহার রুমে ঢুকে পড়েছে। ঘুম নেই চোখে তাই বারান্দায় গিয়ে চাঁদ দেখে কিছু সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল সে। আরিয়ানও নিজের ঘরে গিয়ে বসে আছে। চিন্তা হচ্ছে তার মাধূর্যর বাবা-মা মাধূর্যকে তার সাথে বিয়ে দিতে রাজী হবে কি না। ঐদিকে সেলিমা সানাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে তার ভাইদের বলল তাদের সাথে তার একটা জরুরী বিষয়ে কথা আছে। রায়হান, আমান আর তাদের স্ত্রীরাও সেলিমার কথা শুনার জন্য বসার রুমে গিয়ে বসল। যেহেতু অন্যরা সবাই যার যার রুমে চলে গেছে তাই এখন সেলিমারও কথাটা বলতে সুবিধা হবে। সেলিমা কথাটা কিভাবে বলবে এই পরিস্থিতিতে আর তার প্রতিক্রিয়াই বা কি হবে তাই ভাবছে সে। রায়হান গলা ঝাড়া দিয়ে বলে ওঠল,
রায়হান – কি রে, কিছু বলছিস না যে? এতক্ষণ বললি জরুরী কথা আছে আর এখন আমরা এসে বসে আছি কিন্তু তোর কোনো কথাই নেই!
সেলিমা – হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি। আসলে ভাই, কি করে কথাটা বলব তাও আবার এই পরিস্থিতিতে সেটাই ভাবছি।
আমান ভ্রু কুঁচকে বলল,
আমান – এই পরিস্থিতি মানে কোন পরিস্থিতি?
সেলিমা – আসলে ভাই, তোমরা রাগ কর না please। আমি জানি এখন এই কথাগুলো আমার বলা উচিত হবে না কিন্তু কি করব বলো? নিজের মেয়ের কষ্টটাও তো আমার সহ্য হচ্ছে না। তোমরা তো জানোই সানা অনেক আগে থেকেই আরিয়ানকে পছন্দ করে আর তার জন্য আমরা কয়েকবার তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছি কিন্তু তোমরা বারবার আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছ। দেখো না, এই কারণেই জেদ ধরে সানার বাবা এবার রাহার বিয়েতেও আসেনি। সে যাই হোক, তবুও এখন আমার মেয়েটার কথা ভেবেই আমি আবার তোমাদের কাছে অনুরোধ করছি। তোমরা একটাবার আমার মেয়েটার কথা ভাবো। ও তো তোমাদের ভাগ্নী, তাই না বলো?
মোনালিসা এবার বলে ওঠল,
মোনালিসা – We are understand Selima. খিন্তু এখানে থো আমাদের খিছুই খরার নেই cause আরিয়ান নিজে থেখেই সানাখে বিয়ে খরথে ছায়নি। আর আমরাও থো আমাদের ছেলেখে জোর খরতে পারি না থোমার মেয়ের খথা ভেবে? বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে দুই জনেরই ইচ্ছে থাখা জরুরী। খি বলো রায়হান?
রায়হান বলল,
রায়হান – হ্যাঁ সেলিমা, তোর ভাবী ঠিকই বলেছে। আরিয়ান যেহেতু তোর মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না তখন আমরাও জোর করতে পারিনা তাকে। তাছাড়া বিয়ে- শাদীর ব্যাপারে জোরজবরদস্তি করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। তোর মেয়েকে জোর করে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেই কি সে সুখী হতে পারবে যদি সম্পর্কে ভালবাসা আর বুঝাপড়াই না থাকে? তাছাড়া আমি এই কয়দিনে যতটা বুঝেছি তাতে আরিয়ান মাধূর্য কে পছন্দ করে আর মাধূর্কে বিয়ে করার ব্যাপারেও সে কোনো আপত্তি জানায় নি। তাছাড়া মাধূর্যরও আরিয়ানকে বিয়ে করতে কোনো প্রকার আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। কি বলিস আমান?
আমান – হুম, আমারও তাই মনে হয়। দেখ সেলিমা, সানা এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর বয়স কম তাই পাগলামি করছে কিন্তু তোরা বুঝের হয়েও যদি সানার মতো পাগলামি করিস, এমন অযৌক্তিক বায়না ধরিস তাহলে তো হবে না। তোদের তো বুঝতে হবে তোদের মেয়ের কোনটায় ভালো হবে আর কোনটায় খারাপ। তাছাড়া আরিয়ান তো বাচ্চা ছেলে নয় যে সে আমরা বললেই তোর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে। সে একজন adult person। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার নিজের ভালো-মন্দ বুঝার এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নেবার। সেখানে সে কাকে বিয়ে করবে কাকে করবে না সেটাও সে নিজেই ঠিক করবে। আমরা এই ব্যাপারে তার উপরে কোনো প্রভাব খাটাতে পারিনা। আশা করি, তুইও ব্যাপারটা বুঝবি আর নিজের মেয়েকেও বুঝাবি। আর আশা করি এই ব্যাপারটা নিয়ে এই বাড়িতে আর কোনো কথা ওঠবে না। কারণ তুই জানিস যে মাধূর্য আর আরিয়ানের বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছে আর এই সময়ে মাধূর্যের বাবা-মায়ের কানে এইসব কথা গেলে তারা উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে আমাদের। তাই দয়া করে এই ব্যাপারটা এখানেই ভুলে যা আর তোর মেয়ের বিয়ের জন্য চিন্তা করিস না। আমরা তো আছিই, আমরা দেখেশুনে একটা ভালো পাত্রের হাতেই আমাদের ভাগ্নীকে তুলে দেব। তুই শুধু ও’কে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আরিয়ানের চিন্তাটা ওর মাথা থেকে বের করার চেষ্টা কর।
সেলিমা – কিন্তু ভাই!
এবার রাশেদা বলে ওঠল,
রাশেদা – আর কোনো কিন্তু নয় সেলিমা আপা, নিজের মেয়ের ভালোর জন্যই এটা তোমায় করতে হবে। নইলে পড়ে তোমার মেয়েই কষ্ট পাবে আর তখন তার জন্য তুমি নিজেই দায়ী থাকবে যদি সব জেনেশুনেও তুমি তোমার মেয়েকে এখন থেকেই না সামলাও। তাছাড়া কাউকে শুধু পছন্দ করা আর গভীরভাবে ভালবাসা এক নয়। আমার বিশ্বাস সানা আরিয়ানকে পছন্দ করলেও ভালবাসে না। ও শুধু নিজের আবেগ আর জেদের বশেই এমন পাগলামি করছে। আর এই জেদের বশেই আজ মাধূর্যকেও সে পানিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই পানিতে পড়ে গেছে। আমায় কিসমত বলেছে সবটা। সে নিজ চোখে দেখেছে এই দৃশ্য কিন্তু ভাগ্যিস সানা মাধূর্য কে ধাক্কা দেয়ার আগেই আরিয়ান মাধূর্যকে সরিয়ে নেয় সেখান থেকে আর সানা গিয়ে পানিতে পড়ে। নইলে আজ যদি সানার পরিবর্তে মাধূর্যই পানিতে পড়ে যেত কি হত তখন বুঝতে পারছ? মেয়েটা সাঁতার জানে না আর পানিকেও খুব ভয় পায়। আমার তো শুনেই বুকটা ধুক করে ওঠেছিল। কি ভয়ানক কান্ড হতে চলেছিল আজ তোমার মেয়ের জন্য।
রায়হানরা সবাই অবাক হয়ে এতক্ষণ রাশেদার কথাগুলো শুনছিল। আমান রেগে গিয়ে তার বোনকে বলল,
আমান – শুনেছিস তোর মেয়ের কান্ড কারখানা? আমি তো এইসব কিছু জানতামই না। আজ আরিয়ান মেয়েটাকে না বাঁচালে কি হত বুঝতে পারছিস? কি জবাব দিতাম আমরা মেয়েটার মা-বাবাকে? আরে এই মেয়ের জন্য তুই আমাদের কাছে এত সাফাই গাইছিস? আরিয়ানের বউ করার জন্য এত পাগল হয়ে আছিস? আরে তোর মেয়ে তো নিজের স্বার্থের জন্য দেখছি মানুষ খুনও করতে পারবে। পারবে বলছি কেন, ইতিমধ্যে সেটা করার চেষ্টাও করে ফেলেছে। আমার তো তোর মেয়েকে এখন ভাগ্নী বলে ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে আর এই মেয়েকে কিনা আমার খাঁটি হীঁরার ন্যায় সচ্ছ আর এত নম্র একটা ভাতিজা আরিয়ানের বউ করার জন্য এতবার করে প্রস্তাব পাঠিয়েছিস? ভাগ্যিস আরিয়ান রাজী হয়নি নইলে তোর ঐ উড়নচণ্ডী আর উগ্র স্বভাবের মেয়ে তো ছেলেটার জীবনটাকেই অসহ্য করে ফেলত।
সেলিমা এবার কেঁদে ওঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলতে লাগল,
সেলিমা – তুমি আমার মেয়েকে এভাবে বলতে পারলে ভাইয়া? ও তোমার ভাগ্নী নয়? মানলাম না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে তাই বলে তুমি এভাবে বলতে পারলে আমার মেয়েকে? থাকব না আমি আর এখানে। কালকেই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব কানাডায়। এত অপমান আর সহ্য হচ্ছে না। কোথাকার একটা মেয়ে সে দুইদিনেই তোমাদের এত আপন হয়ে গেল আর আমি আর আমার মেয়েই এখন তোমাদের সবচেয়ে পর, তাই না?
রায়হান বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠল,
রায়হান – আহ থাম তোরা। আর সেলিমা! তুই এখন যাই বলিস না কেন, শাঁক দিয়ে কিন্তু মাছ ঢাকা যায় না। তোর মেয়ে যেটা করেছে সেটা কি তোর কাছে অপরাধ বলে মনে হচ্ছে না? আরে আমি তো বলব এটা শুধু অপরাধই নয় বরং জঘন্যতম অপরাধ। এর জন্য তোর মেয়ের জেলও হতে পারত অথচ তুই বলছিস না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে? সব অপরাধীই অপরাধ করার পর বলে সে না বুঝে করেছে। কিন্তু তুই তো বুঝের? নিজের মেয়েকে এর জন্য কোনো শাসন করেছিস? মনে তো হচ্ছে তুই আগে থেকেই জানতি যে তোর মেয়ে এমন একটা কিছু করেছে?
সেলিমা কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিতেই মোনালিসা বলল,
মোনালিসা – আচ্ছা রায়হান, থুমি আর ও’খে খথা শুনিয়ো না। দেখথে পারছ থো মেয়েঠা খাঁদছে। আর সানাও হয়থ না বুঝোই খাজঠা খরে ফেলেছে থাই থোমরা আর ওখে বখোনা। সেলিমা বোনঠি আমার, খান্নাখাটি না খরে এবার নিজের ঘরে ঘিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর রায়হান, ছলো আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি গিয়ে।
ঐদিকে অনেক রাত হয়ে গেলেও মাধূর্য আর আরিয়ান কারো চোখেই ঘুম নেই। তাই আরিয়ান আর মাধূর্য দুইজনই দুই দিক থেকে ভাবছে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুই জনেই দুই দুইদিক দিয়ে নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সিঁড়ির কাছে যেতেই দুইজনে একে-অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাধূর্য ভয়ে ভুত বলে চিৎকার দিতে নিলেই আরিয়ান তার মুখ চেপে ধরে বলে,
আরিয়ান – Stop, i’m Ariyan. আমি বুথ নই?
চলবে-