#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৬
আশফাক আহমেদ বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। জঙ্গলের গহীন থেকে নানারকম পোকা-মাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে। দূরে কোথাও করুণ সুরে নিশাচর পাখি ডাকছে। সেই শব্দে মনের ব্যাথাটা হু হু করে বাড়তে থাকে আশফাক আহমেদের। তিনি ধীরপায়ে আরিশার ঘরের দিকে এগুতে থাকেন।
আরিশা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। জানালার ফাঁক গলে ওর চোখে-মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ছে। আরিশার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। ওর বারবার মনে হয়, যদি ওর মা বেঁচে থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই জীবনটা আরও সুন্দর হতো। সেঝচাচ্চুও বিয়ে করে নিতো। তাদের ছোট ছোট বাচ্চা থাকতো। ছোটচাচ্চুও হয়তো এতদিনে বিয়ে করতো। সবাইকে নিয়ে জঙ্গলের গহীনে প্রাণহীন বাড়িটা মেতে থাকতো গভীর সুখে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। শুধুমাত্র ওর মা বেঁচে নেই বলে।
আরিশা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশের মস্তবড় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোমল গলায় বলে,
‘মা, তুমি কেন আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলে? তুমি নেই বলে আমরা কেউ ভালো নেই। আমাদেরকে কেন একা করে চলে গেলে? মা?’
আশফাক আহমেদ আরিশার রুমে এসে দেখেন বিছানা খালি। আরিশা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আরিশার কাঁধে হাত রাখেন। আরিশা চকিতে ফিরে তাকায়। আশফাক আহমেদকে দেখে চোখের পানি মুছে বলে,
‘আব্বু, আপনি ঘুমাননি?’
‘তুই ঘুমাসনি কেন?’ আশফাক আহমেদের কন্ঠ ভারী।
“আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। সেটা দেখছিলাম।” কান্নাভেজা চোখে মৃদু হাসলো আরিশা।
আশফাক আহমেদ আলতো করে আরিশাকে বুকে টেনে নিলেন।
‘ঘুমাবি চল। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
আরিশা আশফাক আহমেদের সাথে বিছানায় এগিয়ে গেল। আশফাক আহমেদ বালিশ টেনে আরিশাকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ আরিশা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে,
‘একটা কথা বলবো, আব্বু?’
আশফাক আহমেদ কিঞ্চিৎ অবাক হলেন আরিশা তখনো ঘুমায়নি দেখে। সেটা এড়িয়ে তিনি বলেন,
‘বল?’
‘আম্মু কিভাবে মারা গিয়েছিলো?’
আকস্মিক আশফাক আহমেদের হাত থেমে যায়। তিনি আরিশার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেন।
আরিশা উঠে বসে বললো,
‘আব্বু, আজকে অন্তত আমাকে এড়িয়ে যাবেন না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আম্মু কিভাবে মারা গিয়েছে?’
আশফাক আহমেদ দোনোমোনো করে বলেন,
‘কিভাবে আবার মারা যাবে? সবাই যেভাবে মারা যায় সেভাবে।’
‘সবাই তো একইভাবে মরে না। একেকজন একেকভাবে মরে। বলেন না, আম্মু কিভাবে মারা গিয়েছিলো?’
আশফাক আহমেদ ধমকে বললেন,
‘স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলো। কতবার বলতে হয়? যা ঘুমা এখন।’
রীতিমতো আরিশাকে এড়িয়ে চলে যান আশফাক আহমেদ। আরিশা অশ্রশিক্ত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আজও সত্যিটা বললেন না বাবা?’ কান্না জড়ানো গলায় বলে আরিশা। আরিশার বুক মুঁচড়ে কান্না আসে। বালিশে মুখ লুকিয়ে সারারাত কাঁদে ও।
সকালে ঘুমঘুম চোখ মেলে মোবাইল হাতে নেয় নির্ভীক। ফেসবুকে ঢুকবে বলে ইন্টারনেট চালু করতেই রীতিমতো নোটিফিকেশনের বন্যা বয়ে গেল। অনেকক্ষণ টুংটাং আওয়াজের পর অবশেষে ফোনটা শান্ত হলো। নির্ভীক দ্রুত নোটিফিকেশন চেক করলো। ওর আইডিতে সচরাচর এত নোটিফিকেশন কখনো আসে না। গুরুতর কিছু ঘটেছে কিনা দেখতে গিয়ে নির্ভীক থ বনে গেল। ওর রিসেন্ট পোস্টটাতে রিয়েক্ট, কমেন্টের বন্য বয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত টুংটাং কমেন্ট আসছে। নির্ভীক কমেন্টগুলো পড়তে থাকে দ্রুত।
গতকালের তোলা প্রকৃতির ছবিগুলো রাতে ফেসবুকে শেয়ার করেছিলো নির্ভীক। সবশেষে রেখেছিলো আরিশার কাঁধে বানর ঝোলানো ছবিটা। নির্ভীক অবাক হয়ে দেখে আরিশার ছবিটাতেই সবচেয়ে বেশি রিয়েক্ট ও কমেন্ট পড়েছে। শেয়ারও হয়েছে প্রচুর। অথচ এতদিন যাবৎ বন-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জীবনের রিস্ক নিয়ে কতশত ছবি তুলে ও ফেসবুকে আপলোড করেছে। কখনো তেমন সাড়া পায়নি। আরিশার ছবি সবাই এত পছন্দ করেছে!
নির্ভীকের কেমন একটা ঘোর লেগে যায়। ওর মনে হতে থাকে ও বুঝি রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেল। ও ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে নিলো। নিজের হাতে জোরে চিমটি কেটে দেখলো এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব। পরক্ষণেই ব্যাথায় ককিয়ে উঠে মৃদু হাসলো।
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা থেকে নামবে তখনই ওর ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। নির্ভীক ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে জানতে চায়,
‘কে বলছেন?’
‘মি. নির্ভীক বলছেন?’
‘জ্বি বলছি। আপনি কে?’
অপরপাশের লোকটা পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘এম.পি হোসাইনুল আলমের ছেলে নির্ভীক বলছেন?’
নির্ভীক খানিকটা দমে যায়। এম.পির ছেলে বলে ওর কাছে নানারকম জবের অফার আসে। কিন্তু ও সেসব বিনাবাক্যে রিজেক্ট করে দেয়। বাবার ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে ও কোনো কাজ করতে চায় না। নিজের যোগ্যতায় উঠে দাঁড়াতে চায়।
নির্ভীক পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘আপনি কে বলছেন?’
‘আমি এম.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে বলছি। গতকাল রাতে আপনার কিছু ফটোগ্রাফি দেখলাম। আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আপনি কি একবার অফিসে আসতে পারবেন?’
নির্ভীক রীতিমতো অবাক হয়। ওর বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না। এম.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ঢাকা শহরের সবচেয়ে নামি-দামি কোম্পানির একটি। ওখানে নির্ভীককে কেন ডাকছে? ফটোগ্রাফি করার জন্য? কিন্তু এতবড় কোম্পানিতে ওর মতো ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার দিয়ে কি হবে? ভেবে কুল কিনারা পায় না নির্ভীক। অবশেষে বলে,
‘মানে কেন আসবো? ব্যাপারটা যদি খুলে বলতেন?
‘আপনি আসলেই নাহয় বলবো।’
‘আপনি ব্যাপারটা না বললে…’
‘নির্ভীক, উঠেছো?’ মায়ের ডাক শুনে মাঝপথে কথা থামিয়ে দেয় নির্ভীক। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা লোকটাকে বলে,
‘আমি আপনার সাথে পরে কথা বলি?’
‘ওকে, নো প্রবলেম।’ লোকটা ফোন রেখে দিলো।
মিসেস শায়লা রুমে ঢুকে দেখেন নির্ভীক দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। তিনি খানিক অবাক হয়ে বলেন,
‘এত সকালে উঠলে কি করে?’
‘ম্যাজিক!’ দু’হাত মুখের সামনে নাচিয়ে বলে নির্ভীক।
মিসেস শায়লা মৃদু হাসেন। নির্ভীক মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘টুডে আ’ম সো হ্যাপি মম।’
‘বুঝতে পেরেছি। খুশির কারণটা কি?’
‘ভার্সিটি থেকে ফিরে বলছি। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।’
মিসেস শায়লাকে ছেড়ে নির্ভীক দ্রুত ফ্রেশ হতে গেল।
সকাল সকাল আরমান ও আশফাক আহমেদ দোকানে চলে যান। আরিশা তখনো ঘুমে। সারারাত জেগে ভোররাতে ঘুমিয়েছে বলে আশফাক আহমেদ ওকে জাগাতে বারণ করেছেন। আশফাক আহমেদ ও আরমান সকালের নাস্তা তৈরী করেছে। রাফসান ঘরদোর ও উঠান ঝাড়ু দিয়েছে। এরপর আরমান ও আশফাক আহমেদ নাস্তা করে বেরিয়ে গেলে রাফসান আরিশাকে ডেকে তুলে। আরিশা হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। রাফসান ওর হাত ধরে টেনে এনে ধূসর রঙহীন চেয়ারটায় বসিয়ে বলে,
‘আজকে সব রেডি।’
আরিশা মৃদু হাসার চেষ্টা করে। রাফসান ভ্রুকুটি করে বলে,
‘এখনও মন খারাপ করে আছিস? তোকে আর কখনো কিচ্ছু বলবো না।’
আরিশা হুট করে ছোটবাচ্চার মতো কেঁদে ওঠে। রাফসান হকচকিয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে বলে,
‘কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? আরিশা? চাচ্চু?’
আরিশা কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
‘চাচ্চু, আব্বু আমাকে কেন বলেনা আম্মুর কথা? আম্মু কিভাবে মারা গিয়েছে চাচ্চু? বলো না চাচ্চু, বলো না।’
রাফসানের খুব কষ্ট হয় আরিশার জন্য৷ কাঁদলে অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটাকে বড্ড অসহায় দেখায়। খুব মায়া হয় ওর জন্য। বনেবাদাড়ে বেড়ে ওঠা যার নিয়তি তার এত সুন্দরী হওয়া কি খুব প্রয়োজন ছিল? রাফসান উঠে গিয়ে একহাতে আরিশাকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
‘এভাবে কাঁদে না চাচ্চু। তুই কাঁদলে যে আমাদের খুব কষ্ট হয়।’
‘আমারও তো খুব কষ্ট হচ্ছে। বলো না আম্মু কিভাবে মারা গিয়েছে?’
‘আচ্ছা বলবো। তুই এখন খেয়ে নে। আমাকে তো কাজে বেরুতে হবে। এসে সব বলবো।’ স্বান্তনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলে রাফসান।
আরিশা থম মেরে টেবিলে বসে থাকে। খাবার গলা দিয়ে নামছে না ওর। আরিশাকে মুখে খাবার তুলে দেয় রাফসান। অনেক কষ্টে অল্প কিছু খায় ও। এরপর রাফসান বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বারবার বলে যায়, এসে সবটা বলবে। বারবার এই আশ্বাস দেয়। কিন্তু আদৌ রাফসান সবটা আরিশাকে জানাতে পারবে কিনা ও জানে না। আর জানালে আরিশার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটাও বলা মুশকিল। দ্বিধাগ্রস্থ মন নিয়ে চলে যায় রাফসান। যদিও আজকে ওর যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না।
সকাল সকাল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে নির্ভীক। ওর মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। ক্যামেরা হাতে হেলেদুলে ভার্সিটির গেইটে পা রাখতেই কয়েকজন ছেলেমেয়ে ওর পথ আটকে দাঁড়ায়। নির্ভীকের ফুরফুরে মেজাজ মুহুর্তেই ফ্যাঁকাশে হয়ে আসে। তবুও মুখে হাসি টেনে ও বলে,
‘কিছু বলবে?’
‘রাতারাতি ফেমাস হয়ে গেলি। তা মেয়েটা কে?’ চোখ টিপে বলে মিনহাজ।
নির্ভীক শান্তস্বরে জানতে চায়,
‘কোন মেয়ে?’
‘ঐ যে কাঁধে বানর ঝোলানো।’ সানজু বলে।
নির্ভীক চুপ করে থাকে। ওদের মতলব বোঝার চেষ্টা করে। ছেলেপিলেগুলো নির্ভীকের ডিপার্টমেন্টেরই। তিনজন ছেলে এবং দুজন মেয়ে নিয়ে নিজেরাই দল বানিয়ে ক্যাম্পাসে দাপটের সাথে ঘুরে বেড়ায় এরা। কাউকে পরোয়া করে না। এদের মূলে রয়েছে ছাত্রনেতা ইয়াদ। ওর ডানহাত হলো মিনহাজ আর বামহাত, নির্ভীকের সবচেয়ে অপছন্দের সানজু। বাকি দুজন রিয়া ও রাকিব।
নির্ভীককে নিরব দেখে ইয়াদ বলে,
‘বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের ছবি তুলে বেড়াস তাই না?’
নির্ভীকের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তাও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ও বলে,
‘ঠিক করে কথা বলো। যেটা জানো না সেটা নিয়ে বাজে মন্তব্য করো না।’
‘এ্যাঁহ, বাজে মন্তব্য করো না। বললেই হলো? আমরা তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি একটা সুন্দরী মেয়েকে। এ্যাঁই বলনা ওকে কোথায় পেলি? এত্ত জোশ মাল আমি জীবনে দেখিনি।’ মুখে চুকচুক শব্দ করে বলে ইয়াদ।
কথাটা শোনার পর নির্ভীক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ইয়াদের নাকে জোরে ঘুষি মারে। নাক চেপে ধরে ভূবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে দূরে সরে যায় ইয়াদ। নির্ভীক রাগে থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে এখনই ইয়াদকে মেরে মাটির নিচে পুতে ফেলতে।
‘আমার সামনে যদি আর কোনদিন কোনো মেয়ের নামে বাজে কথা শুনেছি তো খুন করে ফেলবো। মাইন্ড ইট!’
একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে নির্ভীক চলে গেল ক্লাসে।
রাফসান চলে যেতেই আরিশা রাফসানের রুমে যায়। রাফসান রুমটা সবসময় পরিপাটি করে রাখে। রুমের একপাশে বিশাল দেয়াল আলমারি। তাকে তাকে গল্পের বই সাজানো। আরিশা সেখান থেকে পছন্দমতো একটা গল্পের বই নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। সাথে সাথে গাছের মগডাল থেকে ওর কাঁধে লাফিয়ে পড়ে পুঁচকু। আরিশা সেদিকে তাকিয়ে সামান্য হাসার চেষ্টা করে। এরপর পুঁচকুকে কাঁধে নিয়েই বেরিয়ে খানিকটা দূরে চলে যায়।
জায়গাটা একদম নিরিবিলি। তেমন গাছগাছালিও নেই এখানে। শুধু ছোট ছোট চারাগাছ এবং এক বিগত পরিমাণ ঘাস দিয়ে সবুজে সবুজ হয়ে আছে জায়গাটা। মাঝখানে ছোট একটা খাল বয়ে গেছে। চাইলে এক লাফেই খালের এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাওয়া যায়। কিছুটা দূরে একটা জলাশয়। বন্য প্রাণীরা এখানে পানি খেতে আসে। আশেপাশে প্রাণীদের পায়ের ছাপ স্পষ্ট। তখনও জলাশয় থেকে পানি পান করছে দুয়েকটা হরিণ। ঘন জঙ্গলের গাঢ় সবুজ গাছের ছায়ায় খালের পানিগুলো গাঢ় সবুজ রং ধারণ করেছে। খালের ঠিক কিনার ঘেঁষে মস্ত বড় একটা রেইনট্রি তরতর করে বেড়ে উঠেছে। সেই গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঘাসের উপর বসে আরিশা। গাছ-গাছালির ফাঁকে এখান থেকে ওর বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। একবার সেদিকে তাকিয়ে গল্পের বইটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে ও।
খালের ওপারে কিছুদূর গেলেই কলাবাগান। দূর থেকে থরে থরে সাজানো কলার কাঁদিগুলো দেখতে পায় পুঁচকু। কলা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে খালের ওপর লাফিয়ে কলাবাগানে ছুটে সে।
মৃদু বাতাসে গাছ থেকে নাম না জানা কতশত ফুল ঝরে পড়ছে আরিশার কোচায়, খোলা বইয়ে। বাতাসে ওর উড়ন্ত খোলা চুলে আটকে যাচ্ছে সাদা ও হালকা গোলাপী রংয়ের বাহারিরকম ছোট ছোট ফুল। বারবার আরিশার বইয়ের উপর একেকটা ফুল পড়ছে আর ও বই থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।
ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখে ওর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসের দোলা লেগে ফুলগুলো অকালেই ঝরে পড়ছে। অথচ বাতাস না থাকলে ওদের এখন ঝরে পড়ার কথা না। আরিশার মা-ও তো তেমনি অকালে চলে গিয়েছিলো। কোনো দূর্ঘটনা না ঘটলে নিশ্চয়ই অকালে প্রাণ হারাতে হতো না তাকে। কি এমন ঘটেছিলো যেটা বাবা ওর কাছ থেকে আড়াল করছে? আচ্ছা, অকাল মৃত্যু বলে কি কিছু হয়? স্রষ্টা তো অনেক আগেই সবকিছু লিখে রেখেছিলেন। এমনকি একটা পাতা ঝরে পড়ার খবরও তিনি জানেন, লিখে রেখেছেন। ফুলগুলো যে ঝরছে এগুলোও তো তাহলে লেখা আছে।যার যখন মৃত্যু হওয়ার কথা তখনই মৃত্যু হবে। যার যখন ঝরে পড়ার কথা সে তখনই ঝরে পড়বে। আগপিছ হওয়ার সুযোগ তো নেই। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কারণেই একজন মানুষের মৃত্যু হয়৷ তাহলে তো অকাল মৃত্যু বলে কিছু থাকার কথা না। তৎক্ষনাৎ কুরআনের একটা আয়াত মনে পড়ে যায় আরিশার।
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে, অতঃপর জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, অতঃপর তোমাদেরকে বের করে এনেছেন শিশুরূপে, অতঃপর তিনি তোমাদের বৃদ্ধি দান করেন যাতে তোমরা তোমাদের পূর্ণ শক্তির বয়সে পৌঁছতে পার, অতঃপর আরো বৃদ্ধি দেন যাতে তোমরা বৃদ্ধ হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো আগেই মৃত্যু ঘটান যাতে তোমরা তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাও আর যাতে তোমরা (আল্লাহর সৃষ্টি কুশলতা) অনুধাবন কর। [১] মানুষ তাহলে কেন অকাল মৃত্যুর কথা বলে? আসলে তো অকাল মৃত্যু বলে কিছুই নেই। মানুষ তার নির্দিষ্ট বেঁধে দেওয়া সময়ের পর ঠিকই তার রবের কাছে ফিরে যাবে।
গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায় আরিশা। মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ হয় ওর। চোখ ভিজে আসে।
সানজু ও মিনহাজ ইয়াদকে মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসে। একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট ওর নাকে ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়। নাক পুরোপুরি লাল হয়ে গেছে ওর। মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ভার্সিটির পেছনের খোলা জায়গায় বেঞ্চিতে বসে ওরা। ইয়াদের দু’পাশে সানজু ও মিনহাজ। ঘাসের উপর রাকিব ও রিয়া।
ইয়াদ বেঞ্চিতে জোরে কিল মেরে বলে,
‘আমি নির্ভীককে ছাড়বো না। ব্যাটা বদ। কত্তবড় সাহস আমার গায়ে হাত তোলে।’ পরক্ষণেই ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে ও।
সানজু ওর কাঁধে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তুই চিন্তা করিস না। ওর ব্যবস্থা আমি করবো।’
‘তুই কি করবি? তুই তো ওকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছিস।’ মিনহাজ বলে।
‘আরে বিয়ে কি এমনি এমনি করবো নাকি? বিয়ে তো…’
সানজুকে থামিয়ে ইয়াদ বলে,
‘আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আসল কথা বল। কি করবি তুই?’
‘ওকে প্রথমে স্যারদের সামনে ছোট করবো, এরপর ওর বাড়ির লোকেদের কাছে। এরপর সারা দুনিয়ার কাছে। হাহাহা।’ গগন কাঁপিয়ে হাসে সানজু।
রাকিব হতবাক হয়ে বলে,
‘কিন্তু তুই তো ওকে ভালোবাসিস। বিয়ে করতে চাস। ও ছোট হওয়া মানে তো তুই ছোট হওয়া।’
‘ভালোবাসি?’ অদ্ভুত চোখে রাকিবের দিকে তাকায় সানজু। এরপর ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ইয়াদসহ দুজনে হো হো করে হেসে ফেলে।
‘আরে আগে আমার প্ল্যানটা শোন। ওসব ভালোবাসা-টাসা কিচ্ছু না। ওর বাবার খ্যাতি, ওর বিশাল সম্পত্তি এসব কিছু চাই আমার। নির্ভীক? ওরকম হাজারো নির্ভীককে চাইলেই পাবো আমি। কিন্তু অত সম্পত্তি এত ইজিলি কোথায় পাবো?’ বলে জোরে হেসে ফেলে সানজু।
‘এত ইজি ভাবছিস কি করে?’ রিয়া বলে।
‘আরে আমার বাবা তো নির্ভীকের বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওরা দুজনে তো আমাদের বিয়ে সেই কবে ঠিক করে রেখেছে। তো ওর সাথে বিয়ে হলে ইজিলি ওর সম্পত্তিও আমার।’
‘নির্ভীক মানবে? ও তো তোকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না।’ রাকিব বলে।
‘ওর সহ্য করার দরকার নেই। ওকে ব্ল্যাকমেইল করার সব রাস্তা আমার জানা।’ তুড়ি বাজিয়ে বলে সানজু।
‘কি করবি তুই?’ চোখ বড় করে জানতে চায় মিনহাজ।
‘সেসব কথা এখন থাক।’
‘আচ্ছা, এটা তো বল, নির্ভীকের বাবা যে তোদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে সেটা তুই জানলি কি করে? আর তার কারণই বা কি? নির্ভীকের তো এই বিয়েতে মত নেই।’
‘আমাকে বাবা বলেছে। এটার পেছনে অনেক বড় কারণও অবশ্য রয়েছে।’
‘কি কারণ?’ এতক্ষণে উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে ইয়াদ।
‘বাবাও নির্ভীকের দাদুর বিশাল সম্পত্তির জন্য নির্ভীকের ফুফিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। কিন্তু নির্ভীকের দাদুভাইয়া আগে থেকেই নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন বলে সেটা আর হলো না। তাই আমার জন্মের পর ওর বাবা বলেছেন নির্ভীকের সাথেই আমার বিয়ে হবে। এটা কনফার্ম।’
‘তারমানে সব সম্পত্তিও তোর? কত কত বিজনেস, বাড়ি, গাড়ি ওদের।’ চোখ বড় করে জানতে চায় মিনহাজ।
‘হুম। তাই তো হওয়ার কথা।’ মুচকি হেসে জবাব দেয় সানজু।
‘আচ্ছা, এখন এসব ছাড়। আগে নির্ভীকের একটা ব্যবস্থা আমি করে আসি।’ বলে উঠে চলে যায় সানজু।
মিশমি তার আট বছরের ছেলে তানজীরকে নিয়ে আরিশাদের বাড়িতে ঢোকে। আরিশার নাম ধরে ডাকে অনেকবার। কোনো সাড়া পায় না। চিন্তিত ভঙ্গিতে সে বাড়ির আশেপাশে খোঁজে আরিশাকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘সমস্ত দরজা-জানালা খোলা রেখে সবাই গেল কোথায়?’
তানজীর বলে, ‘মাঠে যায়নি তো আবার?’
‘কি জানি। যেতেও পারে। পুঁচকুকেও তো দেখছি না।’
‘আরিশাপুকে না পেলে পুঁচকুকেও পাবে না। এটাই তো স্বাভাবিক।’ মাটি থেকে ছোট ইটের টুকরো নিয়ে সেটাকে দূরে ছুঁড়ে বলে তানজীর।
‘কিন্তু আরিশা গেল কোথায়?’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে মিশমি।
‘আচ্ছা আম্মু তুমি এখানে থাকো। আমি কিছুটা গিয়ে খুঁজে আসি।’ তানজীর বলে।
‘আচ্ছা সাবধানে যাস। আর তাড়াতাড়ি ফিরবি। ঘন জঙ্গল, পথ হারালে বিপদ।’
‘হ্যাঁ আম্মু আমি তাড়াতাড়ি আসবো।’ তানজীর চলে গেল। মিশমি চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়ির সামনে দাওয়ায় বসে রইলো। তার মাথায় একটায় চিন্তা, আরিশার কোনো বিপদ হয়নি তো?
রেফারেন্স:
[১] সূরা আল-মুমিন – আয়াত ৬৭
#Be_Continued_In_Sha_Allah ?