ভালো থেক
রেশমী রফিক
পর্ব – ৪
ফারিজ চলে এসেছে। সঙ্গে রুপম। রুপার হাত ধরে সামনে তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। রুপম বাবার হাত ধরেছে। ফারিজ ওর দিকে আঙুল তুলে বলল,
– আম্মু, ও আমার নতুন ফ্রেন্ড।
আশিক উবু হয়ে ফারিজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আলতো চুমু দিল কপালে। রুপা শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রাখল। যেন একটু আলগা করলেই ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে আশিক। চাপা সুরে বলল,
– বাহ, বিয়ে করে ফেলেছ। আবার বাবাও হয়েছ! ভালো তো। তোমার মায়ের ধারণা তাহলে ঠিক হলো। আমারই কারসাজি ছিল কোনো।
বলেই ফারিজকে নিয়ে পা বাড়াল সামনের দিকে। ফারিজ হাত নেড়ে বিদায় জানাল নতুন বন্ধুকে। রুপমও হাত নাড়ল। দু-কদম সামনে এগোতেই পেছন থেকে আশিক ডাকল,
– রুপা, শোন।
রুপা মনেপ্রাণে সামনে এগোতে চাইল। কিন্তু আশিকের ডাক অগ্রাহ্য করার মনোবল তার নেই, আবারও প্রমাণিত হলো। এক পাও বাড়াতে পারল না। থমকে দাঁড়িয়ে রইল। আশিক এগিয়ে এসে শান্ত সুরে বলল,
– রুপমের বায়োলজিক্যাল ফাদার আমি নই। অ্যাডাপ্ট করেছি। ওর বাবা-মা কমলাপুরের ওদিকে একটা বস্তিতে থাকত। কয়েক বছর আগে ওই বস্তিতে আগুন লাগে। রুপমের মা প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই অনেকখানি পুড়ে গিয়েছিল। শেষ অব্দি রুপমকে সহিসালামতে বাঁচানো গেলেও সে মারা গেছে। হাজব্যান্ড বাচ্চাটাকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিল। আমারই এক পরিচিতের মাধ্যমে ওকে অ্যাডাপ্ট করি।
একটু থেমে আবার বলল,
– সেসময় আমি তোমাদের বাসায় যোগাযোগ করেছিলাম। খুব ছোট ছিল রুপম। এত ছোট বাচ্চা কীভাবে পালতে হয়, জানতাম না। তাই মনে হয়েছিল, তোমাকে জানাই। তুমি হয়তো রুপমের কথা শুনলেই চলে আসবে। তারপর আমরা আবার আগের মতো একসাথে পথ চলব। কিন্তু তোমার মা বললেন, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। এরপর আমি আর তোমার খোঁজ করিনি। তবে সবসময় মন থেকে চেয়েছি, তুমি যেখানেই থাক, ভালো থেক। এখন রুপমকে নিয়েই আমার জীবন। ওকে আমিই পেলেপুষে বড় করেছি এই পর্যন্ত। এখনো করছি। আসলে ঠেকায় পড়লে সব মানুষের দ্বারাই বোধহয় সবকিছু হয়ে যায়, মানে যেটা দরকার আর কী। এভাবেই চলে যাচ্ছে লাইফ। আমাদের বাবা-ছেলের সংসারে আর কেউ নেই।
রুপার মনে হলো, ওর হৃদপিণ্ডটা গলায় উঠে এসেছে। দম নিতে পারছে না। বছর কয়েক আগে আশিক ফোন করেছিল বাসার টিএন্ডটি নম্বরে। হয়তো এর আগে মোবাইলে কল করেছিল। পায়নি। নম্বরটা ওই বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হবার সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে ফেলেছিল। রুপার মা কল রিসিভ করেছিলেন। এরপর মেয়েকে জানিয়েছিলেন। রুপার তখন প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা। আশিকের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই হয়নি। মাকে বলেছিল, হাবিজাবি কিছু একটা বলে আশিককে নিরস্ত করতে। তার সাথে সে কোনো অবস্থাতেই কথা বলতে চায় না। তারপর মা হয়তো নিজেই বানিয়ে বলেছে বিয়ের কথা। অবশ্য তখন কথাটা পুরোপুরি বানোয়াট ছিল না। ওই সময়ে রুপার বড় ভাই একটা প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছিলেন পরিবারে। তার অফিসের এক কলিগ। ভদ্রলোক বিপত্মীক ছিলেন। নানা কারণে সেই বিয়ের কথা বেশিদূর আগায়নি।
নিজেকে প্রবোধ দিল রুপা। মনকে বুঝাল, যা হবার হয়েছে। এখন থেকে পেছন ফেরার উপায় নেই কোনো। আশিকের কথা তখনও শেষ হয়নি। কী কী যেন বলে যাচ্ছিল একমনে। সবটা ওর কানে ঢুকেনি। আর বাকিটা না শোনাই ভালো। সামনে পা বাড়াতেই আবার শুনল,
– তবে একটা কথা কী জানো, রুপা? আম্মা ঠিক বলত। বউ গেলে বউ পাওয়া যায়। কিন্তু মা গেলে আর পাওয়া যায় না। তবে আম্মা জানত না, সন্তান মায়ের মুখ চেয়ে নিজের আনন্দগুলো ত্যাগ করে। এই ত্যাগ যখন পাহাড়সমান হয়ে যায়, যখন এই ভার বইতে পারে না, তখন মায়ের বুক খালি করে চলে যেতে বাধ্য হয়, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। আর একবার চলে গেলে আর ফেরে না। হাজার মাথা কুটলেও তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি আম্মার দোষ দিইনি কখনো। এখনো দিই না। তার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে হয়তো সে ঠিক ছিল। কিন্তু সন্তানের চাওয়াটা, সন্তান নিজের জীবন কীভাবে সাজাতে চায়, তা একজন মায়ের জীবনে সবথেকে বেশি প্রায়োরিটি পাওয়া উচিত। সন্তানের আনন্দগুলোকে পূর্ণতা দেয়ার কাজও মাকে করতে হয়। এই রিয়েলাইজেশন তার কখনো হয়নি। হয়তো এখন হচ্ছে। কিন্তু আমার ফেরার পথ নেই। আম্মাকে আমি অনেক ফিল করি, ভালোবাসি। দূর থেকে আম্মার জন্য এই ভালোবাসাটুকু থাকবে। কিন্তু ফিরতে পারব না। ফেরা উচিতও না আমার। আমি চাই, দুনিয়াতে যতগুলো দিন বাঁচবে, প্রতিটা সেকেন্ডে যেন আম্মা রিয়েলাইজ করে, সে কতটা ভুল ছিল!
একটু থেমে আবার বলল,
– আজকে এই দেখা হওয়া খুব দরকার ছিল, রুপা। নয়তো তোমার ছেলের কথা জানতেই পারতাম না। আজই আম্মাকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করব। যাকে বাঞ্জা বলে দিনরাত জ্বালিয়ে মারত, সেই রুপা আজ রাজপুত্রের মতো দেখতে এক ফুটফুটে সন্তানের মা। মাশাল্লাহ!
রুপার চোখভর্তি জল। আরেকটু পরই গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। ফারিজ ওর নিজের সন্তান নয়, ফারিবের প্রথম পক্ষের। ফারিজের জন্মদাত্রী মা ছেলেকে ফেলেই চলে গেছে। এরপর ফারিব দ্বিতীয় বিয়ে করেছে ছেলের দেখাশুনার জন্য একটা মায়ের দরকার বলে। বিয়ের সময় তার একমাত্র শর্ত ছিল, রুপা কখনো মা হতে চাইবে না। আজীবন ফারিজকে নিজের ছেলে বলে জানবে। রুপা অবাক হয়েছিল। স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানকে দেখাশুনা করতে হবে বলে সে নিজে মা হতে পারবে না, এটা কেমন কথা? স্বভাবতই প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিবার আর পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে সেই প্রতিবাদ গিলে ফেলেছে। এবং ফারিবের ইচ্ছেয়, বিয়ের পর-পরই স্থায়ীভাবে বন্ধ্যাকরণ করেছে।
এই কথাটা আশিককে বলা হলো না। বলার চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। বলতে পারল না। তবে চোখের জল আটকে রাখা সম্ভব হলো না। আশিক ওর চোখের জলটা মুছে দিল সযত্নে। ফিসফিস করে বলল,
– ভালো থেক, রুপা।
(সমাপ্ত)