অ্যাসিড পর্ব ৭

0
520

#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৭

সাইন্স ল্যাবের সামনে মাথা দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্ভীক। সানজু বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওকে ফলো করছে। নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে প্ল্যানমাফিক কাজ করার অপেক্ষায় আছে ও। নির্ভীক করিডোরের পাশ দিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমের সামনে আসতেই ওর ফোন বেজে উঠে। ফোন ধরবে বলে পকেটে হাত ঢোকাতেই পেছন থেকে ওর কলার চেপে ধরে ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে সানজু।
আকষ্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে নির্ভীক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওর দিকে ফিরে। সানজুকে দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে বলে,
‘কি হয়েছে? এসবের মানে কি?’
‘জানো না?’ নির্ভীকের বুকে হাত বুলিয়ে বলে সানজু।

নির্ভীক এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
‘সানজু, আমার মেজাজ খারাপ করো না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
‘হোক না খারাপ। খারাপ করে হলেও তোমাকে কাছে পেতে চাই। আই লাভ ইউ নির্ভীক।’ আকষ্মিক নির্ভীককে জড়িয়ে ধরে সানজু।
নির্ভীক ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারছে না ওকে। বারবার বলছে,
‘সানজু, ছাড়ো আমাকে। খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। পাগল হয়ে গেছো তুমি?’
‘তাহলে বলো জঙ্গলের মেয়েটা কে ছিলো? ওকে তুমি চেনো?’
‘চিনি না, ছাড়ো বলছি।’ অস্বস্তি নিয়ে বলে নির্ভীক।
‘না বললে ছাড়বো না।’
‘সানজু, পাগলামি করো না। প্লিজ ছাড়ো আমাকে।’
‘ছাড়া তো দূরে থাক। তোমাকে কিভাবে অপদস্ত করি দেখো আজকে।’ রেগে বলে সানজু।

সানজু নির্ভীকের হাতজোড়া নিয়ে ওর পিঠে রাখে। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে যায়। দরজার বাইরে প্রিন্সিপাল স্যারসহ ইয়াদরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সানজু চট করে নির্ভীককে ছেড়ে দিয়ে কান্নার ভান করে বলে,
‘স্যার, স্যার…’ বলতে বলতে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নার ভান করে ওর কাঁধে পড়ে থাকে।

প্রিন্সিপাল স্যার বললেন,
‘নির্ভীক, হোয়াট ইজ দিজ? তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি। হাউ ডু ইউ ডু ইট?’
‘স্যার, ট্রাস্ট মি! আমি কিচ্ছু করিনি। দেখুন…’ নির্ভীক কিছু বলার আগেই ইয়াদ বলে,
‘কিছু না করলে ও এমনি এমনি কাঁদছে?’

ইয়াদের কথায় পাত্তা না দিয়ে নির্ভীক স্যারের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ও অভিনয় করছে স্যার।’
‘হেই কোনো মেয়ে নিজ থেকে ছেলেদের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে যায়?’ ইয়াদ বলে।

নির্ভীকের কান দিয়ে অদৃশ্য গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওর চোখমুখ লাল হয়ে আসছে। কেউ টিচারের সামনে এত জঘন্য ভাষায় কথা বলতে পারে? এটুকু ম্যানার্স নেই? ছি!

প্রিন্সিপাল স্যার ধমকে বলেন,
‘মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ ইয়াদ!’
‘স্যরি স্যার। কিন্তু ও আমার ফ্রেন্ডের সাথে যা করেছে…’ ইয়াদ বলার চেষ্টা করে। নির্ভীক ওকে থামিয়ে বলে,
‘স্যার আমি এক্ষুনি প্রুভ করবো আমি কিছু করিনি। আ’ম ইনোসেন্ট।’
‘প্রুভ করো।’

নির্ভীক দু’হাত স্যারের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘দেখুন স্যার, আমার হাত দুটোই বন্ধ। আমি ক্যামেরায় ছবি দেখতে দেখতে করিডোরে হাঁটছিলাম। অকস্মাৎ সানজু টেনে আমাকে ওয়াশরুমে ঢোকায়। ট্রাস্ট মি!’

‘স্যার, এটা কোনো প্রুভ হলো? ক্যামেরাটা হয়তো এক্ষুনি ও হাতে নিয়েছে।’ মিনহাজ বলে।
‘এক্সেক্টলি স্যার।’ ইয়াদ সায় মেলায় ওর কথায়।
‘স্যার, আপনি জানেন যে আমি ক্যামেরা কখনো গলায় ঝুলিয়ে রাখি না। ওটা সবসময় আমার হাতে থাকে। সো, সানজুকে যদি আমিই টেনে আনতাম তাহলে ক্যামেরা আমার হাতে থাকতো না।’ যুক্তি দেখিয়ে বলে নির্ভীক।
‘হ্যাঁ তাই তো।’ প্রিন্সিপাল স্যারও সায় দেয় নির্ভীকের কথায়।

নির্ভীক মুচকি হেসে বলে,
‘এটাতেও যদি কিছু নাহয় তাহলে অফিসে চলো। সিসি টিভি ক্যামেরায় তো সবই রেকর্ড হয়েছে। ওখানে সব ক্লিয়ার দেখা যাবে। ওখানে নিশ্চয়ই ভুল কিছু দেখাবে না?’

‘হ্যাঁ একদম ঠিক কথা বলেছো। চলো নির্ভীক।’ প্রিন্সিপাল স্যার অফিসের দিকে যান। প্রিন্সিপাল নিজেই নির্ভীককে খুব পছন্দ করেন। তিনি নির্ভীককে বিশ্বাস করেন। শুধু প্রমাণের অভাবে কিছু বলতে পারছেন না তিনি।
বাকিরা ওনার পিছু নেয়। সানজু ঘাবড়ে গিয়ে ইয়াদের হাত চেপে ধরে বলে,
‘এবার কি হবে ইয়ার? আমরা তো ধরা পড়ে যাবো!’

ইয়াদ স্বান্তনার বাণী শোনায় সানজুকে।
‘দেখি না কি হয়? আজকে পার পেয়ে গেলেও পরেরবার আর ছাড়ব না ওকে। দেখে নিস।’
‘ধুর শালা! আজকে কি হবে সেটা ভাব। ওর কথা না ভেবে আমাদের কথা ভাব। নির্ভীককে স্যার এমনিতেই বেশি ভালোবাসে। ওর নামে মিথ্যে অপবাদ এনেছি জানলে আমাদেরকে কিন্তু ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে।’ ভয়ে ভয়ে বলে সানজু।

তানজীর মাঠের দিকে এগুতে গিয়ে কি ভেবে পেছনে ফিরে তাকায়। তখনই খালের পাড়ে আরিশাকে দেখতে পায়। আরিশার কাছে গিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে তানজীর। আরিশা ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে ও। একপাশে খোলা বইটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তারওপর আরিশার ডানহাত।
তানজীর উঠে দাঁড়িয়ে আরিশার বাড়ির দিকে তাকায়। মিশমিকে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তানজীর ইশারায় ওখানে আসতে বলে মিশমিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মিশমি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে আরিশার পাশে বসে। আরিশার চোখের কোণে পানি লেগে আছে। মিশমির মনে খটকা লাগে।
“আরিশা কি কাঁদছিলো? কিন্তু কেন?”
মিশমি আলতো ছুঁয়ে ডাকে আরিশাকে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ও।

‘মিষ্টি, তুমি এখানে? কখন এসেছো?’ কান্নাভেজা চোখে অকস্মাৎ খুশি হয়ে আরিশা জড়িয়ে ধরে মিশমিকে। মিশমি ওর একমাত্র ফুফি। মিশমিকে ও মিষ্টি বলে ডাকে।

‘তুই গাছতলায় ঘুমোচ্ছিস কেন? ঘরে জায়গা নেই? কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে কি হতো?’ আরিশার চোখে চোখ রেখে বলে মিশমি।
‘দূর্ঘটনা’ বলতেই আরিশার খুশি মুহুর্তে উবে গেল। চেহারায় নেমে এলো বিষাদের ছায়া।
‘কি হলো?’ মিশমি মৃদু ধাক্কা দেয় আরিশাকে।
‘কিছু না। চলো বাড়িতে যাই।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে আরিশা।
‘আচ্ছা চল।’ মিশমি একমুঠোয় তানজীরের হাত, অন্যমুঠোয় আরিশার হাত নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।

বাড়িতে ঢুকেই আরিশা মিশমি ও তানজীরকে বসতে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা রেডি করতে যায়। মিশমি পিছু ডেকে বললো,
‘কোথায় যাচ্ছিস আরিশা’জা?

মিশমি আরিশাকে ছোটবেলায় জান ডাকতো। বড় হওয়ার পর জানকে ছোট করে জা’বানিয়ে নামের সাথে লাগিয়ে ওকে আরিশা’জা বলে ডাকে।

আরিশা কোমল গলায় জবাব দিলো,
‘এই তো পানি খাবো একটু। তোমরাও খাবে তো? আমি নিয়ে আসছি।’
আরিশা ছুটে যায় রান্নাঘরে। নাস্তার কথা বললে মিশমি কিছুতেই আরিশাকে যেতে দিতো না। মিশমি এ-বাড়িতে আসলে আরিশাকে একটাও কাজ করতে দেয় না। সব সে নিজেই সামলে নেয়। মিশমি তানজীরকে নিয়ে পুকুর ঘাটে যায় হাতমুখ ধুবে বলে।

আরিশা টেবিলে চা-নাস্তা ও লেবুর শরবত এনে রাখতেই খেল মিশমির কড়া ধমক।
‘তোকে বলেছিলাম এসব করতে? এতকিছু করতে গেলি কেন? বলেছিলি শুধু পানি আনবি।’
আরিশা কিছু বললো না। মিশমি বললো,
‘আমি থাকাকালীন আর একটা কাজও করবি না। সাহায্যও করতে হবে না আমাকে। তানজীরের সাথে ঘুরবি-ফিরবি, যা খুশি করবি। কোনো কাজ করতে যেন না দেখি।’

মিশমি তানজীর ও আরিশার দিকে একটা করে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলো। নিজে একটা নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে আরিশার দিকে তাকালো। আরিশাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর মন খারাপ। মিশমি মৃদু কন্ঠে ডাকে ওকে।
‘আরিশা’জা তোর মন খারাপ?’
আরিশা মুচকি হাসার চেষ্টা করে। তাড়াহুড়ো করে বলে,
‘না, না মন খারাপ না। তোমরা এসেছো আমার খুব ভালো লাগছে।’

মিশমির মনে খটকা লাগে। আরিশার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নাহয় মিশমির সাথে এতক্ষণে নিজ থেকে একটাও কথা ও বললো না কেন? আর তানজীরের দিকেই বা একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না কেন?
মিশমির হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় কড়া চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
‘রাফসান তোকে কিছু বলেছে তাই না?’

আরিশার চোখের কোণে পানি জমে গেছে। ও সেটা মুছে বাইরে বেরিয়ে আসে।

প্রিন্সিপাল স্যার অফিসে ঢুকে সিসি টিভির ফুটেজ চালু করলেন সবার সামনে। ফুটেজ দেখার পর স্যার বলেন,
‘ফুটেজ থেকে স্পস্ট প্রমাণ হয় যে নির্ভীক সত্যি বলছে। সানজু-ই ওকে হ্যাঁচকা টানে বাথরুমে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তাহলে এবার সানজু বলো, তোমাকে কি শাস্তি দেয়া যায়?’
‘স্যরি স্যার। আর কখনো এমনটা হবে না। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে সানজু।

‘ইয়াদ, এখন কি মনে হচ্ছে তোমার? কিছু মেয়েরা কি স্বার্থের জন্য নিজেকে ছেলেদের কাছে বিলিয়ে দিতে যায় না?’ আগের কথা ধরে বললেন প্রিন্সিপাল।
ইয়াদ কাঁচুমাচু করে জবাব দেয়, ‘স্যরি স্যার।’

‘আমাকে স্যরি বলে কি হবে? বাই দ্যা ওয়ে, নির্ভীক তুমিই বলো ওকে কি শাস্তি দেয়া যায়?’
‘আপনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করুন স্যার।’ নির্ভীক হাতঘড়িতে চোখ রেখে বলে।
‘তা বললে কি করে হয়? তোমার নামে এতবড় একটা অপবাদ দিলো, তুমি কিছুই বলবে না?’

‘স্যার আপনি নিশ্চয়ই আমার চেয়েও ভালো বুঝবেন। আপনিই যা শাস্তি দিতে চান দিন।’ মুচকি হেসে বলে নির্ভীক। ওর ফোনে এরমধ্যে বহুবার কল এসেছে। স্যারের সামনে ফোনটা ধরতে পারছে না ও।

‘অকে ফাইন। তুমি যখন কিছু বলবেই না তখন আমিই ওদেরকে শাস্তি দিবো। লিসেন সানজু, আজ থেকে আগামি সাতদিনের জন্য তোমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো।’
‘স্যার!’ আহত সুরে চেঁচিয়ে বললো সানজু।

নির্ভীক হাতঘড়িতে চোখ রেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘স্যার, আমার একটু তাড়া আছে। আমি এখন আসি?’
“নিশ্চয়ই। ওদের শাস্তি তো শুনলে। এবার তুমি আসতে পারো।”

নির্ভীক বেরিয়ে চলে যায়। করিডোরে এসে ফোন রিসিভ করে। সকালের লোকটাই ফোন করেছে। তাও নির্ভীক না চেনার ভান করে সালাম দিয়ে জানতে চায়,
‘কে বলছেন?’
‘আমি এম.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে বলছি। সকালে ফোন দিয়েছিলাম। আমাদের একজন ফটোগ্রাফার দরকার ছিলো। মনে নেই আপনার?’ লোকটি বললো।
‘ওহ ইয়াহ ইয়াহ! বলুন কি বলতে চান?’ হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে নির্ভীক।

‘এম.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সাথে কানেক্টেড আয়েশা ফ্যাশন হাউজ। ওখানে আপনার মতোই একজন স্ট্রং ফটোগ্রাফার প্রয়োজন। তাই আপনাকে স্যার অফিসে ডেকেছেন। আপনি আসলে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবো।’
‘ওয়ান সেকেন্ড স্যার। আমি নেচার ফটোগ্রাফার। ফ্যাশন হাউজের ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। স্যরি স্যার আমি আসতে পারবো না।’

‘কিন্তু আপনি যে একটা রূপসী গ্রাম্য মেয়ের ছবি শেয়ার করলেন? ওটা তো নেচারের ছবি না। ছবিটা দেখেই কিন্তু আমরা আপনাকে অফিসে ডেকেছি। এতবড় কোম্পানি থেকে আপনাকে ডাকা হয়েছে। ব্যাপারটা ভেবে দেখুন।’
‘দেখুন, যত বড় কোম্পানি হোক আর অফিসই হোক না কেন আমি কাজটা করবো না। আমার ড্রিম নেচার ফটোগ্রাফি নিয়ে। এখন আমি শুধুমাত্র বড় কোম্পানি বলে দুনিয়া ঘুরে ফটোগ্রাফি করা বাদ দিয়ে বদ্ধঘরে কতগুলো মেয়ের ছবি তুলবো? ইস ইট পসিবল?’

‘আমি বারবার জানতে চাইছি, আপনি নেচার ফটোগ্রাফার হলে মেয়েটার ছবি কেন তুললেন?’
‘সেটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার!’
‘তা বললে তো হয় না মি. নির্ভীক। পার্সোনাল না প্রফেশনাল সেটা আমরা জানি না। আমরা শুধু মডেল হিসেবে মেয়েটার ছবি দেখেছি। তাই আপনাকে অফিসে ডেকেছি।’

নির্ভীক কিছু একটা ভেবে বললো,
‘দেখুন, আপনারা মেয়েটাকে মডেল হিসেবে দেখলেও আমি তাকে মডেল হিসেবে দেখিনি। তাকে আমি নেচারের একটা অংশ ভেবে ছবিটা তুলেছি। কারণ ওকে আমার জঙ্গলের পরী মনে হয়েছে। জঙ্গলে থাকতে থাকতে ও নেচারের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছে। আমার মনে হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ কাঁধে বানর ঝোলানো ঐ মেয়েটা। আপনার মডেলরা কি পারবে ওর মতো কাঁধে বানর ঝুলিয়ে অবলীলায় দাঁড়িয়ে থাকতে? তাছাড়া এটা কিন্তু মেয়েটার কোনো পোজ ছিলো না। ইট’স আ ক্যান্ডিড পিক। ওর সাথে ফ্যাশন হাউজের বদ্ধঘরের অর্ধ-উলঙ্গ মডেলদের তুলনা অন্তত করবেন না প্লিজ। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার কথা।”

‘“আপনি কিন্তু মডেলদেরকে অপমান করছেন।”
“আপনি বাধ্য করেছেন আমাকে।” নির্দ্বিধায় বলে নির্ভীক।
‘আপনার যা ভালো মনে হয় করুন। স্যার আপনাকে যোগ্য ভেবে ডেকেছেন। আপনার যদি ইচ্ছে হয় তো হেলায় ফেলায় সেই যোগ্যতা হারাতে পারেন। আমার কিছু বলার নেই।’ ওপাশের লোকটি বলে।

নির্ভীক হো হো করে হেসে বললো,
‘আপনিই বললেন আমার যোগ্যতা আছে। আপনাদের অফিসে কাজ না করলে নিশ্চয়ই যোগ্যতাটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না। আমার যেহেতু যোগ্যতা আছে সেহেতু আমি নিজেই কিছু করবো। কারো সাহায্য লাগবে না। ইনফ্যাক্ট, কারো আন্ডারে চাকরী করে তার চাকর হতে চাই না বলেই ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিয়েছি আমি। যাইহোক, যেহেতু আপনাদের অফিসে কাজ করবো না সেহেতু আপনার সাথে কথা বলার আর প্রয়োজন মনে করছি না। রাখছি।’
‘কাজটা কিন্তু আপনি ঠিক করলেন না।’ বলে লোকটা নিজেই ফোন রেখে দিলো।

নির্ভীক মুচকি হেসে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। হাসিটা গতকাল আরিশার কাছ থেকে শিখেছে ও। সর্বাবস্থায় মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখা মানুষগুলো অন্যরকম স্নিগ্ধ হয়। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সবসময় মুচকি হাসতেন।

আরিশার পিছু পিছু তানজীরও আসে৷ ও কোমল স্পর্শে আরিশার হাত ধরে বলে,
‘আরিশাপু, তোমার মাটির নিচের ঘরটা তৈরী হয়েছে?’
‘না।’ বিরস মুখে জবাব দেয় আরিশা।
‘কখন তৈরী হবে?’
‘কয়েকদিনের মধ্যে হয়ে যাবে।’
‘আমাকে দেখাবে?’
‘চল দেখাচ্ছি।’

ওরা দুজনে গর্তের কাছে আসে। গর্তের কাছে এসেই তানজীর বললো,
‘আপু, এখানে গর্ত কই?’

আরিশা একটা ঘন ঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গর্ত খোঁড়া শেষ হলেই আরিশা নকল ঝোপ বানিয়ে গর্তটা ঢেকে দেয়। নকল ঝোপটা টেনে একপাশে সরিয়ে গর্তটা তানজীরকে দেখায় ও। তানজীর সেদিকে এগিয়ে উঁকি মেরে ভেতরে তাকায়। এরপর হাঁটু মুড়ে বসে গর্তের মুখে মুখ নিয়ে ‘আরিশাপ্পু’ বলে জোরে চিৎকার করে ডাকে। চিৎকারটা প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে আসে।

আরিশা দ্রুত এসে ওর মুখ চেপে ধরে বলে,
‘কি করছিস এটা? ফুফি শুনলেই তো ধরা পড়ে যাবো।’
তানজীর সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘চলো না, চলো না আমাকে ভেতরে নিয়ে চলো না। আমি দেখবো ভিতরে।’

আরিশা ঝোপটা দিয়ে আবার গর্ত ঢাকতে ঢাকতে বলে,
‘বিকেলে দেখাবো। আর শোন, তোরা তো কয়েকদিন থাকবি তাই না?’
‘আমি জানি না আপু। কিন্তু এইবার আম্মু এসেছে তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে।’

আরিশা হাতের ধুলো ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে উঠে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে বলে,
‘এ আর নতুন কি? মিষ্টি তো বরাবরই আমাকে নিতে আসে কিন্তু প্রতিবারই খালি হাতে ফিরে যায়।’
‘আপু, এবার অন্তত আমাদের সাথে চলো। প্লিজ আপু।’ তানজীরের কন্ঠে অনুরোধ।
‘তাহলে আমার মাটির নিচের কুটিরের কি হবে? কে বানাবে সেটা?’
‘ওটা বানানো শেষ হলে যাবে তো?’
‘না, ওটায় আমাকে বসবাস করতে হবে না?’ দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে আরিশা।
‘ধুর আপু, তারমানে তুমি কখনো যাবে না তাই তো?’
‘হুম। আমি আব্বু আর চাচ্চুদের ছাড়া থাকতে পারব না।’
‘আমাদের ছাড়া ঠিকই থাকতে পারো। আমি তোমার সাথে আর কথাই বলবো না। তুমি খুব খারাপ আরিশাপু। খুব খারাপ।’

তানজীর সামনের দিকে ছুটে যায়৷ আরিশাও ছুটে গিয়ে ওকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তোদেরকেও মিস করি বলেই তো থেকে যেতে বলছি। রাগ করছিস কেন?’
‘তুমি ছাড়ো আমাকে। আমি কথা বলি না তোমার সাথে।’

আরিশা ওকে ছেড়ে দিয়ে পাশে সুপারি গাছের দিকে তাকালো। সুপারি গাছে শুকনো ডাল ঝুলছে। আরিশা মুচকি হেসে বললো,
‘একটা গাড়িতে চড়বি? দারুণ গাড়ি।’

আরিশা ছুটে গিয়ে সুপারি গাছ থেকে ডালটা টেনে ছিঁড়ে নিলো। তানজীরের সামনে ডালটা রেখে খোল বানিয়ে ওখানে ওকে বসিয়ে খোলের সামনের কয়েকটা পাতা নিয়ে তানজীরের হাতে দিয়ে বললো,
‘তুই পাতাগুলো শক্ত করে ধরে রাখবি। আমি এটা টেনে নিয়ে যাবো।’

তানজীর খুশি হয়ে পাতাগুলো ধরলো। আরিশা খোলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’পাশের পাতাগুলো নিজের কোমড়ে বেঁধে ছুটতে লাগলো। তানজীর খিলখিলিয়ে হাসছে। হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলছে,
‘আরিশাপু আমার কাতুকুতু লাগছে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে। হাহাহিহিহুহু’

আরিশা আপনমনে খোল নিয়ে ছুটছে। জঙ্গলের রাস্তা মসৃণ নয়, সামান্য উঁচুনিচু। পথিমধ্যে অসংখ্য ছোটবড় পাথরও রয়েছে। তার ওপর খসখসে আওয়াজ তুলে ছুটে চলেছে সুপারি গাছের খোলটা। জোরে ছোটার ফলে আর উঁচুনিচু পাথরে ঢেউয়ের মতো চলতে গিয়ে তানজীরের পেটের ভেতরের সবকিছু উঠানামা করছে, ঝিনঝিন করছে পেটের ভেতর। তাও ওর সীমাহিন ভালো লাগছে।

অনেকক্ষণ ছুটতে ছুটতে আরিশা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। হঠাৎ করেই খোলটা ভীষণ পাতলা হয়ে গেছে। ও চট করে পেছনে ফিরে দেখে খোলটা খালি পড়ে আছে। তানজীর কোথাও নেই। আরিশা জোরে চেঁচিয়ে ডাকে তানজীরকে।
‘তানজীর! ভাইয়ু কোথায় তুই?’

তানজীরের সাড়াশব্দ নেই। আরিশা হাঁপাতে হাঁপাতে আবার পেছনে ছুটে যায়৷ খোল টানতে টানতে শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। ছুটতে গিয়ে দম আটকে আসে ওর, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ছুটতে গিয়ে হঠাৎই বড় একটা পাথরে হোঁচট খায় আরিশা। গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। গড়াতে গড়াতে মাথা ঠেকে বক্র নারিকেল গাছে। মুহুর্তেই মাথা ফেটে রক্ত বেরোয়। জঙ্গলের গহীন থেকে গহীনে নির্জন গাছতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে আরিশা।

#Be_Continued_In_Sha_Allah

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here