অ‍্যাসিড পর্ব-১৪

0
215

#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ১৪

ফযরের নামাজের পর হাঁটাহাঁটি করা আহমদুল হকের নিত্যদিনের অভ্যাস। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই অথচ তাঁকে দেখে সেটা কারো বোঝার উপায় নেই।সবাই ষাটোর্ধ বৃদ্ধ ভাবেন। দীর্ঘদিন ধরে শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করায় তিনি এখনও বেশ শক্ত-সামর্থ্য রয়ে গেছেন। বরং কম বয়স্ক অন্য লোকদের চেয়ে আহমদুল হককেই বেশি শক্তিশালী দেখায়।
তিনি নামাজে যাওয়ার সময় নির্ভীককে ডেকে সাথে করে নিয়ে যান। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আহমদুল হকের পাশাপাশি নির্ভীক অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। আহমদুল হক নির্ভীকের ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলেন,
‘কি নিয়ে টেনশন করছে আমার দাদুভাই?’

নির্ভীক যেভাবে হাঁটছিলো সেভাবেই হাঁটতে থাকে। আহমদুল হক ওর বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলেন,
‘কি ভাবছো এত?’

নির্ভীক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
‘দাদুভাই, আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো। উত্তরগুলো পাওয়া খুব জরুরি।’
‘আচ্ছা? চলো তাহলে ওখানে বসি?’ খানিকটা দূরে গাছের নিচে একটা বেঞ্চি দেখিয়ে বলেন আহমদুল হক।

নির্ভীক দাদুভাইয়ের হাত ধরে বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। আহমদুল হক বলেন,
‘বলো কি বলতে চাও?’
‘ফুফির ব্যাপারে কিছু বলতে চাই।’ সরাসরি আহমদুল হকের চোখে চোখ রাখে নির্ভীক।

আহমদুল হক নির্বিকার কন্ঠে বলেন, ‘বলো।’
‘ফুফিকে ড্যাড কেন সহ্য করতে পারে না?’
‘সেটা তো ওর ব্যাপার। আমি কিভাবে বলবো?’
‘দাদু ভাইয়া, প্লিজ আজকে আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেও না। আমার জানা খুব দরকার। আমি একটা রহস্যের কাছাকাছি চলে এসেছি।’

‘কিহ?’ ভ্রু কুঁচকে নির্ভীকের দিকে তাকান আহমদুল হক।
‘দাদু ভাইয়া, তোমাকে আরিশার কথা বলেছিলাম না? আমার মনে হচ্ছে আরিশা ফুফির রিলেটিভ কেউ হবে।’

আহমদুল হক বিস্ফোরিত চোখে তাকান নির্ভীকের দিকে। তাঁরও যে একই কথা মনে হচ্ছে। সেদিন ছবিতে জঙ্গলের বাড়িটা দেখে থমকে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়িটা পুরোপুরি হুরির বাড়ির মতো দেখতে ছিলো।

তিনি নিজেকে সামলে বলেন,
‘এটা তোমার কেন মনে হচ্ছে?’
‘মনে হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। দাদু ভাইয়া, প্লিজ বলো না কি হয়েছিলো? আমার মনে হয় ফুফির সাথে গুরুতর কিছু ঘটেছে।’ চট করে কথাটা বলে নির্ভীক।

আহমদুল হক খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরপর বলেন,
‘তোমাকে এতদিন কিছুই জানানো হয়নি। তবে আজ তোমাকে আমি সবটা বলবো।’

নির্ভীক খুশিমনে জানতে চায়,
‘বলো দাদু ভাইয়া, আমি শুনছি।’
আহমদুল হক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
‘হুরিকে ষড়যন্ত্র করে খুন করা হয়েছে।’
নির্ভীক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে,
‘কি বলছো?’
‘হুম। আর ওকে খুন করেছে ওর স্বামী নিজেই।’

নির্ভীকের নিঃশ্বাস আটকে আসে। বেশ খানিকক্ষন কোনো কথাই বলতে পারে না ও। এমন কিছু শুনবে সেটা ও আশা করেনি।

ঝড়ে গাছপালা ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সবকিছু। আরিশা পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে তানজীর গুটিশুটি মেরে ওর পাশে ঘুমোচ্ছে। চাদরটা পায়ের নিচে পড়ে আছে আর ও শীতে কুঁকড়ে গেছে। আরিশা চাদরটা নিয়ে তানজীরের গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ও পুরোপুরি সুস্থ না হলেও মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে। গতরাতের জ্বরটা আর নেই। আরিশা জানালার বাইরে চোখ রাখে। চারপাশে শীতল, ঠান্ডা পরিবেশ। রাতভর বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ সতেজ হয়ে আছে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে।

আরিশা বাইরের পরিবেশ দেখতে রুম থেকে বের হয়ে প্রথমে আশফাক আহমেদের রুমে যায়। আশফাক আহমেদ বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। আরিশা রুমে ঢুকে আশফাক আহমেদের সামনে দাঁড়ায়। গতরাতে ও অসুস্থ থাকায় নিশ্চয়ই মানুষটা ঘুমোয়নি। নিশ্চয়ই জেগে ছিল আরিশার শিয়রে। ফযরের নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাতে এসেছে। বাবার শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় আরিশা। এরপর একে একে আরমান ও রাফসানের রুমে উঁকি দেয়। ওরা ঘুমে বিভোর। সেই সুযোগে আরিশা বেরিয়ে পড়ে বাড়ির বাইরে। সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে ওর। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ঘর, পুঁচকু, লালটু-কালটু, এছাড়া বাকি পশুপাখিরা সব, সবাই ভালো আছে কিনা খোঁজ নেয়া দরকার। গত সন্ধ্যা থেকে তো ও কারো খোঁজই নিতে পারেনি।

আরিশা বাড়ির বাইরে পা রাখতেই যথারীতি পুঁচকু গাছ থেকে লাফিয়ে ওর কাঁধে এসে পড়ে। ও পুঁচকুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
‘ঠিক আছিস তুই? সবাই ঠিক আছে? সবকিছু ঠিকঠাক তো?’

পুঁচকু লাফিয়ে মাটিতে নামে। আরিশার ওড়না ধরে ঝোপের দিকে দেখায়। আরিশা খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। গর্তের বাড়িটার কিছু হলো না তো? ও ছুটে ঝোপের কাছে যায়। ঝোপ সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। ভেতরে অনেক পানি ঢুকেছে। নামার পথটাও পিচ্ছিল হয়ে আছে। আফসোস নিয়ে মুখে চুকচুক শব্দ করে আরিশা। মাথা নেড়ে বলে,
“এটা একদমই ঠিক হলো না। পলিথিনজাতীয় কিছু দিয়ে গর্তের মুখটা ঢেকে দেয়া উচিত ছিলো।”

আরিশার দেখাদেখি পুঁচকুও মাথা নাড়ে। আরিশা একটা গাছের গুড়ির ওপর বসে। গালে হাত দিয়ে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গর্তের দিকে। হঠাৎ হাত উঁচিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ পেয়েছি। অবশ্যই বাড়িটার জন্য একটা দরজা বানাতে হবে। নাহয় গড়ে তোলার আগেই সব তছনছ হয়ে যাবে।’

আরিশা উঠে গোয়ালঘরে যায়। গোয়ালঘরের পরিবেশও স্যাঁতস্যাঁতে। ও বাড়ি থেকে খড়-ভুসি এনে একে একে সব পশুকে খাওয়ায়। এরপর যায় হাঁস-মুরগির ঘরে। ওখানে ধান, চাল, গম দেয়। হাঁসগুলোকে খাওয়ায় শামুকের খোল। শামুকভাঙা আগে থেকেই সংগ্রহে রেখেছিলো রাফসান। আরিশা ওখান থেকে নিয়ে হাঁসগুলোর আশেপাশে ছড়িয়ে দেয়। ঠুকরে ঠুকরে সেগুলো খেতে থাকে হাঁসেরা। খাওয়া শেষে হাঁসগুলোকে পুকুরে ছেঁড়ে দেয় আরিশা। বৃষ্টি বলতে গেলে নেই। এখন যা পড়ছে তা হলো সারারাত গাছের ডালে বৃষ্টির যে ফোটাগুলো জমেছে সেগুলো মৃদু বাতাসে ঝরে ঝরে পড়ছে। আরিশা মুরগী ও গরু-ছাগলগুলোকেও ছেড়ে দেয় পাশেই। ঝড়-বৃষ্টির দিনে অতদূরের মাঠে পশুদের ছেড়ে আসার কোনো মানে হয় না। বাইরের কাজ শেষে ঘরে ঢুকে রান্নায় যায় আরিশা। তার আগে কয়েকটা কলা নিজ হাতে পুঁচকুকে খাইয়ে দেয়।

রান্না করতে করতে ও সিদ্ধান্ত নেয় যে আজকেই ওর মায়ের ব্যাপারটা রাফসানের কাছ থেকে জেনে নিবে। পরক্ষণেই ভাবে, স্বয়ং আশফাক আহমেদের কাছ থেকেই ও সব শুনবে। অবশ্যই জানতে হবে ওর মা সম্পর্কে। বিস্তারিত ওকে জানতেই হবে। আরিশা নাস্তা তৈরী করে টেবিলে সাজিয়ে সবাইকে ঘুম থেকে ডাকতে যায়। বাড়ির সবাই আজকে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুমোচ্ছে। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গতরাতে আরিশার জন্য হোক কিংবা বৃষ্টির জন্য কেউই ঘুমোতে পারেনি। ও একজন একজন করে সবাইকে ডেকে তোলে। আজকে আরিশার অনেক কাজ।

‘দাদু ভাইয়া, তুমি সত্যি বলছো? এটা কিভাবে সম্ভব?’ হতভম্ব নির্ভীক বলে।

“আমিও বুঝতে পারছি না এটা কিভাবে সম্ভব! তবে আমি কখনো বিশ্বাস করি না যে হুরির স্বামী ওর সাথে এমনটা করতে পারে। হুরিকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব বেশি ভালোবাসতো। ওর শ্বশুর নিজে পছন্দ করে ওকে নিয়ে গেছে। আর হুরির বর ওকে বিয়ের আগে একটাবার দেখতে পর্যন্ত চায়নি। বাবার কথাতেই বিয়ে করে নিয়েছে। কত ভালো ছেলে হলে এমনটা পারে ভাবো তো? এই ছেলে কাউকে খুন করতে পারে বলে মনে হয় তোমার?” নিচের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেন আহমদুল হক।

নির্ভীক নিচু কন্ঠে বলে, ‘কিভাবে খুন হয়েছিল সেটা জানো তোমরা?’

“আমরা জানি ও আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে। তবে পরে জানা গিয়েছিল ওর সারা শরীর শুধু আগুনেই ঝলসে যায়নি। আগুনে পোড়ার আগে ওর সারা শরীরে অ্যাসিড পড়েছিল। অ্যাসিডে আগেই ঝলসে গিয়েছে ওর শরীর। সবার ধারণা ওকে পরিকল্পনা করে আগে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে পরে আগুনে পুড়ে মারা হয়েছে। আর এটা করেছে ওর স্বামী। কারণ হুরির মৃত্যুর পর ওর স্বামীকেই ওর পাশে দেখা গিয়েছিল।” আহমদুল হকের চোখে পানি। তিনি অন্যপাশে তাকিয়ে চোখের জল মুছেন।

নির্ভীক শান্ত হয়ে বসে থাকে। কিছু বলার ভাষা নেই ওর। বেশ কিছুক্ষন পর ও বলে,
‘দাদু ভাইয়া, সবাই ধারণা করলেই তো আঙ্কেল খুনি হয়ে যায় না, তাই না? এর জন্য তো প্রুভ লাগবে। আর স্ত্রীকে ঝলসানো অবস্থায় দেখলে যেকোনো স্বামীই তো তার কাছে এগিয়ে যাবে। এতে তাকে খুনি বলা যায় না কোনেভাবেই। তাছাড়া আঙ্কেল যদি খুন করতো তাহলে অবশ্যই ফুফির আশেপাশে থাকতো না, পালিয়ে যেতো।’

‘সেটাই তো কাউকে বোঝাতে পারিনি। সব প্রমাণ জামাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো। ওদের বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। হুরির শ্বশুর মারা গিয়েছে হুরির বিয়ের কয়েকমাস পরেই। বাড়িতে থাকতো শুধু হুরির দেবর ও ননদরা। হুরির মৃত্যুর সময় জামাই ছাড়া বাড়িতে কেউ ছিলো না। তাই সন্দেহটা ওর উপরেই যাচ্ছে সবার।’

‘আচ্ছা দাদু ভাইয়া, ফুফি যদি এভাবেই মারা যায় তাহলে ড্যাড কেন ফুফিকে সহ্য করতে পারে না? বাসায় কাউকে ফুফির নাম নিতে দেয় না কেন?’

‘ওর সাথে হুরির দ্বন্দটা হুরির বিয়ের সময় থেকেই। ও চায়নি হুরির বিয়েটা জামাইয়ের সাথে হোক। ওর বন্ধু ফরহাদের সাথে ও হুরির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমি জামাইকে পছন্দ করে হুরিকে জানিয়েছিলাম। সে-ও জামাইকে না দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাঁধ সাধলো তোমার বাবা। ও বিয়েটা কিছুতেই দিবে না বলে জানিয়েছে। হুরিও বলে দিয়েছে ও আমার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করবে। ওর আগে থেকেই ফরহাদকে পছন্দ ছিলো না।’

‘ফরহাদ মানে কি সানজুর বাবা?’
‘হুম। ও হচ্ছে একটা বদলোক। এমন কোনো নোংরা কাজ নেই যা ও করে না।’
‘ড্যাড জানতো না লোকটা খারাপ?’
‘জানতো না আবার? তোমার ড্যাডকে নানারকম কারসাজি করে ও হাত করে নিয়েছিলো। আর…’ বলে থেমে গেলেন আহমদুল হক। আঁড়চোখে তাকান নির্ভীকের দিকে।
নির্ভীক জানতে চায়, ‘আর?’
‘নানারকম লোভও দেখিয়েছে। এই যেমন; ওকে বিজনেসে হেল্প করবে, বড় নেতা বানাবে।’

‘সবকিছু জানার পরও ড্যাড ফুফির সাথে লোকটার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো? তাও আবার লোভে পড়ে? ছি! এটা ড্যাড কিভাবে পারলো?’ ঘেন্নায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলে নির্ভীক।
‘যেভাবে তোমার সাথে সানজুর বিয়ের কথা ভেবেছে ঠিক সেভাবেই। তার লোভ এখনো যায়নি। সে এখনো আরও উঁচুতে ওঠার আশায় আছে। তার জন্য যদি বোন কিংবা ছেলেকেও বলি দিতে হয় তাও সে দিবে। তাকে আমার ফরহাদের চেয়েও বদ মনে হয়। সে কবে এমন নিষ্ঠুর মানুষে রূপ নিয়েছে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি দাদু ভাই। কি করে আমার ছেলে হয়ে…’ আহমদুল হকের চোখ ফেটে জল নামে। তিনি কান্না আটকানোর চেষ্টা করলেন না।

নির্ভীক দাদু ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে। একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি বাবার এই রূপটা জানতাম না দাদু ভাইয়া। ভাবতাম, রাগী হলেও বাবা খুব ভালো। আ’ম স্যরি দাদু ভাইয়া। ড্যাডের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে।’

আহমদুল হক চোখ মুছে বলেন,
‘তুমি কেন ক্ষমা চাইছো দাদুভাই? তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি। বরং তুমি ঐ কুলঙ্গারের সন্তান হয়েও ওর মতো হওনি। ওর কথামতো রাজনীতি নামক দূর্নীতিতে যাওনি। ওকে আমি হাজারবার বলা সত্ত্বেও ডাক্তারি পড়াতে পারিনি। যেদিন ওকে ডাক্তারি পড়ার কথা বলেছিলাম সেদিন থেকেই ও আমার কথা অমান্য করা শুরু করেছে। আমার কিংবা তোমার দাদুর কারো একটাও কথা শুনতো না ও। অথচ একসময় ও আমাদের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে একটাও কাজ করতো না। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ফরহাদের সাথে ওর আলাপ হয়। আর তখন থেকেই ধীরে ধীরে আমাদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে সে।’

নির্ভীক আহমদুল হকের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বলে, ‘আমি ড্যাডের মতো ভুল করবো না। তোমাদের অসম্মান কোনোভাবেই হতে দেবো না আমি। যে তোমাদেরকে অসম্মান করবে তাদের জায়গা আমার লাইফে হবে না। এটুকু মনে রেখো তুমি।’

আহমদুল হক খুশিতে জড়িয়ে ধরেন নির্ভীককে। তার চোখের জল বাঁধ মানছে না কিছুতেই। নির্ভীক জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বলে,
‘ফুফির আসল খুনিকে আমি খুঁজে বের করবো দাদু ভাইয়া। আরিশার আসল পরিচয়ও খুব শীগ্রই খুঁজে বের করবো। তুমি একদম চিন্তা করো না। ড্যাডের কিংবা ফরহাদ আঙ্কেল বা সানজু কারো কোনো পরিকল্পনা আর সফল হবে না। অন্তত আমার দ্বারা তাদের কোনো প্ল্যান সাকসেসফুল হতে দিবো না।’

“ইন শা আল্লাহ।” আহমদুল হক শক্তহাতে আঁকড়ে ধরেন নির্ভীককে। শেষ বয়সে এসে হুরির খুনিদের শায়েস্তা করার একটা ক্ষীণ আলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

আশফাক আহমেদ আরিশাকে কিছু ঔষধের নাম বলে দিলেন। এরপর বললেন ওগুলোর সরঞ্জাম নিয়ে আসতে। তিনিও আজকে দোকানে যাবেন না। ঝড়-বাদলের দিনে এমনিতেই বেঁচাকেনা তেমন হয় না। তাছাড়া পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে এতদূর যাওয়া-আসা করাও ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঘরে বসেই ঔষধ বানাবেন। দোকানে যে ঔষধগুলো বানানো ছিলো সেগুলো প্রায় শেষের দিকে। আরিশা সরঞ্জাম এনে দিতেই তিনি বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বসে পড়েন।

ওনার সামনেই উঠানে পিঁড়ি পেতে বসেছে আরমান। সামনে হিজিবিজি জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করছে সে। দোকানে যেতে দেরী হবে ওর, কিংবা নাও যেতে পারে। বাড়িতে বসেই আইপিএস ব্যাটারীতে সংযোগ দিবে সে। সামনে পাঁচ-ছয়টা অ্যাসিডের বোতল, কেরোসিনের বোতল, গাদা গাদা তার ও সাদা-লাল দুটো বক্স নিয়ে লাইটার দিয়ে তার পুড়িয়ে একটার সাথে আরেকটার সংযোগ দিচ্ছে সে।

আরিশা আশফাক আহমেদের সাথে নানারকম আলাপ করছে। অন্যদিনের তুলনায় বেশি বেশি কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। সুযোগ খুঁজছে মায়ের কথাটা বলার জন্য। আশফাক আহমেদ ও আরমান খানিকটা অবাক হয়। গতরাতেই ও এত কান্নাকাটি করছিলো অথচ এখন এত হাসিখুশি? নাকি গতরাতে জ্বরের ঘোরে ছিলো বলে…?

‘আজকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন পুঁতুনিকে?’ আরমান বলে।
আরিশা মুচকি হাসে। বলে, ‘বৃষ্টি পড়লেই তো আমি খুশি হয়ে যাই।’
‘তাও ঠিক। ভাবী কিন্তু বৃষ্টি একেবারেই পছন্দ করতো না।’ কাজের ধ্যানেই কথাটা বলে আরমান।

আরিশা আবার হাসে। এই তো সুযোগ এসেছে। আশফাক আহমেদ বুঝতে পারেন আরমান অন্যমনস্ক হয়ে কথাটা বলে ফেলেছ। তিনি কথাটা না শোনার ভান করে ঔষধ বানাতে ব্যস্ত থাকেন। আরিশা বলে,
‘আম্মুর তাহলে কি পছন্দ ছিলো?’

আরমানের টনক নড়ে। ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,
‘পুঁতুনি, অ্যাসিডের বোতলটা তোমার ঘরের আলমারির উপর রাখছি। ওদিকে তো কেউ যায় না। তাও বলে রাখলাম সাবধানতার জন্য।’

আরিশা সায় দিতে একপাশে মাথা দোলায়। অ্যাসিডের বোতল নিয়ে আরিশার রুমে যায় আরমান।

আরিশা আস্তে আস্তে বলে, ‘আব্বু, ও আব্বু!’
‘বল শুনছি।’ বোতলে বড়ি ঢেলে বলেন আশফাক আহমেদ।

‘আম্মুর কথা জানতে চাই।’
‘এত জেনে কি হবে?’ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন আশফাক আহমেদ।
‘আমার জানতে ইচ্ছে করে খুব।’
‘বলবো, আগে সময় হোক তারপর সব বলবো।’
‘সময় কবে হবে?’
‘আগে তোকে বড় হতে হবে।’
‘আমি তো বড় হয়েছিই।’
‘আরও বড় হতে হবে। অন্তত আরও একবছর বড় হতে হবে।’
‘দেখা গেল একবছর পর আমি বেঁচেই রইলাম না। তখন তুমি কথাটা কাকে বলবে শুনি?’ মুখ গোমড়া করে বলে আরিশা।

আশফাক আহমেদ নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকান আরিশার দিকে। ভেজা কন্ঠে বলেন, ‘এসব কি কথা? আর কখনো যেন না শুনি।’

আরিশা চট করে দাঁড়িয়ে গেল। বললো,
‘না বললে আমি আপনার সাথে আর কথাই বলবো না।’
‘কথা বলতে হবে না। তুমি এখনো অসুস্থ। যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।’ স্বাভাবিকভাবে বলেন আশফাক আহমেদ।

আরিশা ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে চলে যায়। ওর ঘরে তানজীর নেই। হয়তো রাফসানের সাথে রাফসানের ঘরে কমিক বই পড়ছে। আরিশা দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর।

নির্ভীক ভার্সিটি থেকে সরাসরি আরিশার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করে নির্ভীক। পথ চিনতে খুব অসুবিধে হয় ওর। গাছপালা ভেঙ্গে চারপাশে ছড়িয়ে আছে। হাঁটার পথটাও দেখা যাচ্ছে না। দিগ্বিদিক হারিয়ে নির্ভীক সমুদ্রের পাড়ে এসে পৌঁছায়। চারদিকে তাকায় ও। পশ্চিমে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি আর পূর্বে ঘন জঙ্গল। সমুদ্রের উত্তাল শব্দ আর শা শা শব্দের জোরালো বাতাসের আওয়াজ ছাড়া কিছু কানে আসে না ওর। ও এলোমেলো পায়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাঁটতে থাকে। সমুদ্রের তীরে মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশটা বেশ লাগে নির্ভীকের। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঘন গাছপালা দেখতে পায়। এখান থেকে সমুদ্র অন্যদিকে বয়ে গেছে। এদিকটায় পূর্বের জঙ্গলের সাথে দক্ষিণের ঘন জঙ্গল এসে মিলিত হয়েছে। খানিকটা আশার আলো দেখতে পায় নির্ভীক। ও দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর থেকে সাদা বাড়িটা দেখে ও খুশিতে জোরে একটা লাফ দেয়। তারপর সেদিকেই এগিয়ে যায়।

বাড়ির সামনে উঁকি দিতেই একটা লোককে দেখে পিছু হেঁটে আসে। বাড়ির দক্ষিণ পাশ ধরে এগোয়। একটা জানালার সামনে এসে কিঞ্চিৎ উঁকি দিতেই আরিশাকে দেখতে পায় ও। মনে মনে বলে,
‘এটাই তাহলে হুরপরীর রুম।’

ঐ ঘরে ঢোকার রাস্তা খোঁজে নির্ভীক। খুঁজতে খুঁজতে জানালার বামপাশে ছোটখাটো তালাবদ্ধ একটা ছোট দরজা দেখতে পায়। অনেক পুরোনো দরজা। শ্যাঁওলা জমে আছে। পাশ থেকে ইটের টুকরো নিয়ে তালায় আঘাত করে নির্ভীক। বহুদিনের পুরোনো তালা। কয়েক আঘাতেই ভেঙ্গে যায়। ক্যাচক্যাচ আওয়াজ তুলে হুঁক খোলে ও। লোহার হুঁকে জং ধরে গেছে। টান দিতেই হুঁকসহ খুলে হাতে চলে আসে। এরপর কপাট খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। ঐ তো আরিশাকে দেখা যাচ্ছে। আল্লাহর নাম নিয়ে ছোট্ট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে নির্ভীক। সাথে সাথে কপাট লাগিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আরিশা তখনো ওকে দেখেনি। ছোট দরজাটার পাশে বড় পুরোনো কাঠের একটা আলমারি। আলমারির বিপরীতে আরও একটা ছোট আলমারি। দুই আলমারির মাঝামাঝিতে পুরোনো দরজাটা ঘরের নিচের অংশে ছিলো। হাঁটুসমানজও নয় দরজাটা বরং তারচেয়েও নিচু। সেখানে বড় টবসমেত একটা চারাগাছ রাখা। আলমারির মাঝামাঝি অংশতে আবার পর্দা দেয়া। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকায় নির্ভীক।

আরিশা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মুখ গোমড়া করলেও কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে সেটা আরিশাকে না দেখলে নির্ভীক জানতো না। নির্ভীক তৎক্ষনাৎ আরিশার একটা নাম দিয়ে দিলো, গালফুলি।
আরিশার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে পর্দার আড়াল থেকে নির্ভীক বেরিয়ে এসেছে সেটা ও নিজেই জানে না। ওর পেছনের আলমারিটায় ওর সাথে ধাক্কা লেগে মৃদু নড়ছে। সে খেয়াল ওর নেই। মৃদু ধাক্কায় মাথার উপর রাখা অ্যাসিডের বোতলটাও নড়ছে।

আরিশা নিজের ঘরে নির্ভীককে দেখে চমকে ওঠে। চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই দেখে নির্ভীকের ধাক্কায় পুরোনো আলমারিটা নড়ছে। আর নড়ছে তারওপর থাকা জিনিসগুলোও। আরিশার চোখ আটকে যায় অ্যাসিডের বোতলটার ওপর। ধাক্কায় ওটা এক্ষুনি পড়ে যাবে। আরিশা ছুটে যায় নির্ভীকের দিকে। কি হতে যাচ্ছে? বোতলের ঢাকনা আলগা হয়ে গেছে। তীব্রভাবে নড়ছে বোতলটা। আরেকটু ধাক্কা লাগলেই তো শেষ। আরিশা ছুটতে ছুটতেই ঘটে গেল অঘটন।

#Be_Continued_In_Sha_Allah ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here