ভালো থেকো পর্ব-৩

0
372

ভালো থেক
রেশমী রফিক
পর্ব – ৩
রুপম, এই নামটা রুপার জীবনে খুব আরাধ্য। ওর নিজের একটা সত্ত্বা, যাকে নিজের ভেতর ধারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে আসেনি দুনিয়াতে। তাকে ইহকালে নিয়ে আসার সমস্ত প্রচেষ্টা এক এক করে ব্যর্থ হয়েছে রুপার। সেজন্যই তো ভাঙ্গল সংসার। ‘বাঞ্জা’ তকমা কপালে জুটিয়ে ফিরতে হলো বাবার বাড়িতে। চির-আপন মানুষ হয়ে গেল চির-পর। অথচ এই বাবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল সে। সমস্ত দুনিয়া পেছনে ফেলে আশিকের পথচলার সঙ্গী হয়েছিল।
যাকগে, পুরনো কথা ভেবে লাভ নেই। যা হবার, হয়ে গেছে। এখন বর্তমানকে পুঁজি করেই বাকি জীবন পার করতে হবে। রুপমের মা হবার সাধ কবেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। ফারিজকে যেন আল্লাহ ধুপ করে ওর কোলের উপর ফেলে দিলেন, ফারিবের ওছিলায়। সেই থেকে ফারিজকেই সমস্ত মনপ্রাণে ধারণ করেছে। ফারিজের মা সে। রুপমের জায়গাটা কখনো ফারিজকে দিতে না পারলেও আদরের কমতি রাখে না।
আশিককে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময়ে চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এলো। আশিক দু-হাত বাড়িয়ে দিতেই ঝট করে কোলে উঠে গেল। আশিকের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। রুপা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। আশিক ওকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বলল,
– রুপম, সালাম দাও তো আন্টিকে।
– আসসালামু আলাইকুম।
রুপা স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। পরিস্থিতি অনুমান করে আশিক বলল,
– আমার ছেলে, রুপম। ওকে সপ্তাহে একদিন নিয়ে আসি এই প্লে-জোনে। আজও নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।
রুপা খুব সাবধানে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল। তার দৃষ্টি তখনো আশিক আর ওর কোলে থাকা ছেলেটার উপর নিবদ্ধ। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অস্ফুট সুরে বলল,
– তোমার ছেলে এটা? সত্যি?
– হ্যাঁ। আমার ছেলে।
উত্তরটা যেন মুখিয়েই ছিল, রুপাকে হারিয়ে দিতে। আজ থেকে অনেকগুলো দিন আগে যে অপবাদ মাথায় নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরতে হয়েছিল, যে অপবাদকে এতকাল ‘মিথ্যে’ বলে এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, সেটা যেন আচমকা ওকে জানান দিল, কতটা ভুল ছিল। সবসময় ভেবে এসেছে, সমস্যা আশিকের। তার বাবা হবার ক্ষমতা নেই। সে নিজে যতবার ডাক্তারের কাছে গেছে, প্রতিবারই ভালো রিপোর্ট পেয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ওর শরীরে কোনো সমস্যা নেই। গর্ভধারণ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত। তবু সুখবরটা শুনতে পাচ্ছিল না। তারপর একদিন কথাচ্ছলে আশিককে বলল ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। আশিক শুরুতে পাত্তা দেয়নি। নানান কথা বলে পাশ কাটিয়েছে। রুপার তাতে রাগ হলেও অন্যভাবে মানিয়েছে। তার কেন যেন বাচ্চা নিয়ে আগ্রহই ছিল না কোনো। সারাক্ষণ বলত,
– আমার তো তুমি আছ, রুপা। তোমারও আমি আছি। আর কী চাই, বলো? আমাদের মধ্যে সন্তান কি এতই জরুরী যে, হন্যে হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হবে? ডাক্তার তো সবকিছুর মালিক নন। কেবল ওছিলা মাত্র। আল্লাহর হুকুম না হলে তার কিছুই করার নেই।
রুপা তবু অবুঝ হয়ে থাকত। গো ধরে বলত,
– তুমি ডাক্তারের কাছে যাবে, এটাই ফাইনাল।
আশিক তখন আশ্বাসের সুরে বলত,
– এত অস্থির হচ্ছ কেন, জান? আল্লাহ যখন রুপমকে দুনিয়াতে পাঠাবেন, দেখবে হুট করে তুমি কনসিভ করে ফেলেছ।
আশিকের কথাগুলো রুপার অশান্ত মনকে খুব সহজেই শান্ত করে দিত। আশিকের বুকে মাথা রেখে রুপার সমস্ত অস্থিরতা নিমেষে উবে যেত। কিন্তু আশিকের মায়ের মাথাব্যাথা একদম স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। ছেলের ঘরে কেন এখনো সন্তান আসছে না, তাই নিয়ে রাতদিন কপাল চাপড়াতেন তিনি। রুপাকে বাগে পেলে হামলে পড়তেন, যেন সব দোষ ওর। অথচ আশিক নিজে উনাকে সবগুলো মেডিকেল রিপোর্ট দেখিয়েছিল। বলেছিল, রুপার কোনো সমস্যা নেই। তবু তিনি মানতে চাইতেন না। ঘুরেফিরে রুপার দিকে আঙুল তুলতেন। তিনি একা নন, আশিকদের আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে, দোষ রুপার মধ্যে। এদের দৃঢ় বিশ্বাস রুপার মনোবল ভেঙ্গে দিত বারবার। মনের ভঙ্গুর কাঠামো আরও বেশি ঝুরঝুরে হয়ে যেত। তারই প্রতিফলন হতো দাম্পত্য কলহে।
রুপার ধৈর্যে কুলায়নি আর। সবসময়ের শান্ত মেয়ে ঝড়ে রুপান্তরিত হয়েছিল হুট করে। আশিক তাকে সামলে রাখতে পারেনি। সেই ঝড় থামতে অনেক সময় লেগেছে। ঝড়ের প্রকোপ এতই ছিল, চারপাশ লন্ডভন্ড করে তবেই নিজ সংসার ছেড়ে এসেছে। আশিক অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিল। ওর মা বৃদ্ধা, অসুস্থ। দু’দিন বাদেই পরকালের ডাক চলে আসবে তার। সেই মানুষের কথায় কান দিতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু রুপা তখন ধর্তব্যে ছিল না। আশিককে তখন রীতিমতো অসহ্যকর মনে হচ্ছিল ওর। আশিকও বলা যায়, ধৈর্যের শেষ সীমানায় চলে গিয়েছিল। ওর অফিসে কীসব ঝামেলা হচ্ছিল। বাসায় ফিরতে দেরি হতো। দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ ভর করে থাকত মাথায়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে, প্রতিদিনই ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া হতো। তাও এমন সব তুচ্ছ প্রসঙ্গে, যা কি না আজকের দিনে মনে পড়লে রীতিমতো হাস্যকর লাগে। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিল আশিক। সেদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, কী ভুলটা করেছে। আগে দিনের অধিকাংশ সময়ে বাসার বাইরে থাকত বিধায় রুপা আর আম্মার মধ্যেকার বিবাদ স্বচক্ষে দেখা হতো না। পরে নানান অনুযোগ-অভিযোগ শুনলেও অত পাত্তা দিত না। দিনের শেষের ক্লান্তিটা ওর কাছে বড় হয়ে দাঁড়াত। কতদিন গেছে, রুপা অভিযোগের ডালা খুলে বসেছে সবে আর সে হাই তুলে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পড়েছে। ঘুম-জড়ানো কন্ঠে রুপাকে অনুরোধ করেছে,
– প্লিজ, ওসব পড়ে শুনব। এখন ঘুমাতে আসো।
আবার মায়ের নালিশসমগ্রও এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। জানত, আম্মা একটু বেশিই লেগে থাকেন রুপার পেছনে। ছেলে তার জানপ্রাণ হলেও ছেলের পছন্দকে তিনি মানতে পারেননি। উপর দিয়ে মেনে নেবার আপ্রাণ অভিনয় করে গেছেন। কিন্তু এই অভিনয় কতকাল চালানো যায়? একসময় ছেলের কাছে বউয়ের নামে নালিশ করা, ছেলের চোখের বউয়ের খুঁত তুলে ধরাটা তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন হয়ে গেল। আশিকের অফিস থেকে ফেরার সময় হলেই তিনি মুখিয়ে থাকতেন, কতক্ষণে নালিশ উগরে দেবেন ছেলের কানে। কিন্তু আশিক বরাবরই ক্লান্তির দোহাই দিয়েছে। মাকে যেমন বুঝাতে পারেনি, তেমনি রুপাকেও সামলাতে পারেনি।
চাকরি ছাড়ার পর যেন অন্য এক দুনিয়া উন্মুক্ত হলো তার সামনে। এতকাল বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব কেবল কানে শুনেছে। এবারে নিজ চোখে দেখতে লাগল। তাও প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। এদের নিরস্ত করতে যাওয়া মানে শরীরের সমস্ত শক্তি এক ধাক্কায় ক্ষয়ে যাওয়া। অল্পদিনেই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল বাসার পরিবেশ। রীতিমতো হাসফাঁস লাগত আশিকের। রুপাও দিনকে দিন পাল্টে যাচ্ছিল। আশিককে দেখামাত্রই যেন তার শরীরে আগুনের হলকা ছুটত। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়ে প্রতি মিনিটে বাদানুবাদ চলতে লাগল। একদিন চুড়ান্ত ধাপে চলে গেল ওরা। রুপা কর্কশ সুরে চিৎকার করছিল। আম্মা নিজ ঘরে বসে উচ্চ সুরে বিলাপ করছিল। অতঃপর ধৈর্যচ্যুতি হলো আশিকের। বিগত কয়েকদিন যেমন শরীরের সর্ব শক্তি ক্ষয় করত বউ-শাশুড়িকে নিরস্ত করতে, সেদিন ক্ষয় করল বউয়ের গায়ে হাত তুলে। বেধড়ক পিটিয়ে অজ্ঞান করল রুপাকে। রক্তাক্ত করে দিল। তারপর অবশ্য নিজেই হাসপাতালে দৌড়ে গেছে। রুপার সেবাযত্ম আর ডাক্তারের পেছনে ছুটাছুটি করেছে ক্লান্তিবিহীন। রুপাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলেছে।
পরের গল্পটুকু লেখার দায়িত্ব রুপা নিজের হাতে তুলে নিল। একদিন একটা চিঠি লিখে বিদায় নিল আশিকের বাসা থেকে। বহুকাল বাদে বাবার বাড়িতে পা দিল। বাবা অবাক হয়েছেন, মা হতভম্ব। কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দেননি। রাগ-অভিমান ভুলে বুকে আগলে নিয়েছেন মেয়েকে। রুপাকে আর ফিরতে দেননি। রুপাও ফিরতে চায়নি। আশিকের প্রতি তার সমস্ত ভালোবাসা মুহূর্তেই উবে গিয়েছিল কর্পূরের মতো। অন্তত এতকাল ধরে সে এটাই ভেবে এসেছে। আজ মনে হচ্ছে, তার ভাবনাটা ভুল ছিল। নয়তো আজ আশিককে দেখার পর বুকের ভেতরটা তিরতির করে কাঁপত না। কিশোরী বয়সের প্রথম ভালোলাগার অনুভূতিটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিত না।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here