অপ্সরী ৮.

0
558

#অপ্সরী
৮.

ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে সদ্য বিবাহিত দম্পতি। ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে মাইশা। ঘুম নেই চোখে। অদ্ভুত এক অস্থিরতায় হৃৎস্পন্দন বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এই বুঝি পাশে থাকা মানুষটার কানে হৃৎস্পন্দনের শব্দ পৌঁছে যাবে। চোখজোড়া বড় করে তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে৷ কি হবে লোকটা যদি এক্ষুনি এসে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয়? ভাবতেই ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে মাইশা। চোখ বন্ধ হয়ে চেহারা কুঁচকে আসছে বারবার৷ এই ঘরে আসার আগে বান্ধবীরা বারবার কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলেছে,

– আজ তোর প্রথম চুমুর দিন। খবরদার! অদ্ভুত সব ভাবনা ভেবে রাতটা নষ্ট করবি না। ঐসব থুতু আদান প্রদান নামে পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই। বি পজিটিভ।

আরো কিসব চুমু সংক্রান্ত মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে যাচ্ছিলো তিনজন মিলে। ছোট খালা আর ছোট মামী ইঙ্গিতে কতকিছু বললো সকালে। জটিল সব কথাবার্তা! ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে। ইচ্ছে হয় ছুটে দৌঁড় দিতে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছোটবেলায় চলে যেতে। কি সরল সুন্দর ছিলো দিনগুলো!

হাতের উপর গাল পেতে শুয়ে আছে হাসিব। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাইশার দিকে৷ তেল চিটচিটে মাথা থেকে জেসমিনের কড়া ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে মেয়েটা। হাসিব জানে সে এখনো ঘুমায়নি৷ ভীষণ অস্থিরতায় মুখ লুকিয়ে ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে৷ মাইশার কাঁধ চেপে ধরলো হাসিব৷ বিছানা থেকে মাইশা লাফিয়ে উঠে বসলো। চমকে গিয়ে বললো,

– হ্যাঁ? কি? কিছু বলবেন?
– এভাবে লাফিয়ে উঠলে কেন? ভয় পেয়েছো?
– কই? নাহ্! না তো।
– ড্রিম লাইটে মানুষের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায়। তোমাকেও দেখতে পাচ্ছি আমি। আতংকে মুখ শুকিয়ে আসছে তোমার৷

একহাতে পুরো মুখে গলায় মাইশা হাতড়াচ্ছে।

– তাই? এতক্ষণ সেজেগুজে স্টেজে বসেছিলাম তো, তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।
– মিথ্যুক! আমাকে এত ভয় কেন পাও?
– না, না৷ ভয় পাইনা।
– তুমি কি ভেবে দুশ্চিন্তায় আধমরা হয়ে যাচ্ছো আমি জানি।
– কি জানেন?
– তখন ড্রইংরুমে বসে তোমার বান্ধবীরা কিসব জ্ঞান দিচ্ছিলো না তোমাকে?
– আপনি জানেন কিভাবে?
– তোমার বান্ধবী হিমু, সে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে জানে না। তার ফিসফিস করে বলা কথাগুলোও আশপাশের লোকজন সবাই শুনেই ফেলে। সেভাবে আমিও শুনেছি, আমার দুলাভাইও শুনেছে৷

মুখে হাত চেপে চোখ বড় করে হাসিবের দিকে তাকিয়ে রইলো মাইশা। অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

– ছিঃ!

নিচুশব্দে হাসতে হাসতে হাসিব বললো,

– আমাকে ছিঃ বলছো কেন? যে ঐ কথাগুলো বলছিলো তাকে ছিঃ বলো।

লজ্জায় মাথা নুয়ে আসছে মাইশার৷ কোথায় যেয়ে সশরীরে লুকানো যাবে পুরো ঘরে চোখ ঘুরিয়ে সেই জায়গা খুঁজছে সে। বালিশে হেলান দিয়ে বসলো হাসিব। বললো,

– কত লজ্জা পাও বলো তো! খুব সাধারণ একটা ঘটনা। এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
– হুম।
– কি হুম? বন্ধু বান্ধব বিয়ের দিন এমন ছোটখাটো টিপস দেয়। ব্যাপার নাহ্। এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার বন্ধুরা আমাকে যা গিফট করেছে তা শুনলে তো দাঁতে দাঁত লেগে ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবা। শুনতে চাও কি দিয়েছে?

মুখ ফুটে কিছু বলছে না মাইশা। কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে৷ মাইশার দিকে খানিকটা ঝুঁকে হাসিব ফিসফিসিয়ে বললো,

– কনডম!

মুখে বালিশ চেপে হাসছে হাসিব। দুহাতে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে রেখেছে মাইশা৷ চোখজোড়া যেন এক্ষুনি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। মাইশার কপালে ধাক্কা দিয়ে হাসিব বললো,

– ভয় পেও না তো। আমি এতটাও অবুঝ না যে তোমাকে হুট করে কাছে টানবো৷ সময় হলে তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিবে। বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? বিয়ে করলেই সব অধিকার একরাতেই আদায় করে নিতে হবে? আমি সেই যুক্তিতে বিশ্বাসী না। বিয়ের পর কি প্রেম করা বারণ? প্রেম করবো আমরা৷ রিকশায় ঘুরে বেড়াব এখানে সেখানে, আইসক্রিম শেয়ার করব, তোমার কোকের বোতলে আমি ভাগ বসাবো, বাইকে চড়ে প্রতি সপ্তাহে চলে যাবো কোনো নদীর পাড়ে বেড়াতে, ছয়মাসে একবার চলে যাবো কোনো পাহাড়ে অথবা সমুদ্রপাড়ে৷ একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবো, মধ্যরাতে চা খেতে বের হবো। রাত তিনটায় তোমার বাসার সামনে চলে আসব তোমাকে দেখতে। তুমি বারান্দায় এসে উঁকি দিবে আর আমি ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকব। তারপর যখন তোমার ইচ্ছে হবে আমাকে শুধু একটা সিগন্যাল দিলেই চলবে। ঐ রাতেই তোমাকে নিয়ে চলে যাব কক্সবাজার৷ সমুদ্র দেখা যায় এমন একটা রুম বুক করে সেখানে বাসর ঘর সাজাবো৷ সমুদ্র পাড়ে আমাদের বাসর হবে।

মুখ বাকালো মাইশা। মিনমিন করে বললো,

– আপনি এত ভালো? দেখলে তো মনে হয়না৷ ঐ দুইদিন যা খেল দেখালেন!
– ওহ্! সেসব মনে ধরে বসে আছো! দেখো একটু চুমু আর একটু জড়িয়ে ধরার বায়না করেছিলাম। জোর তো আর করিনি। খুব সামান্য আবদার কিন্তু! মাসে এক দুইবার এমন ছোটখাটো আবদার তো পূরণ করতেই পারো তাই না?
-…………..
– প্রেমিক হিসেবে আমি চমৎকার। আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড এখনো আমাকে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ প্রেম করেই দেখো একমাস, এরপর দিনরাত শুধু হাসিব হাসিব করবে তুমি। তোমার খাওয়ার প্লেটে, বইয়ের পাতায়, ফ্যানের ব্লেডে, আয়নায়, দেয়ালে সবখানে শুধু আমিই আমি থাকব। বারবার আমাকেই খুঁজে পাবে।

আসর আজানের সময় গড়িয়ে এলো। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটার আলো ছড়িয়ে পড়েছে মুন্নি বেগমের ১৮ বছরের পুরোনো স্টিলের আলমারিটাতে৷ ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর। সাইড টেবিলে ঘুরছে টেবিল ফ্যানটাও। খাটে চিত হয়ে শুয়ে আছে হাফিজ সাহেব। এই গরমে পোলাউ মাংস খেয়ে বড্ড হাসফাস লাগছে তার। ভুড়িওয়ালা পেটটাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে বললো,

– রান্না খুবই স্বাদ হইছে। বেশিই খাইয়া ফেলছি। এখন তো অস্থির লাগতাছে। ও মুন্নি, পেটটায় একটু হাত বুলায়া দাও তো!

দাঁত মুখ খিচিয়ে ধমকে উঠলো মুন্নি বেগম,

– এ্যাহ! হাত বুলায়া দাও মুন্নি! খাওয়ার টেবিলে বইসা কেমনে গুটুর গুটুর খাইতাছিলা আমি খালি তাকায়া দেখছি। নতুন জামাই সামনে বসা তাই কিছু বলি নাই। কতদিন না করছি বয়স হইছে এইবার তো খাবারে লাগাম টানো!
– আমার কি দোষ? তুমি এত স্বাদ কইরা রান্না করো কেন? তরকারিতে লবন বেশি দিয়া রাখবা আর নয়তো বেশি কইরা জিরা গুঁড়া ঢাইলা দিবা তাইলেই আর আমি গুটুর গুটুর কইরা খাবো না।
– হুঁ… এইগুলা করলে বাচ্চারা খাবে কেমনে?
– আচ্ছা একদিন নাহয় খাইছিই! পেটটায় একটু হাত বুলাইলে কি হয়!
– পারবো না আমি। ভোর থেইকা যোহরের আজান পর্যন্ত টানা কাজ করছি৷ আমার দ্বারা এখন কারো পেটে হাত বুলায়া দেয়া সম্ভব না।
– আমি তোমার আবদার রাখছি। আগামী তিনমাস তো তুমি আমারে হুজুর হুজুর করার কথা৷ তা না কইরা আমার সঙ্গে মুখ কালো কইরা কথা বলতাছো!
– কোন আবদার?
– এইযে মাইশারে বিয়ে দিলাম৷ আমি তো আমার মেয়ে এখন বিয়ে দিতাম না৷ তোমার আবদার রাখতে হবে তাই বিয়ে দিছি৷
– ইশ! আমার আবদার রাখতে উনি মেয়ে বিয়ে দিছে! কও যে ছেলে পছন্দ হইছে তাই মেয়ে বিয়ে দিছো৷ নয়তো আমি মুন্নি তোমার ঘরের দরজায় মাথা ঠুকায়া মরলেও মেয়ে তুমি বিয়ে দিতা না৷

তর্ক করার মাঝে হঠাৎ প্রশান্তির প্রশস্ত হাসি হাসলো মুন্নি বেগম৷ বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সে। আহ্লাদী হয়ে হাফিজ সাহেবকে বললো,

– ছেলে ভালো হোক আর অন্য কারণেই হোক, মাইশারে বিয়ে তো দিছো। আমার আবদার তো পূরণ হইছে, এটাই অনেক। মাথা থেইকা বিশাল চিন্তার পাহাড় শেষ হইলো মাইশার আব্বু৷ মাইশারে স্কুলে ভর্তি করানোর পর থেইকাই কি দুশ্চিন্তা করতাম মেয়েরে আমি কই বিয়ে দিব? ছেলে কেমন না কেমন হবে? আমার সব চিন্তা শেষ। এইবার আমি বইসা মনের আনন্দে মাইশার সুখ দেখব। তোমারে আমি এই উপলক্ষে একটা স্পেশাল ধন্যবাদ দিব। খুব জলদিই দিবো৷ এখন গেঞ্জিটা উপরে তুলো দেখি। দাও, পেটটা দাও। হাত বুলায়া দেই।

মুখ টিপে হাসছে হাফিজ সাহেব। পেটের উপর থেকে গেঞ্জি সরিয়ে বললো,

– কি যে করো না মুন্নি! এই মেঘের রুপ নাও আবার এই রোদের রুপ নাও।
– করছো কেন আমারে জোর কইরা উঠায়া নিয়া বিয়ে? করছো যেহেতু এখন সহ্য করতে হবে৷
– হাসিবের কপাল খুবই ভালো। সেও একপ্রকার জোর কইরা মাইশারে বিয়ে করছে৷ আমার মেয়ে তো রাজি ছিলো না। কিন্তু দেখো আমার মেয়ে কি সুন্দর ওর সঙ্গে গল্প করে। এইযে এখন দেখো সাজুগুজু করে হাসিমুখে বেড়াইতে গেছে৷ আর তুমি! তোমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তো ছ্যাত ছ্যাত কইরা উঠতা।
– হাসিবের বউ খুশি করার বুদ্ধি আছে যেইটা তোমার নাই।
– জানি আমার মেয়েরে খুশি করার মত বুদ্ধি আছে, এইজন্যই তো মেয়ে বিয়ে দিছি। নয়তো কি দিতাম? চমৎকার ছেলে।

ঝকঝকে নীল আকাশ। বাতাসে ভেসে সাদা মেঘেরা ছুটে বেড়াচ্ছে এখান থেকে সেখানে। আকাশে গোল বৃত্তাকার সীমানা ধরে উড়ছে চিলগুলো। বিস্তৃত নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট বড় নৌকাগুলো৷ নদীর পাড়ের গাছগুলো বাতাসে হেলছে দুলছে। খ্যাট খ্যাট শব্দ তোলা ইঞ্জিন নৌকায় বসে আছে মাইশা৷ ভীষণ মুগ্ধতায় চোখ জুড়িয়ে আসছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি নদীর বুকে ঝাঁপ দিতে।

মাইশার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাসিব। নৌকার ঠিক মধ্যখানে আসন পেতে বসে আছে মেয়েটা। মুখের উপর উড়ে এসে জুড়ে বসা অবাধ্য চুলগুলোকে যত্ন নিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে বারবার৷ কাজল মাখা ঐ চোখজোড়ায় যেন সীমাহীন মায়া উপচে পড়ছে। হাত ভরা নীল কাঁচের চুড়ি আর কানের ঐ রূপালি ঝুমকা যেন কানের পাশে চুল গুঁজে দেয়ার বাহানায় বারবার হাসিবকে দেখানোর চেষ্টা! পরোক্ষ ইঙ্গিতে যেন মেয়েটা জিজ্ঞেস করছে,

– আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?

বিড়বিড় করে হাসিব বলতে থাকলো,

– কি বলবো বলো তো? তোমাকে নিয়ে কি বলবো আমি! অত সময় আমার আছে নাকি তোমার জন্য একটা কবিতা রচনা করে প্রশংসা করবার মত? তোমাকে দেখতে দেখতেই তো সময় ফুরিয়ে যায়। ছোট্ট করে বলি শোন, সবাই বলে তুমি নাকি মানুষ৷ কিন্তু তোমাকে কখনো আমার মানুষ বলে মনেই হয়নি। এইযে নৌকায় আসন পেতে বসে আছো, ঠোঁট গোল করে গুনগুন করছো, হঠাৎ মুখ বাকিয়ে মুচকি হাসছো এখনও তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি পরী। আকাশ থেকে একটা নীল পরী টুপ করে এই পৃথিবীতে এসে নৌকায় আসন পেতে বসেছে।

-কিছু বলছেন?

মাইশার প্রশ্নে ঘোর কাটলো হাসিবের। মুচকি হেসে বললো,

– হ্যাঁ বলছি তো৷
– শুনিনি৷ ইঞ্জিনের শব্দে আপনার কথার আওয়াজ কিচ্ছু শোনা যায়নি।
– বলছি, ভালো লাগছে তোমার?
– অন্নেএএক। খুব স্ট্রেসে ছিলাম এই কয়দিন। কি যে শান্তি পাচ্ছি আমি! আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না৷ থ্যাংকস!
– কি নিয়ে এত স্ট্রেস? বিয়ে?
– হুম।
– জোর করে ধরে বিয়ে করে ফেললাম তাই না?
– আমি প্রথমদিন কি ভয় পেয়েছিলাম জানেন? কেউ কখনো ওভাবে আমাকে হুমকি দেয়নি তোমাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেলব।
– হাতটা দাও তো, চুড়িগুলো দেখি?

চুড়ি দেখার বাহানায় মাইশার হাত মুঠোবন্দি করে নিলো হাসিব৷ মাইশার আঙুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেখছে সে। মাথা নিচু করে মাইশাকে বললো,

– আমি জানতাম তুমি এখনি বিয়ে করতে রাজি না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি করতামও না। কিন্তু তুমি আমার জন্য কোনো পথ খোলাই রাখোনি। তোমাকে নিজের একান্ত আপন করে না পাওয়া পর্যন্ত আমি এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাইনি৷ ঘুম তো শেষ হয়েছেই, কিছুদিন যাবৎ খাওয়া দাওয়াও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তোমাকে ভালোবাসার কথা জানাতেও পারছিলাম না৷ অবশ্য পারছিলাম না বললে ভুল হবে, ইচ্ছে করে জানাইনি। জানিয়ে লাভ হতো কি? তুমি তো আমার ঐ ভালোবাসা ছেঁড়া কাগজের মত ফু মেরে উড়িয়ে দিতে। এমন কতশত ভালোবাসার প্রস্তাব তুমি উড়িয়ে দিলে এই পর্যন্ত। কারো ভালোবাসার মূল্য আছে নাকি তোমার কাছে? নিজেকে তিল তিল করে শেষ হতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমিই যদি শেষ হয়ে যাই তাহলে তোমাকে পাবো কি করে? নিপার গায়ে হলুদের দিন আমার কাছ থেকে আধ হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলে। ঐ প্রথম এত কাছ থেকে তোমাকে দেখা, তোমার সঙ্গে কথা বলা। এবার মনে হলো নিঃশ্বাস আটকে আসছে৷ আমি এ্যাজমা পেশেন্ট না, তবুও আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো! গলা পর্যন্ত এসে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে আমার। অসুখটা ছিলে তুমি। চিরতরে তোমাকে আমার সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে না বাঁধা পর্যন্ত আমি শান্ত হতে পারবো না। সেই তুমি বিয়ের আসরে বসে কবুল বললে, আমি বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। এতগুলো দিনের এত অশান্তি, এত অস্থিরতা সব মুহূর্তেই উধাও৷

হাসিবের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মাইশা৷ চোখে মুখে অনুভূতির রঙিন আলোর ছটা লেপ্টে আছে৷ মুচকি হেসে বললো,

– আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। কি করে বলেন এত সুন্দর সুন্দর কথা?
– হ্যাঁ, এই কথাগুলো আমি বাসা থেকে মুখস্থ করে এসেছি। আমার এক বন্ধু শিখিয়ে দিয়েছে তোমাকে এসব বলার জন্য৷

মুহূর্তেই মাইশার হাসিমাখা মুখটা কুঁচকে এলো। মাইশার আঙুল টেনে বললো,

– এসব কথা কি করে মাথায় আসে তা তুমি জানবে কিভাবে? মানুষকে প্রেমে ডুবিয়ে মারতে শিখেছো, নিজে তো ডুবে মরো নি এখনো৷ ডুব দাও, তারপর তুমিও রাতারাতি কঠিন ধাতু থেকে সফট জেলি হয়ে যাবে। প্রেম প্রেম কথা বের হবে মুখ থেকে।

শাওয়ারের নিচে আসন পেতে বসে আছে মাইশা। বুকের মাঝে ধুকপুক চলছে। তীব্র ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। হাসিব নামক ঘোর। তার স্পর্শ চাহনী আর কথা বলা সবকিছুতেই মোহ৷ এই প্রথম কোনো পুরুষের সান্নিধ্যে এতটা সময় গড়ালো৷ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোর মধ্যে এই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা দখল করে নিয়েছে৷ তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা সেকেন্ড সুন্দর ছিলো, অদ্ভুত রকমের সুন্দর। ফিরে আসার সময় মানুষটার পিঠে লেপ্টে ছিলো পুরোটা পথ৷ এখনো নাকের ডগা থেকে মানুষটার গায়ের ঘ্রাণ সরেনি। তার কথা ভাবতেই আনমনে মুখটিপে হাসছে মাইশা। ভালো লাগতে শুরু করেছে তাকে। একনজরে অনেকটা সময় ধরে সে তাকিয়ে থাকতে জানে। চোখের পুরোটা জুড়ে অসীম মুগ্ধতারা ছুটোছুটি করতে থাকে। সেই মুগ্ধতা, সেই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা উপেক্ষা করার ক্ষমতা কোনো মানুষের আছে নাকি? যতটা রূঢ় তাকে মনে হয়েছিলো মোটেও মানুষটা তেমন না। একটুখানি পাগলাটে বটে। লোকমুখে শোনা যায় পাগলাটে ধাঁচের মানুষগুলো নাকি প্রেমিক হিসেবে চমৎকার হয়৷ হোক না তাহলে পাগলাটে, মন্দ কি!

মাইশার আলমারীতে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো সারিবদ্ধ শাড়ীগুলো থেকে হাসিব কলাপাতা রঙের শাড়ীটা বের করে নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে আধঘন্টা হলো। বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে আছে তার। বিছানা ছেড়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো,

– তুমি বেরিয়ে আসবে নাকি আমি ভেতরে আসবো? একঘন্টা হয়ে আসছে। আর কতক্ষণ একা বসে থাকব বলো?

তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো মাইশা। ভেতর থেকে বললো,

– ৫ মিনিট!

খানিকসময় বাদে বাথরুম থেকে মাইশা বেরিয়ে এলো৷ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো হাসিব। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো ভেজা চুলে তয়লা পেঁচিয়ে মাইশা দাঁড়িয়ে আছে। কাজল চোখের নিচে হাল্কা লেপ্টে আছে। হাত বাড়িয়ে পড়ার টেবিলের উপরে থাকা টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু নিলো হাসিব। এগিয়ে এসে মাইশার কাছে দাঁড়ালো সে৷ সযত্নে চোখের সীমানা ছেড়ে এসে লেপ্টে যাওয়া কালো দাগটুকু মুছে দিচ্ছে। নিচুস্বরে হাসিব বললো,

– শাড়ী বের করে রেখেছি। তুমি এখন শাড়ীটা পরে আমার সঙ্গে ছাদে যাবে৷

শীতলপাটি হাতে কলাপাতা রঙের শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে হাসিবের পিছু পিছু ছাদে উঠে এলো মাইশা৷ ছাদের কোণায় বড় ড্রামে বোনা হাসনাহেনা গাছটা সাদা ফুলে ভরে উঠেছে। তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা ছাদের এপাশ ওপাশ। পাটি বিছিয়ে রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লো দুজনে৷ অন্ধকার আকাশ জুড়ে আজ নক্ষত্রের মেলা। মাথা উঁচিয়ে সেই দৃশ্যই দেখছে হাসিব। দূরের এক বহুতল এ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছে মাইশা। ঐ ফ্ল্যাটের ছেলেটা মেয়েটার কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মেয়েটা দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে তার ঘাড়৷ ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা এনার্জি বাল্বের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুজনকে। ভীষণ মনোযোগে মাইশা দেখছে তাদের। মিটমিটিয়ে হাসছে সে। মাইশার হাতে হালকা ধাক্কা দিয়ে হাসিব জিজ্ঞেস করলো,

– ঐদিকে কি দেখো?
– ঐ ফ্ল্যাটের ওদের দেখি?
– কোন ফ্ল্যাট?
– ঐ তো সামনে। দেখতে পাচ্ছেন না? হাজবেন্ড ওয়াইফ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে রেখেছে।
– এ্যাহ্! আরেকজনের রোমান্স দেখে মনে মনে সুখের ভেলায় ভেসে বেড়ানো হচ্ছে তাই না?
– দেখতে ভাল্লাগছে তো! কাউকে ভালোবাসতে দেখলে ভালোই লাগে৷
– আমি তোমাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরি, আরো বেশি ভালো লাগবে।

কড়াস্বরে ‘না’ বলেই খানিকটা দূরে সরে এলো মাইশা। তার কান মলে দিয়ে হাসিব বললো,

– আরেকজকে এসব করতে দেখলে সুখ পাও আর আমি করতে গেলেই না!

কন্ঠে সমস্ত আহ্লাদ ঢেলে দিয়ে মাইশা হাসিবের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললো,

– আমাকে আরেকটু ভালোবাসুন, আরো মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনান৷ তবেই না আমি আপনার আরো কাছে আসবো। একটু কাঠখড় না পুড়িয়ে আমাকে পেয়ে গেলে তো আর আমি দাম পাচ্ছি না৷ সস্তা ভাববেন না আমাকে?

নিচুস্বরে হাসলো হাসিব। মাইশার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

– তুমি আমার কে তা তোমাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই৷ যদি কখনো আমার ভালোবাসায় ডুবে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিতে পারো তবেই জানতে পারবে তুমি আমার কে! আগে বন্ধুদের মুখে শুনতাম প্রেমিকার জন্য নাকি তাদের জীবন যায় দশা। বিশ্বাস করতাম না আমি। হাসতাম, হেসে ওদের সব কথা উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, যত্তসব ড্রামাটিক কথাবার্তা। তখন ওরা কি করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো! তারপর মুখ শুকনো করে বলতো, আজ এভাবে বলছিস তো একদিন নিজেও এভাবে ডুবে মরবি। তখনো বুঝিনি ওরা আমাকে শান্তস্বরে অভিশাপ দিচ্ছে। বিন্দাস ঘুরতাম-ফিরতাম। সকালে মায়ের হাতে বানানো নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে অফিস চলে যেতাম। অফিসে আমি সবার কাছে খোশ মেজাজের মানুষ হিসেবেই পরিচিত৷ অফিসে যত কাজের ঝড় ঝাপটা আসুক সবাই কাজের চিন্তায় আধমরা হয়ে গেলেও আমি হইনা। ফুরফুরে মেজাজে হাসতে হাসতে কাজ সেরে ফেলি। অফিস সেড়ে সোজা চলে যেতাম বন্ধুদের আড্ডায়। সেখান থেকে নয়টায় বাসায় ফিরতাম। এরপর মায়ের সঙ্গে গল্প করে ডিনার সেরে লম্বা ঘুম দিতাম। কখনো আড্ডা বাদ দিয়ে মুভি দেখতাম। একাই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম দূরে কোথাও৷ চমৎকার একটা জীবন ছিলো আমার৷ কোনো অপূর্ণতা ছিলো না। নিজেকে খুব পরিপূর্ণ মনে হতো৷ তারপর একদিন তোমাকে দেখলাম। তোমার বান্ধবী নিপা সেদিন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো অঙ্কুরের সঙ্গে দেখা করতে। আমিও ছিলাম অঙ্কুরের সঙ্গে। এই শাড়ীটাই পড়ে এসেছিলে। কি একটা প্রোগ্রাম ছিলো ভার্সিটিতে তোমার। খোপায় ফুল জড়িয়ে এই শাড়ীটা পরেই সোজা প্রোগ্রাম থেকে চলে এলে দেখা করতে। রিকশা এসে আমাদের সামনে থামলো। সেবারই প্রথম তোমাকে আমি দেখলাম। বুকে এসে সজোরে কিছু একটা ধাক্কা দিলো। হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তোমার দিকে৷ আর তুমি তখন ব্যস্ত ভাড়া মেটাতে৷ রিকশা থেকে নেমে শাড়ীর কুঁচি ঠিক করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলে তুমি, আমি আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াইনি৷ পালিয়েছিলাম ঐ জায়গা ছেড়ে৷
– কেন? পালালেন কেন?
– সাহস হয়নি আমার তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোর৷ প্রেম প্রেম পাচ্ছিলো আমার। আমি আমার সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার মাঝে। সর্বনাশ থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছি, পারিনি। সেদিন আমার সর্বনাশ ঘটেই গেলো। পরিপূর্ণ এই জীবনে তোমার তীব্র অভাব অনুভব হওয়া শুরু হলো৷ হাসিখুশি আর ফুরফুরে মেজাজের তকমা পাওয়া এই হাসিবের দিনরাত মন খারাপের অসুখ পেলো৷ যেদিকে তাকাই সবখানেই যেন শুধু মরুভূমি। কোথাও একটু প্রশান্তি নেই৷ তোমার বাসার বারান্দায় এসে কতরাত বিষন্ন মনে বসে থেকেছি! কখনো তুমি আসতে, কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে চলে যেতে৷ তখন চিৎকার করে নিচ থেকে জানাতে ইচ্ছে হতো,

– যেও না প্লিজ! এইতো আমি এখানে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছি। তোমার জন্যই এতরাতে এখানে ছুটে আসা। তুমি চলে গেলে আমি দেখবো কাকে?
– আপনি রাত বিরাতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন?
– হুম, কখনো তো পুরো রাত পেরিয়ে ভোরও হয়েছে দাঁড়িয়ে থেকে। তোমার ভার্সিটির সামনেও দাঁড়িয়ে থাকতাম। প্রায় দিনই একটা বাচ্চা তোমাকে ভার্সিটি ফেরার পথে ফুল দিতো, সেগুলো আমিই পাঠাতাম।
– আপনি!
– হুম।
– এতকিছু আমার জন্য অথচ আমিই জানি না! সামনে এসে বলেননি কেন?
– তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিতে আমি জানতাম। সেই ফিরিয়ে দেয়া আমি মেনে নিতে পারতাম না৷ ভেঙে টুকরো যেতাম। তাই বলিনি৷
-…………….
– ভালোবাসি তোমাকে৷ কতটুকু বাসি সেই সীমাটুকু আমি নিজেও জানিনা৷ শুধু জানি ভালোবাসি৷ আমাকে একটু ভালোবাসবে মাইশা? দুহাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিবে প্লিজ?

উঠে দাঁড়ালো মাইশা৷ শাড়ীর কুঁচি সামলে দৌঁড়ে পালাবার জন্য পা বাড়াতেই আঁচল টেনে ধরলো হাসিব। বললো,

– চলে যাচ্ছো কেন?
– আমার প্রেম প্রেম পাচ্ছে। নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছি৷ এখন কি নিজের সর্বনাশ দেখার জন্য অপেক্ষা করব?

আঁচল ছেড়ে দিলো হাসিব। ছুটে পালালো মাইশা৷ হাসিবের ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হাসি দখল করে নিয়েছে৷ মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। হঠাৎ পিছন থেকে এসে কেউ জড়িয়ে ধরেছে তাকে। তার পিঠে নাক মুখ ঘষে যাচ্ছে৷ বুকের মধ্যখানে দুহাত বেঁধে রেখেছে। হাতজোড়া আঁকড়ে ধরলো হাসিব। বললো,

– ফিরে এলে যে!
– বলতে এসেছি আপনি মানুষটা মোটেও সুবিধার না। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মানুষজনের সর্বনাশ ঘটান।

ঝট করেই হাসিবের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো মাইশা৷ পেছনে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
– খুব তো আমাকে দোষ দিয়ে বেড়ান আমি আপনার ঘুম কেড়েছি৷ জলদি নেমে আসুন, ঘুম পাড়িয়ে দিব৷

মাথা নাড়িয়ে হাসছে হাসিব৷ এক সমুদ্র ভালোবাসা হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে, সেই সমুদ্রে বিলীন হতে অপ্সরীর পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছে সে।

-সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here